ক্রিকেটে মূল দলে থাকা এগারোজন ক্রিকেটারের ব্যাটিং করার ঘটনা নিয়মিত ঘটলেও এগারোজন ক্রিকেটারের সবাই এক ইনিংসে বোলিং করার ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। কারণ উইকেটরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ক্রিকেটাররা গ্লাভস, প্যাড খুলে বল হাতে নিয়েছেন এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না। তাছাড়া এমন অনেক ব্যাটসম্যান রয়েছেন, যারা বড়জোর অনুশীলন করার সময় শখের বশে হাত ঘোরান। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে তাদের বল হাতে দেখা যায় না।
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তো অধিনায়কেরা পার্টটাইম বোলারদের হাতেও বল তুলে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেন। ক্রিকেটের এই ফরম্যাটে একটি বাজে ওভার বদলে দিতে পারে অনেককিছু। সেক্ষেত্রে টেস্ট ক্রিকেটে এরকম সম্ভাবনা নেই। তবে কোনো দলই চাইবে না প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে ছেড়ে কথা বলতে। এজন্য দলের সেরা বোলারদেরকে দিয়েই বল করাতে পছন্দ করেন অধিনায়কেরা।
এমন অনেক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বোলারদের জন্য বাড়তি কোনো সুযোগ সুবিধাই থাকে না। ব্যাটসম্যানরা ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাটিং করে যান নির্বিঘ্নে। এক্ষেত্রে অধিনায়ক দলের স্বীকৃত বোলারদের বিশ্রাম দিতে এবং কোনো অঘটন ঘটে যাবে এমন আশায় অনিয়মিত বোলারদের আক্রমণে আনেন। সবমিলিয়ে একাদশের পাঁচজন ক্রিকেটারের জায়গায় সাতজন কিংবা আটজন ক্রিকেটারের বোলিং করার ঘটনা প্রায় নিয়মিতই ঘটে।
তবে দলের এগারোজন ক্রিকেটারদের মধ্যে দশজন ক্রিকেটারের বোলিং করার ঘটনা ক্রিকেটবিশ্ব মাত্র চৌদ্দবার দেখেছে, যার সবকটি ঘটনা ঘটেছে টেস্ট ম্যাচে। এই ১৪টি টেস্টে কোনো দল জয় পায়নি। ম্যাচ শেষ হয়েছিলো ড্রয়ের মধ্যে দিয়ে। এসব ম্যাচে বোলারদের জন্য বাড়তি কোনো সুবিধাই থাকে না। তাই অধিনায়কেরা বাধ্য হয়েই একের পর এক বোলার পরিবর্তন করে থাকেন।
আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে দলের এগারজন ক্রিকেটারের সবার বোলিং করার ঘটনাও ঘটেছে। এখন পর্যন্ত চারবার এই ঘটনার সাক্ষী হয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব। এই চার ম্যাচও নিষ্প্রাণ ড্র হয়েছিলো। এই চার ম্যাচ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসা যাক।
ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া (১৮৮৪)
আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের সবেমাত্র ১৬ তম ম্যাচ। ওভালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ব্যাট করতে নেমে ইংলিশ বোলারদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানরা। অধিনায়ক উইলিয়াম মারডকের দ্বিশতকের পাশাপাশি পার্সি ম্যাকডোনেল এবং টাপ স্কটের শতকের উপর ভর করে অস্ট্রেলিয়া রানের পাহাড় গড়ছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক লর্ড হ্যারিস একে একে দলের সব ক্রিকেটারকে আক্রমণে আনলেন। তিনি নিজে আক্রমণে আসলেন দলের নবম বোলার হিসেবে। শেষপর্যন্ত উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান আলফ্রেড লিতেলটনকে দলের দশম বোলার হিসেবে আক্রমণে আনেন তিনি।
ইনিংস শেষে আলফ্রেড লিতেলটনই দলের সেরা বোলার ছিলেন। তখনকার সময়ে চার বলে এক ওভার হতো। সে হিসেবে লিতেলটন ১২ ওভার বল করে ১৯ রান খরচায় ৪ উইকেট শিকার করেছিলেন। তার পরে দলের ১১তম বোলার হিসেবে আক্রমণে আসেন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান আর্থার শ্রেউসবারি। তিনি তার ২৩ টেস্টের ক্যারিয়ারের ঐ একবারই বল হাতে আক্রমণে এসেছিলেন। ১৮৮৪ সালের ১১ই আগস্ট শুরু হওয়া এই টেস্ট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া তাদের প্রথম ইনিংসে ৩১১ ওভার (চার বলে এক ওভার) ব্যাটিং করে ৫৫১ রান সংগ্রহ করেছিলো। জবাবে ইংল্যান্ড ব্যাট করতে নেমে ১৮১ রানে ৮ উইকেট হারানোর পর দশ নাম্বারে নামা ওয়াল্টার রেডের ১১৭ রানের ইনিংসের উপর ভর করে প্রথম ইনিংসে ৩৪৬ রান সংগ্রহ করেছিলো। অল্পের জন্য ফলো-অন এড়াতে না পারলেও শেষপর্যন্ত সহজেই ম্যাচ ড্র করতে সক্ষম হয়েছিলো স্বাগতিকরা।
অস্ট্রেলিয়া বনাম পাকিস্তান (১৯৮০)
ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো এক ইনিংসে একাদশের সবার বোলিং করার ঘটনা ঘটেছে ১৯৮০ সালের ৬ই মার্চ অনুষ্ঠিত পাকিস্তান বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে। ফয়সালাবাদে পাকিস্তানের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ১১জন ক্রিকেটারই বল হাতে নিয়েছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করা অস্ট্রেলিয়া নিজেদের প্রথম ইনিংসে ২১১ ওভার ব্যাটিং করে ৬১৭ রান সংগ্রহ করেছিলো। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে গ্রেগ চ্যাপেল ২৩৫ রান এবং গ্রাহাম ইয়ালপ ১৭২ রান করেন।
অস্ট্রেলিয়া রানের পাহাড় গড়লে পাকিস্তানও ছেড়ে কথা বলেনি। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান তাসলিম আরিফের দ্বিশতক এবং অধিনায়ক জাভেদ মিয়াঁদাদের শতকের উপর ভর করে জবাবটা ভালোভাবেই দিচ্ছিলো স্বাগতিকরা। উইকেটে বোলারদের জন্য কিছু নেই জেনে একে একে সব বোলারকেই হাত ঘোরানোর সুযোগ দেন অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল। তিনি নিজে আক্রমণে আসেন দলের ৮ম বোলার হিসেবে৷ এরপর উইকেটরক্ষক রড মার্শও দশ নাম্বার বোলার হিসেবে বল করতে আসেন। ডানহাতি অফস্পিনার হিসেবে তিনি দশ ওভার বল করেছিলেন। এরপর দলের এগারো নাম্বার বোলার হিসেবে বল করেন গ্রাহাম ইয়ালপ। ফয়সালাবাদের ব্যাটিং স্বর্গে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানরা ৬১৭ রান করার পর পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা ১২৬ ওভার ব্যাটিং করে মাত্র দুই উইকেট হারিয়ে ৩৮২ রান সংগ্রহ করেছিলো। তারপর এই টেস্টকে ড্র ঘোষণা করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এই ১২৬ ওভার বল করেন দলের এগারোজন ক্রিকেটারই।
ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০০২)
২০০২ সালের ১০ই মে, সেন্ট জোন্সে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামে ভারত। টসে জিতে ভারতকে প্রথমে ব্যাট করতে পাঠায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ওয়াসিম জাফর ও রাহুল দ্রাবিড়ের অর্ধশতক এবং ভিভিএস লক্ষ্মণ ও অভিষিক্ত উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান অজয় রত্রের শতকের উপর ভর করে নয় উইকেটে ৫১৩ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। এই রান তুলতে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা ১৯৩ ওভার ব্যাটিং করেছিলেন। অজয় রত্র তার অপরাজিত ১১৫ রানের ইনিংস খেলতে ২৮৪ বল মোকাবেলা করেছিলেন।
দু’দিনের বেশি সময় ধরে ফিল্ডিং করার পর ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই উইকেটে পড়ে থাকার সিদ্ধান্তে অটুট ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানরা। ভারতের প্রধান দুই স্ট্রাইক বোলার জাভাগাল শ্রীনাথ এবং আশিষ নেহরা যথাক্রমে ৪৫ এবং ৪৯ ওভার বল করে উইকেটশূন্য ছিলেন। এছাড়া দলের প্রধান স্পিনার অনিল কুম্বলে ভাঙা চোয়ালের কারণে খুব বেশি ওভার করতে পারেননি। তবে ভাঙা চোয়াল নিয়েও তিনি ১৪ ওভার বল করে ব্রায়ান লারার উইকেট শিকার করেছিলেন।
দলের মূল বোলাররা ব্যর্থ হওয়ার পর অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি দলের সবাইকে বোলিং আক্রমণে আনেন। আর এদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কার্ল হুপার, শিবনারায়ণ চন্দরপল এবং রিডলি জ্যাকবস ভারতকে উইকেট দিবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। চন্দরপল তার ১৩৬ রানের ইনিংস খেলতে ৫১০ বল মোকাবেলা করেছিলেন। দলের প্রধান বোলাররা উইকেট না পেলেও ওয়াসিম জাফর, লক্ষ্মণ, দ্রাবিড় এবং টেন্ডুলকার উইকেটের দেখা পেয়েছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের প্রথম ইনিংসে ২৪৮ ওভার ব্যাটিং করার ফলে ভারতের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি দলের সবাইকে দিয়েই বোলিং করান। শেষপর্যন্ত উইকেটরক্ষক অজয় রত্রকে এক ওভার বোলিং দিয়ে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকে ভারত। কারণ তার আগে ভারতের বাকি দশজন ক্রিকেটারই বোলিং করেছিলেন। সেন্ট জোন্স ম্যাচটি এতোই নিষ্প্রাণ ছিলো যে, পাঁচদিনে দুই দলের উইকেট পড়েছিল মাত্র ১৮টি।
দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ২০০৫ সাল
তিন বছর পর আবারও সেন্ট জোন্সে রানের পাহাড় গড়ে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকা। সেন্ট জোন্সে বোলারদের প্রতিটি উইকেটের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সেন্ট জোন্সের ব্যাটিং স্বর্গে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। দুই ওপেনার এবি ডি ভিলিয়ার্স এবং গ্রায়েম স্মিথের শতকের পর জ্যাক ক্যালিস ও অ্যাশওয়েল প্রিন্সও শতক হাঁকালে রানের পাহাড় গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা ১৬৩ ওভার ব্যাটিং করে ৬ উইকেট হারিয়ে ৫৮৮ রান সংগ্রহ করে ইনিংস ঘোষণা করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বড় সংগ্রহের জবাব দিতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজও দুর্দান্ত ব্যাটিং করে। ক্রিস গেইলের ৩১৭ রান, চন্দরপল এবং সারওয়ানের ১২৭ রানের ইনিংসের পর ডোয়াইন ব্রাভোও ১০৭ রানের ইনিংস খেলেন। ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের প্রথম ইনিংসে ৭৪৭ রান সংগ্রহ করে। এই রান তুলতে তারা ২৩৫.২ ওভার ব্যাটিং করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের এমন দাপুটে ব্যাটিংয়ের সামনে সুবিধা করতে পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো বোলার। তাই অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ দলের সব সদস্যকে দিয়ে বোলিং করান। নিয়মিত উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান মার্ক বাউচার দশম বোলার হিসেবে আক্রমণে এসে ডোয়াইন ব্রাভোকে সাজঘরে ফেরত পাঠান। তিনি ১.২ ওভার বোলিং করে ছয় রানের বিনিময়ে এক উইকেট শিকার করেছিলেন। এই ইনিংসে হার্শেল গিবসও এক ওভার বল করেন। এছাড়া গ্রায়েম স্মিথ ৪৩ ওভার এবং ডি ভিলিয়ার্স ২১ ওভার বল করে দুটি করে উইকেট শিকার করেন। সেন্ট জোন্সে অনুষ্ঠিত হওয়া এই টেস্টে দুই দলের মোট উইকেট পড়েছিল মাত্র ১৭টি। দুই দল মিলে রান করেছে ১,৪৬২।