লিওনেল আন্দ্রেস মেসি, গত দুই দশকের আলোচিত এক নাম। তার সতীর্থ কিংবা বিপরীতে ক্লাবের প্লেয়ারদের অনেকেরই দাবি, মেসি এক অপ্রতিরোধ্য খেলোয়াড়ের নাম। এমনকি ইতালির সুপরিচিত ডিফেন্ডার মালদিনি এক ইন্টারভিউয়ে মেসির ইনজুরির কারণে এসি মিলানের বিপক্ষে খেলতে না নামাকে ‘সৌভাগ্য’ বলে অভিহিত করেন। এত অর্জনের পরও ২০১৪ বিশ্বকাপের হারের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সমালোচনায় জর্জরিত এই আর্জেন্টাইন তারকা। পরপর দুইটি কোপা আমেরিকার ফাইনালে হার, জাভি-ইনিয়েস্তা-নেইমারের বিদায়ের পর বার্সেলোনাও অনেকটা হারাতে বসেছে তার জৌলুশ। রোমা, লিভারপুল এবং সর্বশেষ বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হতাশাজনক ৮-২ পরাজয় ফিকে করে দিচ্ছে এই ‘ভিনগ্রহের ফুটবলার’-এর প্রতি দর্শকদের দৃষ্টিভঙ্গি।
২০১৮-১৯ মৌসুম বার্সেলোনার জন্য খুব সুখকরভাবে শেষ না হলেও লিওনেল মেসির জন্য নিয়ে আসে তার ষষ্ঠ ব্যালন ডি’অর। বার্সাকে খুশি থাকতে হয় শুধু লা লিগা টাইটেলেই। কিন্তু মেসির কাঁধে ভর করে গত মৌসুমে শিরোপার স্বপ্নভঙ্গের শুরু হয় প্যান্ডেমিকে দীর্ঘ বিরতির পর লা লিগার শুরু থেকেই। তাই লা লিগায় আবারও সর্বোচ্চ গোলদাতা (২৫) কিংবা সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের (২১) রেকর্ড করেও দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে ‘রাইভাল’ মাদ্রিদের কাছে শিরোপা হারিয়েছে বার্সেলোনা। কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছে বায়ার্ন মিউনিখ।
গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ক্লাবের এমন পরাজয় ভক্তদের কাছে অচেনা। প্রায় সবাই যখন অপেক্ষা করছে ক্লাবের বড়সড় পরিবর্তনের, সেই সময় আলোড়ন সৃষ্টি করে ক্লাবকে পাঠানো, মেসির ‘বুরোফ্যাক্স’, যেখানে মেসি ক্লাব ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান।
প্রায় ২০ বছর আগে (১৮ ডিসেম্বর, ২০০০) একটি ন্যাপকিনে স্বাক্ষরের মাধ্যমে যার ক্লাবে যাত্রা শুরু, তাকে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন দিয়ে আটকে রাখতে হবে, এমন চিন্তা কারও মাথায় না আসাটাই স্বাভাবিক। তাই ২০১৭ সালে চুক্তি নবায়নের সময় মেসি যখন প্রতি সিজনের শেষে স্বেচ্ছায় বিনা শর্তে চলে যাওয়ার ধারা যোগ করেন, তা মেনে নিতে কেউ দ্বিধা করেনি। প্যান্ডেমিকের কারণে গত সিজনের সময় দীর্ঘায়িত না হলে প্রেসিডেন্ট বার্তোমেউকে কড়ায়-গণ্ডায় হিসেব চুকাতে হতো এই ধারার। গত ৩০ আগস্ট মেসির বুরোফ্যাক্স বার্সা ম্যানেজমেন্টের কাছে পৌঁছানোর পর থেকেই সবাই অপেক্ষায় ছিল মেসির কাছ থেকে অফিসিয়াল বক্তব্য শোনার। মেসি হয়তো চাননি কিছু বলে ক্লাব এবং তার ব্যক্তিগত সুনাম ক্ষুণ্ন করতে, কিংবা হয়তো অপেক্ষায় ছিলেন দুইপক্ষের আইনজীবীর মধ্যে মধ্যস্থতার। গত ৩ সেপ্টেম্বর তার বাবা হোর্হে মেসি, মেসির এজেন্ট হিসেবে বার্তোমেউর সাথে দুই দফা আলোচনা শেষে গত রাতে মেসি আরো এক মৌসুম ক্লাবে রয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান।
“আমি জানতাম আমার ক্লাব ছেড়ে যাওয়া সম্ভব, এবং প্রেসিডেন্ট সবসময় বলতেন কোনো সিজন শেষে বার্সায় থাকার সিদ্ধান্ত আমার নিজের। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা ১০ জুনের মাঝে ক্লাবকে অবহিত করার ব্যাপারটিকে টেনে আনছে। অথচ এই বছর তখনও আমরা লা লিগার জন্য খেলছি। করোনাভাইরাসের কারণে সিজনের সময়সীমা পরিবর্তিত হয়েছে। একমাত্র যে কারণে আমি বার্সাতে কন্টিনিউ করছি, বার্তোমেউ’র মতে ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার উপায় রিলিজ ক্লজের ৭০০ মিলিয়ন ইউরো শোধ করা, যা অসম্ভব। আর একটি উপায়, কোর্টে যাওয়া। আমি কোনোদিনই চাই না এই ক্লাবের বিরুদ্ধে কোর্টে যেতে। বার্সা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে, ক্লাবের প্রতি ভালবাসার অবস্থান থেকে আমি কখনোই কোর্টে যেতে চাই না।”
অথচ ক্লাবের হয়ে ৩৪টি শিরোপা জেতা এই খেলোয়ারের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট কোর্টে যেতে পিছুপা হতেন না বলেই সমর্থক ও সমালোচকদের ধারণা। অনেকের মতে, মেসির ক্লাব ছাড়ার হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণ বায়ার্নের কাছে শোচনীয় পরাজয়। যদিও মেসি স্বীকার করেছেন, এতদিন মিডিয়ার সামনে না আসার কারণ এই পরাজয় থেকে জন্ম নেয়া হতাশা, কিন্তু ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্তটি অনেক পুরনো।
“আমি প্রায় এক বছর হল বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি। আমার মতে, ক্লাবের ইয়াং প্লেয়ার প্রয়োজন, নতুন ধারণার প্রয়োজন, এবং বার্সায় আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। যদিও আমি সবসময় চেয়েছি এখানেই আমার ক্যারিয়ারের ইতি টানতে, বাস্তবে আমাকে এখানে ট্রেনিং এবং ড্রেসিংরুমে বেশ কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। আমার তাই মনে হয়েছে নতুন কোনো জায়গায় নিজের অবস্থান দেখার সুযোগ করে নেয়ার। প্রেসিডেন্টের সাথে এই ব্যাপারে কথা বললে সবসময়ই সিজন শেষে চুক্তি অনুযায়ী চলে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তার কথা রাখেননি।”
অন্যতম সেরা ফুটবলার হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন সময়ে সমালোচনার স্বীকার মেসি। সম্প্রতি ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘স্যালারি বাড়ানোর নাটক’, ‘ক্লাবের প্রতি অসম্মান’, এসব বলতে ছাড়েননি অনেকেই – বিশেষত রাইভাল ক্লাবগুলোর সমর্থকরা।
“আমাকে অনেক মিথ্যা অনুযোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, বিশেষত এমন সময়গুলোতে। সবচেয়ে কষ্টদায়ক হচ্ছে, যখন কেউ আমার বার্সেলোনিজম নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আমি সবসময় ক্লাবকে সবকিছুর আগে জায়গা দিয়েছি। বিভিন্ন সময় আমার কাছে ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব ছিল। আমি প্রতি বছরই অন্য কোথাও এর চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করতে পারতাম। কিন্তু আমি সবসময় বলে এসেছি, বার্সা আমার জন্য হোম, বার্সা ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে কষ্টকর। এই সিদ্ধান্ত নেয়া আমার জন্য সহজ নয়, এই সিদ্ধান্ত বায়ার্নের সাথে পরাজয়ের ফলও নয়।”
২০১৫ সালের ট্রেবল জয়ের পর বার্সা ইউসিএল শিরোপার দেখা পায়নি। একের পর এক দামি প্লেয়ার কেনা, ক্লাবের দর্শন থেকে সরে আসা, ‘লা মাসিয়া’র খেলোয়াড়দেরকে যত্রতত্র বিক্রি এবং কাজে না লাগানোর অভিযোগ, সান্দ্রো রোসেলের সময় থেকেও বাজেভাবে ধরা পরে বার্তোমেউ প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার পর। লুইস এনরিকের ট্রেবল জয় আলোচনায় ভাটা ফেললেও নেইমারের বিতর্কিত ট্রান্সফার, ভালভার্দে-সেতিয়েনের মতো ডিফেন্সিভ কোচ নিয়োগ, রোমা-লিভারপুল বিপর্যয়ের পরও কোনো পরিবর্তন না আসার পর থেকে সমর্থকদের রোষ বাড়তে থাকে। ধারণা ছিল, বায়ার্নের পরাজয় হয়তো বা বাধ্য করবে বড়সড় পরিবর্তন আনতে, শেষ হবে বার্তোমেউ আমল। কিন্তু একমাত্র কোচ আর টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বাদে তেমন কোনো পরিবর্তনই দেখা যায়নি এখনও। বার্সার বোর্ডের প্রতি এমন অনুযোগ মেসির কণ্ঠেও।
“আমি সবসময় বলেছি, আমি বার্সার হয়ে শিরোপা জয় করতে চাই, এবং তার জন্য একটি ‘উইনিং প্রজেক্ট’ প্রয়োজন। কিন্তু সত্যি বলতে, গত কয়েক বছরে বার্সার কোনো প্রজেক্টই নেই। তারা শুধুমাত্র শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে।”
গত ২০ বছর ধরে বার্সার সাথে যুক্ত থাকা মেসির ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত শুধু তার জন্যেই নয়, কষ্টদায়ক তার পরিবারের জন্যেও। তাদের বেড়ে ওঠা, বন্ধুবান্ধব, স্কুল – সবকিছুই বার্সেলোনায়। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষ ২-৩ বছর উদ্দেশ্যহীনভাবে বার্সায় কাটাতে চাননি ‘কাতালোনিয়া ক্যাপ্টেন’। চেষ্টা করলে হয়তো কোর্টকাচারিতে মুক্তি মিলতেও পারতো, কিন্তু বয়ে বেড়াতে হতো আরও সমালোচনা। শেষ পর্যন্ত মেসি আশ্বস্ত করেছেন আরও এক বছর বার্সেলোনাতেই থাকছেন তিনি, এবং বরাবরের মতোই চেষ্টা করে যাবেন ক্লাবের জন্য সর্বোচ্চটুকু দেয়ার।
বার্সেলোনার সমর্থকরা এখনকার মতো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও নতুন সিজনের প্রতিটি খেলা তাদের জন্য ঐ লাল-নীল জার্সি গায়ে শেষ খেলা দেখার কাউন্টডাউনমাত্র। ক্লাবের বোর্ডের আমূল পরিবর্তন কিংবা নতুন সিজনে স্পোর্টিং প্রজেক্ট রাতারাতি সফল না হলে নতুন করে চুক্তিতে মেসি যাচ্ছেন না, এটুক নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে। হয়তো ক্লাব লেজেন্ড পুয়োল-জাভি-ইনিয়েস্তা-সুয়ারেজের সাথে সাথে মেসিকেও খুব তাড়াতাড়ি বিদায় জানাতে হবে সমর্থকদের। ততদিন পর্যন্ত মহাকাব্যের রচনা চালু থাকুক এই জাদুকরের বাঁ পায়ে, সেটাই হোক প্রার্থনা।