সময় ও স্রোত কারো জন্য থেমে থাকে না। কিন্তু সময় কতটা দ্রুত অতিবাহিত হয়, আর কত দ্রুত ভালো সময় বদলে বিষাদময় হতাশার সময় হাজির হয়, তা কি আমরা ঠিকভাবে বুঝতে পারি? হয়তো পারি, অথবা পারি না। তবে ফরাসি লিগ ওয়ানে খেলা মোনাকোর ক্লাবের সমর্থক, বোর্ড থেকে খেলোয়াড় পর্যন্ত অনুভব করতে পারছে, কত দ্রুত তাদের সুখের সময় বিদায় নিয়েছে।
দুই মৌসুম পিছিয়ে যাওয়া যাক। ২০১৬-১৭ সালের মোনাকোর কথা চিন্তা করুন তো! পিএসজির ‘ঘরের ট্রফি’ বানিয়ে ফেলা ‘লিগ ওয়ান’ শিরোপাকে তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো দুর্দান্ত মোনাকো। চ্যাম্পিয়নস লিগে তো আরেক চমক, পেপ গার্দিওলার দুরন্ত দলকে শেষ ১৬ থেকে বিদায় করে দিলো লিওনার্দো জারদিমের দল। কোয়ার্টার ফাইনালে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে দিলো ৬ গোল, যদিও সেমিফাইনালে জুভেন্টাসের সামনে তাদের জয়রথ থেমে যায়। কিন্ত এক মৌসুমে লিগ জয়, কুপ দে লা লিগে রানার্সআপ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ ও কোপা দে ফ্রান্সে সেমি-ফাইনালই বলে দেয় সে মৌসুমের তাদের সাফল্যের পরিমাণ।
কিন্তু বর্তমান সময়ে মোনাকো? টানা ১২ ম্যাচে তাদের কোনো জয় নেই। থিয়েরি অঁরির অধীনে মোনাকো জয় পেয়েছে মাত্র ১টি, লিগ ওয়ানে ১৪ ম্যাচে তাদের পয়েন্ট মাত্র ১০। বর্তমানে তারা আছেও অবনমন অঞ্চলে। তাদের ৪০ বছরের ইতিহাসে সব থেকে বাজে শুরু এটি। দুই বছর আগেই লিগ জেতা দলের কেন এমন অবনতি?
খেলোয়াড় বিক্রির অস্বাভাবিকতা
বর্তমান ইউরোপের প্রত্যেকটা ক্লাবই চায় তাদের সেরা খেলোয়াড়কে যেকোনো মূল্যে ধরে রাখতে। অথচ মোনাকো যেন তাদের সেরা খেলোয়াড়গুলো বিক্রি করে দল খালি করাতেই বেশি আগ্রহী ছিল। যদি মোনাকোর খেলোয়াড় বিক্রির পরিসংখ্যান পেছনে থেকে শুরু করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, কীভাবে বিভিন্ন ক্লাব মোনাকো থেকে তাদের সেরা খেলোয়াড়গুলোকে চড়া মূল্যে নিয়ে গেছে।
শুরুটা হয়েছিলো ব্রাজিল বিশ্বকাপের পর থেকে। বিশ্বকাপের ‘গোল্ডেনবয়’কে চড়া মূল্যে প্রথমে তাকে কিনে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। তার পরের বছর দলের সেরা উইঙ্গার অ্যান্থনি মার্শালকে নিয়ে নেয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ইয়ানিক ক্যারাসকো ও লেইভিন কুরজাওয়াকেও তারা সে বছর ধরে রাখতে পারেনি। তবে এসব গুরুত্বপূর্ণ দলবদলের পরও মোনাকো বি এবং অখ্যাত সব ক্লাব থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড় কিনে মোনাকো দারুণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু ২০১৭-১৮ মৌসুমে যেন তাদের স্কোয়াডে ধস নেমে আসে।
২০১৬-১৭ মৌসুমের সাফল্যের পেছনে যে খেলোয়াড়গুলোর বিশেষ অবদান ছিল, পরের মৌসুমে তাদের কেউই মোনাকোতে ছিল না। টিমুই বায়াইয়োকো চেলসিতে এবং ব্রানার্ডো সিলভা ও বেনজামিন মেন্ডিকে ম্যানচেস্টার সিটি বিশাল অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়। প্রত্যাশা থেকে কয়েক শতাংশ বেশি অর্থ পাবার ফলে মোনাকো বোর্ড এসব অফার প্রত্যাখ্যানও করতে পারেনি। এরা যাবার পর সবথেকে ভয়াবহ প্রস্তাব দেয় পিএসজি। আগের মৌসুমে মোনাকোর হয়ে গোলবন্যা বইয়ে দেয়া কিলিয়ান এমবাপেকে লোনে এবং পরের বছর বিশাল অংকের অর্থ দিয়ে কিনে নেবার প্রস্তাব কোনোভাবেই মোনাকো বোর্ড অগ্রাহ্য করতে পারেনি। এমনকি তরুণ স্ট্রাইকার গুইডো ক্যারিলোও সাউদাম্পটনে পাড়ি জমায় মোনাকো ছেড়ে। তবুও জোড়াতালি দিয়ে সে বছরটা পার করেছিলো মোনাকো।
কিন্তু এ বছরের দলবদলের গল্প যেন আরও ভয়াবহ টেরেন্স কনগোলো, রাসিদ গেজ্জাল, অ্যাডাম ডিয়াখবে, জোয়াও মৌতিনহো ও কেইতা বালদের মত খেলোয়াড় বিক্রি করে দেবার পর থমাস লেমার, ফ্যাবিনহোর মতো খেলোয়াড় বিক্রি করে দেয় তারা। তাই, তাদের এমন অধঃপতনের অন্যতম কারণ যে এমন অস্বাভাবিক খেলোয়াড় বিক্রি, তা বলাই বাহুল্য।
ফ্লপ ট্রান্সফার
শুধু মোনাকো নয়, প্রত্যেকটা ক্লাবই সবসময় কোনো খেলোয়াড়ের শূন্যতা পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। বিগত মৌসুমজুড়ে মোনাকো এমনটাই করে এসেছিলো। কিন্তু চলতি মৌসুমে এ বাজিতে তারা আর জেতেনি।
২০১৭ সালের সাইনিং লেফটব্যাক হোর্হে, মিডফিল্ডার ইউরি টিয়েলমান্স আর স্ট্রাইকার স্টিভেন জোভেটিচ তেমন কোনো আশা দেখাতে পারেননি থিয়েরি অঁরি’র ট্যাকটিক্সে। এ বছরের সাইনিং আলেকজান্ডার গোলোভিন, নাসের চ্যাডলি, বেনজামিন হেনরিচ ইনজুরিতে জর্জরিত হয়ে এখনও নিজেদের হারিয়ে খুঁজে চলছেন, মোনাকোর খেলার ধরণের সাথে মানিয়ে নিয়ে নিয়মিত মাঠে নামা তো বহু দূরের কথা। তাই এই ভয়াল সময়ে জেমারসন, জিব্রিল সিদিবে, সুবাসিচ ও রাদামেল ফ্যালকাওদের মতো পুরনো সৈনিকই কোনোমতে দলকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে চলছেন।
ইনজুরি যেন সর্বত্র
বিপর্যয় ডেকে আনা সিদ্ধান্তের পর ‘মরার উপরে খাড়ার ঘা’ হয়ে মোনাকোর ঘাড়ে চেপে বসেছিলো ইনজুরি সমস্যা। আসলে ‘চেপে বসেছিলো’ বললে ভুল হবে, ইনজুরি সমস্যা এখনও তাদের ঘাড়ে চেপে আছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক খেলোয়াড়ই মাঠে নামার জন্য উপযুক্ত নন।
এ মাসের শুরুতে পিএসজি যখন তাদের ৪-০ গোলে বিদ্ধস্ত করে, তখন মোনাকো দলের ১৩ জন খেলোয়াড় ইনজুরিতে আক্রান্ত ছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে, ম্যাচ সামনে রেখে দল ঘোষণা করাই কষ্টকর হয়ে গেছে।
এখনও তাদের প্রধান একাদশের সবাই খেলার জন্য প্রস্তুত নয়। প্রথম পছন্দের গোলকিপার সুবাসিচ বিশ্বকাপের পর থেকে নিয়মিতভাবে খেলতে পারেননি, তিনি এখনও ইনজুরির জন্য মাঠের বাইরে। রাইটব্যাক জিব্রিল সিদিবে হাঁটুর ইনজুরির জন্য দল থেকে দূরে আছেন এপ্রিল মাস থেকে, লেফট-ব্যাকে অ্যান্থনি বারেকাও নেই। মিডফিল্ডের ভরসা রনি লোপেজ নেই সেপ্টেম্বর থেকে। জেমারসন ফিরলেও রক্ষণে কামিল গিলক এখনও প্রস্তুত নন। টিয়েলমান্স ও গোলোভিন মাঠে ফিরলেও পিয়েতো পেলেগ্রিনো ও জোভেটিচকে মাঠে ফিরতে পেতে আরও কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে থিয়েরি অঁরিকে।
জারদিম ও অঁরির পার্থক্য
অক্টোবরের ১১ তারিখে লিওনার্দো জারদিমকে হুট করে কোচের দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা মোটেও সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না মোনাকো দলের জন্য। জারডিমের ৪ বছরে মোনাকোকে ভিন্ন এক রূপে উপস্থাপন করেছেন। তার কোচিং ধরণ শুধুমাত্র মোনাকো দলকে বদলে দেয়নি, ক্লাবের বোর্ডকেও লাভের মুখ দেখিয়েছে। কারণ ক্লাবের যুব দল থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়, বা তরুণ কোনো খেলোয়াড়কে পরিণত ফুটবলার তৈরি করে তিন থেকে চারগুন বেশি দাম দিয়ে বিক্রি করাই ছিলো মোনাকো বোর্ডের অন্যতম লক্ষ্যগুলোর একটি। আর এ দলটির সেরা সময় কিন্তু এনে দিয়েছিলেন এই জারদিমই। হয়তো আর কিছু সময়ের ব্যবধানেই শীতকালীন দলবদলের সময় মোনাকোর এ দুর্দশা আবার সুসময়ে বদলে যেতে পারতো!
থিয়েরি অঁরির কোচিং ক্যারিয়ারের সফলতা কী? একটি দলকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলে তিনি কোন দিক থেকে পারদর্শী? আসলে তিনি কখনও কোনো দলের কোচ ছিলেন না। একটি বড় দলের চাপ নেবার ক্ষমতা হয়তো তার নেই, আর মোনাকোর পরিবেশ বর্তমানে একদমই ভিন্ন। তার কোচিং ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতা বলতে বেলজিয়ামের কোচ রবার্তো মার্টিনেজের সহকারী কোচ হিসেবে থাকা দু’টি বছর।
হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ দল পেলে অঁরির কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুটা ভিন্ন হতে পারতো। কিন্তু সময় কিংবা সুযোগ কোনোটিই তার পক্ষে নেই। দলের সেরা খেলোয়াড়গুলোকে তিনি পাননি ইনজুরির কারণে, বাধ্য হয়ে ব্যবহার করেছেন ‘বি’ দলের আনকোরা খেলোয়াড়দেরকে। হারের বৃত্তে ঘুরতে থেকে নিজেও বিভ্রান্ত হচ্ছেন বারবার। বিভ্রান্তির নমুনা তার ট্যাকটিক্স। প্রতি ম্যাচেই ভিন্ন ফলাফলের জন্য ফর্মেশন পরিবর্তন করছেন, খেলার ধরণে ভিন্নতা আনছেন। মোনাকো অধ্যায় শুরু করেছিলেন ৪-২-৩-১ দিয়ে, সেখান থেকে ৪-৩-৩ এবং মোনাকোর লিগজয়ী ফর্মেশন ৪-৪-২ ব্যবহার করেছেন, যেখানে মেন্ডি, লেমার ও সিদিবে, সিলভা পজিশন পরিবর্তন করে খেলতেন। কিন্তু ফলাফল আসেনি। ১০টিরও অধিক ম্যাচ বেশি খেলার পরও অঁরি সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি, মোনাকোর জন্য কোন কৌশল যথাযথ হবে।
একের পর এক হারের পরও থিয়েরি অঁরির চাকরি এখনও নিরাপদে আছে। ক্লাবের ছেলের বিশ্বাসের উপর ভর করে সমর্থক ও ক্লাবের বোর্ড তার উপর আশা রাখছেন। কিন্তু আবেগ সরিয়ে দেখলে মোনাকোর ভবিষ্যৎ একদমই সুরক্ষিত নয়। উজ্বল সময় পার হয়ে গেছে বহু আগেই, নিভু নিভু আলোকেও গ্রাস করছে নিকষ কালো অন্ধকার। একমাত্র ভাগ্য, কোচ ও ক্লাবের সহায়তাই ফিরিয়ে দিতে পারে তাদের পুরনো সময়। ক্লাবের সকল সৈনিক একসময় অবশ্যই ইনজুরিকে পরাজিত করে মাঠে ফিরবেন, ক্লাবও হয়তো তাদের অ্যাকাডেমি কিংবা বাইরে থেকে তরুণ প্রতিভা উড়িয়ে নিয়ে আসবে ক্লাবে। তখন প্রবল দায়িত্ব কিন্তু শুধুমাত্র অঁরির। সেই মুহূর্তে তার ব্যর্থতায় ডুবে যেতে পারে মোনাকোর ভবিষ্যৎ।
ভবিষ্যতে মোনাকোর ভাগ্যে কী লেখা আছে, সেটা এখন তাই সময়ের হাতেই তোলা রইলো।