সময়ের অন্যতম ক্রিকেট-আলোচ্য — মহাকালের ক্রিকেট পাতায় ‘টিম ইন্ডিয়া’ কি ক্রিকেট আধিপত্যবাদের কোনো নজির রেখে যেতে পারবে? আশির দশকের দোর্দণ্ড প্রতাপধারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেমন রেখেছিল, অথবা একবিংশ শতকের শুরুর দশকের বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া যেমন ছিল, ভারতের পক্ষে তেমন কি হওয়া সম্ভব? কিংবা তার চেয়েও বেশি প্রভাববিস্তারী?
ভারতের ক্রিকেট অঙ্গনে এখন প্রতিভার ছড়াছড়ি। সাইড বেঞ্চ দিয়ে অনায়াসে গঠন করা সম্ভব দাপুটে একাদশ। বিশ্বের যেকোনো পরিবেশে, যেকোনো মঞ্চে ‘ক্রিকেট শো’ দেখাতে পারঙ্গম — এমন ক্রিকেটারে ভরপুর ভারতবর্ষ। পাইপলাইন দুর্দান্ত ক্রিকেটারের ঠাসা। একটি-দুইটি-তিনটি-চারটি শক্তিশালী একাদশ দাঁড় করানোও যেন ‘শচীনের স্ট্রেইট ড্রাইভ’-এর মতো সহজ। একগাদা তরুণ মুখিয়ে আছে নিজেদের মেলে ধরতে, প্রথম সুযোগেই বাজিমাতের অপেক্ষায় একঝাঁক প্রতিভাবান। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং; প্রত্যেকটা জায়গায় বিশ্বমান। পেস ইউনিটে অন্তহীন উদ্যম, স্পিনে বৈচিত্র্যের অভাব নেই, দক্ষতায়-শিল্পে-স্থৈর্য্যে ব্যাটসম্যানদের তালিকাটা পরিপূর্ণ। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে, প্রত্যেকটি পজিশনে বিকল্পের অভাব নেই। ক্রিকেটে ভারত-আধিপত্যবাদ নিয়ে সময়ের বিস্তর যে আলোচনা, তার কারণটা না হয় বোঝা গেল এতে। কিন্তু জনমভর স্পিননির্ভর ও ব্যাটসম্যানে ঠাসা ভারত কোন জাদুমন্ত্রে সর্বক্ষেত্রে এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠল? এত এত বিকল্প ও পাইপলাইনের অফুরান সরবরাহের উৎসমূলই বা কী?
আজকের আলেখ্যে আমরা তা-ই বোঝার চেষ্টা করব। প্রিয় পাঠক, এই আলোচনা যথেষ্ট বিরক্তিকর মনে হতে পারে। অবকাঠামো, পরিকল্পনা, সিস্টেম, প্রসেস, কার্যক্রম, কর্মসূচী… এই আলোচনার পৌনঃপুনিক উপস্থাপনা — হয়তো সরস রচনার উপযোগী নয়। তবে ‘নীরস’ এই রচনার মূলে এইসব শব্দগুচ্ছই।
রাহুল দ্রাবিড়ের সামনে বিকল্পের অভাব ছিল না। ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে চাইলে ক্রিকেটে থাকতে পারতেন বা ক্রিকেট ছেড়ে অন্য অনেক ক্ষেত্রেও কাজের সুযোগ ছিল তার। ‘সম্মানজনক ডক্টরেট’ ডিগ্রী বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়ে দ্রাবিড় বলেছিলেন, তিনি কোনো ক্ষেত্রে ব্যাপক পড়াশোনা ও গবেষণার মাধ্যমে ‘ফিলোসফি অব ডক্টরেট’ হতে চান, এভাবে নয়। বই পড়ার অভ্যাস তার আশৈশব। চাইলে পিএইচডির লক্ষ্যে একাডেমিক পড়াশোনা বা কাজ শুরু করতে পারতেন, অথবা অন্য কিছু। জীবনকে উপলব্ধির তার যে দর্শন, দারুণ ‘অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা’ও হতে পারতেন হয়তো — ক্রিকেট বা জীবন নিয়ে। আর যদি ক্রিকেটের সঙ্গেই যুক্ত থাকতে চান, তাহলেও কত সুযোগ! আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের পর বেশ কয়েক বছর আইপিএল খেলেছেন। কাজ করার সুযোগ ছিল সেখানেও, করেছেনও। ধারাভাষ্যকারও হিসেবে হতে পারতেন প্রথম সারির। আজিঙ্কা রাহানেদের আজকের অবস্থায় উত্তরণে তার অবদান নেহায়েৎ কম নয়। আরো বহু উপায় থাকলেও রাহুল দ্রাবিড় বেছে নেন কোচিং পেশা। আর ভারতীয় ক্রিকেটের আজকের যে সামগ্রিক উন্নয়ন — তাতে রাহুলের এই সিদ্ধান্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই পারে নিখিল ভারত ক্রিকেট সমর্থক গোষ্ঠী।
আমাদের এই গল্পে রাহুল দ্রাবিড় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তার সঙ্গে আছেন আরো অনেকে। সেসব নমস্য নাম ক্রমশ প্রকাশ্য…।
রাজস্থান রয়্যালসে শেন ওয়ার্ন ও রাহুল দ্রাবিড়ের রসায়ন খুব জমে যায়। ওয়ার্ন অবসরে গেলে রাজস্থানের নেতৃত্বে অনুমিতভাবেই রাহুল চলে আসেন। আজিঙ্কা রাহানে, সাঞ্জু স্যামসনদের মতো তরুণদের অভিভাবক হয়ে উঠেন তিনি। অবসরে গেলেও তাই রাজস্থান কর্তৃপক্ষ রাহুলকে ছাড়তে নারাজ। নতুন দায়িত্বও কাঁধে আসে — পরামর্শক। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কের ব্যবহারে ভারতের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা হয়ে ওঠে তৎপর। ফলে ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ সামনে রেখে দলটাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব বর্তায় রাহুল দ্রাবিড়ের সুযোগ্য কাঁধে। অকপটে ও সাগ্রহে কাজটা বুঝে নেন তিনি। কিন্তু রাহুল শুধুমাত্র বিশ্বকাপকে লক্ষ্য রেখে বা বিশ্বকাপের দল গড়ে তুলেই দায়িত্বটাকে শেষ মনে করতে চাইলেন না, ভাবলেন আরো বড় পরিসরে। সামনের ক’টা মাস নয়, পরিকল্পনা যেন তার আগামীর যুগটা নিয়েই। হতে পারে তার দৃষ্টিজুড়ে সময়ের পরিধিটা আরো বেশি।
রাহুল মনোযোগী হলেন ‘এ’-দল সংস্কৃতির সর্বোত্তম ব্যবহারে। দায়সারা হলে হবে না, গড়ে তুলতে হবে গোছালো ও পরিকল্পিত ‘এ’ দল, যেটা ‘ছায়া দল’ হবে মূল দলটার। ভারতীয় ক্রিকেটের দ্বিতীয় মূল দল। প্রায় জাতীয় দলের মতোই সুযোগ-সুবিধা, সমর্থন, মনোযোগ – সব দিতে হবে দলটাকে। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া ক্রিকেটারদের প্রত্যাবর্তন ও নতুন তরুণ ক্রিকেটারদের আত্মপ্রকাশের মঞ্চ হবে এই দল। বয়সভিত্তিক ও ঘরোয়া ক্রিকেট হতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা জাতীয় দলে প্রবেশের অন্যতম মঞ্চ হবে ভারতে।
জাতীয় দলকে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করবে ‘এ’ দল। জাতীয় দলের সম্ভাব্য ও যথোপযুক্ত বিকল্প সরবরাহের কাজটা করবে এই দল। হার্দিক পান্ডিয়া যদি নিয়মিত মূল দলে খেলেন, এবং তাকে ঘিরে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে দলের, তাহলে ভারত ‘এ’ দল হার্দিকের মতোই একজনকে প্রস্তুত রাখবে সবসময়। বিজয় শঙ্কর তখন নিয়মিত থাকবেন ‘এ’ দলে। রবীন্দ্র জাদেজার বিকল্প হিসেবে অক্ষর প্যাটেল শাণিত হবেন, রবি অশ্বিনের অনুপস্থিতিতে দলের পরিকল্পনায় যেন বড় কোনো বাধা না আসে, তাই ওয়াশিংটন সুন্দর প্রস্তুত থাকবেন।
রিশভ পান্তের কথাই ধরা যাক। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় ‘ফোর্থ ইনিংস স্পেশাল’ খেলার আগেই ভারত ‘এ’ দলের সঙ্গে সফর করে নিজেকে শাণিয়ে নিয়েছেন তিনি। ক্যারিয়ারের প্রথম সিরিজেই পাকেচক্রে বোলিং ইউনিটের নেতা বনে গেছেন মোহাম্মদ সিরাজ। বিন্দুমাত্র দমে যাননি তাতে, উলটো ফাইফার দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রস্তুত হয়েই এই মঞ্চে আগমন তার। ভারত ‘এ’ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের বিপক্ষে যে ম্যাচে ১১ উইকেট শিকার করেছিলেন, সেখানে ছিলেন খাজা-হ্যান্ডসকম্ব-ল্যাবুশেন-হেডের মতো ব্যাটসম্যান। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশের আগেই সিরাজরা তাই ধারণ করেন এখানকার বাতাস-পরিবেশ-আবহ। ফলে খুব একটা অচেনা উদ্যান আর থাকে না।
অনেক সময় জাতীয় দলের সফরের পূর্বে শ্যাডো-ট্যুর করে ভারত ‘এ’ দল। সেখানে সম্ভাব্য বিকল্পদের জায়গা হয়। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, জসপ্রীত বুমরাহরা যেমন আদর পেতে অভ্যস্ত, রাহুল নিশ্চিত করতে চান ভারত ‘এ’ দলে সদ্য সুযোগ পাওয়া ঘরোয়া ক্রিকেটের আনকোরা তরুণটির জন্যেও যেন তেমন কদর বরাদ্দ রাখা হয়। কার্যকর পরিকল্পনার সুযোগ্য বাস্তবায়নে জাতীয় দলের যথাযোগ্য ব্যাকআপ যোগানের উপযুক্ত ক্ষেত্র হয়ে উঠে ‘এ’ দল। ফলে পথচলা হয় মসৃণ, বাধাগ্রস্থ হয় না আধিপত্যবাদ অভিযাত্রা।
জাতীয় দল বা ‘এ’ দল — দুটো দলেই ক্রিকেটার প্রয়োজন। এই ক্রিকেটার তো হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসবে না। শক্তপোক্ত পাইপলাইন থাকা লাগবে। মোটা দাগে বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকেই উঠে আসবে জাতীয় দল, ‘এ’ দল, কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেটের সমস্ত ক্রিকেটার। সেজন্য মনোযোগ দিতে হবে সেখানেও।
ধরা যাক, একটা বাগান করবেন আপনি। জগতের সবচেয়ে সুন্দরতম ফুল দিয়ে ভরিয়ে তুলবেন আপনার শূন্য উদ্যান। আপনার প্রয়োজন সুযোগ্য মালি, যারা বাগান ও ফুলের পরিচর্যায় নিবেদিত ও দক্ষ। আপনার প্রয়োজন ফুল চিনতে জানা মানুষ, ভালো ফুলের বীজ খুঁজে নিয়ে আসতে পারা অভিজ্ঞ কর্মীবাহিনী। তারা আপনার জন্য দুনিয়ার আনাচকানাচ থেকে বীজ সংগ্রহ করে আনেন, নান্দনিক ফুলের চাষ হয় আপনার বাগানে, সুবাসে-সৌরভে-সৌন্দর্য্যে অপূর্ব মোহনীয় হয়ে উঠে আপনার বাগান। ফুলের নান্দনিকতায় মুগ্ধ হয় সকলে, আলাপ হয়, গল্প হয়। আপনার নিবেদিত শ্রমিক দল হয়তো অন্তরালেই থেকে যায়। মানুষ পুষ্প কাননের রূপবৈচিত্র্যে মোহগ্রস্থ হয়ে পুষ্পবন্দনায় মেতে উঠলেও কোনো না কোনো সময়, কেউ না কেউ আড়ালের নিবেদন ও পেছনের সহস্র পরিশ্রম নিয়ে আলাপে উৎসাহী হবেই। সেজন্য ফুলের বাগানটা তাক লাগানো হওয়া চাই-ই চাই।
ভারতের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠিক সেই কাজটিই করেছেন। তারা একটি নান্দনিক ক্রিকেটকাননে মনোযোগী হয়ে নিয়োগ করেছিলেন এই কাজে সবচেয়ে যোগ্য ও নিবেদিত কয়েকজনকে।
আইপিএলের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে গঠিত হওয়া মুঘডাল কমিটির পর আরেক সাবেক বিচারপতি আরএম লোধার নেতৃত্বে ‘লোধা কমিটি’ ভারতীয় ক্রিকেটের ত্রুটি সংশোধন ও উন্নতির রূপরেখা দিয়ে বিশাল রিপোর্ট প্রকাশ করে। ভারতের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থাও উদ্যোগী হয় সেই সুপারিশ অনুসারে কাজ করতে। তারই ধারাবাহিকতায় অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব-১৬ পর্যায়ে ৩৮টি দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় ঘরোয়া ক্রিকেট।
এই আটত্রিশ দলের টুর্নামেন্টে অর্ধ হাজারেরও বেশি ক্রিকেটার অংশ নেয়। সেখান থেকে বেছে নেয়া হয় ১৫০ জন ক্রিকেটার। দৈবচয়ন প্রক্রিয়ায় এই তালিকা করা হয় না, সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও পরিকল্পনামাফিকই কাজটা করা হয়। পাঁচজন নির্বাচকের একটা প্যানেল গঠন করে দিয়ে বলা হয়েছে, তোমাদের কাজ হীরে খোঁজে আনা। ঘুরে ঘুরে এই টুর্নামেন্টের ম্যাচ দেখা, আর ভারতবর্ষের কোথায় কোন অজপাঁড়াগায় পড়ে আছে ‘অমূল্য রতন’, তা বেছে আনা।
তারপরও পাঁচজন মানুষের পক্ষে তা অসম্ভব। তখন আম্পায়ার, ম্যাচ অফিশিয়ালস, স্কোরার এবং স্থানীয় স্কাউট বা অভিজ্ঞ ক্রিকেটবোদ্ধা মহল তো আছেই। এদের রিপোর্ট আলাদা গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ক্রিকেটারদের পরিসংখ্যানের খেরোখাতায় থাকে সতর্ক নজর। জহর সন্ধানীদের অনুসন্ধিৎসু চোখ এভাবে তুলে আনে দেড়শ’টি কাঁচা হীরে। তাদের নিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম।
প্রতিটি দলে ২৫ জন করে ছয়টি ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে ১৫০ জনের ক্ষুদে ক্রিকেটাররা। জোনাল ক্রিকেট একাডেমি বা জেডসিএ’র তত্ত্বাবধানে মাসখানেকের লম্বা ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশ নিতে হয় তাদের। এই প্রশিক্ষণ শিবিরে সব ধরনের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা পায় কিশোর বাহিনী। ফিটনেস লেভেল নিয়ে কাজ হয়, ক্রিকেটের টেকনিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার দেখা হয়, ম্যাচ আয়োজন করা হয়; ক্যাম্প শেষে সংগ্রহ করা হয় সমস্ত ডাটা। এই ক্যাম্প বা একাডেমির ফিজিও, ট্রেইনার সবাই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। সুতরাং ভারতীয় ক্রিকেট সংস্থা তার আগামী দিনের তারকাদের জন্য সর্বোচ্চ বিনিয়োগটাই করে।
রাহুল দ্রাবিড় অনুর্ধ্ব-১৯ বা বয়সভিত্তিক দলের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ‘এ’ দল গড়ায় মনোযোগী হন। দুটো দলেরই দায়িত্ব থাকে তার কাঁধে। আইপিএলের দলেও কাজ করতে দেখা যায় তাকে। কিন্তু ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের সংঘাত দেখা দিলে আইপিএলকে ‘টা টা বাই বাই’ জানিয়ে সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন আগামীর ক্রিকেটার তৈরী ও পরিচর্যার কাজে। বর্তমানে ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি বা এনসিএ’র ডিরেক্টরের চেয়ারটা অলঙ্কৃত করছেন তিনিই।
জোনাল ক্রিকেট একাডেমির ক্যাম্পে ছুটে যান দ্রাবিড় নিজেও, ক্লাস নেন কিশোরদের; অনুপ্রাণিত করেন, উৎসাহিত করেন। শুভমান গিলদের মতো তরুণ অনেকেই খুব ভক্ত রাহুলের,
“তিনি আসলে এমন একজন কোচ, যিনি কখনোই আপনাকে বলবে না এটা করো সেটা করো, এভাবে খেলো সেভাবে খেলো। মোটেই না। টেকনিক্যাল ব্যাপার নিয়ে খুব একটা কথা বলেন না তিনি। আপনার খেলার ধরন বদলাতে আসবেন না তিনি। রাহুল স্যার কাজ করেন মূলত কীভাবে মানসিকভাবে শক্তিশালী করা যায়। ম্যাচ পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন অনেক পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার ব্যাপার আছে। স্যার আমাদের জন্য কঠিন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়া যাতে সহজ হয়, সেই দিকটা নিয়ে কাজ করেন আসলে।”
এনসিএ’র কোচিং প্যানেল — পরেশ ম্যামব্রে, নরেন্দ্র হিরওয়ানি, অভয় শর্মা প্রমুখের মতো ব্যক্তিত্বরা ছুটে যান জোনাল ক্রিকেট ক্যাম্পে। তরুণ ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণ দেন, পর্যবেক্ষণ করেন। জহুরীর চোখে পরিমাপ করেন তাদের ক্রিকেট দক্ষতা, শেখার আগ্রহ, মানসিকতা। এই ক্যাম্পগুলো পরিচালনার দায়িত্ব থাকেন একঝাঁক অভিজ্ঞ ও পরীক্ষিত সাবেক ক্রিকেটার, যাদের প্রত্যেকেরই শীর্ষ পর্যায়ের কোচিং সনদ রয়েছে। অজয় রাত্র, শীতাংশু কতক, রমেশ পাওয়ার, গুরুশরণ সিং, ভাস্কর পিল্লাই এবং আরো অনেকে।
রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে এইসব নিবেদিত প্রাক্তন ক্রিকেটারও দিবানিশি রক্ত জল করা পরিশ্রম বিনিয়োগ করে যাচ্ছেন ভারতের আগামী দিনের ক্রিকেট মজবুতির বুনিয়াদ সৃষ্টিতে।
এই যখন অবস্থা, তখন ক্রিকেটবিশ্বে আগামীর সময়টা ভারতীয় ক্রিকেটাধিপত্যের কি না, সেই নিয়ে আলোচনা তো খুবই স্বাভাবিক। যারা নিরেট ক্রিকেট-কাঠামো নিয়ে গড়ে তুলছে অসাধারণ এক ক্রিকেট সংস্কৃতি, তারা আধিপত্য করবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠাই তো বরং অস্বাভাবিক, নাকি?
ফিটনেস লেভেল, চাপ নেয়ার ক্ষমতা, উপস্থিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিচক্ষণতা, রান, উইকেট, ক্যাচ, রান আউট ইত্যাদির পাশাপাশি কোচিং প্যানেল যোগ করেন বিশেষত্বের ব্যাপারগুলো। যেমন — কেউ স্ট্রাইক রোটেটিংয়ে ভালো, কেউ বিগ হিটিংয়ে পারদর্শী, কারো ফিল্ডিংয়ে ক্ষিপ্রতা আছে, কোনো বোলার লাইন-লেংথে বেশ ধারাবাহিক। সব বিচার বিশ্লেষণশেষে জুনিয়র নির্বাচক প্যানেল ও এনসিএ’র কোচিং স্টাফের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে দেড়শ’ জনের দলটা নেমে আসে পঞ্চাশে।
আগেই বলা হয়েছে, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ কেবলই ‘অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ’ ঘিরে করা হয় না, বরং লক্ষ্যটা আরো বড়। বিশ্বকাপের জন্য কুড়ি-ত্রিশ জনের দল দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু এখানকার কেউই ল্যাঠা চুকানোতে নয়, বরং জিঁইয়ে রাখতে অভ্যস্ত। তারা মনে করেন, একজন খেলোয়াড়কে মাসকয়েকের পারফরম্যান্স দিয়ে মূল্যায়ন করা অযৌক্তিক ও অনুচিত। অনেক ক্রিকেটার আছে, যাদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ একটু দেরিতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সমবয়সীদের তুলনায় বেশি শক্তিমান বা দৈহিক গড়নের কারণে কেউ খুব ভালো করে ফেলল, তবে আদতে ক্রিকেটার হিসেবে সে অত ভালো নয়। তো সিস্টেম বা প্রসেসটাকে স্বচ্ছ রাখা দরকার, প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। তাই ৫০ জনের দলটাকে দু’টি গ্রুপে ভাগ করা হয় – প্রতি গ্রুপে পঁচিশ জন। এদের নিয়ে শুরু হয় আবার দীর্ঘ দুই মাসের ট্রেনিং ক্যাম্প।
রাহুল দ্রাবিড়ের একটা দর্শন হচ্ছে — একজন ক্রিকেটারের যথেষ্ট সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকটা প্লেয়ারকে আমি ৮০০ রান করার সুযোগ দেব। এখন কেউ ৩৭৫ বা ৪২৫ করে সুযোগ পেল, আর কেউ ৪০০ রান করে হয়তো বাদ গেল, এটা হতেই পারে। উনিশ-বিশ সিচুয়েশনে আরো কিছু প্যারামিটার বিবেচনা করা হয়, এটা সবাই জানে। তাই বাদ পড়া ব্যক্তির হয়তো অত বেশি খারাপ লাগবে না তখন। রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে কোনো সফরে গেলে স্কোয়াডের সবাই পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে, এটা নিশ্চিত ধরে নেয়া যায়। তার কাছে ‘বেস্ট একাদশ’ বলতে কিছু নেই। এই স্কোয়াডের সবাই বেস্ট। নইলে এই পর্যায়ে তাদের নিয়ে আসা হতো না।
ক্রিকেটারদের গড়ে তোলার এই পুরো প্রক্রিয়া অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দেড় বছর আগে থেকে শুরু হয়, শেষ হয় একদম বিশ্বকাপে গিয়ে। এর মধ্যে নিজেদের মধ্যে ম্যাচ খেলে এই ছেলেরা। যুব ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও অংশ নেয়। প্রতিভা প্রদর্শন ও নিজেকে বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ পাওয়ার পর নির্বাচন করা হয় বিশ্বকাপ স্কোয়াড। এটা এমন না যে বৃত্তির জন্য বা এ প্লাস পেতে পারে এমন ছেলেপিলে আলাদা করে ফেললাম, আর অন্যদের কাছ থেকে হারিয়ে ফেললাম সমস্ত মনোযোগ। উঁহু, একদমই না। তাহলে এত শ্রম, ত্যাগ, বিনিয়োগ, কষ্ট স্বীকার কীসের জন্য? সব ক’টা ক্রিকেটার আমার সম্পদ। এই বিশ্বকাপে না খেললেও ওরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারে, টেস্ট আঙিনায় পা রাখবে, আইপিএল খেলবে। কিংবা শুধুই ঘরোয়া ক্রিকেটও যদি খেলে, তবুও ওদের পরিচর্যায় খামতি রাখা যাবে না। কারণ, আমার যে ক্রিকেটাররা বিশ্ব ক্রিকেটকে চ্যালেঞ্জ জানাবে, তারা তো প্রথমে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলবে। এদের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। তাহলে আমার যদি চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো ক্রিকেটার না থাকে, তবে বিশ্ব উঠোনে গিয়ে বিশ্ব-মান দেখাব কীভাবে?
এনসিএ’তে রাহুল দ্রাবিড়ের সহকর্মী পরেশ ম্যামব্রে, যিনি রাহুলের সঙ্গেই ১৯৯৬-এর সেই ইংল্যান্ড সফরে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। তরুণ ক্রিকেটারদের প্রতি তার বার্তা হচ্ছে,
“প্রতি মুহূর্তে তোমাকে প্রভাব বিস্তার করতে হবে। ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ থাকবে তোমার হাতে। তুমি যখন বল করছো, ব্যাটসম্যানকে চাপে রাখবে। প্রত্যেকটা স্পেল, প্রত্যেকটা বল, প্রত্যেকটা মুহূর্ত নিয়ন্ত্রণ করবে তুমি।”
ম্যামব্রে’র শিষ্যরা এখন গুরুর মন্ত্রে এতটাই উজ্জীবিত যে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটেও বাজে বলের পরিমাণ কমে গেছে অনেক।
ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমির নজর যে সর্বভারতীয় ক্রিকেটেই, তার আরেক প্রমাণ হচ্ছে আনন্দ দাতে’র ফিটনেস-বিপ্লব। বহু পরিশ্রম, সময়, সাধনা করে ক্রিকেটারদের ফিটনেস লেভেল সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। আর ক্রিকেটাররা একাডেমি ছেড়ে বাড়িঘরে গেলে বা রাজ্য দলের হয়ে যখন খেলে, অথবা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সময় দেখা যায় তাদের ফিটনেস লেভেল হ্রাস পায়। আনন্দ দাতে এনসিএ’র ট্রেইনার। বাছা, এত কাঠখড় পুড়িয়ে আমরা তোমার ফিটনেস লেভেল ‘আপ’ করে দেব, আর তুমি এখানে-সেখানে গিয়ে তা ‘ডাউন’ করে ছাড়বে, তা তো হবে না। তিনি বোলিং কোচ ম্যামব্রের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলেন, ডিরেক্টর দ্রাবিড়ের সঙ্গে কথা বললেন। সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে দেবরাজ রাউত — এনসিএ’র অ্যানালিস্ট দায়িত্ব পেলেন ফিটনেস নিয়ে একটি অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের। তাতে জিপিএসও সংযুক্ত করা আছে। ক্রিকেটাররা যেখানেই থাকুন, অ্যাপসে নির্ধারিত ফর্মে টুকে রাখতে হয় নিত্যদিনকার রুটিন। খাওয়া-দাওয়া, অনুশীলন, দৌঁড়ঝাঁপ – সমস্তই রেকর্ড থাকে। ফলে একাডেমি ছেড়ে গেলেও একাডেমির তত্ত্বাবধায়নের বাইরে যান না তারা। একাডেমি ক্রিকেটারদের নিরাপত্তার দিকটাও সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখে। ফ্র্যাঞ্চাইজি হোক বা রাজ্য দল, যদি খেলোয়াড়দের ইনজুরি-ঝুঁকি দেখা দেয়, এনসিএ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সমস্ত কূটনীতিক সম্পর্ক দিয়ে খেলোয়াড়দের বাঁচিয়ে রাখে।
যেখানেই খেলুক, যে দলেই খেলুক — সে ভারতবর্ষের ক্রিকেটার। সে ভারতীয় ক্রিকেটের সম্পদ। সুতরাং সম্পদ নিয়ে ছেলেখেলা চলবে না। অকাতরে খরচ করে ভারতীয় ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা। সোনার ডিম পাড়া মুরগীর পেট না কেটে তার যথাযথ সমাদর জানে তারা। বয়সভিত্তিক দল, এ দল, ঘরোয়া ক্রিকেট সর্বত্র ক্রিকেটারদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে। ‘এ’ দলের ৬০-৮০ জনের একটা তালিকা থাকে। বর্তমানের ক্রিকেটারদের সম্ভাব্য এই মুহূর্তের বিকল্প এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রয়োজন যদি হয়, সেদিক চিন্তা করে আরো একজন বিকল্প তৈরি করে। মুরালি বিজয়ের বিকল্প হিসেবে যেমন মায়াঙ্ক আগরওয়ালকে তৈরি করা হয়েছিল। কোনো কারণে মায়াঙ্ক যদি ব্যর্থ হন, কিংবা ইনজুরিতে পড়েন, সেইদিক বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে প্রিয়াঙ্ক পাঞ্চলকে। প্রতি বছর ‘এ’ দলের চারটি সিরিজ আবশ্যক। দু’টি ঘরে, দু’টি বাইরে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সময়টাতে ২৪টা আনঅফিশিয়াল টেস্ট খেলেছে ভারত ‘এ’ দল। অথচ এই সময়ে বাংলাদেশ, নিউ জিল্যান্ড, পাকিস্তানের মতো দলগুলি টেস্ট ম্যাচও খেলতে পারেনি অত! ২০১৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিশাখাপত্তমের ম্যাচ পণ্ড হলে দিনকয়েকের ব্যবধানে সেই ম্যাচ বেঙ্গালুরুতে স্থানান্তর করে চ্যাপেলকে পর্যন্ত বিস্ময় উপহার দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট। ‘এ’ দল ম্যাচ ঘিরে এত আয়োজন? এত গুরুত্ব ‘এ’ দলের ক্রিকেটের?
ভারতের ক্রিকেট অভিভাবক সংস্থা ভালো করেই জানে, এই বিনিয়োগ সরাসরি ফেরত পাওয়া অসম্ভব। জাতীয় দল ঘিরে আপনার পরিকল্পনা, পরিশ্রম, সাধনা সাফল্যের মুখ যদি দেখে, আপনি তিনগুণ-চারগুণ বা তারও বেশি ফেরত পাবেন, সেটা নিশ্চিত। আর এইক্ষেত্রে এত পয়সাকড়ির ‘শ্রাদ্ধ’ সাধনই সার, উসুল হওয়ার উপায় নেই। কিন্তু সামগ্রিক ক্রিকেটের উন্নয়ন যদি ভাবা হয়, বৃহত্তর প্রেক্ষাপট যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে আদতে এই বিনিয়োগ মোটেও জলে যায় না। বরং ফিরে আসে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে।
উমেশ যাদব, ইশান্ত শর্মা, মোহাম্মদ শামির মতো প্রথম সারির তারকা বোলার ছাড়া, বিরাট কোহলির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও, অশ্বিন-জাদেজা-বুমরাহ না থাকলেও ব্রিসবেনের অস্ট্রেলিয়ান দুর্গ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে ভারত। দুর্দান্ত বেঞ্চশক্তির দাপটে অনিঃশেষ পাইপলাইন — অনাগত আগামীতে বিশ্বক্রিকেটের রাজ্যপাটে একচ্ছত্র হবে ভারতেরই আধিপত্য, ইঙ্গিত মিলছে তেমনটারই।
বিশ্বক্রিকেটে আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠায় ভারত দাঁড় করিয়েছে নিজস্ব এক মডেল, রূপরেখা, কর্মসূচী। প্রচেষ্টা, পরিকল্পনা ও পরিশ্রম সবসময় আলোর মুখ না-ও দেখতে পারে, কিন্তু অবকাঠামোগত মানোন্নয়নের এই সদিচ্ছা ও ঐকান্তিক চেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে নিশ্চয়ই।