১.
আশরাফুল– খুব সম্ভবত বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের সুপারস্টার। তবে ক্যারিয়ারটা মসৃণ ছিল না কখনোই। অনেক চড়াই উৎরাই শেষে নিষিদ্ধ হলেন পাঁচ বছরের জন্য। দর্শকদের মনে আশরাফুলকে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল। কেউ কেউ আশরাফুলের শাস্তিকে সঠিক মনে করেছে, আবার কেউ ভাবছে ‘লঘু পাপে গুরু দণ্ড’। একই অবস্থা পাঁচ বছর শেষে নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পরও।
নিষেধাজ্ঞা শেষ করে ফেরার সাথে সাথেই একদল মানুষ তাকে জাতীয় দলে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আরেকদল মানুষ আবার আশরাফুলকে যেন কখনোই জাতীয় দলে নেওয়া না হয় সেটার পক্ষে কথা বলে যাচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এই দুই পক্ষের কেউই কিন্তু আশরাফুলের কথা চিন্তা করে তাকে জাতীয় দলে নিতে চাচ্ছে কিংবা বাদ দিতে চাচ্ছে এমন কিছু নয়। যিনি নিতে চাচ্ছেন তিনিও ভাবছেন যে, আশরাফুল দলে আসলে দলের জন্য ভালো হবে, আর যিনি নিতে চাচ্ছেন না তিনিও ভাবছেন যে, এই দলে সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা আশরাফুলের নেই। দুই পক্ষই শেষপর্যন্ত দলের উপকারই চাচ্ছেন।
এখন সত্যিকার অর্থেই আশরাফুলকে দলে নিলে সেটা দলের জন্য ভালো হবে নাকি খারাপ- সেটা নিয়েই এই আলোচনা।
২.
কখনো ব্যবসা করেছেন? ব্যবসার অভিজ্ঞতা অনেকেরই না থাকার কথা। তবে ব্যবসা সম্পর্কে বেসিক ধারণা নিশ্চয়ই সবার আছে। একটা ব্যবসা শুরু করার আগে সেটা সম্পর্কে শুরুতে পর্যাপ্ত ধারণা নেওয়া জরুরি। আর শুরুতেই একটা বিষয়ে মানসিক প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন- বিনিয়োগ উঠিয়ে আনতে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ব্যবসার প্রথম কত বছরে মূলধন উঠে আসবে সেই সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা নেওয়া হয়। কোনো ব্যবসায় ৫ বছর, কোনো ব্যবসায় হয়তো ১ বছর। ব্যবসার যে পর্যায়ে মূল টাকাটা উঠে আসে সেই পর্যায়কে বলা হয় ব্রেকইভেন পয়েন্ট (Breakeven point)। এই পয়েন্টে পৌঁছানোর পর যদি আপনি ব্যবসা বন্ধ করে দেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনার লাভ-ক্ষতি সমান। বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই খুব দ্রুত ব্রেকইভেন পয়েন্টে পৌঁছুতে চায়, কারণ এর পর থেকেই লাভের মুখ দেখা শুরু। তবে ভুল ব্যবসায় পা দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূলধন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।
ক্রিকেটে নির্বাচকদের কাজটা অনেকটা এই ব্যবসায়ীদের মতোই। কোন খেলোয়াড়কে সুযোগ দিবে কিংবা কাকে বাদ দেবে সেটা তারা বাছাই করে ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তরুণ খেলোয়াড়দেরকে সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য একটাই যে, তারা একবার দলে সেট হয়ে যেতে পারলে দীর্ঘদিন সার্ভিস দিতে পারবে। সেই হিসেব থেকেই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল আশরাফুল নামের এক খেলোয়াড়কে। অভিষেক টেস্টেই ১১৪ রানের একটা ইনিংস খেলে খুব সুন্দর একটা সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু কালক্রমে নানা কারণেই কলিটা আর পরিপূর্ণ ফুল হয়ে ফুটতে পারেনি।
খুব সম্ভবত বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বেশি সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড় আশরাফুলই।
আশরাফুলের সমস্যাটা আসলে কী? ম্যাচ ফিক্সিংকে খুব বড় সমস্যা হিসেবে ধরা উচিত নয়। এটার জন্য যে শাস্তি পাওয়া উচিত, বোধকরি তার চেয়ে বেশিই পেয়ে গিয়েছেন তিনি। আশরাফুলের মূল সমস্যা হচ্ছে, তিনি চরম মাত্রার অধারাবাহিক। এতটাই অধারাবাহিক যে, টেস্ট ক্রিকেটে পর পর দুই ইনিংসে পঞ্চাশোর্ধ্ব রান করার কৃতিত্ব নেই তার। ওয়ানডে ক্রিকেটে টানা দুই ইনিংসে পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার রেকর্ড মাত্র দুবার, টানা ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার রেকর্ড মাত্র ৮ বার।
১৭৫টি ওয়ানডে ম্যাচে মাত্র ২২.২৩ গড় আর ৬১টি টেস্টে মাত্র ২৪.০০ গড়ের অধিকারী কোনো ব্যাটসম্যানকে আর যা-ই হোক, একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান বলা উচিত নয়। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে আশরাফুল বারবার প্রমাণ করেও গিয়েছেন যে, তার উপর আর যা-ই করা হোক, নির্ভর করা যায় না।
পরিসংখ্যান বলে, আশরাফুলকে নিয়ে ঝুঁকিটা নিয়ে নির্বাচকরা ভুল না করলেও, এত বেশি সুযোগ দিয়ে ভুলই করেছিলেন।
৩.
কিন্তু ঐ যে একটা কথা আছে না, ‘পরিসংখ্যান একটা গাধা’, সেই আলোকেই মাঝে মাঝে পরিসংখ্যানে পিছিয়ে থাকার পরেও আশরাফুলকে নিয়ে আশা দেখা হয়। পরিসংখ্যান আসলে সব কিছু বোঝাতে পারে না। ঠিক যেমন পরিসংখ্যান কখনোই এটা বোঝাতে পারবে না যে, একসময় বাংলাদেশের জয় আর আশরাফুল মোটামুটি সমার্থক ছিল। আশরাফুল প্রতিদিন ম্যাচ জেতাতে পারতেন না। তবে তিনি বাদে ম্যাচ জেতা হবে না- এটা পূর্ব নির্ধারিতই ছিল।
তাছাড়া নির্বাচকদের হাতে সেই মূহুর্তে খুব বেশি বিকল্পও ছিল না। বাংলাদেশের অনেক প্রথম জয়ে আশরাফুলের অবদানগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক-
- অস্ট্রেলিয়া – ১০০
- সাউথ আফ্রিকা – ৮৭
- শ্রীলংকা – ৫২
- নিউজিল্যান্ড – ৬০*
- জিম্বাবুয়ে – ৫১
- ওয়েষ্ট ইন্ডিজ (টি ২০) – ৬১
সেই সময়টাতে তাই আশরাফুলকে সুযোগ দেওয়াটা একেবারে অযৌক্তিক সেটা বলা যাবে না। তাছাড়া বয়সটাও আশরাফুলের পক্ষে ছিল। যে সময়ে আশরাফুল নিষিদ্ধ হলেন, সেই সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৮/২৯, যখন কি না একজন ব্যাটসম্যানের পরিপূর্ণ হবার সেরা সময়। সেই সময়টাতেই আমরা আশরাফুলকে অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে হারিয়েছি।
আশরাফুল থাকলে কি বাংলাদেশ দলের উপকার হতো?
বলার উপায় নেই। তবে এই সময়টাতে যারা সুযোগ পেয়েছেন তারাও কিন্তু বেশিরভাগই নিজেদের সেভাবে তুলে ধরতে পারেননি।
৪.
বাংলাদেশের বর্তমান দলে কি আশরাফুলের জায়গা আছে?
খুব স্পর্শকাতর একটি প্রশ্ন। বিশেষ করে আগের প্রজন্মের কাছে আশরাফুল এক আবেগের নাম। তবুও আবেগ সরিয়ে নিরপেক্ষভাবে কিছু বলার চেষ্টা করা যাক।
প্রথম কথা হচ্ছে, এই দলে আশরাফুলের ভূমিকা কী হবে? বাংলাদেশ দল এই মুহূর্তে মোটামুটি ধারাবাহিক একটি দল। এই দলে আশরাফুলের মতো একজন অধারাবাহিক ব্যাটসম্যান এসে দলের ভারসাম্যটাই না নষ্ট করে ফেলেন! অথবা এমনটাও হতে পারে যে পরিপক্ব এবং অভিজ্ঞ আশরাফুল এবার দলে সুযোগ পেয়ে ধারাবাহিক হয়ে যাবেন। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এই সম্ভাবনা খুবই কম। বরং তার চেয়ে একজন নতুন খেলোয়াড়ের প্রতি বিনিয়োগ করাটাই নিরাপদ।
প্রশ্ন হচ্ছে, আশরাফুল-পরবর্তী যাদেরকে নিয়ে নির্বাচকরা ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তাদের মাঝে কতজন সফল হয়েছেন? সাব্বির আহমেদ ৫৪টি ওয়ানডে ম্যাচে সুযোগ পেয়েও ব্যর্থ। অন্য কেউও সুযোগ পেয়ে নিজেকে যথেষ্ট পরিমাণ তুলে ধরতে পারছেন না।
আশরাফুলকে দলে নেওয়ার পক্ষে কেবল একটা ফ্যাক্টরই যৌক্তিক। সমশক্তি কিংবা কাছাকাছি শক্তির দলের বিপক্ষে জয়ের জন্য বাংলাদেশ দল এই মুহূর্তে প্রস্তুত। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শক্তিমত্তায় অনেকটা এগিয়ে থাকা দলের বিপক্ষে জয় পাওয়ার জন্য এখনো বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষের ব্যর্থতার দিকেও তাকিয়ে থাকতে হয়। আশরাফুল হচ্ছে সেই ক্ষণজন্মা ব্যাটসম্যানদের মাঝে একজন যিনি কি না তার নিজের দিনে মহাশক্তিধর দলকেও হারাতে পারবেন। আশরাফুল-পরবর্তী বাংলাদেশ এই ধরনের কেবলমাত্র একজন ব্যাটসম্যানকেই পেয়েছে, তিনি সৌম্য সরকার।
যে অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশ হারিয়েছিল, অনেকের মতেই সেই অস্ট্রেলিয়া সর্বকালের সেরা ওয়ানডে দল। সেই ম্যাচের পর দুই দলের মাঝে আরো অনেক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ দল আগের চেয়ে অনেক উন্নতি করেছে। অস্ট্রেলিয়া দলও আগের চেয়ে অনেক দুর্বল হয়েছে। কিন্তু এরপরেও আর কোনো ম্যাচে বাংলাদেশের জয় পাওয়া হয়নি। কারণ, এখন পর্যন্ত দুই দলের মাঝে যে ব্যবধানটুকু রয়েছে, সেটা পূরণ করার মতো খেলোয়াড় বাংলাদেশ দলে এই মূহুর্তে নেই। কিন্তু আশরাফুল এই কাজটুকু করতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপ খেলবে তখন একটা পর্যায়ে গিয়ে এমন কঠিন ১-২টি ম্যাচ অবশ্যই পড়বে। সেই ম্যাচগুলো পার করার জন্য আশরাফুলের মতো দুই-একজন খেলোয়াড় দলে থাকা প্রয়োজন। নির্বাচক এবং অধিনায়ক যদি সেই বিবেচনা করেন, তাহলে আশরাফুলকে দলে রেখে একটা ঝুঁকি নিতে পারেন।
৫.
আপনি কোন বিষয়টাকে প্রাধান্য দেবেন? ৫ ম্যাচ খেলে পাঁচটিতেই খুব ভালোভাবে লড়াই করে হেরে যাওয়া, নাকি চারটাতে গো হারা হেরে একটাতে জয় পাওয়া?
একটা সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বাজেভাবে ম্যাচ হারতো এবং কিছু কিছু ম্যাচে জয়ের খুব কাছাকাছি গিয়েও হেরে যেত। বহুদিন পর পর পাওয়া জয়গুলো তাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই সময়টাতে আশরাফুলের ইনিংসগুলো (যদিও সেটা অনেকদিন পর পর আসতো) কার্যকরী এবং প্রয়োজনীয় ছিল।
এখন নির্বাচকরা নতুন এবং তরুণ কোনো খেলোয়াড়কে সুযোগ দিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিনিয়োগ করতে পারেন। কিংবা বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে আশরাফুলকেও সুযোগ দিতে পারেন।
যা-ই করা হোক, বক্তব্য হচ্ছে উদ্দেশ্যটা যেন পরিষ্কার থাকে। খুব বড় ধরনের অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা না ঘটলে আশরাফুলের কাছ থেকে ধারাবাহিকতা আশা করাটা অমূলক। দলে নিলে তার বড় ম্যাচের পারফর্মেন্সের কথা মাথায় রেখেই নিতে হবে, নতুবা তার জায়গায় নতুন কাউকে সুযোগ দেওয়াটাই শ্রেয়।
ব্যবসায় ঝুঁকি আছে, নির্বাচকরাও এক্ষেত্রে হয়তো ঝুঁকি নেবেন। সেটা নতুন খেলোয়াড়কে সুযোগ দিয়ে কিংবা আশরাফুলকে নতুনভাবে সুযোগ দিয়েও হতে পারে।
তবে উপরওয়ালার কাছে সবার প্রার্থনা একটাই, যেটাই হোক, সেটা যেন বাংলাদেশ দলের জন্য কল্যাণই বয়ে আনে।
Feature Image: goromcha.com