অনেকেই বলে থাকেন, ফুটবল নাকি জীবনের চেয়েও বড়! আবার অনেকেরই বিশ্বাস, ফুটবল ও জীবন পরস্পরের সমর্থক। দুটি বক্তব্যই হয়তো অত্যুক্তি, কিন্তু এ কথা মানতেই হবে যে, পৃথিবী নামক গ্রহটির একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে ফুটবলের। আর তাই তো, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা’র জায়গা থেকে ফুটবলের সর্বোচ্চ দুই সংস্থা ফিফা ও উয়েফা ‘সে নো টু রেসিজম’ নামের একটি ক্যাম্পেইন পরিচালিত করে আসছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো পৃথিবী থেকে বর্ণবাদের মতো ভয়াবহ ভাইরাসকে চিরতরে উচ্ছেদ করা।
উয়েফার ওয়েবসাইটে গেলে আমরা দেখতে পাব সেখানে পরিষ্কারভাবে লেখা রয়েছে, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বর্ণবাদ, বৈষম্য ও অসহনশীলতা দূর করা উয়েফার কাছে সর্বোচ্চ প্রাধান্যযোগ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফুটবলের ইউরোপীয় সর্বোচ্চ সংস্থাটি শীর্ষ পর্যায়ের সকল প্ল্যাটফর্মের সদ্ব্যবহার করছে জনসাধারণের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও দ্ব্যর্থহীন বার্তাটি পৌঁছে দিতে: বর্ণবাদকে না বলুন!”
কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, ফিফা ও উয়েফার এত আন্তরিক প্রচেষ্টার পরও, ফুটবলের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদের ভয়াবহতার মাত্রা সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত হচ্ছে, আর সর্বোচ্চ সংখ্যক বর্ণবাদের অভিযোগ আসছে ইউরোপীয় ফুটবলেই। মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগেই স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছিলেন ইংল্যান্ড ও ম্যানচেস্টার সিটি ফরওয়ার্ড রহিম স্টার্লিং, যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। সেই রেশ পুরোপুরি কাটার আগেই, সান সিরোতে সিরি আ’র নাপোলি বনাম ইন্টার মিলান বক্সিং ডে ম্যাচে ‘বানর’ বলে চিৎকার ছোঁড়া হয়েছে কালিদৌ কুলিবালিকে লক্ষ্য করে, যা পরিষ্কারভাবেই বর্ণবাদী আচরণকে নির্দেশ করে।
অথচ সেই ১৯৭১ সালের পর প্রথমবারের মতো সিরি আ’র একটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ২৬ ডিসেম্বরে, যা অধিকাংশ ইতালিয়ানের কাছেই পরিচিত সেইন্ট স্টিফেন্স ডে নামে। তাই স্বাভাবিকভাবেই দিনটি ছিল সেই দেশের অগণিত ফুটবলপ্রেমীর কাছে উদযাপনের মতো একটি উপলক্ষ্য। কিন্তু তা আর হলো না। ম্যাচ শুরুর আগে স্টেডিয়ামের বাইরে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে মারামারিতে মারা যান দ্যানিয়েল বেলারদিনেল্লি নামে জনৈক ব্যক্তি। আর তারপর মাঠে খেলা চলাকালীন এমন বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতে হলো নাপোলির সেনেগালি ডিফেন্ডার কুলিবালিকে, যা সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বসেন তিনি, এবং ফলস্বরুপ লালকার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে।
সব মিলিয়ে যে দিনটি ইতালির ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় একটি দিন হয়ে থাকার কথা ছিল, সেটিই এখন রূপ নিয়েছে কলঙ্কজনক এক অধ্যায়ে। সব ইতালিয়ানই হয়তো ভুলে যেতে চাইবেন এই দিনটিকে। কিন্তু চাইলেই কি এত সহজে ভোলা সম্ভব? বর্ণবাদ এমন একটি গুরুতর বিষয়, সাম্প্রতিক অতীতে যাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দগদগে ঘা করে ফেলা হয়েছে। তাই এখন সময় এসেছে একটা এসপার নয়তো ওসপার করার। বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলাটিতেই যদি প্রতিনিয়ত বর্ণবাদের দৃষ্টান্ত দেখা যায়, এ থেকে সহজেই উপলব্ধি করা সম্ভব এই ২০১৮ সালে এসেও পৃথিবী ঠিক কোন পথে এগোচ্ছে।
কী হয়েছিল সেদিন?
সান সিরোতে সেদিন ম্যাচ চলাকালীন ইন্টার সমর্থকরা এতটাই সশব্দে ‘বানর’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল কুলিবালিকে লক্ষ্য করে যে, নাপোলি কোচ কার্লো আনচেলত্তি অন্তত তিনবার ম্যাচ অফিশিয়ালদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন ম্যাচ বন্ধ করার। যদিও ম্যাচ অফিশিয়ালরা তা করেননি, তবে স্টেডিয়ামের সাউন্ড সিস্টেমে তিনবার ইন্টার সমর্থকদের নির্দেশ দেয়া হয় এমন ন্যাক্কারজনক স্লোগান বন্ধ করতে। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেনি ইন্টার সমর্থকরা। ফলে শেষপর্যন্ত মেজাজ হারিয়ে তার খেসারত দিতে হয় কালিবুলিকে। খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর দুটি হলুদ কার্ড দেখার সুবাদে, ম্যাচের ৮১তম মিনিটে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে, আর দশজনের দলে পরিণত হওয়া নাপোলি অতিরিক্ত সময়ে গোল হজমের মাধ্যমে ম্যাচটি হেরে বসে।
প্রতিক্রিয়া
ম্যাচ শেষে দলের হারের জন্য প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের বর্ণবাদী আচরণকে দায়ী করেন আনচেলত্তি। তিনি বলেন, পুরো ম্যাচ জুড়ে এতবার কুলিবালিকে আক্রমণ করা হয়েছিল যে, একসময়ে তার পক্ষে মাথা ঠান্ডা রাখা সম্ভব হয়নি। আর তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেয়ার পর তার দলের অন্য খেলোয়াড়রাও আর পারেনি খেলায় মনোনিবেশ করতে। তবে তার মতে, এই ঘটনায় কেবল নাপোলিই হারেনি, হেরেছে পুরো ফুটবল খেলাই, আরও বৃহদার্থে দেখতে গেলে মানুষের মানবিকতাবোধও। তাই আনচেলত্তি জানিয়েছেন, পরবর্তী সময়ে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে তার দলের খেলোয়াড়রা খেলা বন্ধ করে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে।
কুলিবালির সাথে হওয়া এমন ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন ফুটবল বিশ্বের অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বই। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নামটি অবশ্যই জুভেন্টাস তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ইতালিয়ান ভাষায় একটি পোস্ট দেন তিনি, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় অনেকটা এমন: “পৃথিবীতে, এবং ফুটবলে, সর্বক্ষেত্রেই শিক্ষা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের প্রয়োজন রয়েছে। বর্ণবাদকে না বলছি, সেই সাথে না বলছি যেকোনো ধরনের অবমাননা ও বৈষম্যকেও!“
এর আগে স্টার্লিং অনুরূপ ঘটনার শিকার হওয়ার পর দোষারোপ করেছিলেন সংবাদমাধ্যমকে, বিশেষত সংবাদপত্রকে। তার মতে, সংবাদপত্রের মাধ্যমেই অতি সূক্ষ্মভাবে মানুষের মনে বর্ণবিদ্বেষের বীজ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অবজ্ঞা করতে শেখানো হচ্ছে। তবে সিটিতে তার কোচ পেপ গার্দিওলা অবশ্য দাবি করেন, বর্ণবাদ কেবল ফুটবলেই সীমাবদ্ধ নেই। বর্ণবাদের নজির দেখা যাচ্ছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই। মানুষ আগে মনে করতো, ফুটবলাররা হয়তো এমন ঘটনা থেকে বেঁচে যাবে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বর্ণবাদের হাত থেকে মুক্তি নেই কারোরই!
ইন্টার মিলানের সাজা
কুলিবালির সাথে হওয়া বর্ণবাদী আচরণের ফলে শাস্তি পেয়েছে ইন্টার মিলান। ইটালিয়ান লিগ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লিগে আগামী দুটি ম্যাচ ইন্টার মিলানকে বন্ধ স্টেডিয়ামে, অর্থাৎ শূন্য গ্যালারীর সামনে খেলতে হবে। এখানে জানিয়ে রাখা দরকার, কুলিবালির সাথে ঘটা বর্ণবাদী আচরণ ও তার ফলে কোনো ক্লাবের শাস্তি পাওয়ার ঘটনা কিন্তু এটিই প্রথম নয়। এর আগেও গত অক্টোবরে কুলিবালির সাথে বর্ণবাদী আচরণের ফলে আংশিক স্টেডিয়াম বন্ধ ও ১০,০০০ ইউরো জরিমানা করা হয়েছিল জুভেন্টাসকে।
ফিফার কী বক্তব্য?
২৬ ডিসেম্বর সান সিরোতে যে ঘটনা ঘটেছে, এবং তার প্রতিবাদে সারা বিশ্বের সচেতন মানুষ যেভাবে একজোট হয়ে ঘটনাটির প্রতি নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তাতে ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সে ব্যাপারে সকলেরই আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। এবং বাস্তবিকই বেশ কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ফিফা। জানা গেছে, ফিফার সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো নাকি খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন বিষয়টি। তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন ফিফার রেফারিং প্রধান মাসিমো বুসাচ্চার সাথে, যিনি খুব শীঘ্রই সকল রেফারির কাছে সার্কুলার পাঠিয়ে দেবেন বর্ণবাদ সংস্লিষ্ট ঘটনাকে কঠোর হাতে দমন করতে।
ফিফার বিদ্যমান নীতি কী বলছে?
এমন নয় যে ফিফা সম্প্রতি এ বিষয়ে কঠোর হয়েছে। কাগজে-কলমে অনেক আগে থেকেই ফিফা এ ব্যাপারে কঠোর ছিল। ফিফার বিদ্যমান নীতি বলছে, কোনো দলের সমর্থকগোষ্ঠীর আচরণ যদি বর্ণবাদী হয়, সেক্ষেত্রে রেফারিকে ম্যাচ বন্ধ করতে হবে, এবং স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে হবে তারা যেন একটি লিখিত ঘোষণা পড়ে শোনায়, যেখানে সমর্থকদেরকে শৃঙ্ক্ষলা ও আচরণবিধি মেনে চলার আহবান জানানো হবে।
যদি এমন আচরণ অব্যাহত থাকে, তাহলে রেফারিকে স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষের দ্বারা আরেকটি ঘোষণা দেওয়াতে হবে, এবং ম্যাচ সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত খেলোয়াড়দেরকে ড্রেসিংরুমে পাঠিয়ে দিতে হবে।
এবং সর্বশেষ, আগের দুটি উদ্যোগও যদি সফল না হয়, কিংবা ম্যাচ পুনরায় শুরু হওয়ার এক পর্যায়ে আবারও সমর্থকরা শৃঙ্খলাভঙ্গ করে, তাহলে রেফারিকে ম্যাচটি স্থগিত ঘোষণা করতে হবে।
ফিফার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
উপর্যুক্ত নিয়মাবলি তো অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান রয়েছে, এবং এটি এখন প্রমাণিত সত্য যে সেগুলো কোনো কাজেই আসছে না। সান সিরোর ম্যাচটিতেই যেমন নিয়মাবলি থাকার পরও রেফারি সেগুলো পুরোপুরি অনুসরণ করেনি। তাই ফিফার প্রধান লক্ষ্য থাকবে আগে রেফারিদেরকে নিয়ম মানতে বাধ্য করা। এর পাশাপাশি ফিফার পরিকল্পনা রয়েছে যেসব স্টেডিয়ামের বর্ণবাদ সংস্লিষ্ট অতীত ইতিহাস রয়েছে, সেসব স্টেডিয়ামে পর্যবেক্ষক পাঠানো। কোনো স্টেডিয়ামে যদি এরপরও সমর্থকগোষ্ঠী কর্তৃক বর্ণবাদী আচরণের উদাহরণ চোখে পড়ে, তাহলে ঐ ক্লাবকে সব ধরনের প্রতিযোগিতা থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বহিষ্কৃত হতে হবে।
ঠিক কতটা ভয়ংকর রূপ এই বর্ণবাদের?
অনেকের কাছেই বর্ণবাদ নিয়ে এত আলোচনা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। অনেকেই ভাবতে পারেন, সামান্য দুই-একটি ঘটনা ঘটেছে বলে সেটি নিয়ে এত কথা বলতে হবে? এত সরব হতে হবে? যারা এমনটি ভাবছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, উপরে যে দুটি ঘটনার কথা বলা হয়েছে সেগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে নিয়মিতই বর্ণবাদের দেখা মেলে। বেশিরভাগ ঘটনাই ঢাকা পড়ে যায়, গণমাধ্যম সেগুলোকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে প্রচার করে না। যেহেতু এই ডিসেম্বরেই স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ ও সান সিরোর মতো বিশ্বসেরা দুটি স্টেডিয়ামে, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দুই ক্লাবের খেলোয়াড় এমন আচরণের শিকার হয়েছেন, তাই বিষয়টি নিয়ে এত মাতামাতি শুরু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ইউরোপীয় ফুটবলে বর্ণবাদ একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সেরকমই কিছু ঘটনার কথা সংক্ষেপে জানাচ্ছি।
- শুরু করা যাক বেলজিয়াম দিয়ে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ক্লাব ব্রুগেইতে গিয়ে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছিলেন চার্লেরোই ডিফেন্ডার ফ্রান্সিস এন’গাঙ্গা। ঐ একই মাসে লোকেরেন ও ব্রুগেইতে পরপর দুই ম্যাচে এমন ঘটনার শিকার হওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন স্ট্যান্ডার্ড লিজের উইঙ্গার পল হোসে এম’পোকু।
- বুলগেরিয়ান ক্লাব লেভস্কি সোফিয়াকে জরিমানা করেছিল উয়েফা, এবং নির্দেশ দিয়েছিল দুটি ম্যাচ শূন্য গ্যালারির সামনে খেলার। কারণ, ইউরোপা লিগের প্রাথমিক পর্বে ভাদুজের বিপক্ষে ম্যাচের দুটি লেগেই সহিংস ও বর্ণবাদী আচরণ করেছিল দলটির সমর্থকরা।
- বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানির বিদায় নেয়াটা লজ্জাজনক ছিল বটে। কিন্তু বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে জার্মান ফুটবলে এর চেয়ে বড় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় জাতীয় দল থেকে মিডফিল্ডার মেসুত ওজিলের অবসরের সিদ্ধান্ত। তিনি অবসরের কারণ হিসেবে দায়ী করেন বর্ণবাদী আচরণ ও অশ্রদ্ধাকে। ওজিল বলেন, তার পারফরম্যান্স নিয়ে জার্মান সমর্থকরা যে এত বেশি সমালোচনা করছে, এর কারণ আসলেই তার খারাপ খেলা নয়, বরং তুরস্কের সাথে তার অতীত সম্পর্ক। শ্লেষের সাথে ওজিল জানান, “যখন জিতি তখন আমি জার্মান, কিন্তু হারলেই আমি হয়ে যাই অভিবাসী!”
- ২০১৮ বিশ্বকাপ ফাইনালের দুদিন আগে ক্রোয়েশিয়ার সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ ইগোর স্টিমাচ তার ফেসবুক পেজে ফ্রান্স স্কোয়াডের আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ১৩ জন খেলোয়াড়ের নাম প্রকাশ করেন, এবং প্রত্যেকের নামের পাশে তারা আফ্রিকার যে দেশের সেই দেশের পতাকা জুড়ে দেন। যেমন: এমবাপে (ক্যামেরুন), পগবা (গিনি)। এরপর তিনি প্রথমে ক্রোয়াট ভাষায় ও পরে ইংরেজিতে লেখেন, “কেউ কি জানেন আমরা ফাইনালে আসলে কাদের বিপক্ষে খেলতে চলেছি?” ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ক্ষোভের মুখে তিনি পোস্টটি মুছে ফেলতে বাধ্য হন, কিন্তু পরদিন এক সংবাদমাধ্যমে বলেন, “আমাদেরকে ফ্রান্সের পাশাপাশি পুরো আফ্রিকা মহাদেশের বিপক্ষে খেলতে হবে। তারা (ফ্রান্স) পুরো ১০০ কোটি মানুষের মধ্য থেকে তাদের সেরা একাদশ বেছে নেয়ার সুযোগ পাবে।” এমন বর্ণবাদী আচরণের পরও স্টিমাচকে কোনো ধরনের জরিমানা বা নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়নি, এবং তিনি এখনও একজন টিভি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে চলেছেন।
- ইউরোপা লিগে সুইডিশ দল মালমোর বিপক্ষে এক ম্যাচে দুই মিডজিল্যান্ড সমর্থক একটি ব্যানার নিয়ে গিয়েছিল যেখানে সুইডিশ ক্লাবের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল, “আগামীকাল আবারও নিজেদের শহরেই তোমরা অভিবাসী হয়ে যাবে!” পরবর্তীতে ক্লাব কর্তৃপক্ষ ঐ দুই সমর্থককে নিষিদ্ধ করে।
- ইংল্যান্ডে ২০১৭-১৮ মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে ফুটবল ম্যাচগুলোতে বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক ঘটনার বিরুদ্ধে রিপোর্টের পরিমাণ ১১% বৃদ্ধি পেয়েছে। গত মৌসুমে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে যে ৫২০টি অভিযোগ রিপোর্ট করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৫৩%-ই ছিল বর্ণবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট। এছাড়াও এক জরিপের ফলাফলে জানা যায় যে, দেশটির ৫৪% ফুটবল ভক্তই ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে বর্ণবাদী ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন, কিন্তু ৪০% ভক্তই জানেন না এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কোথায়, কীভাবে রিপোর্ট করতে হবে।
- পুরো বিশ্বকাপ জুড়েই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়ের আধিক্য থাকার দরুণ ফ্রান্সকে টিটকারি শুনতে হয়েছে যে দলটি আসলেই কতটা ‘ফরাসি’। বিশ্বকাপ জয়ের পরও এ নিয়ে কানাঘুঁষা কমেনি, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বেড়েছে। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে নিস স্ট্রাইকার মারিও বালোতেল্লিকে ডিজন সমর্থকদের সাথে অসদাচরণের দায়ে হলুদ কার্ড দেখানোর পর তিনি অভিযোগ এনেছিলেন, ঐ সমর্থকরা নাকি তার সাথে বর্ণবিদ্বেষী আচরণ করেছিল। যদিও লিগ কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে বালোতেল্লিকে দেখানো হলুদ কার্ডটি বাতিল করে, তবে তারা বালোতেল্লির অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ পায়নি, যার কারণে ম্যাচ রেফারি ও ডিজন সমর্থকদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি।
- জানুয়ারিতে ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসের ব্লেইজে মাতুইদি অভিযোগ করেন, তিনি নাকি কাগলিয়ারিতে বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন। ম্যাচ শেষে তিনি বলেন, “আমি এমন ভান করতে পারছি না যে কিছুই হয়নি। আমার সাথে যা হয়েছে তা খুবই লজ্জাজনক। এর বিরুদ্ধে আমাদেরকে অবশ্যই প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে।” পরবর্তীতে তিনি ইনস্টাগ্রাম পোস্টের মাধ্যমে গোটা ঘটনাটি খোলাসা করেন, “আজ আমি ম্যাচ চলাকালীন বর্ণবাদের শিকার হয়েছি। দুর্বল মানুষেরা ঘৃণার মাধ্যমে আমাকে উত্যক্ত করার চেষ্টা করে।” ফরাসি এই খেলোয়াড় আরও জানান, রেফারিকে জানানোর পরও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি, এবং ইতালিয়ান ফেডারেশনও কাগলিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তবে ক্লাবটি দায় স্বীকার করে মাতুইদির কাছে ক্ষমা চেয়েছিল।
- জানুয়ারিতে একটি ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে স্পেনের স্পোর্টিং গিজন ক্লাবের সমর্থকদের বলতে শোনা যায়, “আমরা কোনো কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়কে দলে চাই না। আমরা মারেও (দলটির যুব ফুটবল অ্যাকাডেমি) থেকে খেলোয়াড় চাই। গিজনের জন্য গর্বিত।” এরও দুই বছর আগে এই গিজনের মাঠেই ইনাকি উইলিয়ামসকে লক্ষ্য করে বানর গালি ছোঁড়া হয়েছিল, যার ফলে লিগ কর্তৃপক্ষ ক্লাবটিকে ১৮,০০০ ইউরো জরিমানা করেছিল। কিন্তু পরে স্পেনের ক্রীড়া আদালতে এই জরিমানা বাতিল করা হয়, এবং বলা হয়: মাঠে যা ঘটেছে তার জন্য ক্লাবকে সরাসরি দায়ী করা যাবে না, কেননা ক্লাবের পক্ষ থেকে সমর্থকদেরকে আচরণবিধি মেনে চলার আহবান জানানো হয়েছিল।
- রাশিয়া বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচে সুইডেনের খেলোয়াড় জিমি দুরমাজ একটি ফ্রি-কিক কনসিড করেছিলেন, যা থেকে লক্ষ্যভেদের মাধ্যমে ম্যাচ জিতে নিয়েছিল জার্মানি। সুইডেনের অনেক সমর্থকই বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি, এবং তারা অনলাইনে জিমির বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণ প্রদর্শন করতে শুরু করে। এর প্রতিবাদে সুইডেনের পুরো জাতীয় দলের স্কোয়াড একসাথে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছিল, “ফাক রেসিজম!”
শেষ কথা
উপরের ঘটনাগুলো নিছকই হাতেগোনা কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। কিন্তু বাস্তবে ইউরোপীয় ফুটবলে এমন বর্ণবাদের দৃষ্টান্ত দেখা গেছে আরও অনেক বেশি। প্রায় সকল দেশের ঘরোয়া ফুটবলই জর্জরিত হয়েছে বর্ণবাদের অভিযোগে। তাই এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইউরোপীয় ফুটবলে বর্ণবাদ অবশ্যই একটি গুরুতর সমস্যা। এবং সমস্যাটি যে ফুটবলের মাঠ ছাপিয়ে গোটা ইউরোপীয় জীবনধারাতেই প্রভাব ফেলছে, সেটিও চরম সত্য। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশের আভ্যন্তরীণ সংকট, যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়ের ফলে প্রচুর মানুষ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে অভিবাসী হিসেবে প্রবেশ করছে ইউরোপের দেশগুলোতে। কিন্তু ইউরোপের মানুষের অভিবাসীদের ব্যাপারে কেমন দৃষ্টিভঙ্গি, ফুটবল খেলার বর্ণবাদ যেন সেটিরই একটি প্রামাণ্য চিত্র।
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়ুন-
১) The Manager: Inside the Minds of Football’s Leaders
২) The Football Book
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/