একটা সময় কোচিংয়ে নিয়মিত ক্লাস নিতাম। সেখানেই শিখেছিলাম, শুরুতেই যদি দর্শকদের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে চিন্তার উদ্রেক করা যায়, তবে শ্রোতারা আরও একটু বেশি সম্পৃক্ত হতে পারেন বক্তার সঙ্গে। সেই কথাকেই মোক্ষবাণী ধরে নিয়ে শুরুটা করা যাক একটা নিরীহ এবং ছোট্ট প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আসলে কেমন ক্রিকেটার?
তাঁর সম্পর্কে এক একজনের একেক রকম ধারণা। কেউ ভাবেন তিনি দুর্দান্ত, কেউ আবার ভাবেন তিনি ‘মোটামুটি চলে’ টাইপ, কেউ কেউ আবার সরাসরি বাতিলের খাতায়ও ফেলে দিতে ভুল করেন না। কখনও উঠেছেন ক্যারিয়ারের শীর্ষে, আবার দুই ম্যাচ শেষেই তাঁকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে তলানিতে। ক্যারিয়ারের গ্রাফটা ওঠানামা করেছে এত দ্রুত যে, আকাশ আর মাটির ফারাকটা সেভাবে বোধহয় বুঝে ওঠারই সুযোগ পাননি। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা কখনওই ছিলো না তাঁর, ‘গ্ল্যামার’টাও সেভাবে তাঁর মধ্যে খুঁজে পাননি অনেকেই। তবে সেগুলোকে আদৌ পাত্তা না দিয়ে রিয়াদ এগিয়ে গেছেন নিজের মতো করে, পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে। কিন্তু তবুও প্রশ্ন ওঠে, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কি সত্যিই ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়ার মতো কিছু করতে পেরেছেন আদৌ?
৩৩ টেস্টে একটিমাত্র সেঞ্চুরি, ত্রিশ গড়ে মোট সংগ্রহ মাত্র ১৮০৯ রান। অন্যদিকে ১৪৫ ওয়ানডেতে ৩৪.৬৭ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৩১৫৫ রান, সেঞ্চুরি মাত্র তিনটি। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে যাওয়ার মতো কোনও আলামত খুঁজে পাওয়া যাবে না, মনে হবে নেহায়েত সাধারণ একজন ক্রিকেটার। কিন্তু দলের পিঠ বাঁচানো ইনিংস যে আজ অবধি কতবার খেলেছেন, কতবার যে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখ থেকে টেনে তুলেছেন দলকে, সে হিসেব এই মূর্খ পরিসংখ্যানের খাতাটা বোঝাতে পারে না।
রিয়াদ বরাবরই দারুণ একজন টিমম্যান, দলের যেকোনো প্রয়োজনের মুহূর্তে কোনো না কোনো ভূমিকাতে তিনি হাজির হতেও ভুল করেন না। তাঁর এমনই গুণ, দল বিপর্যয়ে পড়লে তিনি দৃঢ় হাতে সামাল দেন, আবার রানরেটে পিছিয়ে পড়লে খেলতে জানেন ‘টর্নেডো’ ইনিংস, আবার দলের প্রয়োজনে পার্টটাইমার হিসেবে বল হাতে তুলে নিয়ে এনে দিতে পারেন কাঙ্ক্ষিত ব্রেকথ্রু। এমনকি উইকেটরক্ষণের প্রয়োজনে প্রথমবারের মতো উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়েই করে ফেলেন টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে স্ট্যাম্পিংগুলোর মধ্যে একটা! তবে বাংলাদেশ দলে রিয়াদের ভূমিকাটা বোঝাতে শুধু এই অনুচ্ছেদটুকু বোধহয় একেবারেই অপ্রতুল ; এতটাই অপ্রতুল যে তাঁকে ছাড়া এখন ড্রেসিংরুমের কথা চিন্তা করাই শক্ত হয়ে উঠেছে!
তাহলে রিয়াদকে বুঝতে পারার জন্য কী করা উচিত? উত্তরটা খুব সহজ, ম্যাচ পরিস্থিতি দেখা। তবে পরিসংখ্যান দিয়ে সেটা বোঝা বড় শক্ত, এর জন্য প্রয়োজন নিয়মিত বাংলাদেশ ক্রিকেটকে অনুসরণ করা।
বরাবরই অন্যদের থেকে একদম আলাদা তিনি। এই যেমন, সবাই তাঁর ‘ফার্স্ট নেইম’ বা ‘লাস্ট নেইম’ দিয়ে পরিচিত হলেও তিনি পরিচিত হয়েছেন নিজের ‘মিডল নেইম’ দিয়ে। মোহাম্মদ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, সকলে তাঁকে মাহমুদউল্লাহ হিসেবেই চেনেন। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, লোকসমাগমের সামনে বোধহয় কিছুটা ইতঃস্ততবোধ করেন রিয়াদ। হয়তো নিজের মতো করে থাকতে চান, হয়তো একদমই চুপচাপ– শান্ত প্রকৃতির একজন মানুষ তিনি। আবার যখন ড্রেসিংরুমে ফেরেন, খোলসটা একদম ঝেড়ে ফেলে হয়ে যান দারুণ আড্ডাবাজ এবং উৎফুল্ল একজন মানুষ। ‘গুডবয়’ ইমেজ ঝেড়ে ফেলে তিনি হয়ে যান সকলের মধ্যমণি, ‘গ্যাংনাম স্টাইল’ নাচে সবার সেরা তিনি, আনন্দে-কৌতুকে পুরো ড্রেসিংরুম মাতিয়ে রাখতে তাঁর জুড়ি নেই। অথচ ড্রেসিংরুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেই গুটিয়ে যান হঠাৎ, শরীরী ভঙ্গিই বুঝিয়ে দেয় সংবাদ সম্মেলনেও সেভাবে অভ্যস্ত নন। লাইমলাইটে আসাটা তাই কখনওই তেমন একটা হয়ে ওঠেনি তাঁর।
তবু কখনও কখনও অন্যান্য খেলোয়াড়দের ভিড়ে নিজ গুণে ভাস্বর হয়ে ওঠেন তিনি। বিশেষ করে তাঁকে যখন দলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তিনি সর্বস্ব উজাড় করে দিতে জানেন। মেধাবী কিংবা সর্বজয়ী কোনো রূপ নয়, বরং শ্রমিকরূপটাই বেছে নিয়েছেন বরাবরই। দল তাঁকে যখন যেখানে চেয়েছে, সেখানেই নির্দ্বিধায় খেলেছেন, পারফর্মও করেছেন। তবু তাঁকে নিয়ে প্রশ্নের সীমা নেই, পান থেকে চুন খসলেই তাঁর মুণ্ডুপাত চলতে থাকে। তামিম ইকবাল কিংবা এনামুল হকরা সমালোচনায় তিতিবিরক্ত হয়ে নিজের প্রাপ্য সম্মানটা দাবি করলেও তিনি কোনোদিন করেননি, বরং বেছে নিয়েছেন নেপথ্য নায়কের পথটাকেই। হয়ে উঠেছেন এক যোগ্য সৈনিক, যিনি তুমুল বিপর্যয়ের মুখেও পিছু হটতে জানেন না। শরীরী ভাষায় সেভাবে আক্রমণাত্মকতা না থাকলেও মানসিকভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন বীরদর্পে যুদ্ধ করতে জানা এক সৈনিক হিসেবে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় দলের নিয়মিত কিছু সদস্য ‘ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লীগ (আইসিএল)’-এ যোগ দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ দল থেকে তাঁদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়, ফলে আকস্মিকভাবে শূন্যতা তৈরি হয় বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারে। মাত্রই দলে এসেছেন রিয়াদ, সেভাবে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাননি তখনও। হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, দলে সিনিয়রমোস্ট খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনি একজন। তবু দলে নিজের অবস্থানটা সম্পর্কে সেভাবে ধারণা নেই তাঁর, দলে তাঁর ভূমিকাটা নিয়েও নিশ্চিত নন। সেরা এগারোতে থাকছেন বটে, তবে তাঁকে ব্যবহার করা হচ্ছে স্লগ ওভার স্পেশালিস্ট হিসেবে! মারকাটারি ব্যাটিংয়ে তখনও অনভ্যস্ত লিকলিকে স্বাস্থ্যের অধিকারী রিয়াদ বুঝলেন, দলে টিকে থাকতে হলে মানিয়ে নিতে হবে এমন পরিস্থিতির সঙ্গে। শুরু হলো নিজের অস্তিত্বের লড়াই, নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করলেন তখন থেকেই।
প্রথমবারের মতো নিজেকে মেলে ধরেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই অ্যাওয়ে টেস্ট সিরিজে। বলাই বাহুল্য, সেই সিরিজেই তাঁর টেস্ট অভিষেক ; আর অভিষেকেই ইনিংসে পাঁচ উইকেটসহ ম্যাচে মোট আট উইকেট নিয়ে জগতকে শুনিয়েছিলেন তাঁর আগমনধ্বনি। ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে অন্তর্ভুক্তি থাকলেও ‘বোলার’ মাহমুদউল্লাহ যেভাবে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক ফ্লয়েড রেইফারকে নিজের ‘বানি’ বানিয়ে ছেড়েছিলেন, সেটা এখন পর্যন্ত ভোলার কথা নয় কারো। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাঁর ক্যারিয়ারে বরাবরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেটা ইতিবাচক দিক থেকেই হোক, কিংবা নেতিবাচক। এই সিরিজটা দারুণ কেটেছিলো তাঁর, বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো আরেকজন পিওর অলরাউন্ডারের। সে সম্ভাবনার কিছুমাত্র পূরণ করে উঠতে পারেননি রিয়াদ, তবে সেটা অন্য আলোচনা।
তবু যেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সেভাবে চোখে পড়ছেন না সেভাবে, অন্যদের মতো মারকাটারি ব্যাটিং করতে না পারলেও স্লগ ওভারেই নামতে হচ্ছে প্রায় প্রতি ম্যাচেই, তাই সিঙ্গেলস-ডাবলসে টুকটাক নিয়মিত রান করলেও সেভাবে রানের চাকা ঘুরাতে পারছেন না। ফলে জনরোষের মুখে পড়তে হচ্ছে বারবারই, অন্যদিকে নির্বাচকেরাও হয়ে উঠছেন অস্থির। প্রশ্ন উঠে গেলো দলে তাঁর ভূমিকা নিয়ে, কতটা পারফর্ম করতে পারছেন রিয়াদ? তাঁর নিজের কাছেও সেটার সঠিক জবাব নেই, দলে নিজের ভূমিকাটাই তো বুঝে উঠতে পারছেন না! নিজের সঙ্গে যুঝতে যুঝতেই হয়তো কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, ফলে বাজে ফর্মের কারণে বাদ পড়লেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজে।
তবে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না, পরের সিরিজেই আবার ফিরলেন দলে। কিন্তু দলে ফিরলেও সেভাবে পারফর্ম করতে পারছিলেন না, সিঙ্গেল ডিজিটে আউট হয়ে যাচ্ছিলেন। কোনও ইনিংসে টুকটাক রান করলেও সাত নম্বরে নেমে একশ’র কম স্ট্রাইকরেট নিয়ে আউট হয়ে যাওয়াটাকে মোটেই সুনজরে দেখছিলেন না কেউ। এমন অবস্থায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিলো তাঁর, অন্তত একটা দারুণ পারফরম্যান্সই শুধু পারতো তাঁকে টিকিয়ে রাখতে। আর তাঁকে বলা হতো বাংলাদেশের সবচেয়ে স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান, সেখানে তাঁকে নিয়মিত সাত নম্বরে খেলানোটাকেও নেহায়েত অপচয় ছাড়া অন্য কিছু বলা চলে না।
অবশেষে ব্রেকটা পেলেন সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই, ২০১২ সালের হোম সিরিজে। সিরিজের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ম্যাচে যথাক্রমে ৫২, ৫৬ এবং ৪৮ রানের অনবদ্য তিনটা ইনিংস খেললেন সাত নম্বরে ব্যাটিং করতে নেমে। তিনটি ম্যাচেই বাংলাদেশ দারুণ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়েছিলো, আর প্রচন্ড চাপের মুখে এমন তিনটা ইনিংস দিয়েই প্রথমবারের মতো বুঝিয়ে দেন, তিনি হারিয়ে যেতে আসেননি। এই দারুণ পারফরম্যান্সের ফলাফলটাও পান হাতেনাতে, পরের সিরিজে প্রোমোশন পান পাঁচ নম্বরে।
সেই থেকে শুরু তাঁর ক্যারিয়ারের নতুন মোড়, এরপর দিন যত গেছে, তিনি নিজেকে আরও শাণিত করে তুলেছেন। দলের জন্য ওয়ানডাউন পজিশনে ব্যাটিং করেছেন, চার নম্বরেও ব্যাটিং করেছেন, এমনকি দলের প্রয়োজনে লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিং করতেও পিছপা হননি কখনও। দল যখনই যেখানে তাঁর সার্ভিস চেয়েছে, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। বিপর্যয়ের মুখে একা দাঁড়িয়ে দলের ভারটাকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে দলকে বিপদমুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তবু কেন যেন প্রথম দিকের ওই নড়বড়ে পারফরম্যান্সটাই মানুষ মনে রাখতে চেয়েছে, টানা দুইটা ম্যাচে বাজে পারফর্ম করলেও একাদশে তাঁর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। অথচ তাঁর ম্যাচ-বাই-ম্যাচ পারফরম্যান্স ডিটেইলস খুঁজলে দেখা যাবে, টানা তিন ম্যাচ সিঙ্গেল ডিজিট রান করেছেন গোটা ক্যারিয়ারে মাত্র তিনবার! ধারাবাহিকতার দিক থেকে হয়তো কিছুটা প্রশ্ন তবু উঠতে পারে, কিন্তু দলের দুঃসময়ে সবচেয়ে পরীক্ষিত সেনানীকে এভাবে বারবার ছুঁড়ে ফেলাটাও কি সমীচীন ছিলো আদৌ?
যা হোক, এরপর আবার ক্যারিয়ারে ছন্দপতন ; ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট মাস অবধি তাঁর ব্যাটে রানের দেখা নেই। এই সময়কালে তাঁর ফিফটি মাত্র একটি, অন্যদিকে টেস্টেও ২০১৩ সালের মার্চ মাসের পর টানা এক বছরে কোনও ফিফটিই করতে পারেননি। ফলে দলে তাঁর জায়গা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠলোই, উপরন্তু তৎকালীন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ভায়রা হওয়ার কারণে নানারকম টিপ্পনীও শুনতে হলো তাঁকে। বরাবরই মিডিয়ার সামনে অপ্রতিভ মাহমুদউল্লাহ তখনও সামনে বেরিয়ে আসেননি, বরং আরও কিছুটা যেন খোলসের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলেন।
এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে ধুঁকে ধুঁকে শেষ অবধি হারিয়েই গিয়েছেন, এমন নজিরও কম নেই। কিন্তু সেই দলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ নেই, বরং সেটাকেই নিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। আর দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের মুখে তিনি যে কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারেন, সেটা দেখানোর জন্য বেছে নিলেন ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরটিকেই! তবে আগের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে কিছুটা না বললে মাহমুদউল্লাহর প্রতি অবিচারই করা হবে।
দীর্ঘ আড়াই বছরের ব্যাড প্যাচ কাটালেন এমন সময়ে, যখন বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিলো সবচেয়ে বেশি। সেন্ট ভিনসেন্ট টেস্ট ; বাংলাদেশ নিশ্চিত ইনিংস পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে ধুঁকছে, ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে মাত্র ১০৭ রানেই। ইনিংস পরাজয় এড়াতে তখনও প্রয়োজন প্রায় দুইশ’ রানের কাছাকাছি, অন্যদিকে সুলিমান বেন– কেমার রোচদের দুর্দান্ত বোলিং প্রদর্শনীতে জবুথবু হয়ে আছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা। ঠিক এমন সময়ে মাঠে নেমেই পাল্টা আক্রমণ শুরু করলেন মাহমুদউল্লাহ-মুশফিক, গড়লেন ১৩০ রানের অনবদ্য একটি জুটি, মাহমুদউল্লাহ নিজে খেললেন ৬৬ রানের একটি দারুণ ইনিংস। সুসময় বুঝি মাত্রই উঁকি দিলো, এরপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও খুব একটা খারাপ পারফরম্যান্স করেননি। তবে সেরা কৃতিত্বটা দেখালেন বিশ্বকাপেই, নিজের জাত চেনালেন গোটা বিশ্বের সামনে।
২০১৫ বিশ্বকাপটা বাংলাদেশ শুরু করেছিলো একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস দিয়ে, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশী কোনও ব্যাটসম্যান বিশ্বকাপের আসরে সেঞ্চুরি করতে পারেননি। এটা নিয়ে অধিনায়ক-কোচসহ অনেকেই আফসোস এবং আশার বাণী শুনিয়ে গেছেন, তাই সবাই মিলেই এবার বুক বেঁধেছিলেন অন্তত একটা সেঞ্চুরির আশায়। কিন্তু সেটা যে আসবে মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকেই, সেটা ভাবতে পেরেছিলেন কতজন?
তিনি অবশ্য ভেবেছিলেন, আর নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সবচেয়ে বড় মঞ্চ হিসেবে খুঁজে নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিকে। বিশ্বকাপে টিকে থাকতে হলে সেই ম্যাচে জিততেই হবে বাংলাদেশকে, এমন সমীকরণ মাথায় রেখেই খেলতে নেমেছিলো দল। তবে শুরুটা একদমই ভালো হয়নি সেদিন; যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন মাহমুদউল্লাহ, বাংলাদেশ তখন ধুঁকছে। আট রানেই পড়ে গেছে দুটো গুরুত্বপূর্ণ উইকেট, ক্রিজে আছেন সদ্যই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসা অনভিজ্ঞ সৌম্য সরকার। জেমস অ্যান্ডারসন-স্টুয়ার্ট ব্রডরা রীতিমতো সাপের মতো সুইং করাচ্ছিলেন, সাথে ছিলো ইনিংস গড়ার পর্বতপ্রমাণ চাপ। কি অসাধারণভাবে সেই চাপ উড়িয়ে দিয়ে শাসন করলেন ইংলিশ বোলারদেরকে! মুশফিককে সঙ্গী করে গড়লেন ১৪১ রানের জুটি। ইনিংসের ৪৬তম ওভারে যখন ক্রিস ওকসের দারুণ ফিল্ডিং প্রদর্শনীতে রান আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছেন, তাঁর নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ১০৩ রান! বিশ্বকাপ আসরে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিটা এলো তাঁরই হাত ধরে।
পরের ম্যাচেই আবারও গড়লেন ইতিহাস, এবার বাংলাদেশের প্রথম (এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র) ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়লেন। শুধু সেটাই নয়, গোটা আসরে সেরা দশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। চার নম্বরে নেমে তাঁর এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর সবাই ভাবতে শুরু করলো, যাক, হয়তো এবার তিনি দলে নিজের জায়গাটা খুঁজে পেলেন!
কিন্তু তিনি যে সেই সৌভাগ্য করে আসেননি! টি-টোয়েন্টিতে বরাবরই তাঁর অন্তর্ভুক্তি প্রশ্ন জাগাতো, দলে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে। সাব্বির রহমানকে আকস্মিকভাবে তিন নম্বরে উঠিয়ে আনার কারণে সাকিবকে মিডল অর্ডারে জায়গা ছেড়ে দিতে তাঁকে সচরাচর নামানো হয় সাত নম্বরে, বোলিংয়েও তাঁর চার ওভারের দরকার খুব একটা পড়ে না। ফলে তাঁর যোগ্যতার সমান সম্মানটা তাঁকে কখনও সেভাবে দেওয়া হয়নি, বরং তাঁকে হঠাৎ দিয়ে দেওয়া হয় ‘অনভ্যস্ত’ সেই ব্যাটিং পজিশনে দলের ফিনিশার রোলটা। আর অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে গোটা বিশ্ব লক্ষ্য করে, মাহমুদউল্লাহ সেই পজিশনেও নিজেকে খুব অসাধারণভাবে মানিয়ে নিয়েছেন!
সেটাই বুঝি কাল হলো তাঁর জন্য। টি-টোয়েন্টির সাফল্য দেখে নির্বাচকেরা আরও একটু উৎফুল্ল হয়ে ওয়ানডেতেও তাঁকে নামিয়ে দিলেন ডাউন অর্ডারে, আর তিনিও দলের প্রয়োজনমতো যথারীতি টুকটাক করে রান করে যেতে থাকলেন। ফলে তাঁকে নির্বাচকেরা ভাবতে শুরু করলেন ডাউন অর্ডারের জন্যই, অন্যদিকে তিন নম্বরে সাব্বির রহমানের উপর্যুপরি ব্যর্থতার পরও সেই পজিশনে তাঁর কথা বিবেচনাতেই আনা হলো না!
অথচ বরাবরই ভাবা হয়ে এসেছে, মাহমুদউল্লাহ দারুণ ক্লিন হিট করতে পারলেও খুব বড় স্লগার কিংবা হার্ডহিটার হিসেবে কল্পনা করাটা কিছুটা কষ্টসাধ্যই বটে। খালেদ মাহমুদ সুজন অনেকদিন ধরেই তাঁকে দেখেছেন খুব কাছে থেকে। তাঁর মতে,
“ছোটবেলা থেকেই রিয়াদ খুব ক্লিন হিটার ছিলো বলের। তাঁকে আমি সবসময়ই বলে এসেছি টপ অর্ডারে ব্যাটিং করতে। সে আসলে সাকিব বা মুশফিকের মতো এসেই প্রথম বলে চার মেরে দেওয়া ম্যাটেরিয়াল নয় ঠিক।”
তবে কে শোনে কার কথা? মাহমুদউল্লাহ এখনও ব্যাটিং করেই চলেছেন ডাউন অর্ডারে, আর টিম ম্যানেজমেন্টের ভাষ্য অনুসারে অদূর ভবিষ্যতেও তাঁকে টপ অর্ডারের জন্য ভাবা হচ্ছে না। তবে সম্প্রতি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সাব্বিরের নিদারুণ ব্যর্থতা এবং বড় মঞ্চে আরও একবার মাহমুদউল্লাহর জ্বলে ওঠার ফলে পুরোনো আলোচনাটাই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সাকিবের সঙ্গে জুটি গড়ে প্রিয় প্রতিপক্ষ নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে করা সর্বশেষ সেঞ্চুরিটি ওয়ানডে ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা একটি ইনিংস, আর এই ইনিংসের পর গোটা বিশ্বের প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, “মাহমুদউল্লাহ কেন সাত নম্বরে?” অবশ্য সেটাও তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়, এর আগে সুনীল গাভাস্কারের মতো কিংবদন্তী ক্রিকেটার বলেছিলেন, “সম্ভবত এই মুহুর্তে বিশ্বের সেরা সাত নম্বর ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহই!”
কি ‘পরম সৌভাগ্য’ আমাদের, অভিষেকের দশ বছর পার করে এসেও মাহমুদউল্লাহকে সেই একই কথা শুনে যেতে হচ্ছে!
তাঁকে আমরা কখনও সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি, তাঁর প্রতিভার যোগ্য স্বীকৃতি মেলেনি কখনোই। উপরন্তু পান থেকে চুন খসতেই তাঁকে বিষোদ্গার করতে আমাদের বিন্দুমাত্র বাধেনি কখনও, বরাবরই মিডিয়া এড়িয়ে চলতে চাওয়া মানুষটি যে সবচেয়ে সহজ টার্গেট! তাঁর বিশাল বড় একটি ফ্যানবেইজ নেই, গ্ল্যামারাস কোনও অ্যাপিয়ারেন্স নেই, চেহারার মধ্যে একটা নিষ্পাপ গোবেচারা ভাব, আর ব্যবহারেও মাটির গন্ধ ; এই মানুষটাকে সমালোচনার সহজ টার্গেট না বানানোর কোনও প্রশ্নই তো ওঠে না!
তবু হাল ছাড়েননি রিয়াদ, চোয়ালবদ্ধ সংকল্পে লড়ে গেছেন দাঁতে দাঁত চেপে। যখনই দলের প্রয়োজন হয়েছে, অবতীর্ণ হয়েছেন মূল পুরোধা হিসেবে। ২ রানের বেদনায় পোড়া সেই এশিয়া কাপের ফাইনাল, কিংবা ৩ বলে ২ রানের হতাশায় দগ্ধ হওয়া কিছু মুহূর্ত এসেছে ঠিক, তবে তার চেয়ে ঢের বেশি ম্যাচ একা হাতে তুলে এনেছেন তিনি। হয়তো অনেক ম্যাচ জেতাতে পারেননি, ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবেও তাঁকে সেভাবে চোখে পড়েনি। বরাবরই যে তাঁর দলে ভূমিকাটা ছিলো ‘সাইলেন্ট গার্ডিয়ান’ হিসেবে, যিনি সকল বিপর্যয়ের মুখে হয়ে উঠবেন দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব! আর তাই খুবই সাধারণ একটি পরিসংখ্যান নিয়েও বাংলাদেশের ইতিহাসে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ হয়ে উঠেছেন অনন্যসাধারণ, আমাদের ডার্ক নাইট! আর তাঁর মতো একজন প্রতিভাকে এভাবে ব্যবহার করতে না জানার ব্যর্থতায় পরিপূর্ণ বিকশিত হতে না দিতে পারাতেই কি আমাদের দুর্ভাগ্যটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না?
Featured Photo: Stu Forster/Getty Images