সদ্যই শেষ হলো গ্রীষ্মকালীন ট্রান্সফার উইন্ডো। ২০২১-২২ মৌসুমকে সামনে রেখে ইউরোপের প্রতিটি বড় ক্লাবই কোচ ও বোর্ডের পছন্দের স্কোয়াড গড়ে নেয়ার উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রয়োজনীয় রদবদল সেরে নিয়েছে। তবে এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোকে অভিহিত করা হচ্ছে স্মরণকালের অন্যতম সেরা ট্রান্সফার উইন্ডো হিসেবে। জুন মাসের ৯ তারিখে শুরুর পর থেকে পরবর্তী বারো সপ্তাহে এই ট্রান্সফার উইন্ডোতে এমন অবিশ্বাস্য সব দলবদলের ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা ছিল না কোনো ফুটবলপ্রেমীর। নিকট অতীতে এতগুলো নাটকীয় দলবদল আর কখনও হয়নি। ট্রান্সফার উইন্ডোর একেবারে শেষ মিনিট পর্যন্ত ফুটবলপ্রেমীরা উৎকণ্ঠায় সময় পার করেছেন।
লা লীগা কর্তৃপক্ষের বেধে দেয়া নিয়মের কড়াকড়ি এবং বার্সেলোনার মাত্রাতিরিক্ত বেতনের বোঝার গ্যাঁড়াকলে পড়ে শেষ মুহুর্তে ভেস্তে যায় লিওনেল মেসির চুক্তি নবায়নের সমস্ত আয়োজন। বার্সেলোনার সাথে দীর্ঘ দুই দশকের বন্ধন ছিন্ন করে মেসি পাড়ি জমিয়েছেন ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইতে। গত মৌসুম থেকেই গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছিল যে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসের স্পোর্টিং প্রজেক্ট নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নন। এই মৌসুমের ট্রান্সফার উইন্ডো শুরু হওয়ার পর হ্যারি কেইনকে সাইন করাতে ব্যর্থ হওয়া ম্যানচেস্টার সিটির সাথে যখন রোনালদো নতুন চুক্তি করার দ্বারপ্রান্তে, তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের।
শেষ পর্যন্ত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ঘরেই ফিরলেন। আঁতোয়ান গ্রিজম্যানের বিশাল অংকের বেতন ছিল বার্সেলোনার জন্য চিন্তার বিষয়। তাকে একেবারে শেষ মুহুর্তে সাবেক ক্লাব আতলেতিকো মাদ্রিদে দলবদল করা হয়। এছাড়াও প্রিমিয়ার লীগের ক্লাব অ্যাস্টন ভিলা থেকে একশো মিলিয়নে জ্যাক গ্রিলিশকে ম্যানচেস্টার সিটিতে নিয়ে আসা, ফরাসি ইয়াংস্টার কিলিয়ান এমবাপ্পের জন্য একশো আশি মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া কিংবা সদ্য সেরি আ চ্যাম্পিয়ন ইন্টার মিলান থেকে বেলজিয়ান তারকা রোমেলু লুকাকুর চেলসিতে প্রত্যাবর্তন– এবারের ট্রান্সফার উইন্ডোতে নাটকীয়তার কমতি ছিল না মোটেও।
বিশ্বায়নের কল্যাণে প্রযুক্তি এসে ঠেকেছে হাতের মুঠোয়। যোগাযোগ হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজতর। পৃথিবীর এ-প্রান্তে বসে ও-প্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে অল্প সময়ের ব্যবধানে। আমাদের দেশে ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী থাকার সুবাদে ইউরোপীয় দলবদলের এই মৌসুমে ফুটবল সমর্থকেরা নিজ নিজ ক্লাবের দলবদল সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন ট্রান্সফার উইন্ডোর একেবারে শুরু থেকেই। ট্রান্সফার মার্কেটের সম্ভাব্য দলবদল নিয়ে যেসব সাংবাদিক কিংবা ওয়েবপোর্টাল তথ্য প্রকাশ করে, তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলোতে নিয়মিত ঢুঁ মারা কিংবা ওয়েবপোর্টালে নিয়মিত প্রবেশ করা ছিল এই বারো সপ্তাহের নিয়মিত ঘটনা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা ফুটবলপ্রেমীরা যেসব সাংবাদিক কিংবা ওয়েবপোর্টাল থেকে দলবদল চলাকালীন তথ্য পেয়ে থাকি, তারা কীভাবে সেসব তথ্য সংগ্রহ করে? প্রতিটি ক্লাবই একজন খেলোয়াড়কে নিজ দলে আনার অফিসিয়াল ঘোষণা দেয়ার আগপর্যন্ত সবকিছুর গোপনীয়তা রক্ষা করতে চায়। কিন্তু তারপরও ট্রান্সফার মার্কেটের সাংবাদিকরা কীভাবে সেসব খবর আগেই পেয়ে যান? ক্লাবগুলো খেলোয়াড়দের এজেন্টদের সাথে যখন আলোচনায় বসে, তখন সেটি হয় সম্পূর্ণ লোকচক্ষুর আড়ালে, দরজা বন্ধ করে। এমনকি অফিসিয়াল ঘোষণার আগে গণমাধ্যমে ক্লাবগুলোর মুখপাত্ররা পর্যন্ত কোনো শব্দোচ্চারণ করেন না। তারপরও দেখা যাচ্ছে সাংবাদিকেরা একের পর এক হালনাগাদ তথ্য দিয়েই যাচ্ছেন। তাদের দেয়া তথ্যে কোন খেলোয়াড়কে কয় বছরের চুক্তির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, সাপ্তাহিক বেতন কত দেয়া হবে, শর্ত পূরণের পরিপ্রেক্ষিতে বেতনের বাইরে আরও কত বোনাস পাবে– এসবেরও উল্লেখ থাকে, এবং দিনশেষে অনেক তথ্যই মিলে যায়!
‘সর্ষের মধ্যেই ভূত’- এই তত্ত্বের সফল প্রয়োগ ঘটতে দেখা যায় ট্রান্সফার উইন্ডোর ক্ষেত্রে। দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা খেলোয়াড়ের এজেন্ট কিংবা ক্লাবের অভ্যন্তরে কোনো নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ রাখেন এবং তাদের মাধ্যমেই খবর সংগ্রহ করেন। ট্রান্সফার মার্কেটের কিংবদন্তি সাংবাদিক ফ্যাব্রিজিও রোমানোর মতে,
“আমি কাজ শুরু করেছিলাম জিয়ানলুকা ডি মার্জিওর সাথে। তিনি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন। যেসব তথ্য হাতে আসে সেগুলো শুধু ক্লাব নয়, খেলোয়াড়ের এজেন্ট ও অন্যান্য উৎসের সাথে মিলিয়ে নেয়ার মানসিকতা থাকতে হয়। আমার মনে হয়, ট্রান্সফার মার্কেটের তথ্য পাওয়ার মূল রহস্য হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা। বর্তমানে এই ধরনের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রচুর উৎস থাকতে হয়, যেখান থেকে আপনি তথ্য পেতে পারেন।”
অর্থাৎ একটি ট্রান্সফারের সাথে খেলোয়াড় বাদ দিয়ে যেসব ব্যক্তিবর্গ যুক্ত থাকেন, তাদের কাছ থেকেই সাংবাদিকেরা তথ্য পেয়ে থাকেন।
তবে ট্রান্সফার উইন্ডো চলাকালীন ভুয়া খবরের ছড়াছড়িও দেখতে পাওয়া যায়। কিছুদিন আগেই ‘এল চিরিংগুইতো টিভি’ নামে এক স্প্যানিশ গণমাধ্যম রিপোর্ট করে, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তার সাবেক ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে ফিরতে চান এবং কোচ আনচেলত্তি তার দ্বিতীয় মেয়াদে রোনালদোকে পাশে চান। কিন্তু পরবর্তীতে আনচেলত্তি ও রোনালদো– দুই পক্ষ থেকেই এই রিপোর্টকে মিথ্যা দাবি করা হয়। অনেক নিউজ পোর্টাল স্রেফ নিজেদের ওয়েবসাইটের ট্রাফিক বাড়ানোর জন্য এসব ভুয়া নিউজ করে। এল চিরিংগুইতো টিভির সেই রিপোর্ট রিয়াল মাদ্রিদ ও রোনালদো ভক্তদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়, সেই সাথে ওয়েবসাইটের ট্রাফিক ও পরিচিতি বাড়িয়েছিল। কিন্তু এসব নিউজের কারণে ওয়েবপোর্টালের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়।
অনেক সময় দেখা যায়, খেলোয়াড়দের অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্রীড়া সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। সেক্ষেত্রে খেলোয়াড়েরা আড্ডা দেয়ার সময় তাদের সাংবাদিক বন্ধুর সামনে ক্লাব ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে কিংবা নতুন ক্লাবের প্রতি আগ্রহ দেখালে সেগুলো গণমাধ্যমে স্থান করে নেয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে স্বয়ং খেলোয়াড়ই তথ্যের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ তারকা গোলকিপার ইকার ক্যাসিয়াসের স্ত্রী স্প্যানিশ গণমাধ্যমে ক্রীড়া সাংবাদিকতার কাজ করতেন। অনেকেই ধারণা করেন, খেলোয়াড় থাকাকালে রিয়াল মাদ্রিদের বিভিন্ন তথ্য ক্যাসিয়াস তার স্ত্রীকে দিয়েছিলেন।
ট্রান্সফার মার্কেটের এই মুহূর্তের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাংবাদিক ফ্যাব্রিজিও রোমানো। অফিসিয়াল ঘোষণা আসার আগেই যখন তিনি ‘হেয়ার উই গো!’ ক্যাপশন দিয়ে কোনো দলবদলের ঘটনা নিশ্চিত করেন, তখন সবাই ধরে নেয় এটি নিশ্চিতভাবেই ঘটবে। এ প্রসঙ্গে তিনি স্পোর্টসবাইবেল নামের একটি ওয়েবপোর্টালে বলেছিলেন,
“ট্রান্সফার মার্কেটের যেকোনো তথ্য প্রকাশে প্রথম হওয়া আমার লক্ষ্য নয়। আমার প্রধান কাজ একেবারে সত্য তথ্যটুকু মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। আমি মানুষের স্বপ্ন নিয়ে খেলতে চাই না। ট্রান্সফার উইন্ডোতে আসলে কী ঘটছে– আমার কাজ মানুষের সামনে সেটা ব্যাখ্যা করা। আমি কে– সেটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়, কী ঘটছে এখানে– সেটা গুরুত্বপূর্ণ।”
ট্রান্সফার মার্কেটের সাংবাদিক হিসেবে মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেন। তার কাছ থেকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় বলে বিভিন্ন ক্লাবের সমর্থকরা দলবদল সম্পর্কিত বিভিন্ন জিজ্ঞাসায় তাকে ব্যস্ত রাখে। তার নেটওয়ার্ক এতই বড় যে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর যেকোনো দলবদলের তথ্য তিনি পেয়ে যান দ্রুততম সময়ের মধ্যে।
আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে ক্রীড়া সাংবাদিকরা ঠিক গোয়েন্দার মতো ক্লাব ও খেলোয়াড়ের মধ্যকার গোপন খবর বের করে এনে ফুটবলপ্রেমীদের সামনে উপস্থাপন করেন। ট্রান্সফার মার্কেটে শতভাগ সঠিক খবর বের করে আনাটা বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ। খেলোয়াড়ের এজেন্ট কিংবা বিভিন্ন গোপন সূত্রের মাধ্যমে অফিসিয়াল ঘোষণার আগেই সাংবাদিকেরা খবর পেয়ে যান। আধুনিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সাংবাদিকদের কাজকে নিঃসন্দেহে সহজ করে এনেছে।