১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দ, ক্রিকেট নামক খেলাটির প্রথম স্বীকৃত ম্যাচটি মাঠে গড়ানোর বছর সেটা। সেখান থেকে এই পর্যন্ত আসার পথে ক্রিকেট পেয়েছে অগণিত মহানায়ক, পেয়েছে অসংখ্য স্মৃতি যা আঁকড়ে রাখা যায় স্মৃতির মণিকোঠায়। তেমনি করেই ক্রিকেট তার স্মৃতিতে অম্লান রেখেছে এক মহানায়ককে, যার নাম স্যার জন বেরি জ্যাক হবস; ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যান বলা হয় যাকে। স্মৃতির পাতায় তিনি অক্ষত আছেন ‘দ্য মাস্টার’ নামে।
এ যুগের ক্রিকেটের দুই-একজন আদর্শ ব্যাটসম্যানের নাম বলতে গেলে সামনে আসবে স্টিভেন স্মিথ-বিরাট কোহলি-জো রুটদের নাম। একটু পিছিয়ে গেলে আসবেন শচীন-লারা-সাঙ্গাকারা। এদের মধ্যে শচীন তো আবার শতকেরও শতক করেছেন। কিন্তু এদেরও বহু আগে শতকের সংখ্যাকে ডাবল হান্ড্রেডের ঘরে নিয়ে যেতে যেতে ১৯৯তে গিয়ে থামা একজন ব্যাটসম্যান জ্যাক হবস। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার শতকের সংখ্যা বিতর্কের ঊর্ধ্বে ১৯৭টি, বেশিরভাগ রেকর্ডই সমর্থন করে ১৯৯কে। ১৯৯টি টেস্ট শতকের মালিক স্যার জন বেরি জ্যাক হবস একজন সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ১৯০৮ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত, মাঝে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আন্তর্জাতিক অভিষেকের ২য় বছরেই মনোনীত হন উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে, ১৯২৬ সালে আরও একবার। বিংশ শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজনও নির্বাচিত হন জ্যাক হবস। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৯৯টি শতকের মালিক হবসের ঝুলিতে আছে ৬১ হাজার ৭৬০ প্রথম শ্রেণির রান। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে নাইটহুডও পান হবসই। এত সব সাফল্যের পেছনের গল্পটাও জানা যাক, জানার শুরুটা হোক একদম জন্ম থেকেই।
১৮৮২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, শনিবার। ক্যামব্রিজের এক দরিদ্র দম্পতির সংসারে নতুন সদস্যের আগমন। বাবা-মা দারিদ্রের সাথে লড়াই করে কাটান দিন। সংসারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। এর উপর তার পরে সংসারে আছে আরও ৫ ভাই আর ৬ বোন, সবার বড় হিসেবে অভাবের সংসারে তার শখ-আহ্লাদ মেটানোটা অসম্ভবই ছিল বলতে হবে। এই অভাবের সংসারেই বাবা সিনিয়র হবসের মাধ্যমেই ক্রিকেটকে চেনেন হবস। বাবার মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করা আর মাঝেমধ্যে আম্পায়ারিং করার মধ্য দিয়েই হবস চিনতে শুরু করেন ক্রিকেটকে। ভালোবাসার শুরুটাও সেখান থেকেই।
বাবার সাথে যেতেন, খেলা দেখতেন, সেখানে অনুশীলনরত ক্রিকেটারেদের বিভিন্ন শৈলী দেখে নিজে চেষ্টা করতেন তেমনটা করার। একা একাই অনুশীলন করতেন হবস; শুরুর বয়সে তার ছিল না কোনো কোচ, কোচের কাছে পাঠানোর মতো সামর্থ্যই হয়তো ছিল না তার পরিবারের। একা একা অনুশীলন করতেন ঠিক, তবে হবসের ছিল না কোনো ক্রিকেট ব্যাটও। ব্যাটের বদলে ব্যবহার করতেন স্ট্যাম্প, সাথে থাকতো কুড়িয়ে পাওয়া পুরনো টেনিস বল। এটা অবশ্য তাকে সাহায্যই করেছে। সরু স্ট্যাম্প দিয়ে বলকে আঘাত করা রপ্ত করায় প্রশস্ত ব্যাট দিয়ে গোল বলের মোকাবেলা করা তার জন্য হয়ে যায় আরও সহজ।
১২ বছর বয়সে প্রথম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেট দলে জায়গা করে নেন হবস। সেন্ট ম্যাথুস চার্চ একাদশের হয়ে খেলেন, খেলেন ইয়র্ক স্ট্রিট বয়েজের হয়েও। এরপরই টানাটানির পরিবারে নতুন দুর্যোগ হয়ে এলো নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাবার মৃত্যুটা। ৬ ভাই ৬ বোনের পরিবারের বড় ছেলে হবস; বাবার অবর্তমানে তাকে যে পরিবারের দায়িত্ব নিতেই হবে। তাই তো লেখাপড়া ছাড়তে হলো তাকে ওই বয়সেই। ১৯৮৫ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সেই জীবিকার তাগিদে যোগ দিলেন চাকরিতে।
পছন্দের চাকরিই খুঁজে পেয়েছিলেন; কেসাস কলেজে মাঠকর্মী হিসেবে যোগ দেন হবস, একই সাথে গ্রাউন্ডসম্যান আর নেট বোলারের দায়িত্বও পালন করে যান মানসিক আনন্দের সাথেই। এখানেই অনুশীলন করতেন আরেক কিংবদন্তি রনজিৎসিংজি। হবস দেখতেন তার অসাধারণ রিস্ট মুভমেন্ট, চেষ্টা করতেন আয়ত্বে নেয়ার। কাউন্টির দল সারেও এখানে অনুশীলন করতো। ১৯০১ সালে হবসের সুযোগ আসে একটি অপেশাদার আর পেশাদারের মাঝামাঝি রকমের দলের হয়ে খেলার। সেখানে অসাধারণ পারফর্ম করে মনোযোগ কেড়ে নেন স্থানীয় দলগুলোর।
বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের এক বন্ধুপ্রতিম ব্যাক্তি টম হেওয়ার্ডের কাছে আবেদন করেন হবসের ব্যাপারে কিছু করে তাদের সাহায্য করতে। উল্লেখ্য, টম হেওয়ার্ড ছিলেন হবসের শৈশবের নায়ক। হেওয়ার্ড তাতে সায় দিয়ে ২০ মিনিট হবসের ব্যাটিং দেখেন, আর তাতেই যা হবার হয়ে যায়। ওভালে কাউন্টি দল সারের হয়ে পরবর্তী ট্রায়ালে হবসের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন তিনি। এসেক্সও ট্রায়ালের চেষ্টা করে করেছিলেন হবস, তবে দিতে পারেননি শেষ অব্দি সেখানে। এপ্রিল ১৯০৩, সারেতে হবস যান ট্রায়ালে অংশ নিতে। সেখানেই বাজিমাৎ, চুক্তিবদ্ধ হয়ে গেলেন সারের সাথে। ১৯০৩ সালে চুক্তিবদ্ধ হবস সারের হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নামেন ১৯০৫ সালে। অভিষেক ম্যাচে খেলেন ১৮ আর ৮৮ রানের ইনিংস। পরের ম্যাচে এসেক্সের বিপক্ষে ১৫৫। এর পরপরই অ্যাশেজ খেলতে আসা অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষে সুযোগ পান ব্যাট হাতে নিজেকে বড় জায়গায় প্রমাণ করার, খেলেন ৯৪ রানের ইনিংস। ক্যারিয়ারের প্রথম ৩ বছরের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তার গড় ছিলো ২৫.৮২, ৪০.৭০, এবং ৩৭.৪৫। ১৯০৮ সালেই ডাক পেয়ে যান ইংলিশ জাতীয় দলে।
১৯০৮ সালের শুরুর দিনেই অভিষিক্ত হন জ্যাক হবস। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে রান করেন ৮৩। পরের টানা ২ ইনিংসে ২০ এর ঘরে গিয়ে আউট হন, আর ৪র্থ ইনিংসে অপরাজিত থাকেন ওই ২০-এর ঘরেই। পরের ইনিংসে ২য় অর্ধশতকের দেখা পান হবস, এরপরের ২ ইনিংসে ০ আর ৭২।
জাতীয় দলের হয়ে প্রথম শতক পেয়েছেন নিজের ক্যারিয়ারের দ্বাদশ ম্যাচে, ২৩তম ইনিংসে। ১৯১০ সালের ১১ মার্চ কেপ টাউনে শুরু হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষের ম্যাচে প্রথম ইনিংসেই খেলেন ১৮৭ রানের ইনিংস। অভিষেক বছরে আন্তর্জাতিক গড় ৪৩.১৪ আর ফার্স্ট ক্লাসে ৩৭.৩৩। ১৯১১-১২ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক সিরিজে করেন ৩টি শতক। নিজেকে নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী ততদিনে দিয়ে ফেলেছেন নিজের পারফরমেন্স দিয়েই। বাকি বছরগুলো রেকর্ড গড়ার, সেঞ্চুরির রেকর্ড।
“লাইফ বিগিনস আফটার ফোরটি” – এই প্রবাদটি যেন হারে হারে সত্য জ্যাক হবসের বেলায়। তার করা শতকের বেশিরভাগই ৪০ বছর বয়সের পরে করা। জাতীয় দলের হয়ে করা ১৫ সেঞ্চুরির ৮টিও সে সময়ের। ফার্স্ট ক্লাসে তো অনেক বেশিই। ৪৩ থেকে ৪৬ বছর বয়স পর্যন্ত তার সংগ্রহ প্রায় ১১ হাজার রান। সব থেকে বেশি বয়সে আন্তর্জাতিক টেস্ট শতক করার রেকর্ডটি (৪৬ বছর ৮২ দিনে) এখনও তারই দখলে। ১৯২৯ সালের ৮ মার্চ করা শতকটির মাধ্যমেই এই রেকর্ডটিকে করে নেন নিজের। পরেরজন শতক করেছেন ৪৫ বছর ১৫১ দিনে। ১৯০৯ আর ১৯২৬ সালে দুইবার উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার হন তিনি, তা তো শুরুর দিকেই বলেছি। ২০০৯ সালে করা ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা টেস্ট একাদশেও জায়গা করে নেন তিনি। আন্তর্জাতিক টেস্টে অন্তত ৩,০০০ রান করেছেন এমন ব্যটসম্যানদের মধ্যে তিনি এখনো সর্বোচ্চ গড়ের তালিকায় আছেন সেরা দশে। জ্যাক হবসের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ গড় ১৯২৬ সালে, ৮১.০০। ১৯২৪ সালে গড় ছিল ২য় সর্বোচ্চ ৭৫.২৮। সর্বনিম্ন গড় ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে, ১৯০৯ সালে তার গড় ছিল ২৬.৪০।
হবস একজন ওপেনার হলেও ওপেনিংয়ের বাইরে অন্যান্য পজিশনেও খেলেছেন মাঝেমধ্যে। ৫ নাম্বার পজিশনে তার খেলা ৩ ম্যাচে তার গড় ১২৩। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ শতক তো তারই, ২য় সর্বোচ্চ অর্ধশতকেরও মালিক হবস। ২৭৩টি অর্ধশতক করে তিনি আছেন ২৯৫টির মালিক উলির পরই। ইংলিশ আরেক ব্যাটসম্যান হার্বার্ট সাটক্লিফের সাথে হবস গড়েছেন সাকুল্যে ৩,৩৩৯ রানের জুটি, আর রোডসের সাথে ২,২৯৪ রানের।
স্যার জন বেরি জ্যাক হবস ৮৩৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে খেলেছেন ১,৩২৫ ইনিংস। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৩১৬, গড় ৫০.৭০, শতক ১৯৯, অর্ধশতক ২৭৩টি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মর্যাদাবান যুগে তার এই পারফরমেন্সই তাকে মনে রাখতে বাধ্য করার মতো যথেষ্ট। সেখানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ৬১ ম্যাচে ৫৬.৯৪ গড়ে ৫,৪১০ রান তার প্রাপ্তির খাতাকে আরও বড় করে। নিজ দেশের হয়ে ১০টি টেস্ট শতক করা প্রথম ব্যাটসম্যান জ্যাক হবস। মোট শতক ১৫টি, অর্ধশতকের সংখ্যা ২৮।
ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংও করতে পারতেন টুকটাক। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার আছে ১০৮টি উইকেট; আছে ৫৬ রানে ৭ উইকেট নেয়ার রেকর্ডও। আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২.৬৩ ইকোনমিতে উইকেট সংখ্যা ১টি।
এক নজরে তার পরিসংখ্যান দেখলে যে কেউ অবাক হতে বাধ্য। আর মাঝে বিশ্বযুদ্ধের কারণে ৫টি বছর না হারালে করতে পারতেন আরও অনেক কিছু। বিশ্বযুদ্ধের পরও বেঁচে থাকা হবস খেলতে থাকেন আগের থেকেও ভালোভাবে, নতুন ছন্দে। সাদা-কালো যুগের ৩০ বছরের এক বর্ণিল ক্যারিয়ার শেষ করেন ১৯৩৪ সালে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শেষবার খেলেন ১৯৩০ সালে। ১৯৫৩ সালে পান প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে নাইটহুড অ্যাওয়ার্ড, জ্যাক হবস হয়ে ওঠেন ‘স্যার জ্যাক হবস’। তার ১০ বছর পর ১৯৬৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর ৮১ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন তিনি।
১৯৬৩ সালে নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তিনি এখনো আছেন আমাদের মাঝেই। আছেন আইসিসির সর্বকালের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান তালিকার ৪ নম্বরে। এখনো প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর ওভালে তার জন্মদিন উদযাপন হয় তারই প্রিয় টমেটো স্যুপ, ভেড়ার রোস্ট, আর আপেল দিয়ে। হয়তো একবিংশ শতাব্দীর চার-ছক্কার ক্রিকেটের কারণে সাদা পোশাকের ক্রিকেট পিছিয়ে গিয়েছে; তবুও বিশ্ব পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যানের খোঁজ করতে গেলে শচীন-সাঙ্গাকারা-ব্রায়ান লারা হয়ে ফিরে যাবে সেই ‘দ্য মাস্টার’ অবধিই।