বিশ্বকাপের আগেও বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্টের দুর্ভাবনায় ছিল তরুণ ক্রিকেটাররা। দলের পাঁচ জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটাররা যেভাবে সামনে থেকে পারফর্ম করে যাচ্ছেন, সেই অনুযায়ী তরুণদের পারফরম্যান্সের খাতাটা একেবারেই গোলমেলে। কিন্তু একাদশের হিসেব পার করতে গেলে আরও ছয়জন তো লাগবেই!
এ নিয়ে যখন নিত্যনতুন আলোচনা আর সমালোচনা, তখনই সামনে এলো আয়ারল্যান্ড সফর। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে আইরিশ কন্ডিশনে স্বাগতিক দল ও উইন্ডিজের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের চেয়ে ভালো কোনো প্রস্তুতি আর হতে পারে না। ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে সেই সিরিজকেই কাজে লাগালো তরুণরা। সপ্তমবারের মতো কোনো সিরিজ বা টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠে প্রথম কোনো শিরোপা জিতলো বাংলাদেশ। সেই জয়টা এবার কোনো জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার নয়, বরং কাঁধে দায়িত্বের জোয়াল তুলে নিয়েছিলেন সৌম্য সরকার, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতদের মতো তরুণরা। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দলের প্রধান কোচ স্টিভ রোডস তাই নির্ভার হচ্ছেন এই ভেবে যে, বাংলাদেশ এখন আর পাঁচ ‘বুড়ো’র অধীনে নেই!
প্রথমবারের মতো ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়ের পর ‘ফ্যাভ ফাইভ’ তথা মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এবং সাকিব আল হাসানের বাইরেও দলের ছেলেরা পারফর্ম করছে ভেবে আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন রোডস। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের পাশাপাশি তরুণরাও বুঝিয়ে দিয়েছে, দলের প্রয়োজনে তারা হাল ধরতে প্রস্তুত, যেকোনো সময়। এমন প্রস্তুতি ইংল্যান্ডেও বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে কাজে লাগবে বলে ভাবনা সাবেকদের।
পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক সৌম্য সরকার। ফাইনালে দলের প্রয়োজনে কম বলে বড় ইনিংস খেলে নিজের জাত চিনিয়েছেন আরও একবার। অন্যদিকে মিডল অর্ডারে মোসাদ্দেক সময়মতো হাফ সেঞ্চুরি করে দলকে জিতিয়েছেন। সবকিছু মিলেই উইন্ডিজকে ফাইনালে ৫ উইকেটের ব্যবধানে ম্যাচ হারিয়েছে বাংলাদেশ, কেটেছে ১০ বছরের অভিশাপ।
এমন অবস্থায় দলের হেড কোচ রোডস মনে করেন, সাইড স্ট্রেইনের ইনজুরিতে ফাইনাল ম্যাচে ড্রেসিংরুমে কাটানো সাকিবের অনুপস্থিতিতে তরুণদের পারফর্ম করা, ম্যাচ বের করে আনার সক্ষমতা প্রমাণ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন আর পাঁচজনের দল নেই।
‘আমরা ত্রিদেশীয় সিরিজে দারুণ কিছু করে দেখিয়েছি। বিশেষ করে দুই-তিনজন ক্রিকেটার এক কথায় স্পেশাল ইনিংস খেলেছে। এখন আপনি যদি মোসাদ্দেকের কথা চিন্তা করেন, ও কিন্তু এখন সব প্রতিপক্ষকে চাপের মধ্যে রাখতে পারবে। এটাই এই স্কোয়াডের শক্তি। সে ব্যর্থ হলেও ব্যাটিং পজিশনের দিক থেকে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর ভালো সুযোগ রয়েছে। আরও অনেক ভালো ক্রিকেটার খেলছে, তারা নিজেদের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করছে। এগুলো সবই বড় দলের বিপক্ষে জয় পেতে আত্মবিশ্বাস এনে দেয়।’
তিনি আরও বলেন,
‘বাংলাদেশ ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। আমরা নিজেদের যে অবস্থানে নিতে চাইছি, সেদিকেই এগোতে পারছি। এভাবে এগোতে থাকলে লোকে দলের বিগ ফাইভকে নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেবে।’
ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ওঠার ম্যাচে ভালো করা লিটন কুমার দাস ও আবু জায়েদ রাহীকে ফাইনাল ম্যাচে বাদ দেওয়াটাও দলের জন্য সাধারণ ব্যাপারে পরিণত করতে চান স্টিভ রোডস। এশিয়ার দলগুলোর কাছে সাধারণত আগের ম্যাচে ভালো করা ক্রিকেটার পরের ম্যচে জায়গা না পাওয়াটা একরকম ‘ট্যাবু’। তারপরও আয়ারল্যান্ডে সেই কাজ করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ টিম ম্যামেজমেন্ট। রোডস তো বটেই, অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাও এমন সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত রাখার আশা প্রকাশ করেছেন।
রোডস বলেন,
‘আগের ম্যাচে পাঁচ উইকেট পাওয়ার পরও আমরা ফাইনালে রাহীকে দলে রাখিনি। অবশ্যই এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। তার পরও এটা বুঝতে হবে, সেরা খেলোয়াড়দের নিয়েই স্কোয়াড তৈরি হয়েছে, স্কোয়াডের হয়েই সে ভালো করেছিল। তাদের সবাইকে এটা বুঝতে পারতে হবে যে, খেলাটা কোন নির্দিষ্ট একাদশ কিংবা ব্যক্তিগত নয়। এটা একটা দলের খেলা, যেখানে একাধিক ভালো ক্রিকেটারের জায়গা হয়েছে।’
সৌম্য সরকারের মতো দলের তরুণ ক্রিকেটারদের সেরা পারফরম্যান্সটা বের করে আনতে আরও সময় দেওয়া উচিত বলে মনে করেন রোডস। বিশেষ করে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে ডাবল সেঞ্চুরি করে সৌম্যর ফেরাটা যেমন ছিল, সেই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল আয়ারল্যান্ডেও। তরুণ সব ক্রিকেটারকে এভাবেই ফেরা দেখতে চান ইংলিশ কোচ। তিনি বলেন,
‘ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশনে সৌম্য সরকার যেভাবে সেঞ্চুরি আর ডাবল সেঞ্চুরি করেছিল, সেটা ছিল একরকম রেভল্যুশন। তবে তার আগে সমর্থকরা ছেলেটার অফ ফর্মকে পুঁজি করে অনেক বেশি বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে পার করিয়েছে। আর এগুলো যখন সৌম্য শুনেছে, তখন তার পারফরম্যান্সে আরও বেশি খারাপ প্রভাব পড়েছে। তবে এর মধ্যে দিয়েও ঘুরে দাঁড়ানোটা ছিল দেখার মতো। আমি আশা করি, তার অসাধারন কিছু ইনিংস দেখার পর এবার লোকে কিছুটা হলেও তার পিছু ছাড়বে। আমাদের উচিত তাকে সমর্থন দেওয়া, কাজটা সহজ করে দেওয়া। কিন্তু সবাই তার জন্য এটা করছে না।’
ত্রিদেশীয় সিরিজের সাফল্যের পর বিশ্বকাপে বর্তমান ব্যাটিং লাইনআপে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে চান না কোচ। জানিয়েই দিয়েছেন, বর্তমান লাইনআপ নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট। তবে অপেক্ষা সাকিবের ফেরার। বলেছেন,
‘আমি মনে করি, আমরা ত্রিদেশীয় সিরিজে অনেক ভালো খেলেছি। বিশেষ করে আমাদের ব্যাটিং সত্যিই মনে রাখার মতো ছিল।’
ব্যাটিং পজিশন নিয়ে তিনি আরও বলেন,
‘আমরা এমন ধারাবাহিকভাবেই ব্যাট করতে চাই, আর আপনারা দেখেছেন সাকিব ছিল না ফাইনাল ম্যাচে। তো অনেকগুলো পজিশন বদলানোর চেয়ে আমরা একটা ব্যাটিং পজিশন বদলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ আমরা চার নম্বরে মুশফিক, পাঁচ নম্বরে মিঠুন আর ছয়ে রিয়াদকে ধারাবাহিক পেতে চাইছি।’
তিনি আরও বলেন,
‘এভাবে সবকিছু করা গেলে দল সফল হবে। শুধু যার যার কাজটি ঠিকভাবে করা চায়।’
চান্দিকা হাতুরুসিংহের পদত্যাগের পর বহু নাটক শেষে বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পান স্টিভ রোডস। তার নিয়োগের আগে একাধিক সিরিজ কোনো কোচ ছাড়াই মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। যার একটি ছিল গেল বছরের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজ। সেই সিরিজেও মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচে হার মানে বাংলাদেশ।
মূলত বিশ্বকাপকে মাথায় রেখেই দক্ষিণ আফ্রিকান সাবেক ক্রিকেটার ও কোচ এবং ভারতের বিশ্বকাপজয়ী কোচ গ্যারি কারস্টেনের পরামর্শে স্টিভ রোডসকে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। ইংলিশ কোচ রোডসের রণপরিকল্পনায় ইংলিশ কন্ডিশনে সুবিধা করতে পারবে, এমন ভাবনা থেকেই প্রথমবারের মতো কোনো জাতীয় দলের দায়িত্ব পান রোডস। নিজের পরিকল্পনা নিয়ে ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন তিনি। এখন অপেক্ষা বিশ্বকাপের আসরে প্রত্যাশার মূল্যায়ন করার।