১.
মার্টিন ক্রোর চৌকস নেতৃত্বগুণে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে নিউ জিল্যান্ড অপ্রতিরোধ্য ছিল। আসরের শুরুতে তাদের ফেভারিট হিসেবে ধরা না হলেও অধিনায়ক ক্রো তার বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বে দলকে ধারাবাহিক সফলতা এনে দিচ্ছিলেন। বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো রঙিন জার্সি ব্যবহার করা হয়েছিল ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে। রঙিন জার্সি গায়ে বিশ্বকাপের এই আসরকে আরও রাঙিয়ে তোলে ক্রোর নিউ জিল্যান্ড। ওয়ানডেতে তিনি স্পিনারকে দিয়ে বোলিং উদ্বোধন করার সাহস দেখিয়ে সফল হয়েছেন। ওপেনার মার্ক গ্রেটব্যাচকে পিঞ্চ হিটার হিসেবে খেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে করে পাওয়ার-প্লের ১৫ ওভারে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দিতে পারেন।
গ্রুপ পর্বে নিউ জিল্যান্ড প্রথম সাত ম্যাচের সবকটিতে জয় পেয়েছিল। গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে এসে পরাজয়ের স্বাদ পায় তারা। স্বাভাবিকভাবে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তারা। সেমিফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। ভাগ্যের সহায়তায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে শেষদল হিসেবে সেমিফাইনালের টিকেট পেয়েছিল ইমরান খানের পাকিস্তান। গ্রুপ পর্বের প্রথম পাঁচ ম্যাচে তাদের জয় মাত্র একটি। তা-ও আইসিসির সহযোগী দেশ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। জিম্বাবুয়ে বিপক্ষে দুই পয়েন্ট এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভাগ্যগুণে এক পয়েন্ট পেয়েছিল তারা। গ্রুপ পর্বে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাট করে মাত্র ৪৭ রানে আট উইকেট হারানোর পর শেষপর্যন্ত ৭৪ রান সংগ্রহ করে। জবাবে ইংল্যান্ড এক উইকেটে ২৪ রান তোলার পর বৃষ্টির কারণে ম্যাচ আর মাঠে গড়ায়নি, যার দরুন পাকিস্তান মহামূল্যবান ১ পয়েন্ট পায়।
আসরের শুরুতে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও শেষ তিন ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং নিউ জিল্যান্ডকে পরাজিত করে অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টপকে টুর্নামেন্টের শেষ চারে জায়গা করে নিয়েছিল পাকিস্তান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে বৃষ্টির বদৌলতে এক পয়েন্ট না পেলে শেষ তিন ম্যাচে জয় পেলেও গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে হতো পাকিস্তানকে।
২.
১৯৯২ সালের ২১ মার্চ। অকল্যান্ডে বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় পাকিস্তান এবং নিউ জিল্যান্ড। গ্রুপ পর্বে নিউ জিল্যান্ড আট ম্যাচের মধ্যে শুধুমাত্র পাকিস্তানের কাছেই পরাজিত হয়েছিল। অন্যদিকে টানা তিন জয়ে সেমিফাইনালের টিকেট পেয়েছিল পাকিস্তান। নিউ জিল্যান্ডের অধিনায়ক মার্টিন ক্রো টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
নিউ জিল্যান্ডের ওপেনার মার্ক গ্রেটব্যাচ পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই পাওয়ার-প্লের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করেছিলেন। এদিনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ওয়াসিম আকরাম এবং আকিব জাভেদের বলে দুটি ছয় হাঁকিয়ে শুরুটা ভালোই করেছিলেন গ্রেটব্যাচ। তবে নিজের ইনিংসকে বড় করতে পারেননি তিনি। ব্যক্তিগত ১৭ এবং দলীয় ৩৫ রানের মাথায় আকিব জাভেদের দুর্দান্ত স্লোয়ারে বোল্ড আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন তিনি। তার বিদায়ের পর আরেক ওপেনার জন রাইটও বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি।
দলীয় ৩৯ রানের মাথায় দুই ওপেনারের উইকেট হারানোর পর ক্রিজে আসেন অধিনায়ক মার্টিন ক্রো। দুর্দান্ত ছন্দে থাকা ক্রো এদিনও দলের হাল ধরেছিলেন। প্রথমে অ্যান্ড্রু জোন্স, এবং পরে কেন রাদারফোর্ডের সাথে জুটি গড়ে রানের চাকা সচল রেখেছিলেন তিনি।
চতুর্থ উইকেট জুটিতে ক্রো এবং রাদারফোর্ড ১০৭ রান যোগ করে দলকে ভালো অবস্থানে পৌঁছে দেন। রাদারফোর্ড ৬৮ মিনিট ক্রিজে থেকে ৬৮ বল মোকাবেলা করে পাঁচটি চার এবং একটি ছয়ের মারে ৫০ রান করে ফিরে গেলেও পাকিস্তানের বোলারদের বেশ দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেছিলেন ক্রো। শেষপর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো বোলারের হাতে ধরা দেননি তিনি। তার ইনিংসের সমাপ্তি ঘটে রান আউটের মধ্য দিয়ে। ৮৩ বলে সাতটি চার এবং তিনটি ছয়ের মারে ৯১ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
তার বিদায়ের পর শেষদিকে ইয়ান স্মিথের দশ বলে অপরাজিত ১৮ রানের উপর ভর করে নিউ জিল্যান্ড নির্ধারিত ওভার শেষে সাত উইকেটে ২৬২ রান সংগ্রহ করে। ওয়াসিম আকরাম এবং মুশতাক আহমেদ দুটি উইকেট শিকার করলেও অধিনায়ক ইমরান খান দশ ওভারে ৫৯ রান খরচায় উইকেটশূন্য ছিলেন।
৩.
তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ানডেতে ২৬৩ রানের লক্ষ্য তাড়া করে ম্যাচ জেতা বেশ কঠিন কাজই ছিল। পাকিস্তানের লড়াই শুধুমাত্র নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষেই ছিলো না। স্নায়ুচাপ ঠিক রেখে তাদের লড়াই করতে হয়েছে স্বাগতিক নিউ জিল্যান্ডের দর্শকদের বিপক্ষেও। তবে নিজেদের ইনিংসের শুরুতে তারা একটি ভালো সংবাদ পেয়েছিল, যা নিউ জিল্যান্ডের জন্য ছিলো ট্রাজেডি। পুরো টুর্নামেন্টে দলকে বিচক্ষণতার সাথে নেতৃত্ব দেওয়া মার্টিন ক্রো ব্যাটিং করার সময় হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরিতে পড়েন। ফলে ফিল্ডিংয়ের সময় মাঠে নামতে পারেননি তিনি।
মার্টিন ক্রো মাঠে না থাকলেও, তার দেখানো পথে নিউ জিল্যান্ডের হয়ে বোলিং উদ্বোধন করেন অফস্পিনার দীপক প্যাটেল। ব্রেক-থ্রু এনে দিতেও বেশি সময় নেননি। পাকিস্তানের ৩০ রানের উদ্বোধনী উইকেট জুটি ভাঙেন ১৪ রান করা আমির সোহেলকে সাজঘরে ফেরত পাঠিয়ে। এরপর তিন নাম্বারে নামা অধিনায়ক ইমরান খান দলের হাল ধরলেও বেশ ধীরগতিতে ব্যাটিং করছিলেন। তিনি ৪৪ রান তুলতে বল খেলেছিলেন ৯৩টি। এর আগে রমিজ রাজাও ৪৪ রান করেছিলেন। ইমরান খান দলীয় ১৩৪ রানে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে এবং সেলিম মালিক দলীয় ১৪০ রানে চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে সাজঘরে ফিরে গেলে চাপের মুখে পড়ে পাকিস্তান। তখনও জয়ের জন্য ১৫ ওভারে ১২৩ রান প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের।
১৯৯২ সালের ওয়ানডে ক্রিকেটে শেষ ১৫ ওভারে ১২৩ রান তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। তাই অনেকেই নিউ জিল্যান্ডের ফাইনাল খেলার প্রতিচ্ছবি দেখে ফেলেছিল। এমন সময় ক্রিজে আসেন মাত্র ২২ বছর বয়সী ইনজামাম-উল হক। তিনি দেখেশুনে খেলার কোনো সময় পাননি। নিজের ইনিংসের শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে থাকেন। তার অকল্পনীয় ইনিংসের পথে প্রথম ঝড় বয়ে যায় ক্রিস হ্যারিসের উপর। লেগ সাইডে দুর্দান্ত দুটি শট খেলার পর লং-অনে চোখ ধাঁধানো একটি ছয় হাঁকিয়েছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক জন রাইট আক্রমণে আনলেন অফস্পিনার প্যাটেলকে। তিনিও রেহাই পাননি। প্রথম আট ওভারে ২৮ রানের বিনিময়ে এক উইকেট শিকার করা এই বোলার শেষপর্যন্ত নিজের বোলিং কোটা শেষ করলেন ৫০ রান খরচ করে। ক্রিস হ্যারিস ছিলেন সবচেয়ে খরুচে। তিনি দশ ওভার বল করে ৭২ রানের বিনিময়ে এক উইকেট শিকার করেছিলেন।
৪.
ইনজামাম-উল হক রান আউট হয়ে সাজঘরে ফেরার আগে ৩৭ বলে সাতটি চার এবং একটি ছয়ের মারে ৬০ রানে ইনিংস খেলেছিলেন। ইনিংসে তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১৬২.১৬। সেসময়ে বিশ্বকাপের ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করে কমপক্ষে ৫০ রান করেছে এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট ছিলো তার। তিনি পঞ্চম উইকেট জুটিতে মাত্র দশ ওভারে ৮৭ রান যোগ করেছিলেন জাভেদ মিয়াঁদাদের সাথে। জুটিতে জাভেদ মিয়াঁদাদের ভূমিকা ছিল তাকে স্ট্রাইক দেওয়া, যে কাজটি মিয়াঁদাদ বেশ ভালোভাবেই করেছিলেন।
ইনজামামের বিদায়ের পর পাকিস্তানের জয়ের জন্য পাঁচ ওভারে ৩৬ রানের প্রয়োজন ছিল। উইকেটরক্ষক মঈন খানের ১১ বলে অপরাজিত ২০ রানের ক্যামিও ইনিংসের পাশাপাশি জাভেদ মিয়াঁদাদের অপরাজিত ৫৭ রানের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ের উপর ভর করে এক ওভার এবং চার উইকেট হাতে রেখে জয় তুলে নিয়েছিল পাকিস্তান। নিউ জিল্যান্ডের নিয়মিত অধিনায়ক মার্টিন ক্রো ড্রেসিংরুমে বসে পাকিস্তানের জয়োৎসব দেখছিলেন। তিনি অবশ্য পরে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক জন রাইটকে দোষারোপ করে বলেছিলেন, তার পরিকল্পনা ভুল ছিলো।
সেমিফাইনালে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন ইনজামাম-উল হক। অনেকের মতে, পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ব্যাটসম্যান ইনজামাম। রেকর্ড তার পক্ষেই কথা বলে। ২২ বছর বয়সী ইনজামাম তার আগমনী বার্তা দিয়েছিলেন ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। তার দুর্দান্ত ইনিংসের উপর ভর করেই পাকিস্তান প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে। এরপর ফাইনালেও দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে দলকে শিরোপা জিততে সাহায্য করেন তিনি।
অথচ নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ইনজামামের খেলার কথা ছিলো না। পেট খারাপ থাকার পাশাপাশি ভীষণ অসুস্থ ছিলেন তিনি, তাই ম্যাচের আগের দিন রাতে অধিনায়ক ইমরান খানকে বলেছিলেন, “আমার মনে হয় আমি খেলতে পারবো না”। তারপর একপ্রকার জোর করেই ইনজামামকে খেলতে পাঠিয়েছিলেন ইমরান খান। তিনি বলেছিলেন, “তুমি অন্যকিছু নিয়ে ভাববে না। শুধু ভাবো ম্যাচে তুমি কেমন খেলবে।” শেষপর্যন্ত ইনজামাম খেললেন। শুধুমাত্র একাদশে থেকেই অধিনায়কের কথা রাখলেন না। ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস খেলে অধিনায়কের অগাধ বিশ্বাসের প্রতিদান দিলেন। এই ইনিংসের কল্যাণেই শেষপর্যন্ত পাকিস্তান প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।