ক্রিকেট, সমগ্র উপমহাদেশে এই জ্বর এতো তীব্রভাবে বিরাজমান, দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও এই উন্মাদনায় চাপা পড়ে যায় খুব সহজে। ভারতে ক্রিকেটকে ধর্মের মতো করে পালন করা হয়, বাংলাদেশে একমাত্র এই ক্রিকেটই গোটা জাতিকে এক ছাদের নিচে দাঁড় করাতে পারে। রাতারাতি এই দিনটি আসেনি বাংলাদেশে, এসেছে দীর্ঘ এক রাস্তা অতিক্রম করার পর। সেই রাস্তায় ছিলো চড়াই-উতড়াই, ছিলো সৌভাগ্যের ছোঁয়া, ছিলো কূটনৈতিক সাফল্য-ব্যর্থতার সহাবস্থান। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ পায়ের নিচের মাটি শক্ত করার চেষ্টা করেছে, নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছে বাইশ গজে। অবশেষে ফল দিতে শুরু করেছে এই দীর্ঘ অপেক্ষার, উঁকি দিতে শুরু করেছে এক নতুন সূর্যের আলোকরশ্মি।
এখন আর বাংলাদেশকে ‘মিনোজ’ ডেকে অবজ্ঞা করা হয় না। সংবাদ সম্মেলনে এখন আর কোনো দল ম্যাচ-পূর্ববর্তী সম্মেলনে বলার সাহস করে না চিরাচরিত সেই কথা, “বাংলাদেশকে আমরা কোনোভাবেই ছোট করে দেখছি না।” উপরন্তু মাঠে নামার আগে আমরা এখন বাকযুদ্ধে নামতে দু’বার ভাবি না, আমরা অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো কুলীনতম সদস্যদেশকে চোখ রাঙাতে পারি, মুখোমুখি লড়াইয়ে ইটের বদলে পাটকেল ফিরিয়ে দিতে পারি। উন্নতি যে আমাদের হয়েছে, সেটা এখন গোটা বিশ্বের কাছেও স্পষ্ট।
তবু কেন যেন সবার কাছে ব্যাপারটা ঠিক স্পষ্ট নয়। সর্বশেষ মিরপুর টেস্টে খেলতে নামার আগেও বাংলাদেশ টেস্ট র্যাংকিংয়ে ছিলো নয় নম্বরে, অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান ছিলো চার নম্বরে। অস্ট্রেলিয়া শিবিরও হয়তো ভেবে উঠতে পারেনি, টাইগারদের পরবর্তী শিকার হতে পারে তারাও! এই টেস্টের আগে ক’জনই বা বিশ্বাস করতে পেরেছিলো, ‘অসাধ্য’ সাধন করবে বাংলাদেশ?
অসাধ্য? এক ধাপ পিছিয়ে আসতেই হচ্ছে। অসাধ্য কেন হবে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো? তারা তো অপরাজেয় নয়! তারা এমন দুর্দান্ত কোনো পারফরম্যান্সও করে আসেনি এখানে আসার আগে। আর তাছাড়া সাকিব আল হাসান তো সিরিজ শুরুর আগেই ভবিষ্যদ্বক্তা বনে গিয়ে বলে বসেছিলেন, “এই সিরিজ ২-০ ব্যবধানেও জেতা সম্ভব আমাদের পক্ষে!” সাকিব কোত্থেকে পেয়েছিলেন এতোটা সাহস, এতোটা আত্মবিশ্বাস?
পেয়েছিলেন নিজেদের সামর্থ্য থেকে, নিজেদের উপর বিশ্বাস থেকে। তারা জানতেন তাদের শক্তিমত্তার জায়গাটা, তারা জানতেন প্রতিপক্ষের দুর্বলতার কথা। তারা জানতেন, নিজেদের সম্পূর্ণ উজাড় করে দিতে পারলে তারা ঠিক কতটা ভালো খেলতে পারেন। আর বাংলাদেশ যেদিন ভালো খেলে, সেদিন তাদের হারানো যে কতটা কঠিন, সেটা এখন সমগ্র বিশ্বেরই জানা!
এতক্ষণ যতটা শুনলাম, সবই চর্বিতচর্বন। কিন্তু ঠিক পরিষ্কার হলো না, বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করার পর কেন শচীন টেন্ডুলকারের মতো জীবন্ত কিংবদন্তী এই পরাজয়কে ‘অঘটন’ বলে আখ্যা দেবেন? অস্ট্রেলিয়ার এই পরাজয় কি সত্যিই স্রেফ ‘অঘটন’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়? এই প্রশ্নের উদয় হতে না হতেই ইএসপিএন ক্রিকইনফো দারুণ বিশ্লেষণী একটি লেখা উপহার দিয়েছে, যেখানে চারটি মূল কারণের কথা বলা হয়েছে, যার জন্য বাংলাদেশের এই জয়কে স্রেফ ‘অঘটন’ আখ্যা দেওয়াটা উচিত নয়। সেটার সাথেই আরও কিছু খুঁটিনাটি যোগ করেই কিছুটা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এ লেখায়, বুঝতে চাওয়া হয়েছে সত্যিই এই জয়টি অঘটন, নাকি নিরেট বাস্তবতা।
অস্ট্রেলিয়ার ‘উপমহাদেশ-জুজু’
এই বছরের শুরুতে ভারত-সফরে দারুণ শুরু করেও সেটা ধরে রাখতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। প্রথম টেস্টে ৩৩৩ রানের বিশাল ব্যবধানে ভারতকে হারিয়ে সিরিজ শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকে ২-১ ব্যবধানে পরাজিত হতে হয়। বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির এই উদাহরণটি স্রেফ একটি ব্যতিক্রম নয়, বরং গত পাঁচ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়াতে অস্ট্রেলিয়ার নিয়মিত চিত্র এটিই। ২০১৬ সালে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাওয়া শ্রীলংকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হওয়া, ২০১৪ সালে আরব আমিরাতে পাকিস্তানের কাছে সিরিজ হারা কিংবা ২০১৩ সালে ভারতের বিপক্ষে পরাজয়; পরিষ্কারভাবেই বুঝিয়ে দেয়, দক্ষিণ এশিয়ার মাটিতে ঠিক স্বচ্ছন্দ নয় অস্ট্রেলিয়া।
যদি পরিসংখ্যান দিয়েই বুঝাতে হয়, তবে গত পাঁচ বছরে এশিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট খেলেছে সাকুল্যে ১২টি। আর এই ১২টি ম্যাচের মধ্যে একটিমাত্র টেস্টেই জয়লাভ করেছে তারা, হ্যাঁ, ভারতের বিপক্ষে এই বছরের শুরুতে ঐ ম্যাচটি দিয়েই গত পাঁচ বছর ধরে চলমান এশিয়ার মাটিতে জয়খরা কাটিয়েছিলো স্টিভ স্মিথের নেতৃত্বাধীন দলটি।
শুধু গত পাঁচ বছরের কথাই না তুলে বাংলাদেশের মাটিতে এর আগে খেলা শেষ সিরিজেই ফতুল্লা স্টেডিয়ামে কোনোক্রমে তিন উইকেটের জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। বলা বাহুল্য, সিরিজটি হয়েছিলো ২০০৬ সালে এবং অস্ট্রেলিয়ার সেই দলটিকে তখনও রীতিমতো অপ্রতিরোধ্যই বলা চলে। তবু তারা বাংলাদেশের মতো উদীয়মান টেস্ট দলের বিপক্ষে ভুগেছিলো। আর এবার যখন তারা সফরে এসেছে, বাংলাদেশ দলে রয়েছে তামিম ইকবালের মতো এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা ওপেনার, বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, ‘বিস্ময়বালক’ হিসেবে খ্যাত মুস্তাফিজুর রহমান, অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম, উদীয়মান তরুণ মেহেদী হাসান মিরাজসহ আরও অনেকে। এই দলটি আর যা-ই হোক না কেন, শক্তিমত্তার দিক থেকে কোনো অংশেই অস্ট্রেলিয়া থেকে পিছিয়ে নেই।
অভিজ্ঞতার লড়াই
বাংলাদেশের প্রথম ছয়জন ব্যাটসম্যানের সাকুল্যে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে ১৯৯টি টেস্ট, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটি মাত্র ১৬৮টি। মাত্র দু’জন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানের পঞ্চাশের বেশি টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে: ডেভিড ওয়ার্নার এবং স্টিভ স্মিথ। অন্যদিকে তামিম-সাকিব-মুশফিক তিনজনেরই পঞ্চাশ বা তদুর্ধ্ব টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে অভিজ্ঞতার দিক থেকেও অস্ট্রেলিয়ার এই দলটি বাংলাদেশের তুলনায় বেশ পিছিয়ে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
মিরপুরে টসভাগ্য এবং বাংলাদেশ
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ টসে জিতেও টেস্ট হেরেছে, এমন দৃষ্টান্ত মাত্র দুইটি। অন্যদিকে টসে জিতে ব্যাটিং করতে নেমে জয়ের দৃষ্টান্ত রয়েছে চারটি। ফলে এটা মোটামুটি পরিষ্কার, টস জিতলে মিরপুরে বাংলাদেশেরই ফেভারিট হিসেবে মাঠে নামার কথা। তবে মুদ্রার অন্য পিঠে, টসে হেরেছে এমন টেস্টে বাংলাদেশের জয়ের দৃষ্টান্ত মাত্র একটি, অন্যদিকে পরাজয় দুটি।
নিজেদের মাঠে শক্তিশালী বাংলাদেশ
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই সিরিজের আগে বাংলাদেশ শেষ হোম সিরিজ খেলেছিলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেই সিরিজে প্রথম ম্যাচে জয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেও মাত্র ২২ রানে পরাজিত হয় বাংলাদেশ, এরপর দ্বিতীয় টেস্টে ইতিহাস গড়ে টেস্ট জেতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
একটু পেছন ফিরে তাকাই। মিরপুরে দ্বিতীয় টেস্টে টসে জিতে ব্যাটিং করতে নেমে ২২০ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ, সেঞ্চুরি করেন তামিম ইকবাল। এরপর সফরকারী দল ব্যাটিংয়ে নামলে গত ম্যাচেই অভিষিক্ত মেহেদী হাসান মিরাজের ৬ উইকেটের সৌজন্যে গুটিয়ে যায় মাত্র ২৪৪ রানেই। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করতে নেমে শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডকে ২৭৩ রানের টার্গেট ছুঁড়ে দেয় বাংলাদেশ। জবাবে ব্যাটিং করতে নেমে শতরানের ওপেনিং জুটি গড়েন অ্যালিস্টেয়ার কুক এবং বেন ডাকেট, দু’জনের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েই লাঞ্চ ব্রেকে যায় দুই দল। তবে লাঞ্চ ব্রেক শেষ হওয়ার পর নাটকীয়ভাবে বদলে যায় গোটা ম্যাচের দৃশ্যপট, মাত্র ৬৪ রানের মধ্যেই ইংল্যান্ড হারায় তাঁদের ১০ উইকেট। সেখানেও নায়ক সেই দুজন- মেহেদী মিরাজ এবং সাকিব আল হাসান! ২৭৩ রানের ‘ছোট্ট’ টার্গেট ছুড়ে দেওয়া বাংলাদেশই সেই টেস্ট জিতেছিলো ১০৮ রানে!
এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে মুস্তাফিজুর রহমানের দুর্দান্ত বোলিংয়ের সৌজন্যে ৭৮ রানের লিড নিতে সক্ষম হয়েছিলো। দুটো ঘটনাই বুঝিয়ে দেয়, ঘরের মাঠে টেস্ট ক্রিকেটেও যথেষ্ট শক্তিশালী বাংলাদেশ। কিন্তু প্রশ্ন যদি ওঠে, বাংলাদেশ কেন ঘরের মাঠে শক্তিশালী?
স্পিন-সহায়ক উইকেট
গত পাঁচ বছরে স্পিন বোলিংয়ের মোকাবেলা করা নন-এশিয়ান দেশগুলোর জন্য হয়ে উঠেছে বেশ চ্যালেঞ্জিং। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে কোয়ালিটি স্পিনারের সংখ্যা নেহায়েত কম, একজন নাথান লায়ন কিংবা ইমরান তাহিরের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। তাদেরকেও সাবকন্টিনেন্টে কিছুটা যেন স্ট্রাগল করতে হয় পারফর্ম করার জন্য। তাছাড়া ব্যাটিংয়েও খুব কম ব্যাটসম্যানই আছেন, যারা সাকিব-মিরাজ-তাইজুলকে নিয়ে গঠিত বৈচিত্র্যময় এবং কোয়ালিটি স্পিন অ্যাটাককে সহজে সামলাতে পারেন।
আর নন-এশিয়ান দেশের ব্যাটসম্যানদের এই দুর্বলতার কথা খেয়াল রেখেই দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের দেশগুলো স্পিনসহায়ক পিচ প্রস্তুত করে থাকে। এই জালেই এর আগে ধরা পড়েছে ইংল্যান্ড, এবার টাইগারদের নতুন শিকার অস্ট্রেলিয়া। কে জানে, বৃষ্টিবিঘ্নিত না হলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টেও হয়তো দারুণ কিছু হতে পারতো!
প্রতিপক্ষের রূপান্তরকাল
এই পয়েন্টটি হয়তো কিছুটা বিতর্কের জন্মও দিতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্য দলগুলোর যদি ট্র্যানজিশনাল পিরিয়ড চলতে থাকে, তাহলেও সেটার পিছনে তো আর বাংলাদেশের হাত নেই! নিঃসন্দেহে নেই, এবং এতে করে বাংলাদেশের কৃতিত্বও কিছুমাত্র কমে যায় না। তবু এই পয়েন্টটি অন্তর্ভুক্ত করার কারণ, ইয়াহু ক্রিকেট বাংলাদেশের এমন নজরকাড়া সাফল্যের পেছনে একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে এটিকে। তাদের মতে, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা ইংল্যান্ডের গৌরবময় অতীতের সঙ্গে বর্তমান দলের পারফরম্যান্সের পার্থক্যটা বিশাল, তাদের সেই চিরাচরিত ঐতিহ্যের ছায়াটুকুও বর্তমান দলে অনুপস্থিত প্রায়। উপরন্তু, বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলা দলের বেশ কিছু খেলোয়াড়ের স্কিল নিয়েও কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে।
তর্কসাপেক্ষে আমরা মেনেই নিলাম, অন্যদের টিমের কোয়ালিটি খারাপ ছিলো বলেই বাংলাদেশ ভালো করেছে। তবু সেই সুযোগটা আমরা নিতে শিখেছি, প্রতিপক্ষ সামান্যতম ভুল করলেও আমরা এখন সেটিকেই শক্তিতে পরিণত করে নিতে শিখেছি। এটাই বা কম কীসে? একটা সময় ছিলো, যখন সামান্য একটি সিরিজের ম্যাচ জিতলেই গোটা মাঠে আমরা ‘ল্যাপ অফ অনার’ দিয়ে ফেলতাম। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক এক টেস্ট জয়ের পর দলের কোনো ক্রিকেটারেরই বিন্দুমাত্র অতি-উচ্ছ্বাস চোখে পড়েনি, যেন একেবারেই ডালভাত একটা ব্যাপার! বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছে, তারই বিশেষ এক নিদর্শন যেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই মহাকাব্যিক জয়টি।
ভারসাম্যপূর্ণ দল
গত বেশ কিছু বছর ধরেই বাংলাদেশের এই দলটি একসাথে খেলছে। তারা নিজেদের সম্পর্কে এখন খুব ভালোভাবে জানে; তাদের শক্তিমত্তা, সামর্থ্য এবং সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে প্রত্যেকেই দারুণভাবে ওয়াকিবহাল। প্রত্যেকেই জানে দলে নিজের ভূমিকাটুকু, সবাই জানে কার পক্ষে কতটুকু করা সম্ভব। আর এভাবেই ড্রেসিংরুমে গড়ে উঠেছে দারুণ একটি পরিবেশ, যা তাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা আরও ভালো করে তুলেছে।
গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দল, জিততে জিততেও হেরে গিয়েছে অনেকবার। চোখ বন্ধ করলে এখনও এশিয়া কাপ ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২ রানের পরাজয় কিংবা ভারতের বিপক্ষে ৪ বলে ২ রান নিতে না পারার ব্যর্থতার কথা ভেসে উঠতে পারে। আরেকটু দূরে গেলে শ্রীলংকার বিপক্ষে রুবেল হোসেনের বলে মুত্তিয়া মুরালিধরনের হঠাৎ ‘ব্যাটসম্যান’ হয়ে ওঠার স্মৃতিটুকুও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ২০১৪ সালে একের পর এক ম্যাচে খুব কাছাকাছি গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে, পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে হয়েছে বারবার। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছে দলটি, আগুনে পুড়ে হয়েছে খাঁটি সোনা!
দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হলো ম্যাচ-উইনারের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো হারে বৃদ্ধি পাওয়া। স্থিতধী একটি টিম কম্বিনেশনের কারণে দলের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে খুব ভালো করে জানে। দলে দু’জন কোয়ালিটি ওপেনিং ব্যাটসম্যান এবং সলিড মিডল অর্ডার থাকাতে দল নিয়মিত ভালো করতে শুরু করেছে।
সাকিব এবং তামিমের জুটি
বিশ্বের যেকোনো অধিনায়ক তার দলে সাকিব আল হাসান এবং তামিম ইকবালের মধ্যে যেকোনো একজনকে পেলেই কৃতার্থ বোধ করতে পারেন। বাংলাদেশের পরম সৌভাগ্য, এই দুজনই লাল-সবুজ পতাকার নিচেই খেলেন। ওপেনিংয়ে তামিমের আধিপত্য, ব্যাটে-বলে সাকিবের মুন্সীয়ানা– একজন অধিনায়ক এর চেয়ে বেশি আর কী-ইবা চাইতে পারেন?
দক্ষিণ এশিয়ার টেস্টে রান করার জন্য সেরা সময়টা হলো নতুন বল নেয়ার পর। বল যত পুরোনো হয়, টার্ন আর রিভার্স সুইং তত ছোবল দিতে শুরু করে। নতুন অবস্থায় কাঠিন্যের কারণে বল সহজে ব্যাটে আসে এবং স্ট্রোক খেলতে তুলনামূলক সুবিধা হয়। ঠিক এমন মুহূর্তে তামিম ইকবালের মতো ধারাবাহিক, সহজাত স্ট্রোকমেকার, আঁটসাঁট টেকনিকের আগ্রাসী, আধিপত্য বিস্তারকারী এবং একই সাথে সংবেদনশীল একজন ব্যাটসম্যানকে যদি পাওয়া যায়, যেকোনো দলের জন্যই সেটা প্লাস পয়েন্ট হতে বাধ্য!
আর সাকিব আল হাসান! তাকে নিয়ে আসলে এতো কথা বলা হয়ে গেছে, এতো বিশেষণ দেওয়া হয়ে গেছে, তবু যেন সেটা শেষ হতে চায় না। আর নিজে মুডে থাকলে যে তিনি কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারেন, সেটা অস্ট্রেলিয়াকে জিজ্ঞেস করলেই বোধ করি তারা সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন। শেষ চারটা দিন তো আর কম ধকল গেল না তাদের উপর দিয়ে!
ওয়ার্ল্ড ক্লাস স্পিনারদের বসতি
বাংলাদেশে আর যা-ই হোক না কেন, বিশ্বমানের স্পিনারদের অভাব কখনোই হয়নি। এনামুল হক মনি, মোহাম্মদ রফিক থেকে শুরু করে হালের মেহেদী হাসান মিরাজ কিংবা তাইজুল ইসলাম, বাংলাদেশের মাটিতে বরাবরই প্রতিপক্ষের ইনিংসে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে স্পিনাররাই।
বাঁহাতি স্পিনের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে মোহাম্মদ রফিকের উত্তরসূরী হিসেবে এসেছেন আবদুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসান, এনামুল হক জুনিয়র, তাইজুল ইসলামরা। সৌভাগ্যজনকভাবে, প্রত্যেকেই বিশ্বমানের, নিজের দিনে যেকোনো ব্যাটিং লাইনআপকে ধ্বসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন এবং দারুণ বৈচিত্র্যময়। আর সম্প্রতি এই বাঁহাতি স্পিনারদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ডানহাতি অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ। সব মিলিয়ে দারুণ বৈচিত্র্যময় এবং আগ্রাসী একটি বোলিং লাইনআপ রয়েছে বাংলাদেশের।
এতো এতো ফ্যাক্ট আর তত্ত্বের পরও কেউ যদি বলেন, বাংলাদেশের জয়টা স্রেফ একটি ‘অঘটন’ ছিলো, তার উদ্দেশ্যে সত্যিই আর তেমন কিছুই বলার থাকে না। শুধু একটা কথা বলে দেওয়াটাই যথেষ্ট: টেস্ট ক্রিকেটে আসলে ‘অঘটন’ ঘটিয়ে জেতা সম্ভব হয় না। মাত্র ২০ রানে জিতেছে বাংলাদেশ, এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে বাংলাদেশ পুরো ম্যাচেই দারুণ আধিপত্য বিস্তার করেই জিতেছে। অস্ট্রেলিয়ার বাইরে তিন বছর পর হান্ড্রেড করতে সক্ষম হয়েছেন ডেভিড ওয়ার্নার, ছিলেন দারুণ ছন্দে। সাথে বেশ ভালোই সঙ্গ দিচ্ছিলেন বর্তমান বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট ব্যাটসম্যান স্টিভ স্মিথ। সেই অস্ট্রেলিয়াকেই ২ উইকেটে ১৫৮ থেকে শেষ পর্যন্ত ২৪৪ রানে অলআউট করেছে বাংলাদেশ, শেষ আট উইকেট পড়েছে মাত্র ৮৬ রানে। ঠিক একইভাবে ইংল্যান্ডকেও নিজেদের মাটিতে মাত্র ৬৪ রানের মধ্যে ১০ উইকেট নিয়ে গুটিয়ে দিয়ে জিতেছিলো বাংলাদেশ।
ভুলে গেলে চলবে না, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টের ঠিক আগের টেস্টেই শ্রীলংকার মাটিতেই স্বাগতিকদের হারিয়ে এসেছে বাংলাদেশ, প্রমাণ করেছে বিদেশের মাটিতেও তাঁদের সামর্থ্য। এটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা, বাংলাদেশের সামর্থ্য। ফলে ‘অঘটন’, ‘ফ্লুক’, ‘আপসেট’ কিংবা ‘মিরাকল’, যেটাই বলা হোক না কেন, সত্যিটা হলো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই টেস্টে বাংলাদেশ জিতেছে যোগ্য দল হিসেবেই। আর ভবিষ্যতেও চলতেই থাকুক এই জয়যাত্রা, এটাই হোক কাম্য!