আমরা যখন নিন্দা করছি, তখন রুমানা আহমেদ চাইলে মুখের উপর বলে দিতে পারেন অনেক কথা। বলে দিতে পারেন, যত গুড় ঠিক ততটা মিষ্টি। তোমাদের তো খেজুর গাছই নেই, গুড়ে মিষ্টি কি করে আসবে? চুপচাপ শোনা ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকবে না তখন। তারপরও, আমরা বলে যাই। অকথ্য ভাষায় বলে যাই। আর রুমানারা শুনে যান মাথা নিচু করে। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটে এসব কটু কথা যেন আজকাল গা সওয়া হয়ে গেছে। আমরা তাদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে পারি না, কিন্তু ঠিক ঠিক পারফরম্যান্সের কৈফিয়ত চাই।
১.
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট থেকে এই মুহূর্তে কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি অ্যামব্রোসের মতো ফাস্ট বোলার কিংবা মুত্তিয়া মুরালিধরন-শেন ওয়ার্নের মতো স্পিনার আশা করা ভার। কিন্তু আমাদের অনেক সংগ্রামের কাহিনী আছে। সেসব শুনলে হয়তো মোড় ঘুরতে পারে শত মানুষের, বের হয়ে আসতে পারে নতুন দিনের ওয়ালশ-ওয়ার্নরা। এসব গল্প, সত্যিকারের গল্প। আমাদের ক্রিকেটার মেয়েগুলোর গল্প। তাদেরই একজন রুমানা আহমেদ। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের এক ‘অটোমেটিক চয়েজ’, যিনি কিনা একাধারে লেগস্পিন, ব্যাটিং দুটোই চালিয়ে যান। দলের অধিনায়কত্ব করেছেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন নারীদের বিগ ব্যাশ টি-টোয়েন্টি লিগে।
ক’জনই বা জানেন এসব কথা? দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের জন্য যখন বাংলাদেশ ছাড়ছিল বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল, তখন অধিনায়ক রুমানা বলেছিলেন, তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যাচ্ছেন। এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, এদিন খেলেও কেন এখনও অভিজ্ঞতার পিছনে ঘোরা! কেন এখনই সফলতার সুর নেই সবার কণ্ঠে? সত্যি বলতে, উত্তরটা আমাদের সবারই জানা। দীর্ঘদিন পর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় আসলে? হয়তো বা না।
রুমানা আহমেদের অধীনে সেবার দল মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কিন্তু এরপর কী এক জাদুকরী শক্তিতে ঘুরে দাঁড়ালো সবাই, যেন মনে হয় রূপকথা। এশিয়া কাপের শিরোপা জয়, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়, টি-টোয়েন্টি বাছাইপর্বে ‘আনবিটেন’ চ্যাম্পিয়ন! মানে একসঙ্গে তিনটি ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরলো আমাদের মেয়েরা। সেসব সফলতা নিঃসন্দেহে দলীয়। কিন্তু রুমানার কথা আলাদা করে না বললেই নয়।
এই তিন সিরিজে ১৪ ম্যাচে একাই ২১ উইকেট নিয়েছেন রুমানা। লেগস্পিনার রুমানা, আমাদের নারী শেন ওয়ার্ন। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত উইকেট। তারপরও মনে দুঃখ তার। ব্যাটিংটা যে ভালো হয়নি! তাই সাফল্যটাকে ধরেছেন একপেশে হিসেবে।
দলে একজন লেগস্পিনারের অভাব প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছে বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট। জুবায়ের হোসেন লিখন সেক্ষেত্রে বড় সুযোগ হতে পারতেন। কিন্তু সেই ‘সাদা হাতি’ পোষার ঝুঁকি বোধ হয় এখনও নিতে পারেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। অন্যদিকে, বাংলাদেশ নারী দলে দুজন লেগস্পিনার ফাহিমা খাতুন ও রুমানা আহমেদ। দুজনেই দারুণ সফল। বিশেষ করে রুমানার ঘূর্ণি বল যেন প্রতিপক্ষের দেয়াল চুরমার করতে সর্বদা প্রস্তুত
২.
ইংল্যান্ডের সারা টেলর কিংবা অস্ট্রেলিয়ার এলিস পেরির মতো সুযোগ সুবিধা পায় না বাংলাদেশে নারী ক্রিকেটাররা। যে কয় পয়সা বেতন পায় তা দিয়ে নিজেদের চলতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ক্রিকেটার হিসেবে যে জীবনযাত্রা প্রয়োজন, সেটা পেতেও কষ্ট করা লাগে।
রুমানা তো তারপরও একসঙ্গে সব করছিলেন। পাশাপাশি পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু টানা সিরিজের আগে যখন কেবল অনুশীলনেই নিজেদের ক্যারিয়ার খুঁজছিল বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা, তখন আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন রুমানা। বিরক্ত হয়ে খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন অন্য কিছু করার। তারপর যখন আবারও ম্যাচ শুরু হলো, যখন নিজের ধারটা আবারও প্রমাণ করতে পারলেন, তখন টের পেলেন ক্রিকেটার হওয়ার জন্যই জন্ম হয়েছে তার। ক্রিকেটারই হতে হবে তাকে। তাই এখনকার লক্ষ্য নিজেকে আরও ছাড়িয়ে যাওয়ার। অনেক দূর এগিয়ে নেওয়ার।
রুমানা বলেছেন, ‘আমি নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চাই। কিন্তু এই সিরিজগুলোর আগে এভাবে আমি ভাবিনি। আমি ক্রিকেট ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। কারণ আমাদের খেলাই হচ্ছিল না। শুধু শুধু অনুশীলন। মন খারাপ করে অনেক সময় অনুশীলনেও যেতাম না আমি। একপর্যায়ে ভেবেছিলাম অন্য কিছু করবো।’
সবকিছু যেন অলৌকিকের মতো হয়েছে। হুট করে ঘুরে গেছে জীবনের পাল। নিজের সামর্থ্য সম্পর্কেও নতুন করে ধারণা পেয়েছেন রুমানা। কিন্তু একে তো ক্রিকেটার হিসেবে নিজের সঙ্গে সংগ্রাম, সঙ্গে যোগ হয়েছে সমর্থকদের উটকো খোঁচা। রাস্তায় বের হলে নাকি এহেন কথা নেই তাদের শুনতে হয় না। মাশরাফি বিন মুর্তজা-সাকিব আল হাসানরা খারাপ করলে তাদেরকে বলা হয়, ছেলেরাই কিছু করতে পারছে না, মেয়েরা কী করবে! এসব কথা খুব খারাপ লাগে রুমানার কাছে। তিনি জাতীয় দলের সদস্য হিসেবে যে সম্মানটুকু প্রয়োজন, ততটুকু চান। এর বাইরে কিছু নয়।
গেল বছরের কথা। ৬০০ টাকা করে ঘরোয়া ক্রিকেটে ম্যাচ ফি পায় নারী ক্রিকেটাররা। এই কথা অনেকটা ফাঁস হওয়ার মতো করে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরের গল্পটা সবার জানা। মাঝে বলা হয়েছিল, এই ৬০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা করা হবে। কিন্তু হয়নি। রুমানারা যদি সেসব কথা মাথায় নিয়ে থেমে যেতেন, তাহলে হয়তো আজকের এশিয়া কাপ কিংবা বাছাইপর্বের শিরোপা ঘরে আসতো না।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে নিজের সেরাটা করছেন রুমানা। এখন পর্যন্ত খেলেছেন ৩৫ ওয়ানডে। ব্যাট হাতে তুলেছেন ৭৩৪ রান, সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংসটি ৭৫। রয়েছে পাঁচখানা হাফ সেঞ্চুরি। এছাড়া বল হাতে নিয়েছেন ৩৭ উইকেট। টি-টোয়েন্টিতে রান আছে ৫৭১ (৫১ ম্যাচে)। উইকেট ৪৬টি।
৩.
ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির জীবনী নিয়ে তৈরি ‘ধোনি দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ সিনেমার একটা অংশ ছিল। সেখানে দেখানো হয়, খেলে আবার ট্রেন ধরে পরীক্ষা দিতে যান। অনেকটা একই অবস্থা রুমানার। যখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়েন, তখনই মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি হলো। ওই সময়েই পড়ে গেল তার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। কিন্তু কোনোটাই তার কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই তিনি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতেন, আবার খেলে গিয়ে বাসে উঠতেন পরীক্ষা দিতে!
আজকের অবস্থায় আসার জন্য যে সংগ্রাম তাকে করতে হয়েছে, তার ছোট্ট এই নমুনাগুলোই বোধহয় ক্রমশ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রুমানা এখনও পড়াশোনা ছাড়েননি। চালিয়ে যাচ্ছেন স্নাতক পর্যায়ের লেখাপড়া।
খুলনার এই মেয়ে মাধ্যমিক শেষ করেছেন জেলার রোটারি হাইস্কুল থেকে। এরপর ইসলামিয়া মাধ্যমিক কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক। মজার ব্যাপার হলো, লেগস্পিনে যে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন রুমানা, তিনি কখনও ভাবেনইনি যে তিনি কখনও ক্রিকেটার হবেন! কলেজে থাকাকালীন সময়ে কোচ ইমতিয়াজ হোসেনের সান্নিধ্য পান, তখন থেকেই একে একে জাতীয় দল পর্যন্ত আসার ধাপগুলো পার করা। বলে রাখা ভালো, এই ইমতিয়াজ হোসেনের অধীনে ছিলেন নারী জাতীয় দলের আরেক ক্রিকেটার জাহানারা আলম। তারও হাতেখড়ি এই কোচের কাছে।
রুমানার স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলে খেলা। ক্রিকেটার হওয়ার পর সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে তার। কিন্তু তারপরও কিছু আক্ষেপ তো রয়েই গেছে। ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি খেলার মধ্যে সাদা পোশাকের টেস্ট খেলার অভাবটা খুব করে টের পান রুমানা। যেখানে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার নারী ক্রিকেটাররা সমানে টেস্ট খেলে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনও শুরুই করতে পারেনি। অথচ, আর কদিনই বা খেলতে পারবেন ক্রিকেট? তাই এই স্বপ্নটা পূরণ হোক, মনেপ্রাণে তা চান রুমানা।
আক্ষেপ ভরা কণ্ঠে বলেন, ‘লঙ্গার ভার্সনের ক্রিকেটই তো আসল। আমিও স্বপ্ন দেখি সাদা পোশাকে খেলার। যদি কিছু বিদেশি এনেও চারদিনের ম্যাচ খেলতে পারতাম! তাহলেও অনেক ভালো লাগতো।’
ফিচার ইমেজ- Dhaka Tribune