মাহমুদউল্লাহ, সম্মানটুকু নিয়ে বিদায় বলা যেত না?

নুরুল হাসান সোহানকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশের অধিনায়ক করা হয়েছে, সেটি আর ‘খবর’ নেই।

দেশের অধিকাংশ শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী, স্রেফ এই সিরিজ নয়, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অধিনায়কত্বের পাট চিরতরেই চুকে গেছে — এশিয়া কাপ থেকেই টি-টোয়েন্টি দলের হাল ধরবেন সাকিব আল হাসান। সে গুঞ্জন সত্য কি মিথ্যে, সেটা বোঝা যাবে কিছুদিন বাদেই। 

মাহমুদউল্লাহর চাকরিচ্যুতির খবর অবশ্য এবারই প্রথম নয়; ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভরাডুবির পরও গুঞ্জন উঠেছিল, মাহমুদউল্লাহকে আর রাখা হচ্ছে না।

সেবার অবশ্য টিকে গিয়েছিলেন। এবং যদিও বিসিবি কর্তাদের মুখ থেকে জোর করেও বের করা যাচ্ছে না যে সোহানকে অধিনায়কত্ব দেয়াটা আসলে মাহমুদউল্লাহ অধ্যায়ের ইতি টানার শুরু, এবার তার পালা সারা হবার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। এবং সেখান থেকেই আসলে প্রশ্নটা আসে, বিন্দুমাত্র সম্মান নিয়েও কি শেষটা করা যেত না, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ?

সম্মানের প্রশ্নটা আসছে এই কারণেই যে এত কিছুর পরও মাহমুদউল্লাহ বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটারদের একজন, এবং যেকোনো ফরম্যাট থেকেই তার বিদায়টা যথাযোগ্য হওয়াটা প্রয়োজন ছিল। 

নিজের শেষ টেস্টে খেলেছিলেন দারুণ ১৫০ রানের ইনিংস; Photo: JEKESAI NJIKIZANA/AFP via Getty Images

 

টেস্ট থেকে তার অবসরটা সে রকম হওয়ার সুযোগ ছিল। দারুণ এক ১৫০ রানের ইনিংস, সতীর্থরাও তাকে দিল গার্ড অফ অনার। কিন্তু ম্যাচ শেষ হতেই কোনো এক অজানা কারণে শুরু হলো লুকোছুপি; অবসর নিচ্ছেন বলেই গার্ড অফ অনার দেয়া হচ্ছে, এই সত্যটা আর কেউ মুখ ফুটে বলতেও চাইলেন না।

তাই সাদা জার্সি থেকে মাহমুদউল্লাহর অবসরটা হলো বিসিবির এক প্রেস রিলিজ থেকে, সেই টেস্টের প্রায় মাস পাঁচেক পরে। 

টি-টোয়েন্টি থেকে মাহমুদউল্লাহ অবসর নিচ্ছেন, এমন কোনো গুঞ্জন অবশ্য এখনও শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু নেয়া কি যেত না? কেন শুধু শুধু বছরখানেক ধরে নিজেকে অসম্মানিত হতে দেখতে হলো সোশ্যাল মিডিয়ায়, শেষের আগে কেন হতে হলো প্রায় পুরো সমর্থকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল?

টি-টোয়েন্টিতে মাহমুদউল্লাহর স্বর্ণালী সময়ের ব্যাপ্তি তিন বছরের মতো, ২০১৬ থেকে ২০১৮। সে সময়ে ফিনিশার রোলে প্রায় প্রতি ম্যাচেই দুর্দান্ত খেলছিলেন তিনি, দলও পাচ্ছিল সাফল্য।

এরপর টি-টোয়েন্টি দলের দায়িত্বটা পেয়েছিলেন টালমাটাল এক সময়ে, সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞায়। প্রথম ম্যাচেই হারিয়েছিলেন ভারতকে, তাতে দেখা গিয়েছিল আশার আলো।

কিন্তু তারপর থেকে ঘরের মাটিতে ব্যাটিংয়ের অযোগ্য পিচ বানিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডকে হারানো ছাড়া মাহমুদউল্লাহর অধিনায়ক হিসেবে অর্জন আর কিছুই নেই।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরই শেষটা বলে দিতে পারতেন; Photo: INDRANIL MUKHERJEE/AFP via Getty Images

 

এবং অধিনায়ক হিসেবে মাহমুদউল্লাহ পাস মার্কও তুলতে পারেননি সাম্প্রতিক সময়ে। লেফট-রাইট ম্যাচআপ বর্তমান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ট্যাকটিক্স, কিন্তু এটির প্রতি মাহমুদউল্লাহর যে অতিরিক্ত নির্ভরতা, তাতে দল ডুবেছে প্রায়ই। চিন্তা করুন, স্রেফ দু’জন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান আছেন বলে মাহমুদুল্লাহ দলের সেরা বোলার সাকিব আল হাসানকে ব্যবহার করাই বন্ধ করে দেন!

তার ওপর যোগ করুন ব্যাট হাতে তার সাম্প্রতিক দুর্দশা। ওয়ানডেতেও মাহমুদউল্লাহ আজকাল এত ধীরলয়ে খেলেন যে সেটা দলের জন্য কোনোভাবেই আর উপকারী হয়ে থাকে না। সেখানে টি-টোয়েন্টিতে তার ব্যাটিংটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আরও অরুচিকর, শেষ ফিফটি মেরেছেন সেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাপুয়া নিউ গিনির সঙ্গে।

ব্যাটে রান নেই, সেটি যত বড় সমস্যা, তার চেয়ে বড় সমস্যা মাহমুদউল্লাহ’র টেকনিকে। পা নড়ছে না, হেড পজিশনে গড়বড় হয়েই যাচ্ছে, ফলে শট খেলার সময় শরীরের যে ভারসাম্য, সেটি নষ্ট হয়ে তার ব্যাটিং হয়ে দাঁড়াচ্ছে কুৎসিত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডেতে স্টাম্পিং হওয়ার সময় যেভাবে পড়ে গেলেন, সেটি যে কারও চোখে ভয়ংকর রকম দৃষ্টিকটু।

বয়স ৩৭ পেরিয়েছে, এসময় রিফ্লেক্স কমবে, সেটিই স্বাভাবিক। অনেক ক্রিকেটার মানিয়ে নিয়ে এর চেয়েও বেশি বয়সে খেলেছেন। কিন্তু খালি চোখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, মাহমুদউল্লাহ সেটি পারছেন না, ব্যাটিং তো বটেই, প্রভাব পড়েছে ফিল্ডিংয়েও।

মাঠে এখন রীতিমতো লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে তাকে, সামান্য কঠিন ক্যাচও হাত ফসকে যাচ্ছে, গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে তো সামান্য দূর দিয়ে বল গেলেই আর ধরতে পারছেন না!

ব্যাটিংয়ে হুমড়ি খেয়ে-ই পড়ছেন আজকাল; Photo: RANDY BROOKS/AFP via Getty Images

 

এগুলোকে খালি চোখে নিন্দুকের সমালোচনা বলে বোধ হলেও, এই বয়সে এসে এগুলো হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে, মাহমুদউল্লাহ’র সেটি বোঝার কথা আরও আগে। কিন্তু দৃশ্যত এবং কার্যত, মাহমুদউল্লাহ হয় সেটি বুঝছেন না, অথবা বুঝেও করছেন না।

তার নামে বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ট্রোল ও মিমের ছড়াছড়ি, সেটি নিশ্চয়ই তিনিও দেখছেন। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেটির জবাবও চেয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, পাপুয়া নিউ গিনিকে হারিয়ে এরকম প্রশ্ন করাটা রীতিমতো হাস্যকর।

অথচ মাহমুদউল্লাহ চাইলেই সবটুকু সম্মান নিয়েই টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ইতি টেনে ফেলতে পারতেন। সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর বলতে পারতেন, এ-ই শেষ, আর নয়। তাতে তার ক্যারিয়ারের শেষভাগে একটা দুঃস্বপ্নস্বরূপ বিশ্বকাপ থাকলেও তার আগে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজ জয় থাকত (আপাতত বোকা পরিসংখ্যানটাই থাক, মিরপুরের পিচের কথা আড়ালে রেখে)।

কিন্তু তিনি সেটি করলেন না। এবং এখনও করছেন না, যখন তাকে দল থেকে প্রায় ‘বাদ’ই দেয়া হয়েছে। বিসিবি যতই বিশ্রামের কথা বলুক, বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিসিবি নিজে থেকে কাউকে বিশ্রাম দিয়েছে, এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কেবল দায় নয়, প্রায় অসম্ভব।

মাহমুদউল্লাহকে এক সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রিস্টোফারের নোলানের ব্যাটম্যানের সঙ্গে তুলনা করা হতো, ডাকা হতো ‘দ্য ডার্ক নাইট’।

মাহমুদউল্লাহর বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি বরং বেছে নিয়েছেন হার্ভি ডেন্টের পথ; এবং সেই সংলাপ, ‘আইদার ইউ ডাই আ হিরো, অর লিভ লং এনাফ টু সি ইয়োরসেলফ বিকাম দ্য ভিলেন’। মাহমুদউল্লাহ নিজেকে ভিলেন হয়ে যেতে দেখেছেন; অথচ সেটি হবার কথা ছিল না।

পেসার তো বটেই, স্পিনারের বলেও পা যেন নড়ছেই না তার; Photo: CHRISTIAAN KOTZE/AFP via Getty Images

 

এমনকি এখনও মাহমুদউল্লাহ বেন স্টোকসের উদাহরণটা মানতে পারেন। ওয়ানডে থেকে মাত্র ৩১ বছর বয়সেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক, কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন নিজের সবটুকু দেবার বিষয়টি। নিজের শেষ ওয়ানডের আগে স্টোকস বলেছিলেন, 

“ক্রিকেট সূচি এবং আমাদের থেকে যা আশা করা হয়, সেটি আমার মতে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যে-ই ইংল্যান্ডের জার্সি পরুক, তার থেকে এটির শতভাগ প্রাপ্য। এবং আমার এটা ভালো লাগেনি যে আমি যেভাবে চাচ্ছিলাম, সেভাবে অবদান রাখতে পারছিলাম না। আমি এখন টেস্ট দলের অধিনায়ক, এবং যে পরিমাণ ক্রিকেট সামনে আছে, আমার নিজের শরীরের ওপর খেয়াল রাখতে হবে।” 

মাহমুদউল্লাহও এই পথ ধরে এগুতে পারতেন। আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, যেটি নিয়ে ২০২১-এর শুরু থেকেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে এসেছেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল ও টিম ম্যানেজমেন্ট। সেটি যেহেতু তিনি খেলবেনই, সেহেতু অন্য ফরম্যাট ছেড়ে দিয়ে নিজেকে ৫০ ওভারের ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত করতে পারতেন তিনি।

তবে তিনি সেটি করেননি, তিনি পথ ধরেছেন মাশরাফি বিন মর্তুজার। মাশরাফি নিঃসন্দেহেই বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার, কিন্তু তিনিও নিজের অবসর নিয়ে কথোপকথনটা অযথা টেনেছেন ২০২০ পর্যন্ত। এবং তিনি কেবল অধিনায়কত্বই ছেড়েছেন, এখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেননি। তাতে দল থেকে বাদ পড়েই বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়কত্বের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ‘ফুলস্টপ’ পড়েছে, বরণডালা নিয়ে নয়।

মাশরাফির বিদায়টাও সুখকর ছিল না; Photo: STRINGER/AFP via Getty Images

 

মাহমুদউল্লাহর ক্ষেত্রেও সেটিই হতে যাচ্ছে। টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলার যে সুবর্ণ সুযোগগুলো পেয়েছেন, একটিও কাজে লাগাননি, বরঞ্চ বিদায়ক্ষণটাকে তিক্ত করছেন একটি একটি করে মুহূর্ত বাড়িয়ে।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, এটা বোধহয় না করলেও পারতেন। শেষটা নায়ক হিসেবে হয়তো শেষ করা হতো না, তবে খলনায়কও হতে হতো না তবে।

An article on how Mahmudullah Riyad has delayed his retirement, which has done him no good.

Featured Photo:  Getty Images

Related Articles

Exit mobile version