জোসে মরিনহো বর্তমান কোচদের ভেতর সবচেয়ে উঁচু মানের এবং সেরাদের একজনই হয়তো হবেন। কিন্তু কিছু দিক থেকে তিনি আগাগোড়া বিতর্কিত। পোর্তোর মতো সাধারণ মানের একটি দল নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে সফলতার দেখা পেয়েছেন, চেলসির হয়ে জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগও। কিন্তু কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটে ওঠার মতো অবস্থায় থাকা বেশ কিছু খেলোয়াড়কে তিনি অগ্রাহ্য করেছেন, যারা পরবর্তীতে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের একজন হয়ে উঠেছেন। তিনি হয়তো নিজেও জানেন ক্যারিয়ারজুড়ে তার খেলোয়াড় নির্বাচনের ভাবনাচিন্তায় বেশ ভুল ছিল। কিন্তু এ ভুলের মাশুল তো দেওয়া যায় না। পেছনে পেছনে তাই অনেকেই ক্ষেপে আছেন পর্তুগীজ এ কোচের ওপর।
কেভিন ডি ব্রুইন
বেলজিয়ান এ মিডফিল্ডার শুধু প্রিমিয়ার লিগের সেরা নয়, তাকে বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডারের একজন ধরা হয়। বর্তমান ম্যানচেস্টার সিটি দলে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় তিনি। অথচ উঠতি সময়ে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে তিনি একদমই পাত্তা পাননি। গেন্ত থেকে চেলসিতে আসলেও মরিনহোর চেলসি দলে কেভিন ডি ব্রুইন খেলেছেন মাত্র ৩ ম্যাচ। চেলসিতে তখন বিশ্বসেরা মিডফিল্ডারদের ছড়াছড়ি। ডি ব্রুইনের মত উঠতি তারকাকে যত্ন নেবার সময় কোথায় তাদের! তাই কোন সুযোগ না দিয়ে তাকে পাঠানো হয় গেন্ত ও ভের্ডার ব্রেমেনে লোনে। এবং একটা সময় ১৮ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে জার্মান ক্লাব ভলফসবার্গে বিক্রি করে দেওয়া হলো তাকে।
জার্মানে গিয়ে ডি ব্রুইন নিজেকে তারকা খেলোয়াড় হিসেবে মেলে ধরলেন। ২০১৪/২০১৫ মৌসুমে ডি ব্রুইন ৩৪ ম্যাচে ১০ গোল ও ২০ অ্যাসিস্ট করে নিজেকে প্রমাণ করেন। এ মৌসুমে দারুণ পারফর্মেন্সের ফলে আবারও সুযোগ আসে প্রিমিয়ার লিগে ফেরার। ম্যানচেস্টার সিটি তাকে কিনে নেয় ৫৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। সেই থেকে ইতিহাদ স্টেডিয়ামেই আছেন এ বেলজিয়ান তারকা। পেপ গার্দিওলার ছোঁয়ায় বর্তমানে তিনি পরিণত হয়েছেন বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডারদের একজন। কিন্তু আর একটু যত্নবান হলে এই রত্ন হতে পারতো ব্লুজদের। তারা যে কি হারিয়েছে তা এখন নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারে!
ডেভিড লুইজ
চেলসিতে তাকে নিয়ে এসেছিলেন কার্লো আনচেলত্তি। কার্লোর চেলসি দলে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। মরিনহো আসার পর লুইজের সে সুখের সময় শেষ হয়ে যায়। তার ট্যাকটিসের সাথে ডেভিড লুইজ মানানসই না, এই অজুহাত দিয়ে মরিনহো তাকে দল ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত দেন। ২০১৪ সালে ৫০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ডেভিড লুইজ পাড়ি জমান ফ্রান্সে।
পিএসজির হয়ে টানা দুই মৌসুম লিগে জেতার পর চেলসি আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আন্তোনিও কন্তের একাদশে তিনি আবার সুযোগ করে নেন। ২০১৬-১৭ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগ জেতার পেছনে তার ভালোরকম অবদান ছিল। কন্তে চলে গিয়ে মাউরিজিও সারি কোচ হিসেবে আসার পর তিনিও ডেভিড লুইজের প্রতি আস্থা রাখেন। তাই বর্তমান চেলসি দলে রক্ষণের অন্যতম মুখ তিনি, শুধুমাত্র জোসে মরিনহো তাকে ব্যবহার করতে পারলেন না।
মোহাম্মদ সালাহ
মোহাম্মদ সালাহ বিশ্বের কাছে পরিচিতি পেয়েছিলেনের বাসেলের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্মেন্সের ফলে। এই দুর্দান্ত পারফর্ম তাকে প্রিমিয়ার লিগে টেনে নিয়ে আসে। ১১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে কিনে নেয় চেলসি।
খুব তাড়াতাড়ি ক্যারিয়ারে নতুন মোড়ের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। চেলসির মত দল এবং মরিনহোর মত কোচ। কিন্তু এই ক্লাব ও কোচই কাল হলো তার। সালাহকে আগ্রহের সাথে চেলসি কিনে আনলেও মরিনহো তাকে ব্যবহার করতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। আর সালাহ যা সুযোগ পেয়েছিলেন, তাতেও নজরকাড়া কিছু করে দেখাতে পারেননি। ফলে পরের মৌসুমে তাকে লোনে ফ্লোরেন্টিনা যেতে হয়। সেখানে নিজেকে ফিরে পান তিনি ও রোমা নতুনভাবে আগ্রহ দেখায় তার উপর। রোমার প্রবল আগ্রহের ফলে চেলসি তাকে বিক্রি করে দেয়। রোমার হয়ে সালাহ মাত্র এক মৌসুম খেলেছেন। আর তাতেই বাজিমাত।
লিভারপুলের হয়ে গত মৌসুমে সালাহ ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন অলরেডদের হয়ে। যে সালাহ একসময় প্রিমিয়ার লিগ ফ্লপ খেতাব নিয়ে চুপিসারে বিদায় নিয়েছিলেন, সেই সালাহ বীরের বেশে ফিরে গতবার হলেন প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়।
রোমেলু লুকাকু
একজন তরুণ ফুটবলার, যে কিনা আগের মৌসুমে আন্ডারলেখটের হয়ে ৭৩ ম্যাচে ৩৩ গোল করেছে, তাকে কোন ক্লাব দলে এনেও ব্যবহার না করে বিদায় করে দেয়! জোসে মরিনহো রোমেলু লুকাকুর সাথে এমনটাই করেছিলেন। দারুণ সম্ভাবনাময় একজন স্ট্রাইকার দলে থাকলেও তাকে অকস্মাৎ বিদায় করে দেন।
আন্ডারলেখটে নিজের প্রতিভা তুলে ধরার পর, রোমেলু লুকাকু চেলসিতে নিজেকে প্রমাণ করতে প্রিমিয়ার লিগে মাত্র ১০টি ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন। একজন তরুণের পক্ষে বড় ক্লাবের চাপ সহ্য করে প্রথমেই নিয়মিত ভালো পারফর্মেন্স করা সম্ভব না। লুকাকু পারেননি। তাকে লোনে দেওয়া হলো, এভারটন ও ওয়েস্টব্রমের হয়ে ১৭ ম্যাচে ১৫ গোল করলেন। এভারটন তাকে কিনতে আগ্রহী হলে চেলসি মাত্র ২৮ মিলিয়নে তাকে বিক্রি করতে রাজি হয়।
লুকাকু পরবর্তীতে কি করেছেন তা সবার জানা। এভারটনে তার নিয়মিত গোল করার ক্ষমতা দেখে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাকে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি এর বিনিময়ে দলে ভেড়ায়। তবে অদ্ভুত হলো, যে মরিনহো চেলসির সময় তাকে ব্যবহারই করেননি, তিনিই লুকাকুকে ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিয়ে আসেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত তো হয়েছে চেলসিই, লুকাকুকে পেলে হয়তো তাদের স্ট্রাইকারের অভিশাপটা ঘুচতো।
লিওনার্দো বোনুচ্চি
বোনুচ্চি হয়তো বর্তমানে তার সেরা স্থান থেকে সরে গেছেন, কিন্তু কয়েক বছর আগেও তিনি ছিলেন বিশ্বের সেরা ডিফেন্ডারদের একজন। অথচ এই বোনুচ্চি ইন্টার মিলানে থাকাকালীন মরিনহোর আস্থা কাড়তে পারেননি।
ইন্টারের মিলানের দায়িত্ব মরিনহো পাবার পরেই তিনি বোনুচ্চিকে ছাটাই করেন। বোনুচ্চি তখন মাত্র জানান দিচ্ছেন, তিনি ভবিষ্যতের সেরাদের একজন হবার পথে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মরিনহো ঠিকই তাকে লোনে দিয়ে দিলেন। লোনে অন্য দলে বোনুচ্চি ভালো খেললেও মরিনহো তার দিকে ফিরেই তাকালেন না। আবার লোনে এক বছর কাটানোর পর তাকে জেনোয়ার কাছে বিক্রিই করে দেওয়া হয়।
জেনোয়া ও বারিতে নিজেকে প্রমাণ করার পর বোনুচ্চিকে কিনে নেয় জুভেন্টাস। জুভেন্টাসে বোনুচ্চি বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার হিসেবে মেলেন ধরেন। বুফনের পাশাপাশি ‘বিবিসি’ত্রয়ী ডিফেন্ডার ছিল অনবদ্য। মরিনহো যদি বোনুচ্চিকে নিয়ে একটু ভেবে দেখতেন, তাহলে এতদিনে তার ইন্টারের রক্ষণ ভরসা হয়ে থাকার কথা।
ফিলিপে লুইজ
লন্ডনের সাথে ব্রাজিলিয়ান লেফট-ব্যাক ফিলিপে লুইজের সম্পর্ক খুবই অল্প সময়ের। স্পেন থেকে গেলেন, এক বছর দেখলেন, তারপর আবার স্পেনে ফিরে গেলেন; ঘটনা অনেকটা এমনই।
অনেক প্রত্যাশা নিয়ে লুইজ স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে গিয়েছিলেন। চেলসির ২০১৪-১৫ লিগ জেতানো মৌসুমে চেলসি দলেও ছিলেন তিনি, তবে তা না খেলে কৃতিত্ব জেতার মতো। মরিনহোর অধীনে লুইজ মাত্র ১৫ ম্যাচ মাঠে নেমেছিলেন। পরের মৌসুমেই তাকে আবার পুরনো ক্লাবের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তবে লুইজ নিজের ক্যারিয়ার শেষ হতে দেননি, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে ফিরে নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করে গেছেন। তার সুফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা ফুলব্যাকদের মাঝে ফিলিপে লুইজের নাম অবশ্যই থাকবে।
তবে লুইজকে নিয়ে ব্লুজ ফ্যানদের তেমন আক্ষেপ নেই। বরাবরই তাদের ভালো ফুলব্যাক ছিল বলে মরিনহোর এ অবহেলার জন্য তিনি সেভাবে সমালোচিত হননি।
এছাড়াও আছে টিয়াগো, যাকে বেনফিকা থেকে কিনেও ঠিকমতো ব্যবহার করা হয়নি। পরবর্তীতে তিনি অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের লিজেন্ড খেতাব দিয়ে অবসরে যান। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে এসেও তিনি যেন এ ধারা বজায় রাখেননি। তরুণ ডাচ উইঙ্গার মেম্ফিস ডিপাইকে নিজের স্কোয়াডে কখনও রাখেননি তিনি। হয়তো ডিপাই ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। কিন্তু মরিনহো তো ‘স্পেশাল ওয়ান’ বলে পরিচিত, ডিপাইকে কীভাবে দলের সাথে মানিয়ে নেওয়া যায় তা কি ভাবতে পারতেন না? ‘অলিম্পিক লিঁও’-র হয়ে ডিপাই টানা গোল করে যাচ্ছেন, আর অ্যালেক্সিস সানচেজ?
পোর্তোর হয়ে রূপকথার গল্প বাদে মরিনহোকে নিয়ে বড়াই করার কোন উপযুক্ত গল্প নেই। ‘স্পেশাল ওয়ান’ হলেও মরিনহো কখনোই তরুণ খেলোয়াড়দের সুযোগ দেন না, বরং অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের নিয়ে একাদশ তৈরি করে শিরোপা জয়তেই তার আগ্রহ বেশি। তিনি কখনোই একজন তরুণ প্রতিভাকে তৈরি করে ব্যবহার করতে আগ্রহী নন।
সময়ের সাথে সবকিছুই বদলায়। ফুটবল বদলেছে, মরিনহো বদলাননি। এখন আর অভিজ্ঞ খেলোয়াড় দিয়ে একাদশ সাজালেই সাফল্য আসে না। এক সময় উঠতি তরুণদের অবহেলা করেছেন, পরবর্তীতে তারাই হয়েছেন বিশ্বসেরা। ‘রেড ডেভিল’দের হয়ে এখনও একই কাজ করে যাচ্ছেন। তাই তার সাফল্যের খাতা শূন্য, সমালোচনার খাতা পূর্ণ।
Featured Image Credit : FUTBULIE/Youtube