বুন্দেসলিগায় ডর্টমুন্ড ১৭ ম্যাচে ৪২ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেই বড়দিনের ছুটি উপভোগ করতে গিয়েছে। তাদের আনন্দে বাড়তি উপলক্ষ অবশ্যই বায়ার্ন মিউনিখের থেকে ৬ পয়েন্টে এগিয়ে থাকা। ২০১৮-১৯ মৌসুম দুই দলই শুরু করেছে তাদের নতুন কোচ নিয়ে, নতুন কোচ নিকো কোভাচ বায়ার্নকে নিয়ে হিমশিম খেলেও ডর্টমুন্ডকে দুর্দান্ত সূচনা এনে দিয়েছেন কোচ লুইস ফাভ্রে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ডর্টমুন্ড তাদের প্রতিপক্ষের গোলবারের লক্ষ্যে করা শটের ২২% গোলে রূপান্তর করতে পেরেছে, যা লিগে সর্বোচ্চ। ডর্টমুন্ডের চেয়ে গোলে বেশি শট নিলেও, বায়ার্নের শট গোলে রূপান্তরের হার মাত্র ১১%! দেখা যাচ্ছে, ডর্টমুন্ডের অসাধারণ সূচনার স্তম্ভ বেশি গোলের সুযোগ তৈরি নয়, বরং শট গোলে রূপান্তরিত করার দারুণ সাফল্য। ক্লাবটির এই সাফল্যের অন্যতম পুরোধা স্প্যানিশ স্ট্রাইকার ‘সুপার সাব’ পাকো আলকাসার। মাত্র ১২ ম্যাচে ১২ গোল করে বুন্দেসলিগার সর্বোচ্চ স্কোরার এখন এই স্ট্রাইকার এবং এই ১২টি ম্যাচের মধ্যে তিনি ম্যাচ শুরু করেছেন মাত্র ৫টি! বাকি ৭ ম্যাচেই তিনি নেমেছেন বদলি খেলোয়াড় হিসেবে, গোল করেছেন এবং দলকে জিতিয়েছেনও।
মৌসুমে এখন পর্যন্ত শুধু ৫০২ মিনিট খেলেছেন পাকো এবং গোলে শট নিয়েছেন ২৪টি। অর্থাৎ, প্রায় প্রতি ৪২ মিনিটে গোল করেছেন একটি করে এবং তার শট গোলে রূপান্তরের হার ৫০%! ডর্টমুন্ডের নিখুঁত ফিনিশের অন্যতম চাবিকাঠিই এই স্ট্রাইকার। যেখানে বার্সেলোনায় দুই মৌসুম কাটানোর পর তার গোল সংখ্যা মাত্র ১৩টি, সেখানে নতুন লিগে প্রথম মৌসুমেই অল্প সময়ে পাকোর এত গোলের রহস্য কী! লুইস ফাভ্রের হাতে কী এমন জাদুকাঠি আছে যা বদলে দিয়েছেন তাকে?
জার্মান ক্লাব ডর্টমুন্ডের হয়ে পাকো আলকাসারের সাফল্যের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, চমৎকার সাধারণ কিছু কৌশল। যেসব কৌশলের নিখুঁত প্রয়োগ পাকো আলকাসারকে করে তুলেছে দুর্দান্ত একজন গোলস্কোরার এবং ফাভ্রের অন্যতম অস্ত্র। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে গোলবারের সামনে পাকো কতটা নিখুঁত। সেই সাথে এটাও পরিষ্কার যে- সঠিক সময়ে, সঠিক পজিশনে থাকার ব্যাপারেও তিনি মারাত্মক সফল। কারণ, তার ১২ গোলের ৭টিই করেছেন পেনাল্টি বক্সের মধ্যে। তাছাড়া, গোলের জন্য পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় স্পেস বা ক্ষেত্র তৈরি করে নেওয়াতেও তার জুড়ি নেই। কীভাবে পাকোকে গোল করার মতো সুবিধাজনক অবস্থানে তার সতীর্থরা খুঁজে পায় এবং পাকোই বা কীভাবে গোলের সুযোগ তৈরিতে ভূমিকা রাখেন?
শুরুতে মাঠে পাকো সাধারণত আক্রমণভাগে প্রতিপক্ষের দুই সেন্টার ব্যাকের মাঝামাঝি বা আশেপাশে অবস্থান করেন। এখন ডর্টমুন্ড যখন আক্রমণে যায়, স্বভাবতই প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের লক্ষ্য থাকে বল ও ধারাবাহিক পাস। আক্রমণের শুরুতেই সাধারণত পাকোর কাছে বল খুব একটা দেওয়া হয় না। পাকো বরং ডিফেন্ডারদের পাশ কাঁটিয়ে বলের বিপরীতে দৌড়ান, অর্থাৎ ‘অফ দ্য বল মুভমেন্ট’। বল আক্রমণভাগের ফাইনাল থার্ডের ভেতরে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায়, এই স্ট্রাইকার জায়গা করে নিয়েছেন এমন জায়গায়, যেখানে তিনি একদম আনমার্কড। খুব সহজ মনে হলেও আসলে এখানে সময়ের নিখুঁত হিসাব রয়েছে। ফাইনাল থার্ডে যখন তার কোনো সতীর্থ ফাইনাল পাস খেলেন, পাকো তখনও সেই পাস করা বল থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। এরপর কার্যত দৃশ্যমান হয় তার গতির কৌশল। সুযোগ বুঝে গতি বাড়িয়ে ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে তৈরি করে নেন প্রয়োজনীয় স্পেস এবং বল পাওয়ার পর ফিনিশিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত সময়।
পাকোর এই সাফল্যে তার সতীর্থদের সাথে দারুণ বোঝাপড়ার বড় অবদান রয়েছে। তাছাড়া, পাকোর অফ দ্য বল মুভমেন্ট, এককথায় অসাধারণ। ডিফেন্সিভ লাইনের ভেতরে পাকো যখন কড়া মার্কিংয়ে থাকেন, তখন নিজের কাছে আসা বল ৩ সেকেন্ডের বেশি খুব একটা রাখেন না তিনি। ৩ সেকেন্ডের মধ্যেই বল পাস করে তিনি তার অফ দ্য বল মুভমেন্টের উপর কাজ শুরু করেন। এখানে এই টার্মটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ডর্টমুন্ডে পাকোর কার্যকর ভূমিকায় এর বড় ভূমিকা রয়েছে। বল ছেড়ে দিয়ে দিয়ে তিনি আক্রমণভাগের ভেতরে যতক্ষণে জায়গা করে নিচ্ছেন, ততক্ষণে তার সতীর্থরা বল নিয়ে পৌঁছে যায় প্রতিপক্ষের বিপজ্জনক জায়গার আশেপাশে। সহজ কথায় বলতে গেলে, পাকো ও তার সতীর্থরা মিলে একটি ভ্রম তৈরি করেন; যেখানে চেষ্টা করা হয় এই স্ট্রাইকারের উপর থেকে ডিফেন্ডারদের নজর যতটা সম্ভব সরিয়ে নেওয়া। এক্ষেত্রে পাকোর ভূমিকা তার অফ দ্য বল মুভমেন্ট, আর সতীর্থদের ভূমিকা হচ্ছে- তার বিপরীতে ফাইনাল পাস দেওয়া এবং স্পেস তৈরিতে সহায়তা করা। কাজটি হয়ে গেলে, বাকি থাকে দুইয়ে দুইয়ে মিলে চার হওয়া শুধু। সময় ও জায়গা মতো বল পেয়ে পাকো তার কাজটি করেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে।
লুইস ফাভ্রের ডর্টমুন্ডে পাকো আলকাসার আক্রমণভাগে পেয়েছেন অসাধারণ কিছু প্রতিভার সাথে অভিজ্ঞতার দুর্দান্ত সমন্বয়। আক্রমণে পাকো দুই পাশে পাচ্ছেন সানচো, গুরেইরো বা লারসেনদের মতো তরুণ প্রতিভা, দুই উইঙ্গারের মাঝে খেলা ক্লাবটির সেরা তারকা রয়েস। আক্রমণে তাই ফাভ্রের কৌশল অনুযায়ী সতীর্থরাও পাকোর অফ দ্য বল মুভমেন্টের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ায় বেশ পটু। তারা ততক্ষণ পর্যন্ত বল পাকোর পায়ে দেন না, যতক্ষণ না তিনি গোল করার মতো ফাকা জায়গা বা উপযুক্ত অবস্থা তৈরি না করছেন। এজন্য বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায়, পাকো থাকাকালীন সময়ে আক্রমণে ফাইনাল পাস তার বিপরীতে দেওয়া হয়। তিনি ডানে থাকলে পাস দেওয়া হয় বামে এবং বামে থাকলে ডানে। পাকো যেমন অফ দ্য বলে উপযুক্ত জায়গার খুঁজে থাকেন, তেমনি তার সতীর্থরাও তাকে এই কাজের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার চেষ্টা করেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই মৌসুমে ডর্টমুন্ডের সেরা গোলদাতা হওয়ার পরেও আলকাসারকে নিয়মিত একাদশে দেখা যায় না কেন? আলকাসারের বিগত মৌসুমের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, তিনি যথেষ্ট ইনজুরিপ্রবণ। তাকে বদলি হিসেবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার ফাভ্রের কৌশলে এখন পর্যন্ত সফল। কারণ, ডর্টমুন্ডে এই মৌসুমে যোগ দিলেও, এর মধ্যেই ৩ বার পেশি সমস্যায় ভুগতে হয়েছে তাকে। তাছাড়া, বদলি হিসেবে তার যে পারফরম্যান্স, সেখানেও মনে হয় না ভক্ত কিংবা খোদ পাকোর কোনো অভিযোগ রয়েছে। স্প্যানিশ এই স্ট্রাইকার তার মোট গোলের অর্ধেকই করেছেন ম্যাচের শেষ ১০ মিনিটে! বোঝাই যাচ্ছে, ডর্টমুন্ডে তার প্রতিটি গোলের কতটা গুরুত্ব ছিল। লেভারকুজেনের বিপক্ষে তার জয়সূচক দুই গোল, অগসবুর্গের বিপক্ষে ম্যাচ বদলে দেওয়া হ্যাটট্রিক কিংবা বায়ার্নের বিপক্ষে জয়সূচক গোল; প্রথম মৌসুমেই ইদুনা পার্কে আলকাসারের দুর্দান্ত ভূমিকার উজ্জ্বল উদাহরণ।
ডর্টমুন্ডে পাকো আলকাসারের গোলের জাদু অবশ্যই পুরো মৌসুম জুড়ে দেখতে চাইবে ডর্টমুন্ড ভক্তরা। এমনকি এই মৌসুম পরেও, ইদুনা পার্কে এই স্ট্রাইকারের অসাধারণ অফ দ্য বল মুভমেন্টে বা গোলে দক্ষিণ স্ট্যান্ডে আনন্দের ঝড় বয়ে যাবে। বার্সা থেকে লোনে আসলেও, এই বছরই তা চূড়ান্ত রূপ দিয়ে কিনে নিয়েছে জার্মান ক্লাবটি। ফর্মে থাকা আলকাসারের সাথে ডর্টমুন্ডের সম্পর্ক যে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কে পরিণত হতে যাচ্ছে, এই ব্যাপারে আপাতত কোনো সন্দেহ নেই। যা-ই হোক, মৌসুমের শেষ পর্যন্ত এভাবে ফাভ্রে তার কৌশলে সফল হবেন কিংবা পাকোও একই হারে গোল পেতে থাকবেন, তা নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই।