বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার।
এই সৈকত থেকে শহরের ভেতরে একটু এগিয়ে গিয়ে মুমিনুল হকদের বাড়ি। ছোটবেলা থেকে সাগরের গর্জন শুনে বড় হয়েছেন। কখনো সাগরের রুদ্র রূপ দেখেছেন। তাই জীবনের ঝড়ঝঞ্চা মুমিনুল হককে খুব একটা টলাতে পারে না। বাজে সময়েও খুব একটা ভেঙে পড়েন না। আবার ভালো সময়েও খুব উচ্ছ্বসিত হন না।
বেশ কিছুদিন ধরে টেস্টেও নিজের প্রকৃত রূপটা দেখাতে পারছিলেন না। সে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা নেই এই বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের। আবার এখন সময়টা ভালো হতে শুরু করেছে। তিন বছর পর আবার ওয়ানডে দলে ডাক পাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ নিয়েও উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছেন না বাহাতি এই ব্যাটসম্যান। বলছেন, সুযোগ পেলে সেটা আনন্দের খবর হবে; তবে তার চেয়ে বেশি হবে একটা দায়িত্ব। সুযোগ পেলে সেই দায়িত্বটা কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে আবির্ভাবের শুরু থেকে মুমিনুল হককে দেশের সেরা প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানদের একজন বলে মনে করা হয়। টেস্টে তিনি নিজের সেই সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেছেন অনেকবার। একটা সময় অবধি বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের সাথে তুলনা হচ্ছিলো মুমিনুল হকের।
টানা ১১ টেস্টের কোনো না কোনো ইনিংসে কমপক্ষে পঞ্চাশ রানের ইনিংস ছিলো তার। আর একটা টেস্ট এই রেকর্ডটা ধরে রাখতে পারলে সর্বকালের সেরাদের তালিকায় নাম তুলে ফেলতে পারতেন। ক্যারিয়ারের প্রথম ১৪ টেস্ট শেষেও তার ব্যাটিং গড় ছিলো ৬০.০০। তখন তার গড়ের সাথে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের গড়ের তুলনা চলতো প্রায়শ!
টেস্টেও এই গড়টা ধরে রাখতে পারেননি; সেটা আজকের যুগে প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। তবে টেস্টের চেয়েও মুমিনুলের জন্য বড় একটা খারাপ ব্যাপার হলো, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তিনি একেবারে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছিলেন। বলা হচ্ছিলো, তিনি টেস্ট ব্যাটসম্যান। এই তকমাটা তার শরীরে লাগিয়ে দেওয়ায় ওয়ানডেতে আর সুযোগই হচ্ছিলো না।
এটা ঠিক, যে ২৬টা ওয়ানডে খেলেছেন, তাতে কখনোই খুব বলার মতো কিছু করতে পারেননি। মাত্র ৩টি ফিফটি আছে তার এই ফরম্যাটে। কিন্তু এই ২৬টা ম্যাচেও কখনো একটা নির্দিষ্ট ব্যাটিং পজিশনে থিতু হতে পারেননি। ৩ থেকে ৮ নম্বর অবধি ওঠা নামা করতে হয়েছে তাকে। শেষ অবধি ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে দল থেকে বাদই পড়ে গেছেন। আর এর মধ্যে সুযোগ আসেনি।
অথচ এই সময়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে পরপর দুটি মৌসুমে অসামান্য ক্রিকেট খেলেছেন, রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। গত বিপিএলেও দারুন পারফর্ম করেছেন। তারপরও কপাল খোলেনি মুমিনুলের। অবশেষে মুমিনুল সেই সুদিনটা দেখতে পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। আসছে এশিয়া কাপের প্রাথমিক দলে রাখা হয়েছে তাকে।
শুধু প্রাথমিক দলে রাখাটাই শেষ কথা নয়। জাতীয় দল নির্বাচন যারা করেন, তাদের কিছু সূত্র জানাচ্ছে, এশিয়া কাপের মূল দলেও জায়গা হয়ে যেতে পারে তার। এক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে সম্প্রতি শেষ হওয়া আয়ারল্যান্ড সফরে ‘এ’ দলের হয়ে একদিনের ম্যাচে মুমিনুলের খেলা ১৮২ রানের ইনিংস।
এই ইনিংস দেখার পর নির্বাচকরা অনেকে মনে করছেন, জাতীয় দলের ওয়ানডেতে তিন নম্বর সমস্যার সমাধান হতে পারেন মুমিনুল। সাকিব আল হাসানকে আপাতত তিন নম্বরে খেলিয়ে কিছু উপকার পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তাতে ৫ নম্বর জায়গাটা আবার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তাই সাকিবকে পাঁচেই পাঠিয়ে মুমিনুলকে তিন নম্বরে খেলানোর একটা চিন্তা কাজ করছে।
প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু অবশ্য এখনই মুমিনুলকে জাতীয় দলে খেলানো হবে আবার, এমন নিশ্চয়তা দিচ্ছেন না। তবে তিনি স্বীকার করলেন যে, মুমিনুল খুব ভালোভাবে তাদের বিবেচনায় আছেন। এশিয়া কাপ দলে তাকে নেওয়া হতে পারে, এমন সম্ভাবনা থেকেই তাকে ‘এ’ দলের অধিনায়ক করে পাঠানো হয়েছিলো বলে বলছিলেন প্রধান নির্বাচক।
নান্নু বলছিলেন, মুমিনুলের প্রতিভায় তাদের কখনোই আস্থার অভাব ছিলো না। সেই আস্থা থেকেই তাকে দলে রাখা হয়েছে,
“আমরা ওকে কখনোই বিবেচনার বাইরে রাখিনি। সে খুব ট্যালেন্টেড ব্যাটসম্যান। আমরা ওয়ানডেতে এরকম একজনকে প্রয়োজন মনে করছি বলেই তাকে ‘এ’ দলের অধিনায়ক করে পাঠানো হয়েছে। সে ভালোমতো বিবেচনায় আছে বলে তাকে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো।”
মুমিনুলকে দলে রাখার ব্যাপারে নির্বাচকরা অবশ্য আরেকজনের মতামতের ওপর নির্ভর করছেন- কোচ স্টিভ রোডস। রোডস এরই মধ্যে মুমিনুলকে টেস্টে দেখেছেন। সেই সাথে তার খেলা দেখে এসেছেন নিজে আয়ারল্যান্ডে গিয়ে। ফলে ক্যাম্প শুরু হলে কোচের মতামত নিয়েই একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে নান্নু বলছিলেন,
“ওর ব্যাপারে আমরা ইতিবাচক। তবে কোচের একটা মতামত আছে। কোচ আয়ারল্যান্ডে গিয়েছিলেন। ক্যাম্প শুরু হলে ওর উন্নতিটা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।”
কিন্তু মুমিনুল নিজে কী ভাবছেন?
এই দীর্ঘ ওয়ানডে বিরতি স্বাভাবিকভাবেই তাকে হতাশ করার কথা। বিশেষ করে সর্বশেষ বিশ্বকাপে যেভাবে তাকে নিয়ে ছেলেখেলা করা হয়েছে, তাতে একটা অভিমান থাকার কথা। কিন্তু মুমিনুল নিজে কখনোই এসব আলাপে আগ্রহী নন। তিনি বরং বলছিলেন, তার সীমাবদ্ধতার কারণেই তিনি ওয়ানডে দলে সুযোগ পাচ্ছিলেন না।
মুমিনুলের মত হলো,
“আমার শটস ছিলো খুব লিমিটেড। এত কম শট নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দীর্ঘদিন ভালো করা কঠিন। ওয়ানডেতে এটা আরও দ্রুত সমস্যা তৈরি করে। তাই ওয়ানডে দলে ছিলাম না। এটা নিয়ে আমি কাজ করেছি। এখন যদি শটস বাড়াতে পারি, টেস্টেও তার প্রভাব পড়বে। ওয়ানডেতেও একসময় না একসময় সুযোগ আসবে।’
এখন অবশ্য সুযোগ এসেছে সেসব স্মৃতি পেছনে ফেলে আসলেই সামনে তাকানোর। মুমিনুল নিজেও টের পাচ্ছেন ওয়ানডের আবার এই হাতছানিটা। তিনি বলছেন, যদি সেই সুযোগটা আসে, তাহলে আনন্দের চেয়ে বেশি জরুরি হলো সেটাকে কাজে লাগানো। টেস্টের সাথে মিলিয়ে তিনি বলছেন, এটা হলো প্রতিদিন নতুন করে শুরু করার মতো ব্যাপার। ওই ১৮২ রানও তার সাথে থাকবে না, খারাপ সময়ও থাকবে না। তাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। সেই শুরুর অপেক্ষায় আছেন এই ব্যাটসম্যান,
“সুযোগ পেলে তো অবশ্যই খুশি হবো। তবে তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, সুযোগ পেলে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। এটাও টেস্টের মতো। প্রতিদিন নতুন খেলা। প্রতিদিন নতুন করে শুরু করতে হবে আমাকে। আশা করি সেটা করতে পারবো। আর তাহলেই ডাক পাওয়াটা কাজে লাগবে।”
এবার মুমিনুলকে এই আরেকটা সুযোগের দুয়ারে এনে দিলো আয়ারল্যান্ড সফর। বিদেশের মাটিতে তার অধিনায়কত্ব, ব্যাটিং; সবই প্রশংসিত হচ্ছে। আয়ারল্যান্ড সফরকে মুমিনুল নিজে অবশ্য বলছেন, তার জীবনের অন্যতম সেরা শিক্ষার একটা জায়গা। এখান থেকে তিনি অনেক কিছু শিখে এসেছেন বলে বলছিলেন।
১৮২ রানের ওই ইনিংসটা না খেললেও এই সফরটাকে তিনি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন বলে দাবি করছিলেন মুমিনুল হক,
“এখানে আমি অনেক কিছু শিখেছি। ভিন্ন একটা কন্ডিশনে কিভাবে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলা যায়, সেটা আমাকে একেবারেই নতুন করে শিখতে হয়েছে। আমি অনেক ধরনের শটসও করেছি। আমার ধারণা, আমার ক্যারিয়ারে এই সফরটা খুব উল্লেখযোগ্য একটা শিক্ষার জায়গা হয়ে থাকবে।”