টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে মাত্র দুজন বোলার এক ইনিংসে দশ উইকেট শিকারের কীর্তি অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন ইংল্যান্ডের অফস্পিনার জিম লেকার এবং আরেকজন ভারতের লেগ স্পিনার অনিল কুম্বলে। কিন্তু এক ম্যাচে প্রতিপক্ষের ১১ জন ব্যাটসম্যানকে আউট করার ঘটনা ঘটেছে ছয়বার। ছয়জন ভিন্ন বোলার এই গৌরব অর্জন করেছেন। এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়া বোলারদের মধ্যে অনিল কুম্বলে ঐ ম্যাচে প্রতিপক্ষের ১১ জন ব্যাটসম্যানকে আউট করতে পারেননি। কারণ পাকিস্তানের এগারো নাম্বার ব্যাটসম্যান ওয়াকার ইউনিস দুই ইনিংসেই অপরাজিত ছিলেন।
এক টেস্ট ম্যাচে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন জিম লেকার। তিনি ১৯৫৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যানচেস্টার টেস্টে একাই ১৯ উইকেট শিকার করেন। টেস্ট ক্রিকেটে এক ম্যাচে একজন বোলার কমপক্ষে ১৪ উইকেট শিকার করেছেন। এমন ঘটনা ঘটেছে ২৪ বার, এদের মধ্যে শুধুমাত্র জিম লেকার ছাড়া আর কেউই ঐ ম্যাচে প্রতিপক্ষের ১১ জন ব্যাটসম্যানকে আউট করতে পারেননি। এক ম্যাচে প্রতিপক্ষের ১১ জন ব্যাটসম্যানকে আউট করা বোলারদের ছয়জনের মধ্যে পাঁচজন ঐ ম্যাচে ১৩ উইকেট কিংবা ১২ উইকেট শিকার করেছেন।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক ম্যাচে প্রতিপক্ষে ১১ জন ব্যাটসম্যানকে প্যাভিলিয়নের পথ দেখানো বোলারদের সম্পর্কে চলুন জেনে আসা যাক।
জিম লেকার
প্রথম বোলার হিসেবে প্রতিপক্ষের ১১ জন ব্যাটসম্যানকে আউট করেছেন ইংল্যান্ডের অফস্পিনার জিম লেকার। ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই শুরু হওয়া ম্যানচেস্টার টেস্টে তিনি এই কীর্তি গড়েন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনি প্রথম ইনিংসে ৩৭ রানের বিনিময়ে ৯ উইকেট শিকার করেছিলেন। প্রথম ইনিংসে তার ঘূর্ণি থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন ওপেনার জিম বার্ক এবং অপরাজিত থাকার কল্যাণে রে লিন্ডওয়াল।
ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে জিম লেকার একাই অস্ট্রেলিয়ার সবক’টি উইকেট শিকার করেন। মাত্র ৫৩ রানের বিনিময়ে তিনি ১০ উইকেট নেন। তার শিকারের তালিকায় জিম বার্ক এবং রে লিন্ডওয়ালও ছিলেন। ফলে প্রথম বোলার হিসেবে এক ম্যাচে প্রতিপক্ষের ১১ জন ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরত পাঠানোর কীর্তি গড়েন প্রথম বোলার হিসেবে এক ইনিংসে ১০ উইকেট শিকার করা এই অফস্পিনার।
শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন
দ্বিতীয় বোলার হিসেবে প্রতিপক্ষের ১১ জন ব্যাটসম্যানকে আউট করার কীর্তি গড়েছিলেন ভারতের শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন। কাকতালীয়ভাবে তিনিও অফস্পিনার। তিনি ১৯৬৫ সালের ১৯ মার্চ নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে দিল্লিতে এই কীর্তি গড়েন। প্রথম ইনিংসে এই অফস্পিনার ৭২ রানের বিনিময়ে ৮ উইকেট শিকার করেছিলেন। এর মধ্যে তিনি গ্রাহাম ডাউলিং, টেরি জার্ভিস, রস মরগান, বেভান কংডন, বার্ট সাটক্লিফ, ভিক পোলার্ড, জন ওয়ার্ড এবং ফ্রাঙ্ক ক্যামেরুনের উইকেট শিকার করেছেন।
দ্বিতীয় ইনিংসে জন রিড, ব্রুচ টেইলর এবং রিচার্ড কলিঞ্জের উইকেট তুলে নিতে পারলেই ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের সব ব্যাটসম্যানকে আউট করার কীর্তি গড়তেন। শেষপর্যন্ত তা-ই ঘটলো। দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি ৪ উইকেট শিকার করলেও বেছে বেছে রিড, টেইলর এবং রিচার্ডের উইকেটই শিকার করেছিলেন। শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন দিল্লি টেস্টে ১৫২ রানের বিনিময়ে ১২ উইকেট শিকার করেছিলেন, যার ফলে নিউ জিল্যান্ডকে ৭ উইকেটে পরাজিত করতে সক্ষম হয় ভারত।
জিওফ ডাইমক
অস্ট্রেলিয়ার বাঁহাতি পেসার জিওফ ডাইমক ১৯৭৯ সালের ২ অক্টোবর ভারতের কানপুরে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে ১৬৬ রান খরচায় ১২ উইকেট শিকার করেন। ম্যাচে তার দুর্দান্ত বোলিং সত্ত্বেও ভারতের কাছে পরাজিত হয় অস্ট্রেলিয়া। তবে বাঁহাতি এই পেসার দলকে জেতাতে না পারলেও ম্যাচে ভারতের ১১ জন ব্যাটসম্যানকেই সাজঘরে ফেরত পাঠান।
প্রথম ইনিংসে তিনি ৯৯ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট শিকার করেছিলেন। তার ৫ উইকেটের মধ্যে ছিলো সুনীল গাভাস্কার, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, কারসান ঘাবড়ি, শিবলাল যাদব এবং শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘাবনের উইকেট। ম্যাচে প্রতিপক্ষের সব কয়জন ব্যাটসম্যানের উইকেট তুলে নিতে হলে দ্বিতীয় ইনিংসে এই পাঁচ ব্যাটসম্যান ছাড়া বাকি ছয় ব্যাটসম্যানকে আউট করতে হতো। তিনি তা-ই করে দেখালেন। ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি মাত্র ৬৭ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট শিকার করেছিলেন, যার মধ্যে শিবলাল যাদবকে ছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যানকেই তিনি প্রথম ইনিংসে আউট করতে পারেননি। তার ৭ উইকেটের মধ্যে ছয়জন ব্যাটসম্যান প্রথম ইনিংসে তার বলে আউট হননি, তবে দ্বিতীয় ইনিংসে তার বলে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছিলেন।
দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি কপিল দেব, দিলীপ দোশি, সৈয়দ কিরমানি, যশপাল শর্মা, দিলীপ ভেঙ্গসরকার এবং চেতন চৌহানের উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচে ভারতের ১১ জন ব্যাটসম্যানকেই সাজঘরে ফেরত পাঠানোর কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন।
আব্দুল কাদির
১৯৮৭ সালের ২৫ নভেম্বর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লাহোর টেস্টে মুখোমুখি হয় পাকিস্তান। ঐ টেস্টে ইংল্যান্ডকে একাই পরাজিত করেন পাকিস্তানের লেগস্পিনার আব্দুল কাদির। ম্যাচে তিনি মাত্র ১০১ রানের বিনিময়ে ১৩ উইকেট শিকার করেছিলেন। তার দুর্দান্ত বোলিং নৈপুণ্যে ইংল্যান্ডকে ইনিংস ও ৮৭ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে পাকিস্তান।
আব্দুল কাদির তার ১৩ উইকেটের মধ্যে প্রথম ইনিংসেই তুলে নেন ৯ উইকেট। মাত্র ৫৬ রানের বিনিময়ে ৯ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। ফলে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ১৭৫ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল। জবাবে পাকিস্তান তাদের প্রথম ইনিংসে ৩৯২ রান সংগ্রহ করে। আব্দুল কাদির প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের ডেভিড ক্যাপেল এবং ব্রুচ ফ্রেঞ্চকে ছাড়া বাকি নয় ব্যাটসম্যানকেই আউট করেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে এই দুই ব্যাটসম্যান সহ মোট ৪ উইকেট শিকার করে দলের জয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি ম্যাচে ইংল্যান্ডের ১১ জন ব্যাটসম্যানকেই আউট করেন।
ওয়াকার ইউনিস
১৯৯০ সালের ২৬ অক্টোবর ফয়সালাবাদে পাকিস্তানের বিপক্ষে মুখোমুখি হয় নিউ জিল্যান্ড। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১০২ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পরেও ওয়াকার ইউনিসের কল্যাণে ৬৫ রানে জয় তুলে নেয় পাকিস্তান। ওয়াকার ইউনিস ম্যাচে ১৩০ রানের বিনিময়ে ১২ উইকেট শিকার করেন। এর মধ্যেই তিনি নিউ জিল্যান্ডের ১১ জন ব্যাটসম্যানকে আউট করার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানের করা ১০২ রানের জবাবে নিউ জিল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ২১৭ রান সংগ্রহ করে। ওয়াকার ইউনিস ৭৫ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট শিকার করে নিউ জিল্যান্ডকে বড় লিড নিতে দেননি। তিনি নিউ জিল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে ক্রিস প্রিংলে, ইয়ান স্মিথ, মার্টিন ক্রো এবং ফিল হোর্নেকে ছাড়া বাকি সাত ব্যাটসম্যানকে আউট করেন। দ্বিতীয় ইনিংসে এই চার ব্যাটসম্যান সহ পাঁচ উইকেট শিকার করে পাকিস্তানের জয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের ১১ জন ব্যাটসম্যানকেই আউট করেন তিনি।
মুত্তিয়া মুরালিধরন
শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরন ২০০০ সালের ২০ জুলাই সর্বশেষ বোলার হিসেবে প্রতিপক্ষের ১১ জন ব্যাটসম্যানকে আউট করার কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গল টেস্টে এই কীর্তি গড়েন। ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইনিংস ও ১৫ রানের ব্যবধানে জয়লাভ করে শ্রীলঙ্কা। মুরালিধরন গল টেস্টে ১৭১ রানের বিনিময়ে ১৩ উইকেট শিকার করেছিলেন।
গল টেস্টে প্রথমে ব্যাট করে শ্রীলঙ্কা সনাৎ জয়াসুরিয়া এবং মাহেলা জয়াবর্ধনের জোড়া সেঞ্চুরির উপর ভর করে ৫২২ রান সংগ্রহ করে। জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের প্রথম ইনিংসে ২৩৮ রানে সবকটি উইকেট হারিয়ে ফলো-অনে পড়ে। মুরালিধরন ৮৭ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট শিকার করে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইনআপ একাই ধসিয়ে দেন। প্রথম ইনিংসে তিনি গ্যারি কারস্টেন, নেইল ম্যাকেঞ্জি, জ্যাক ক্যালিস, জন্টি রোডস, শন পোলক এবং মার্ক বাউচারের উইকেট তুলে নেন। ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার ১১ জন ব্যাটসম্যানকে আউট করতে হলে মুরালিধরনকে দ্বিতীয় ইনিংসে ড্যারেল কালিনান, ল্যান্স ক্লুজনার, নিকি বোয়ে, পল অ্যাডামস এবং মাখায়া এনটিনির উইকেট শিকার করতে হতো। মুরালি তা-ই করে দেখালেন। দ্বিতীয় ইনিংসে এদের উইকেট সহ মোট ৭ উইকেট শিকার করে দলকে জেতানোর পাশাপাশি ম্যাচসেরার পুরস্কারও জেতেন তিনি।