রুস্তম কাসিমজানোভ লাইমলাইটে আসেন ২০০৪ সালে ফিদে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার পর থেকে। উজবেক এই দাবাড়ুর আরেক পরিচয় হয়তো অনেকেই জানেন না, তিনি একজন অনবদ্য দাবার কোচও। খেলার মাঠে তিনি যেমন পটু, তেমনই প্রশিক্ষক হিসেবেও তার সাফল্য ঈর্ষণীয়। বয়স চল্লিশের কোঠা ছাড়ালেও ফিদের বর্তমান র্যাঙ্কিং অনুযায়ী তিনি উজবেকিস্তানের এক নম্বর দাবাড়ু। আবার অন্যদিকে সেকেন্ড হিসেবে তিনি বিশ্বনাথন আনন্দকে ২০০৮, ২০১০ এবং ২০১২ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জিততেও সহায়তা করেছেন। এমন প্রথিতযশা এক দাবা প্রতিভার কথাই আজ আমরা জানবো।
রুস্তম কাসিমজানোভ ফাবিয়ানো কারুয়ানার সেকেন্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন ২০১৫ থেকেই, সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপেও তিনি কারুয়ানাকে সাহায্য করেন। লন্ডনে সাউন্ড-প্রুফ কাচের বিপরীতে কার্লসেন আর কারুয়ানা যখন রঙ্গমঞ্চে আসীন, তখন তাদের নিজ নিজ সেকেন্ডদের টিম কিন্তু ঠিকই গেমগুলো অ্যানালাইজে ব্যস্ত! মূল ম্যাচের বারো গেম ৬-৬ এ সমতা হওয়ায় ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ায়, সেখানে ৩-০ তে জয় ছিনিয়ে নেন ম্যাগনাস কার্লসেন। এই ম্যাচ এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে চেসবেইজ-এর এডিটর আন্দ্রে শুলজ মুঠোফোনযোগে রুস্তমের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ৬ ডিসেম্বর, ২০১৮।
আন্দ্রে: ম্যাচ তো শেষ, আপনার অনুভূতি কী এব্যাপারে?
রুস্তম: আমি হতাশ, ম্যাচের মাঝ দিকেও আমাদের ভালো সম্ভাবনা ছিল, বিশেষ করে ষষ্ঠ বা অষ্টম গেমের সময়। যা-ই হোক, আমরা তো শুরুতেও হেরে যেতে পারতাম!
আন্দ্রে: অষ্টম গেমে যেখানে উইনিং চান্স ছিল বলে আপনার মনে হয়, সেটা কি কারুয়ানা যখন Qh5 তে না দিয়ে h3 তে চাল দেন, তখন?
রুস্তম: হ্যাঁ, ঠিক সেই মুহূর্তেই! ফাবির তখন পজিশন যথেষ্ট অনুকূলে ছিল, কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সে ধরতে পারেনি তার চান্সটা। ম্যাগনাসের বোড়েগুলো একটু বেশিই এগিয়ে গেছিল, ফলে তার পজিশনে যথেষ্ট ভেদ্য জায়গা ছিল। সেসময় হলে কোনো একটা নয়েজ আসছিল কোথায় থেকে যেন, বোধ হয় এটা ফাবিকে কিছুটা ডিস্ট্র্যাক্ট করে দেয়। এটা ছিল খেলার একটা ক্রুশাল মোমেন্ট, তখন ক্যালকুলেট করে বুঝে-শুনে চাল দিতে হত। কিন্তু সে বেশ তাড়াহুড়া করে h3-তে চাল দেয়, তেমন চিন্তাভাবনা না করে।
আন্দ্রে: ষষ্ঠ গেমেও একটা উইনিং ট্যাকটিক ফাবি মিস করে যান, যদিও সেটা খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না …
রুস্তম: হ্যাঁ, সেখানেও যথেষ্ট পটেনশিয়াল ছিল। তবে তা খুঁজে পাওয়া যদিও অনেক কঠিন ছিল, তবে অবশ্যই অসম্ভব ছিল না। আসলে এমন সময়ে ম্যাচ বের করে আনতে হলে আপনার মনের জোর থাকতে হবে। ম্যাগনাস অবশ্যই অজেয় নয়! আর আপনাকে মনে ধারণ করতে হবে যে, আপাতদৃষ্টিতে যদিও গেমটা পুরোই ড্র, তবুও জয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু তখন কারুয়ানার খেলা দেখে মনে হচ্ছিল, সে হাল ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে।
আন্দ্রে: শুরুতে রোসোলিমো ভ্যারিয়েশন ট্রাই করলেও পরে ওপেন সিসিলিয়ানে ব্যাক করার আইডিয়া কীভাবে এসেছিল?
রুস্তম: রোসোলিমো ট্রাই করলেও তা তেমন ধোপে টিকছিল না, শুরুর গেমটা লাকি ছিল বলতে গেলে। তবে প্রথমটার পর আর কোনো গেমেই কাজে আসেনি রোসোলিমো। সেজন্যই প্ল্যানে বদল আনা হয়। কারণ দেখা যাচ্ছিল, সেগুলোর জন্য কার্লসেন বেশ ভালোমত প্রস্তুত। ফলশ্রুতিতে সভেশনিকভ ভ্যারিয়েশন ট্রাই করে দেখা হয়, কারণ এটি টপ লেভেলের দাবায় কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়েছে অদ্যাবধি। এসব ছাড়াও দশম গেমে ফাবি সম্ভবত তার প্রিপারেশন ভুলে গিয়েছিলেন।
আন্দ্রে: এটাও কি সম্ভব?
রুস্তম: হ্যাঁ, এরকম ঘটনা আদতে অসম্ভব কোনো ব্যাপার না। এটা যে কারো সাথেই ঘটতে পারে। টপ খেলোয়াড়দের অনেক প্রিপারেশন নিতে হয়, এত বেশি লাইন, এত ধরনের মুভের ভেতর একটু গুলিয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় আসলে। আর একাধিক লাইনের ভেতর গুলিয়ে ফেলার মতো সামান্য ভুল আসলে যে কেউই করে বসতে পারে।
আন্দ্রে: সাদা ঘুঁটিতে ম্যাগনাসের প্রিপারেশন কি অপর্যাপ্ত ছিল? কোনো ঘাটতি নজরে এসেছিল কি?
রুস্তম: বিষয়টা তেমন নয়, ম্যাগনাসের প্রস্তুতি বরাবরের মতোই ছিল। আমার যেটা মনে হয়েছে, ওপেনিং তার জন্য সেরকম জরুরি কিছু নয়। এ কারণে সে ওপেনিংয়ে জোর কম দিয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে তারও প্রিপারেশন কাজে আসেনি। যেমন শুরুতে একসময় ম্যাগনাস কুইন’স গ্যাম্বিট দিয়ে চমক আনেন, কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে তাকে এটা ছেড়ে দিতে হয়।
আন্দ্রে: ম্যাগনাসের ক্ষেত্রে আসলে হচ্ছিল কী? সাদা ঘুঁটিতেও কেন তিনি তার গেমগুলোকে জয়ে পরিণত করতে পারছিলেন না?
রুস্তম: সঠিকটা আমি জানি না। হয়তো ম্যাগনাস টাইব্রেকে সন্তুষ্ট ছিলেন, এর কারণ র্যাপিডে তার নিজের দক্ষতার উপরে তার ভরসা ছিল; এমনও হতে পারে। কারিয়াকিনের সাথের ম্যাচেও আমরা এমনটা দেখেছি, ম্যাগনাস র্যাপিডে যেতে আগ্রহী ছিলেন। আর তার দ্রুতগতির দাবার দখল সত্যিই প্রশংসাযোগ্য, কারণ সে বেশ সহজেই গেমগুলো নিজের করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
আন্দ্রে: ম্যাচ চলাকালীন একটি ভিডিও খুব সম্ভবত ভুলে লিক হয়ে যায়, যেটায় ফাবির প্রিপারেশনেরও কিছু অংশ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এমনকি প্রিপারেশনের ধাঁচও আন্দাজ করা যাচ্ছিল কিছুটা। আপনার কি মনে হয়, ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণে এর কোনো ভূমিকা ছিল?
রুস্তম: না, সত্য বলতে সেটার তেমন ভূমিকা ছিল না।
আন্দ্রে: কত সময় ধরে এবং কীভাবে আপনারা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন এই ম্যাচের জন্য?
রুস্তম: ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের পর থেকেই আমরা ভ্রমণে ছিলাম, কোনো টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছিলাম অথবা কোনো ট্রেনিং ক্যাম্পে ছিলাম। অনেক সময়ই আমরা অনেক দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়েছি, যেমন নিউ ইয়র্কের কাছের হ্যাম্পটনে, এবং রেক্স সিঙ্কফিল্ডেও যেটা কিনা বলতে গেলে একবারে বনের ভেতর। হিসেব করলে দেখা যাবে ক্যান্ডিডেটসের পর আমরা বোধ হয় সাতটা দিনও বাড়িতে কাটাইনি।
আন্দ্রে: ম্যাগনাসের সেকেন্ড কারা কারা এ খবর কি আপনারা পেয়েছেন? পিটার হেইন নিয়েলসেন বাদে আর কে কে আছেন তার দলে?
রুস্তম: লরেন্ট ফ্রেসিনেট, এবং আমরা যতটুকু খবর পেয়েছি দানিয়েল দুবভও আছেন তার সেকেন্ডের টিমে। (এবং পরে জানা যায়, নিলস গ্রান্দেলিউস, ইয়ান গুস্তাফসন প্রমুখও ছিলেন কার্লসেনের টিমে)
আন্দ্রে: আপনাদের টিমের সবার নামই তো জানা, তাই তো …
(সাধারণত সেকেন্ডদের টিম সিক্রেট হিসেবে থাকে, যাতে প্রতিপক্ষ খেলার স্টাইল আন্দাজ করতে না পারে)
রুস্তম: হ্যাঁ, আমি ছাড়াও আছে ইয়ান ক্রিস্তিয়ান কিরিলা, যে এখন লন্ডনে আছে আমাদের সাথে। আর আলেসান্দ্র রামিরেজ এবং লিনিয়ার ডমিঙ্গেজ যুক্তরাষ্ট্রে বসেই সাহায্য করছেন।
আন্দ্রে: মূল ম্যাচে কিন্তু কারুয়ানা কার্লসেনের সাথে সমানে সমানই খেলেছেন। কিন্তু টাইব্রেকে তিনি একদম দাঁড়াতেই পারলেন না ম্যাগনাসের সামনে, এটার কারণ কী মনে হয় আপনার?
রুস্তম: আসলে তার একটা খারাপ দিন গেছে, সত্যি বলতে আমি ভাবিনি সে এভাবে হারবে। কারণ, টাইব্রেকের আগে র্যাপিড দাবায় তাদের স্কোর কিন্তু ইভেন ছিল। কিন্তু সেদিন আসলে ফাবির সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল না।
আন্দ্রে: গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, ম্যাচটা হেরে গেলে ম্যাগনাস দাবাই ছেড়ে দেবেন? আপনার কী মনে হয়?
রুস্তম: তার পরিবার সঠিক ব্যাপার বলতে পারবে, তার বোন মনে হয় কিছু ইঙ্গিত করেছিল। ম্যাগনাস আসলে কোনো ম্যাচই হারতে চায় না।
আন্দ্রে: খেলার ফলাফলে আপনি কি এখনও হতাশ?
রুস্তম: হ্যাঁ, আসলে। অনেকেই অনেকসময় আমাকে অভিনন্দন জানাতে আসে ভালো ফলাফলের জন্য, আমি জানি না কেন। কারণ, আসলে আমরা সেকেন্ডরা প্রায় সবসময় পর্দার আড়ালেই থাকি। আর শুনতে অহংকারী শোনাতে পারে, কিন্তু আমি এর আগে কখনও কোনো বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে হারিনি, যতগুলোতে সেকেন্ড হিসেবে ছিলাম। হারের অভিজ্ঞতা আমার কাছে নতুন সেই হিসেবে।
আন্দ্রে: ফাবির মনের অবস্থা কী এখন?
রুস্তম: ম্যাচ শেষে এখনও আমরা সেভাবে বসিনি, একদিন শুধু ডিনারে এক হয়েছিলাম আমরা যেখানে কারুয়ানার বাবা-মাও ছিলেন। তবে আমাদের আবার বসতে হবে, পুরো বিষয়ে বিশদে আলোচনার জন্য।
আন্দ্রে: আপনারা কি এরপরও একসাথে কাজ করে যাবেন?
রুস্তম: হ্যাঁ, আমাদের কোলাবরেশন এখানেই শেষ নয়। সামনেই গ্র্যান্ড চেস ট্যুর শুরু হয়ে যাবে অতি শীঘ্রই।
আন্দ্রে: আপনার কী মনে হয়, কারুয়ানা কি আবারও চ্যালেঞ্জার হতে পারবেন?
রুস্তম: কেন নয়? সে এখনও টগবগে তরুণ, এখনও দারুণ ফর্মে আছে। আরও উন্নতি করবে সে দিনকে দিন। তবে অবশ্যই কোনো কিছুই এমনি এমনি আসে না। আপনি আগে থেকে বলতে পারবেন না, একটা ক্যান্ডিডেট টুর্নামেন্টে কী হতে পারে! বর্তমান দাবাবিশ্বে অনেক দাবাড়ু আছে ক্যান্ডিডেট হওয়ার যোগ্য। তবে ফাবির চান্স এখনও বেশ ভালো পরিমাণে আছে এটা বলতে পারি।
আন্দ্রে: রুস্তম, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এতটা সময় নিয়ে আমাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার জন্য।
রুস্তম: আপনাকেও স্বাগত!