গত মাস থেকে আমরা ‘রোর বাংলা প্লেয়ার্স অফ দ্য মান্থ’ নামে একটি নতুন সেগমেন্ট চালু করেছি। এই সেগমেন্টে সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে একটি নির্দিষ্ট মাসে ভিন্ন ভিন্ন লিগের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হবে। চলুন, তবে দেখে নেওয়া যাক, অক্টোবর মাসে কোন কোন খেলোয়াড় দারুণ পারফর্মেন্সের মাধ্যমে এই তালিকায় জায়গা করে নিল।
প্রিমিয়ার লিগ – জেমি ভার্ডি (লেস্টার সিটি)
গত মৌসুমের শেষের দিকে ব্রেন্ডন রজার্সকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর বেশ ভালো ফর্মে থেকে শেষ করেছিল ক্লাবটি। সেই ভালো ফর্মের ধারা এই মৌসুমেও অব্যাহত রেখেছে তারা। চেলসি, আর্সেনাল, টটেনহ্যামের মতো ক্লাবকে টপকে পয়েন্ট টেবিলের তিন নাম্বারে অবস্থান করছে তারা। আর লেস্টারের এই অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন তাদের অভিজ্ঞ স্ট্রাইকার জেমি ভার্ডি।
অক্টোবর মাসে প্রিমিয়ার লিগে ভার্ডি ম্যাচ খেলেছেন মোট তিনটি। লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচে নিষ্প্রভ ছিলেন ভার্ডি, লেস্টারও সেই ম্যাচে অলরেডদের সাথে পেরে ওঠেনি। পরের ম্যাচে বার্নলির বিপক্ষে যখন ০-১ গোলে পিছিয়ে ছিল লেসটার, তখন গোল করে দলকে সমতায় ফেরান এই ইংলিশ স্ট্রাইকার। আর মাসের শেষ ম্যাচে সাউদাম্পটনে গিয়ে রীতিমত তাণ্ডব চালিয়ে আসে লেসটার। ৯-০ গোলে জেতা সেই ম্যাচে দারুণ এক হ্যাটট্রিক করেন তিনি। অক্টোবর মাসে প্রিমিয়ার লিগে ইকেই গুন্ডোগানও দারুণ ছিলেন। তবে তিন ম্যাচে চার গোল করা ভার্ডিকেই এই মাসে প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত করা হলো।
লা লিগা – লিওনেল মেসি (বার্সেলোনা)
ইনজুরির কারণে এবার মৌসুমের শুরুর দিকে বেশ কিছু ম্যাচ মাঠের বাইরে ছিলেন লিওনেল মেসি। তবে ইনজুরি থেকে ফিরে নিজের স্বরূপে ফিরতে খুব বেশি সময় তিনি নেননি, সেভিয়ার বিপক্ষে পুরো ম্যাচে দারুণ খেলে করেছিলেন এক গোল। এইবারের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচে করেছিলেন এক গোল ও এক অ্যাসিস্ট। আর অক্টোবর মাসে নিজেদের শেষ লিগ ম্যাচে রিয়াল ভ্যালাদোলিদের বিপক্ষে ছিলেন অতিমানবীয় রূপে। ওই এক ম্যাচেই করেছিলেন দুই গোল ও দুই অ্যাসিস্ট।
অক্টোবরে অবশ্য বার্সেলোনার আরেকটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাতালোনিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত থাকায় ২৬ অক্টোবর রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ম্যাচটি স্থগিত হয়ে গেছে। তবে অন্যদের তুলনায় এক ম্যাচ কম খেললেও চার গোল ও তিন অ্যাসিস্ট করে সবার ওপরেই রয়েছেন মেসি। তাই অক্টোবর মাসে লা লিগার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটি নিঃসন্দেহে তারই প্রাপ্য।
সিরি আ – লাউতারো মার্টিনেজ (ইন্টার মিলান)
বেশ বড় একটা সময় ইন্টার মিলানের আক্রমণভাগকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাউরো ইকার্দি, দলটির গোলের মুল উৎসে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। এমন একজন পরীক্ষিত পারফরমার গত মৌসুমে ক্লাব কর্মকর্তাদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে দলের বাইরে চলে যান। নিজেদের সেরা খেলোয়াড়কে হারিয়ে ইন্টারের আক্রমণভাগের কেমন হাল হবে, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন।
তবে এই আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের ফেলে যাওয়া দায়িত্বটা বেশ ভালোভাবে পালন করছেন আরেক আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার লাউতারো মার্টিনেজ। খুব অল্প সময়ের মাঝেই নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন। বিশেষ করে এই অক্টোবর মাসজুড়ে দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন তিনি। এই মাসে সিরি আ’তে মোট পাঁচ ম্যাচ খেলে তিনি করেছেন চার গোল, আর সাথে মোট দু’টি পেনাল্টি আদায় করেছেন। পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষস্থানের জন্য জুভেন্টাসের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে ইন্টারের। আর সেই লড়াইয়ে দলকে টিকিয়ে রাখার নেপথ্য কারিগর তিনি। জুভেন্টাসের মিরালেম পিয়ানিচও দারুণ সময় পার করছেন, তবে সব মিলিয়ে লাউতারো মার্টিনেজকেই এই মাসে সিরি আ’র সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বেছে নেওয়া হলো।
বুন্দেসলিগা – রবার্ট লেভান্ডস্কি (বায়ার্ন মিউনিখ)
‘এক ঘোড়ার প্রতিযোগিতা’ হিসেবে পরিচিত বুন্দেসলিগার এবারের হালচাল বেশ ভিন্ন। পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষস্থানের জন্য প্রথম নয়টি দলের মধ্যে রীতিমতো ইঁদুর লড়াই চলছে। ফ্রাঙ্ক রিবেরি ও অ্যারিয়েন রোবেনের মতো অভিজ্ঞ দুই যোদ্ধাকে হারানো সত্ত্বেও বায়ার্ন যে এই লড়াইয়ে টিকে আছে, তাতে সবচেয়ে বড় অবদান রবার্ট লেভান্ডস্কির।
মৌসুমের শুরু থেকেই দারুণ ছন্দে আছেন এই পোলিশ স্ট্রাইকার, অক্টোবর মাসেও বজায় রেখেছেন সেই ধারা। এই মাসে বুন্দেসলিগায় মোট তিন ম্যাচ খেলে প্রতিটি ম্যাচেই গোলের দেখা পেয়েছেন। তবে এই স্ট্রাইকারের এমন ধারাবাহিক পারফর্মেন্স সত্ত্বেও এই তিন ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটি ম্যাচে জয়ের দেখা পেয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ। লেভান্ডস্কির সাথে দলের অন্য খেলোয়াড়েরা জ্বলে না উঠলে বহুদিন পর ঘরোয়া লিগের শ্রেষ্ঠত্ব হাতছাড়া হতে পারে ক্লাবটির।
লিগ ওয়ান – কিলিয়ান এমবাপ্পে (প্যারিস সেন্ট জার্মেই)
মেসির মতো এবার কিলিয়ান এমবাপ্পেও মৌসুমের শুরুর দিকে ইনজুরিতে পড়েছিলেন। তবে ফিরে আসার পর ফর্মে ফিরতে একদমই সময় নেননি, অক্টোবর মাসজুড়ে যে কয়টি তিনি ম্যাচ খেলেছেন, সবগুলো ম্যাচেই তিনি ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। নিঁসের বিপক্ষে ৮৩ মিনিটে বদলি হিসেবে নেমে করেছিলেন এক গোল। আর মার্শেইর বিপক্ষে ৭১ মিনিট খেলে করেছিলেন জোড়া গোল।
তার এমন রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের কারণে নেইমারের অভাব একদমই অনুভূত করছে না পিএসজি। অক্টোবর মাসে তার আরেক সতীর্থ অ্যানহেল ডি মারিয়াও অবশ্য দারুণ ছন্দে ছিলেন, কিন্তু ইনজুরি থেকে ফিরেই এমন রাজকীয় প্রত্যাবর্তন উপহার দেওয়ায় মারিয়াকে পিছনে ফেলেছেন এমবাপ্পে।
চ্যাম্পিয়নস লিগ: রাহিম স্টার্লিং (ম্যানচেস্টার সিটি)
পেপ গার্দিওলা আসার পর থেকেই রাহিম স্টার্লিং যেন অন্য এক অবতারে পরিণত হয়েছেন, এই মৌসুমেও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগে অসাধারণ ফর্মে আছেন এই ইংলিশ উইঙ্গার। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ঘরের মাঠে ডায়নামো জাগরেবের বিপক্ষে মুখোমুখি হয় ম্যানচেস্টার সিটি। হোম ম্যাচ সাথে দুর্বল প্রতিপক্ষ – তাই সব মিলিয়ে স্টার্লিংকে সেদিন বিশ্রামে রেখেছিলেন গার্দিওলা।
কিন্তু স্টার্লিংকে ছাড়া একাদশ নামিয়ে কিছুতেই যেন গোলের দেখা পাচ্ছিল না সিটিজেনরা। অবস্থা বেগতিক দেখে ৫৬ মিনিটে বদলি হিসেবে নামেন তিনি। মাঠে নামার মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই স্টার্লিং পেয়ে যান গোলের দেখা। আর ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে ফিল ফোডেনের গোলে অ্যাসিস্ট করে দলের জয় নিশ্চিত করেন।
চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের পরের ম্যাচে আটলান্টার মুখোমুখি হয় ম্যানসিটি। এ ম্যাচে ২৮ মিনিটে গোল খেয়ে বেশ বেকায়দায় পড়ে যায় সিটিজেনরা। তবে এবারও ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন স্টার্লিং, তার করা দারুণ এক অ্যাসিস্টে গোল করে দলকে সমতায় ফেরান সার্জিও আগুয়েরো। এর চার মিনিট পর পেনাল্টি আদায় করে দলকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও রাখেন বড় ভূমিকা।
তবে দ্বিতীয়ার্ধে রীতিমত তাণ্ডব চালিয়েছেন এই ইংলিশম্যান; ৫৮ থেকে ৬৯ – মাত্র এগারো মিনিটের মাঝে তিন গোল করে আটলান্টাকে একাই গুঁড়িয়ে দেন তিনি। দুই ম্যাচে মোট সাত গোলে অবদান রাখা স্টার্লিং যে অক্টোবরে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেরা খেলোয়াড়, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।
ইউরোপা লিগ: গ্যাব্রিয়েল মার্টিনেল্লি (আর্সেনাল)
এ মৌসুমের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে করিন্থিয়ানস থেকে ১৮ বছরের তরুণ ফরোয়ার্ডে গ্যাব্রিয়েল মার্টিনেল্লিকে দলে ভেড়ায় আর্সেনাল। বড় বড় সব দলবদলের মাঝে মার্টিনেল্লির এই আগমন সেভাবে নজরও কাড়েনি। মূলত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তাকে দলে নিয়েছিল ‘গানার’রা। কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে নিজের অভিষেক মৌসুমেই দুর্দান্ত পারফর্মেন্স উপহার দিচ্ছেন তিনি। ইএফএল কাপে নটিংহ্যাম ফরেস্টের বিপক্ষে জোড়া গোল করে প্রথম আলোচনায় আসেন তিনি।
এরপর সেই ভালো ফর্মের ধারা ইউরোপা লিগেও টেনে নিয়ে গেছেন মার্টিনেল্লি। অক্টোবরে ইউরোপা লিগে দুইটি ম্যাচ খেলেছে আর্সেনাল। স্ট্যান্ডার্ড লিয়েজের বিপক্ষে ম্যাচে মার্টিনেল্লি একাই দুই গোল ও এক অ্যাসিস্ট করে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেন। পরের ম্যাচে ভিটোরিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৮ মিনিটে গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল আর্সেনাল, সেখানেও ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। তার গোলেই ১-১ এ সমতায় ফিরে আসে আর্সেনাল, পরে গানাররাই ম্যাচটি জিতে নেয় ৩-২ গোলে। সব মিলিয়ে দুই ম্যাচে ৩ গোল ও ১ অ্যাসিস্টে অক্টোবরে ইউরোপা লিগের সেরা খেলোয়াড় গ্যাব্রিয়েল মার্টিনেল্লি।