হ্যাটট্রিক শব্দটা জন্ম ক্রিকেট থেকে। বলা হয় আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই শব্দটার উদ্ভব হয়েছিলো। কিংবদন্তী আছে যে, এই এইচ স্টিফেনসন নামে এই ভদ্রলোক পরপর তিন বলে তিন উইকেট তুলে নেওয়ার পর ভক্তরা তাকে একটা হ্যাট উপহার দিয়েছিলেন; এই হ্যাট পরে স্টিফেনসন তিন বলে তিন উইকেটের ‘ট্রিক’ করেছিলেন বলেই ব্যাপারটা নাকি হ্যাটট্রিক হলো!
হ্যাটট্রিক শব্দটা এখন ক্রিকেট আর ফুটবলের কল্যানে খুবই পরিচিত একটা ব্যাপার। মেসি-রোনালদোর হ্যাটট্রিক কয়টা কিংবা লাসিথ মালিঙ্গা কয় বার হ্যাটট্রিক করলেন, এসব সবার যেন মুখস্থ। কিন্তু হ্যাটট্রিক কেবল এই দুই খেলায় নয়, দুনিয়ার অনেক খেলায় জড়িয়ে আছে।
হকি, ওয়াটার পোলো, মোটোর রেসিং, বেসবল থেকে শুরু করে ডার্ট নিক্ষেপে অবধি হ্যাটট্রিক হয়। কী করে হয়?
ফুটবল
ফুটবলের হ্যাটট্রিকের ব্যাপারটা খুব সরল- এক খেলায় তিন গোল করলেই সেটা হ্যাটট্রিক। সেই তিন গোল পরপর করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তবে কোনো কোনো দেশে পরপর তিন গোল করলে সেটাকে পারফেক্ট হ্যাটট্রিক বলা হয়।
হ্যাটট্রিকের হিসাবে পেনাল্টি থেকে করা গোল গণনা করা হয়। অতিরিক্ত সময়ে করা গোলও হিসাব করা হয়। কিন্তু টাইব্রেকারের জন্য আয়োজিত পেনাল্টি শুট আউটে করা গোল এই হিসাবে যুক্ত হয় না।
আন্তর্জাতিক খেলায় প্রথম হ্যাটট্রিক করেন স্কটল্যান্ডের জন ম্যাকডৌগাল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮৭৮ সালে এক ম্যাচে তিন গোল করেছিলেন তিনি। ফিফা বিশ্বকাপে প্রথম হ্যাটট্রিক হয় শুরুর আসরেই। ১৯৩০ সালে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে এই কীর্তি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ট প্যাটেনাউ। বিশ্বকাপ ফাইনালে একমাত্র হ্যাটট্রিকটি হয়েছিলো ১৯৬৬ সালে; করেছিলেন জিওফ হার্স্ট।
বেসবল
আগে বেসবলে কোনো একজন খেলোয়া পরপর তিনবার বলে আঘাত করতে পারলে সেটাকে হ্যাটট্রিক বলা হতো। আর পরপর চার বার আঘাত করতে পারলে সেটাকে গোল্ডেন সমবেরো বলার একটা প্রচলন আছে।
কিন্তু ইদানিং বেসবলে হ্যাটট্রিকের সংজ্ঞা বদলে দিচ্ছেন ভক্তরা। তারা বলছেন, একজন খেলোয়াড় তিনটে হোম রান নিতে পারলে সেটা হ্যাটট্রিক হবে।
২০১৫ সালে টরোন্টো ব্লুর খেলোয়াড় এডউইন এনকার্নাসিওন তৃতীয় হোম রান নিলে ভক্তরা মাঠে হ্যাট ছুড়ে মারেন। হ্যাট ছুড়ে মারাটাকে আইস হকিতে হ্যাটট্রিক উদযাপনের একটা উপায় বলে মনে করা হয়। পরের বছরও ব্লু ভক্তরা তাদের খেলোয়াড়দের এই কীর্তি এভাবে উদযাপন করেছেন।
ডার্ট
ডার্ট নিক্ষেপে কোনো খেলোয়াড় যদি পরপর তিনটি ‘বুলস আই’ করেন, মানে তিনবার একেবারে কেন্দ্রে ডার্ট লাগাতে পারেন, তাহলে সেটাকে হ্যাটট্রিক বলা হয়। একজন বিখ্যাত ডার্ট খেলোয়াড় অ্যালান ইভান্স তার ক্যারিয়ারে অনেকবার এই কাজ করেছেন। এই হ্যাটট্রিককে অনেকে ‘অ্যালান ইভান্স শট’ বলেও ডাকেন।
ক্রিকেট
হ্যাটট্রিকের আদি জায়গা হলো ক্রিকেট। এখানে কাজটা বেশ শক্ত। আপনাকে পরপর তিন বলে তিনটি উইকেট নিতে হবে। এর মধ্যে কোনো ওয়াইড বা নো, কোনোরকম অবৈধ ডেলিভারি হলেও আর হ্যাটট্রিক পূর্ণ হবে না। তবে এই হ্যাটট্রিক হতে পারে দুই ওভার জুড়ে, এমনকি দুই ইনিংস জুড়েও; তবে নিজের পরপর তিন বলে উইকেট নেওয়ার বিকল্প নেই।
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন ফ্রেড স্পফোর্থ। ১৮৭৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরপর তিন বলে তিন উইকেট নেন এই অস্ট্রেলিয়ান। ১৯১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার জিমি ম্যাথুস একই টেস্টের দুই ইনিংসেই হ্যাটট্রিক করেন। টেস্টে দুবার করে হ্যাটট্রিক করেছেন জিমি ম্যাথুস, হিউ ট্রাম্বল ও ওয়াসিম আকরাম।
অভিষেক টেস্টেই হ্যাটট্রিক করার কীর্তি আছে মরিস অ্যালম, পিটার পেথেরিক ও ড্যামিয়েন ফ্লেমিংয়ের। আবার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করার কীর্তি আছে হিউ ট্রাম্বল ও জিওফ গ্রিফিনের। কোর্টনি ওয়ালস, মার্ভ হিউজেস ও জার্মেইন লসন দুই ইনিংস মিলিয়ে হ্যাটট্রিক করেছেন। মার্ভ হিউজেস এর মধ্যে তিন ওভার ধরে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। তিনি প্রথম উইকেট পান ওভারের শেষ বলে। পরের উইকেট পান পরের ওভারের প্রথম বলে; যাতে প্রতিপক্ষের ইনিংস শেষ হয়ে যায়। পরের ইনিংসে তিন নম্বর ওভারে এসে প্রথম বলে তৃতীয় উইকেট পান।
বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে টেস্টে হ্যাটট্রিক করেছিলেন অলক কাপালি। হ্যাটট্রিক করা কোনো বোলারের সবচেয়ে কম উইকেট শিকারের রেকর্ড কাপালির; তার মোট উইকেট ৬টি।
টেস্টে নিজের করা ইনিংসের প্রথম তিন বলেই তিন উইকেট নিয়েছিলেন নুয়ান জয়সা। আর ইনিংসের প্রথম ওভারেই হ্যাটট্রিক করেছিলেন ইরফান পাঠান। ২০০৬ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে করাচি টেস্টে এই কীর্তি করেন তিনি।
১৯৮২ সালে পাকিস্তানের জালাল উদ্দিন প্রথম ওয়ানডে হ্যাটট্রিক করেন। শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্কা ওয়ানডেতে তিনটি হ্যাটট্রিক করেছেন। মালিঙ্গার কীর্তি অবশ্য এতটুকুতে বোঝা যাবে না। তিনি দুবার ডাবল হ্যাটট্রিক করেছেন।
টানা চার বলে উইকেট নিলে ক্রিকেটের পরিভাষায় বলা হয় ‘ডাবল হ্যাটট্রিক’। যেহেতু প্রথম বল থেকে ধরলে হ্যাটট্রিক হয়, দ্বিতীয় বল থেকে ধরলেও হ্যাটট্রিক।
ডাবল হ্যাটট্রিক একবার করলেই ক্রিকেটে অমর হয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট। লাসিথ মালিঙ্গা করে ফেলেছেন দুই বার। ডাবল হ্যাটট্রিকের ডাবল! ২০০৭ সালে করেছিলেন ওয়ানডেতে। আর ২০১৯ সালে করেছেন টি-টোয়েন্টিতে।
ওয়ানডেতে একমাত্র বোলার হিসেবে তিনটি হ্যাটট্রিকের মালিক তিনি আগে থেকেই। আর টি-টোয়েন্টিতে একমাত্র বোলার হিসেবে দুটি হ্যাটট্রিক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একমাত্র বোলার হিসেবে ৫টি হ্যাটট্রিক মালিঙ্গার। ওয়াসিম আকরামের আছে ৪টি হ্যাটট্রিক।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে ডাবল হ্যাটট্রিক করার স্বাদ পেয়েছেন আর কেবল একজনই। গত মার্চে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে রশিদ খান।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে একই ইনিংসে দুবার করে হ্যাটট্রিক করার ঘটনা আছে দুটি। অ্যালবার্ট ট্রট ও জোগিন্দর রাও এই কাজ করেছেন।
হকি (আইস হকি)
হকির ব্যাপারটাও ফুটবলের মতো। এখানেও এক খেলায় তিন গোল করতে পারলে হ্যাটট্রিক হবে। হকিতে ব্যাপারটাকে বলা হয় ‘ন্যাচারাল হ্যাটট্রিক’। এই ন্যাচারাল হ্যাটট্রিকের ক্ষেত্রে হকিতে একটা শর্ত আছে। এখানে ফুটবলের মতো ম্যাচ জুড়ে তিন গোল করলেই হবে না। গোল তিনটি টানা হতে হবে। এক বা দুই গোল করে ফেলার পর অন্য কোনো সতীর্থ গোল করলে তৃতীয় গোলটির পর আর হ্যাটট্রিক হবে না।
এছাড়া ম্যাচ জুড়ে তিন গোল করলেও অনেকে হকি হ্যাটট্রিক বলে বিবেচনা করা হয় কোনো কোনো দেশে। তবে সেটা সর্বজনস্বীকৃত নয়।
ধারণা করা হয়, ১৯৩০-এর দশক থেকে হকিতে হ্যাটট্রিক শব্দটা চালু হয়েছে।
আইস হকির ক্ষেত্রে হ্যাটট্রিকের ব্যাপারটা একইরকম। তবে আইস হকিতে একটা মজার প্রথা আছে। এখানে কোনো খেলোয়াড় হ্যাটট্রিক করলে সেই দলের সমর্থকরা মাঠে হ্যাট ছুড়ে মারে। এর চেয়ে ভালো উদযাপন আর কী হতে পারে!
মোটর রেসিং
এই খেলাটায় বিচিত্র ধরনের কারণে হ্যাটট্রিক হয় বলে সমর্থকরা বিবেচনা করেন। অন্যান্য খেলার মতো এখানে হ্যাটট্রিক রেকর্ড রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে পরপর তিনটি রেস জিতলে, একই ইভেন্ট পরপর তিনবার জিতলে, পোল পজিশন ধরে রাখতে পারলে এবং একই ইভেন্টে দ্রুততম ল্যাপ দিতে পারলে ও রেস জিতলে লোকেরা সেটাকে হ্যাটট্রিক বলে।
রাগবি (ইউনিয়ন ও লিগ)
রাগবি ফুটবলে কোনো খেলোয়াড় এক ম্যাচে তিন বা তার বেশি ট্রাই করতে পারলে সেটাকে হ্যাটট্রিক বলা হয়। সব ধরনের পদ্ধতিতে ট্রাই করতে পারলে সেটাকে ফুল হাউস বলা হয়। কোনো খেলোয়াড় হ্যাটট্রিক করলে সাধারণত ওই খেলোয়াড়কে ম্যাচ বলটা উপহার দেওয়া হয়।
হ্যান্ডবল ও ওয়াটার পোলো
ফুটবল বা হকির মতোই ব্যবস্থা। এক ম্যাচে একজন খেলোয়াড় তিনবার স্কোর করতে পারলে সেটাকে হ্যাটট্রিক বলা হয়। ওয়াটার পোলোতে হ্যাটট্রিকের গুরুত্ব থাকলেও হ্যান্ডবলে খুব একটা গুরুত্ব পায় না এই শব্দটা।
খেলাধুলা নিয়ে আরও জানতে আজই পড়ে নিন এই বইগুলো
২) A Biography of Rahul Dravid: The Nice Guy Who Finished First
৩) সাকিব আল হাসান – আপন চোখে ভিন্ন চোখে
৪) শচীন রূপকথা