ক’দিন আগে আর্জেন্টিনার ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য অসভালদো আর্দিলেজ বলেছেন, আর্জেন্টিনা দল এখন ‘মেসি এবং যেকোনো দশজন’!
অনেকে আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, ‘মেসি এবং দশজন অকম্মা।’ এই কথাটি নতুন কিছু নয়। এর আগেও শোনা গেছে। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু অবধি বলা হতো, আর্জেন্টিনা দল হলো ‘ম্যারাডোনা এবং দশজন’।
মানে, সেই যুগে ম্যারাডোনা এবং এই যুগে মেসি; এই দুজনকেই বহন করে যেতে হচ্ছে আর্জেন্টিনার ভার। মিল তো কেবল এই ভার বহনেই নয়। দুজনই যার যার প্রজন্মের সেরা ফুটবলার, দুজনই বাম পায়ের বিশ্বসেরা, দুজনই দশ নম্বর, দুজনই প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা।
আবার অনেক অমিলও আছে। ম্যারাডোনা কখনো আর্জেন্টিনা, কখনো স্পেন, কখনো ইতালিতে দর্শক মাতিয়েছেন। বিপরীতে মেসি পড়ে আছেন এক বার্সেলোনাতেই। ম্যারাডোনা ছিলেন খেয়ালী, মুডি, এককালে মাদকাসক্ত। সে তুলনায় মেসি নিতান্তই ভালো মানুষ এবং সহজ চরিত্রের মানুষ।
তারপরও দুজনের তুলনা তৈরি হয়। বছরের পর বছর আলোচনা হয়-কে সেরা? মেসি, নাকি ম্যারাডোনা?
এই তর্কের কোনো শেষ নেই। তারপরও কয়েকটা মানদন্ডে তুলনা করে দেখা যেতে পারে মেসি আর ম্যারাডোনাকে।
জন্মগত প্রতিভা
১৯ বছর বয়সে লিওনেল মেসি যখন গেটাফের বিপক্ষে সেই বিখ্যাত গোলটি করলেন, তখন ডিয়েগো ম্যারাডোনা নিজেই বললেন, মেসি ইতিহাসের সবচেয়ে গিফটেড ফুটবলার। মেসির সেই গোলটা ছিলো ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার করা ‘সর্বকালের সেরা’ গোলের একেবারে হুবহু প্রতিরূপ।
মেসি ও ম্যারাডোনা দুজনই বাম পায়ের ফুটবলার। ফলে দুজনেরই জন্মগতভাবে বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ অস্বাভাবিক। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফুটবল শেখার আগে দুজনই দৃষ্টি কেড়েছেন। দুজনেরই ফুটবলে শ্রেষ্ঠ সম্পদ প্রকৃতি থেকে পাওয়া ক্ষমতা। সেই অর্থে পরিশ্রম করে অর্জন করা ক্ষমতা দুজনের কারোরই নেই। তাদের যেন তৈরি করেই পাঠানো হয়েছে।
ম্যারাডোনার সর্বকালের সেরা গোলটি ছিলো কৃত্রিম টার্ফের ওপর। তাই গ্যারি লিনেকার মনে করেন, আজকের দিনের সবুজ মাঠে খেললে ম্যারাডোনার বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও বেশি থাকতো। তবে মেসিকে তুলনামূলক অনেক বেশি আটোসাটো ডিফেন্স সামলাতে হয়। তাই প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতায় দুজনের কাউকে পিছিয়ে রাখা খুব মুশকিল।
গোলস্কোরিং
ম্যারাডোনা ক্লাবের হয়ে ২৫৯টি এবং জাতীয় দলের হয়ে ৩৪টি গোল করেছেন। মূলত মাঝমাঠের খেলোয়াড় ছিলেন এবং ক্লাবে মূলত প্লেমেকার হিসেবে খেলতে হতো। সে বিবেচনায় ম্যারাডোনার এই গোলসংখ্যা ঈর্ষণীয়।
কিন্তু মেসি গোল করার ব্যাপারটাকে রোনালদোর সাথে মিলে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। তারা দুজনেই স্ট্রাইকার না হয়েই তিরিশ বা চল্লিশের দশকের ভুরি ভুরি গোলের সময়কেও পার করে গেছেন সব রেকর্ডে।
মেসি ক্লাবের হয়ে ৩৮৩টি গোল করেছেন। পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়ে করেছেন ৬৪টি গোল। বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনা- দুই দলের পক্ষেই সর্বকালের সবচেয়ে বেশি গোলের মালিক তিনি। এছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগার রেকর্ড গোলও মেসির।
ফ্রি কিক, ড্রিবল, বক্সের বাইরে থেকে শট, এমনকি হেড করেও গোল করেছেন মেসি। নিন্দুকেরা বলেন, ম্যারাডোনার মতো হাত দিয়েও গোল করার রেকর্ড আছে তার। রসিকতা একপাশে রেখে বললে বলতে হয়, গোল স্কোরার হিসেবে ম্যারাডোনার চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবেন লিওনেল মেসি।
শারীরিক শক্তি
ম্যারাডোনা ছিলেন বেটে, গাট্টাগোট্টা; যার দুটো পা ছিলো গাছের কান্ডের মতো। এমন একটা যুগে ম্যারাডোনা ফুটবল খেলেছেন, যখন কিনা ডিফেন্ডাররা ক্রিয়েটিভ ফুটবলারদের মেরে মাঠের বাইরে বের করে দ্বিধা করতো না। সেই যুগে ম্যারাডোনা আত্মগোপন না করে এ ধরনের সংঘর্ষে সরাসরি লিপ্ত হতেন। শারীরিক শক্তিতে এটা ছোটখাট মানুষটা মাঠের যে কারো চেয়ে কম যেতেন না। সে সময় রেফারিতের কাছ থেকে খেলোয়াড়রা এত বেশি সুরক্ষা পেতেন না। ফলে মাঠে নিয়মিত মারপিটের শিকার হতেন ম্যারাডোনা।
বিপরীতে মেসিরা রেফারিদের দারুণ প্রতিরক্ষার সুবিধা পান। আজকের দিনে লিওনেল মেসি বা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে ম্যাচ জুড়ে টানা ফাউল করা হবে, এটা কল্পনাও করা যায় না। তার অনেক আগেই রেফারির কার্ড বেরিয়ে আসবে পকেট থেকে। ফলে দৃশ্যত শারীরিক শক্তি বলতে যা বোঝায়, সেখানে মেসিকে পরীক্ষা দিতে হয় না।
তবে মেসি আবার ভিন্ন ধরনের শক্তির অধিকারী। ম্যারাডোনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ফুটবল খেলতে হয় তাকে। প্রতি সপ্তাহে ম্যাচের পর ম্যাচ খেলতে হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। ইনজুরিতে না পড়ে বছরের পর বছর বার্সেলোনার প্রতিটি ম্যাচ খেলে যাওয়ার এই বিস্ময়কর ক্ষমতা অন্য ধরনের ফিটনেস প্রমাণ করে।
ট্রফি
বার্সেলোনার হয়ে এমন কোনো ট্রফি নেই, যা জেতেননি লিওনেল মেসি। চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি, নয়টি স্প্যানিশ লিগ, চারটি কোপা দেল রে, তিনটি ক্লাব কাপ; ট্রফি আর ট্রফি। সে তুলনায় ম্যারাডোনার ক্লাবে অর্জন খুব বেশি নয়। দুটো সিরি আ, দুটো উয়েফা কাপ এবং আরও কিছু ছোট ট্রফি জিতেছেন তিনি। কিন্তু ম্যারাডোনার কাছে একটা ট্রফি আছে, যা মেসিকে কয়েক যোজন পিছিয়ে রেখেছে।
হ্যাঁ, বিশ্বকাপ।
ম্যারাডোনা দুটো বিশ্বকাপ ফাইনালে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে একটা জিতেছেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমি ফাইনালে তার পারফরম্যান্স ছিলো অতিমানবীয়। এরপর ফাইনাল জেতায় তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্য।
বিপরীতে মেসি তিনটি বিশ্বকাপ এরই মধ্যে খেলে ফেলেছেন; বিশ্বকাপ তো দূরে থাক, জাতীয় দলের হয়ে কোনো ট্রফিই জিততে পারেননি। তবে টানা তিনটি মেজর টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছেন; ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালও আছে এই তালিকায়।
তাহলে মেসি যদি এবার বিশ্বকাপ জিততে না পারেন, তিনি কি এই ট্রফির কারণেই পিছিয়ে থাকবেন?
বলা মুশকিল, পন্ডিতরা একটু অন্যরকম মনে করেন। বিশেষজ্ঞ টিম ভিকারি এক লেখায় দেখিয়েছেন, পার্থক্যটা আসলে একজন হিগুয়েইন ও বুরুচাগার মধ্যে। ভিকারি বলছেন, জার্মানির বিপক্ষে ১৯৮৬ ফাইনালে ফলাফল যখন ২-২, তখনই বুরুচাগা এক ‘সহজ’ গোল করে ম্যাচ জেতালেন। আর গত তিনটি ফাইনালে তার চেয়েও সহজ সুযোগ মিস করলেন হিগুয়েইন।
ভিকারি কল্পনা করতে বলছেন, এমন যদি হতো, সেদিন বুরুচাগা যদি হিগুয়েইন হতেন এবং গত তিনটি ফাইনালে হিগুয়েইন যদি বুরুচাগা হতেন? তাহলে ম্যারাডোনা থাকতেন ট্রফিলেস এবং মেসি এখন একটি বিশ্বকাপ ও দুটি কোপার মালিক!
পার্থক্য তাই মেসি আর ম্যারাডোনার নয়; পার্থক্য একজন হিগুয়েইন আর বুরুচাগা বা ক্যানিজিয়ার। ম্যারাডোনা একটি নিবেদিত দল পেয়েছিলেন, যারা সামর্থ্যের শেষ বিন্দু অবধি খেলতে রাজি ছিলো। আর মেসি পেয়েছেন হিগুয়েইন, প্যালিসিওদের।
তারপরও ট্রফির বিবেচনায় নির্মোহ বিচারে ম্যারাডোনা এই বিশ্বকাপের কারণে এগিয়ে থাকবেন।
নেতৃত্বগুণ
ম্যারাডোনা একজন ক্যারিশমাটিক মানুষ। তার আশেপাশে যে গেছে, সে তার মোহে পড়ে গেছে। তিনি মানুষকে মন খুলে ভালোবাসেন, মন খুলে গালি দিতে পারেন। তিনি চিৎকার করে উজ্জীবিত করতে পারেন। শুধু অধিনায়ক হিসেবে নয়, কোচ হিসেবেও তিনি দেখিয়েছেন, তার সম্পদ ওই চিৎকার করে, বুকে জড়িয়ে, হেসে কিংবা কেঁদে মানুষকে তাতিয়ে তোলা।
ফলে সাধারণ দৃষ্টিতে ম্যারাডোনাকে শ্রেয়তর নেতা বলে মনে হবে। কিন্তু মেসির নেতৃত্বগুণ অন্য জায়গায়। তিনি সামনে থেকে পারফর্ম করে নেতৃত্ব দেন। তিনি বাকিদের সামনে উদাহরণ হয়ে উঠতে চান।
তবে সামগ্রিক বিচারে নেতা হিসেবে ম্যারাডোনা এগিয়ে থাকবেন।
এই গেলো কয়েকটি মানদন্ডে দুজনের তুলনা। কিন্তু দুই যুগের দুই কিংবদন্তীর কি আসলে তুলনা হয়? হয় না বলেই এই বিতর্ক এখানে শেষ হওয়ারও নয়।
এরপরও আলোচনা চলবে- কে সেরা?