বহু বছর আগের কথা।
মিকি স্টুয়ার্ট তখন পেশাদার ফুটবল, পেশাদার ক্রিকেট, দুটোই খেলতেন। ছেলেকে নিয়ে একদিন মাঠে গেছেন একটা ফুটবল ম্যাচ দেখাতে। ছোট্ট ছেলেটা খুব মজা করছিলো। হাজারো সমর্থকের সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করছিলো সে।
খেলা শেষে ছেলেটির বাবা মিকি স্টুয়ার্ট এসে বললেন, “এই শত শত মানুষের মধ্যে বেশিরভাগই হয়তো কোনোদিন পেশাদার খেলোয়াড় হতে পারবে না। এর মধ্যে হয়তো একজন পেশাদার খেলোয়াড় হবে।”
ছেলেটি হাত উঁচু করে বললো, “সেই মানুষটা আমি।”
সেদিন মিকি স্টুয়ার্ট হয়তো হেসেছিলেন। কিন্তু কালক্রমে সেই ছেলেটির কথাই সত্যি হয়েছে। ছেলেটি হয়ে উঠেছেন পেশাদার এক ক্রিকেটার। বাবাকেও ছাপিয়ে গেছেন যে জগতে। বাবা মিকি স্টুয়ার্ট ইংল্যান্ডের হয়ে ৮টি টেস্ট খেলেছিলেন। আর সেদিনের সেই ছেলেটি বড় হয়ে ১৩৩টি টেস্ট খেলেছে; ১৫টি সেঞ্চুরিসহ ৮ হাজারের ওপরে টেস্ট রান করেছে।
সেই ছেলেটিই অ্যালেক স্টুয়ার্ট।
এককালের ওপেনিং ব্যাটসম্যান, উইকেটরক্ষক, অধিনায়ক; অনেক পরিচয় অ্যালেক স্টুয়ার্টের। কিন্তু এই সবকিছু ছাপিয়ে তিনি এখন একজন ক্রিকেটার গড়ার কারিগর। বাবার পথ ধরে অ্যালেকও হয়ে উঠেছিলেন সারের একজন কিংবদন্তী। সেই সারে ক্লাবেরই ক্রিকেট পরিচালক এখন অ্যালেক স্টুয়ার্ট। আর এখানেই তিনি এখনকার অলি পোপ বা স্যাম কুরানের মতো ইংল্যান্ডের তরুণ প্রতিভাদের তুলে আনছেন, তৈরি করছেন ইংলিশ ক্রিকেটের জন্য অসাধারণ এক পাইপলাইন।
সারের সাথে অ্যালেক স্টুযার্টের সম্পর্ক বাবার আমল থেকে। বাবা মাইকেল জেমস স্টুয়ার্ট বা মিকি স্টুয়ার্ট ছিলেন সারের কিংবদন্তী। সারের কোচও ছিলেন। মিকি যখন সারের কোচ, তখনই অ্যালেক একটু একটু করে বিকশিত হয়েছেন। আবার বাবার কোচিংয়ে ইংল্যান্ড জাতীয় দলেও খেলেছেন তিনি। সারের হয়ে বাবা-ছেলে দুজনই অসামান্য সব পারফরম্যান্স করেছেন।
পিতা-পুত্রকে তাই স্থায়ীভাবেই স্মরণীয় করে রেখেছে সারে। ওভালের একটি গেটের নামকরণ করা হয়েছে ছেলে অ্যালেকের নামে। অন্যদিকে একটি প্যাভিলিয়নের নাম বাবা মিকির নামে। এই প্রসঙ্গ উঠতেই অ্যালেক স্টুয়ার্ট একটু হাসেন। বলেন, প্যাভিলিয়নের আগে তো গেট। তাই তিনি একটু আগে আছেন,
“দেখুন, প্রথমের ব্যাপারটা প্রথমে। আপনাকে তো ভেতরে গিয়ে প্যাভিলিয়ন বা অন্য কোথাও যেতে গেলে আগে গেট দিয়ে ঢুকতে হবে।”
মজা করে এই কথাটা বললেও স্টুয়ার্ট বাবা-ছেলে অনেকদিন অবধি একটা রেকর্ড নিজেদের করে রেখেছিলেন। জিম্বাবুয়ের ম্যালকম ওয়ালার ও অ্যান্ডি ওয়ালারের আগ অবধি স্টুয়ার্টরাই ছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোচ ও খেলোয়াড় হিসেবে একই সময়ে দলে থাকা একমাত্র বাবা ও ছেলে জুটি।
অ্যালেক স্টুয়ার্টের অভিষেক হয়েছিলো যখন, তখনই জাতীয় দলের কোচ মিকি স্টুয়ার্ট।
তার জন্য অভিষেকের সময়টা কঠিন ছিলো না। কারণ কাউন্টি ক্রিকেটে তিনি লম্বা সময় ধরে বাবার কোচিংয়ে খেলে অভ্যস্ত ছিলেন। অ্যালেক বলছিলেন, এই ধরনের ক্ষেত্রে কোচ-খেলোয়াড় ও পিতা-পুত্র সম্পর্কের পার্থক্যটা ধরে রাখা খুব জরুরি।
স্টুয়ার্ট বাবা-ছেলে মাঠে ও বাসায় কেমন সম্পর্ক ধরে রাখতেন, সেটা বলছিলেন অ্যালেক,
“আমরা যখন বাসায় থাকতাম, তখন অবশ্যই উনি আমার বাবা। কিন্তু যখনই ক্রিকেটের কথা আসতো, আমি আমার ওই কোচের মধ্যে কখনো বাবাকে দেখতে পাইনি। আমি একজন সাধারণ খেলোয়াড় ছিলাম তার কাছে। আর উনি আমার কাছে কোচই ছিলেন। আমি কখনো ক্রিকেট মাঠে বা ড্রেসিংরুমে তাকে বাবা বলে ডাকিনি বা বাবা বলে উল্লেখও করিনি। আবার ওখান থেকেই আমরা যখন বাসায় ফিরতাম, তিনি আমার অতি আপন বাবা হয়ে যেতেন। তবে এটা সত্যি যে, সে সময় বাবা ছেলের চেয়ে কোচ-খেলোয়াড় সম্পর্কটাই বেশি ছিলো।”
এখন অবশ্য অ্যালেক নিজেই অনেক সিনিয়র হয়ে গেছেন। এতটাই যে, সারেতে তিনি ক্রিকেটার তৈরি করার মূল দায়িত্বে আছেন। এখানে নিজের কাজের ধরন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, যেসব শিশু-কিশোরের মধ্যে তিনি নিজেকে মেলে ধরার প্রবণতা দেখেন, তাদেরই বেছে নেন ভবিষ্যত তারকা হিসেবে,
“আমি বিশ্বাস করি, কারো ব্যক্তিত্ব দুই শতাংশের বেশি পরিবর্তন করা যায় না। যখন কারো ওপর চাপ আসে, সে তখন তার নিজের চরিত্র প্রকাশ করে ফেলে। আমি কঠিন ধরনের ছেলেদের পছন্দ করি। কম রানে আউট হয়ে গেলো, ক্যাচ ফেলেছো কিংবা উইকেট পাওনি; কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তখন? পালাবে, অজুহাত দেবে, কাউকে দোষ দেবে; এমন ছেলের প্রতি আমার আগ্রহ নেই। যদি তুমি নিজে যা, তা-ই দেখাতে চাও, তাহলে সারেতে আমি তোমাকে চাইবো।”
শুধু নিজের বর্তমান ভূমিকা নিয়ে কথা বললে তো চলতে না। অ্যালেক স্টুয়ার্ট এই ক্রিকেটার তৈরির মাঝে মাঝেই ফিরে যান নব্বই দশকের সেই সময়ে। যখন তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান।
নব্বইয়ের দর্শকরা এখনও প্রতিটা বল সামলানোর আগে স্টুয়ার্টের সেই ব্যাট মোচড়ানোর কথা ভুলে যাননি। এই প্রসঙ্গটা উঠতে অ্যালেক যেন একটু লজ্জা পেলেন। বললেন, এটা তিনি না করে পারতেন না। এখন অবশ্য বিরাট কোহলিও কাজটা করেন দেখে একটু স্বস্তি পান,
“আমি স্রেফ ওটা না করে পারতাম না। একবার একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে গেছি। সেখানে আয়োজকরা বললো, আমি যদি একটা ওভার ওটা না করি, আমাকে বাড়তি কিছু অর্থ দেবে। আমি না করে পারিনি। যা-ই হোক, এখন বিরাট কোহলিকে এটা করতে দেখি। এটা ওর জন্য নিশ্চয়ই কাজে দেয়; আমার জন্যও কাজে দিতো।”
ক্রিকেট নিয়েই শুধু পড়ে থাকেন না অ্যালেক। বাবার মতো কখনো ফুটবল খেলেননি। তবে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাটা নাকি তার ক্রিকেটের চেয়েও বেশি। নিজেই বলছিলেন ফুটবলের প্রতি এই আকর্ষণের কথা।
যখন সারের কাজ থাকে না, পরিবারকে সময় দিতে হয় না, তখন অ্যালেক স্টুয়ার্ট একজন পুরোদস্তুর চেলসিভক্ত। চেলসির জন্য কখনো মাঠে গিয়ে, কখনো টেলিভিশনের সামনে গলা ফাটান। বলছিলেন,
“সত্যি কথা বলি, একটা বাচ্চা হিসেবে আমি ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলই বেশি পছন্দ করতাম। আমি যখন ১৬ বছর বয়সী, তখন অবধি আমি করিন্থিয়াস ক্যাসুয়ালসের (মিকি স্টুয়ার্টও এই ক্লাবে খেলতেন) হয়ে খেলতাম। পরে ক্রিকেটটাই আমার ক্যারিয়ারকে দখল করে নিলো। আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু ভালোবাসাটা এখনও ফুটবলের প্রতি।”
বাবা ও দাদার পথ ধরে অ্যালেক স্টুয়ার্টের কোনো সন্তান অবশ্য ফুটবল বা ক্রিকেটে আসেননি। তার মেয়ে এমিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। আর ছেলে গেমিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
স্টুয়ার্ট হেসে বলেন,
“আমি কোনো গেম চালুই করতে পারি না।”
ফুটবল, ক্রিকেট, গেম- এসব নিয়ে তার সংসার এখন। কিন্তু এই সংসারে বারবার ফিরে আসে ক্রিকেটের সব স্মৃতি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গ্রাহাম থর্পের একটা ঘটনা মনে করে এখনও হাসেন অ্যালেক,
“থর্প সেদিন খুব অল্প রানে আউট হয়ে গিয়েছিলো। ও বেশ রাগ হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরেছিলো। সামনে ছিলো একটা কাঠের দরজা। ওটা ঠেলে খুলতে হয়। আমরা একটু সংকুচিত হয়ে বসেছিলাম। থর্প এসে দরজা না ঠেলে পা দিয়ে মারলো লাথি। পা সেই কাঠের দরজা ভেঙে ঢুকে গেলো। একটা গম্ভীর পরিবেশে কেমন একটা দৃশ্য। থর্প পা টানাটানি করছে, কিন্তু ছাড়াতে পারছে না। শেষ অবধি ও চিৎকার করে বললো, “কেউ একজন এসে পা-টা ছাড়িয়ে দাও।” আমরা আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না।”
এভাবে হাসি-ঠাট্টায় কেটে যায় সময়। আর সময়টা পার করেই অ্যালেক স্টুয়ার্ট ছোটেন আবার সারে ক্লাবে। তিনি যে সেখানকার ক্রিকেটার তৈরির কারিগর।