মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরের বাসিন্দাদের কাছে তিনি ‘বাল্টিমোর বুলেট’, সাঁতারুদের কাছে ফ্লাইং ফিশ, অনেকের কাছে সাঁতারের সুপারম্যান। যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন, কোনো বিশেষণেই তার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং তার অলিম্পিকের সুইমিং টিমের সদস্যদের দেয়া নামটিই বেশ মানানসই। তার সতীর্থরা তাকে অভিহিত করে ‘GOAT’ বলে, যার অর্থ ‘Greatest of All Time’।
তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা সাঁতারুই শুধু নন, সর্বকালের অন্যতম সেরা অলিম্পিয়ানও। বলছি অবিসংবাদিত সম্রাট মাইকেল ফেল্পসের কথা। অলিম্পিকের ইতিহাসে অমরত্ব পাওয়া মাইকেল ফেল্পসকে তাই টাইম পত্রিকা সম্বোধিত করে সাঁতারের ‘Real GOAT’ বলে।
২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে ১৫ বছরেরে এক মার্কিন যুবা এসেছে জীবনের প্রথম অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য। তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিল এই ছেলেই সুইমিংপুলের জলদানব হয়ে ভেঙে ফেলবে একের পর এক সব রেকর্ড?
মাইকেল ফ্রেড ফেল্পস ১৯৮৫ সালের ৩০ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরে জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বাবা ছিলেন অ্যাথলেট। মা ছিলেন মিডল স্কুল প্রিন্সিপাল। ফেল্পসের যখন ৯ বছর বয়স, তখন তার বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মায়ের কাছেই বড় দুই বোনের সাথে বড় হতে থাকে ফেল্পস।
বড় দুই বোন ছিলেন স্থানীয় সুইমিং টিমের সদস্য। বোনদের সাথে ফেল্পসও নেমে পড়ে সাঁতারে। তবে প্রথমদিকে সাঁতারের প্রতি খুব একটা ঝোঁক ছিল না তার। ৭ বছর বয়সে সুইমিংপুলের পানির নিচে ডুব দিতেই রীতিমতো ভয় পেতো বাচ্চা ছেলেটি। তাই তার প্রশিক্ষক শুধুমাত্র পানির উপরে উল্টো হয়ে ভেসে থাকার অভ্যাস করতে বলতেন। আর বলা বাহুল্য, সাঁতারে ফেল্পস প্রথম যে বিষয়টি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিলেন, তা ছিল ব্যাকস্ট্রোক।
১৯৯৬ সালে ফেল্পসের সাঁতারু জীবন শুরু হয় লয়োলা হাই স্কুলের সুইমিংপুলে। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় তার প্রথম কোচ বব বাউম্যানের সাথে। এই বাউম্যানই ছিলেন বাল্টিমোর অ্যাকুয়েটিক ক্লাবের প্রশিক্ষক। এ ক্লাবেই ফেল্পস তার সাঁতার শেখা শুরু করেছিলেন। পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে ফেল্পসের প্রতিভা এবং সাঁতারে তার দক্ষতা সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন বাউম্যান। তাই ফেল্পসকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দক্ষ সাঁতারু হিসেবে তৈরি করার উদ্দেশ্যে নিজেও নেমে পড়লেন পুলে। শুরু হলো ফেল্পসের জোরদার প্রশিক্ষণ।
১৯৯৯ সালে ফেল্পস যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দলের বি-টিমের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের সুইমিং টিমের সদস্য হন তিনি। এত কম বয়সে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করা ছিল অলিম্পিকের ৬৮ বছরের ইতিহাসে প্রথম। সেই অলিম্পিকে খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি ফেল্পস, পাননি কোনো পদকও।
সেই পদক না পাওয়ার জ্বালা মেটান ২০০১ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। ২০০ মিটার বাটারফ্লাই বিভাগে ফেল্পস বিশ্ব রেকর্ড করে ক্যারিয়ারের প্রথম সোনা জয় করেন। তখন তার বয়স ১৫ বছর ৯ মাস। সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারু হিসেবে তিনি এই অনন্য কীর্তিটি করেন। উল্লেখ্য, সিডনি অলিম্পিকে এই ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে ফেল্পস পঞ্চম হয়েছিলেন। জেতার কী তীব্র বাসনা থাকলে পরের বছরে সেই একই ইভেন্টে শুধু সোনাই নয়, বিশ্বরেকর্ড করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ বোধ হয় ফেল্পস।
ফেল্পসের অলিম্পিকের পদক অভিযান শুরু ২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিক দিয়ে। সেই অলিম্পিকে আটটি পদক পান তিনি। তার মধ্যে ছয়টি স্বর্ণ এবং দুটি তাম্র পদক। অলিম্পিকের প্রথম সোনাটি পান ৪০০ মিটার এককে মেডলি, জিততে সময় নেন ৪ মিনিট ৮.২৬ সেকেন্ড, যা ছিল বিশ্ব রেকর্ড। বাকি সোনাগুলো আসে ১০০ ও ২০০ মিটার বাটারফ্লাই, ২০০ মিটার মেডলি, ৪×২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলে এবং ৪×১০০ মিটার মেডলি রিলেতে।
প্রথম সোনা জয়ের পর এক সংবাদ সম্মেলনে ফেলেপস বলেছিলেন,
“সব সাঁতারুই ছেলেবেলা থেকে অলিম্পিক সোনা জয়ের স্বপ্ন দেখে মনে মনে। এই স্বপ্ন সফল করার জন্য তারা জান-প্রাণ লাগিয়ে দেয়। আমিও সকলের মতো ঠিক এটিই চাইতাম। অলিম্পিক পোডিয়ামে উঠে সোনার পদক গলায় ঝোলাব, আস্তে আস্তে আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠবে, অমনি চোখে জল চলে আসবে- এমন অভিজ্ঞতার জন্যই তো অলিম্পিকে আসা।”
৪×১০০ মিটার মেডলি রিলেতে তার সোনাটি অনেকটা ‘পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা’র মতো। এই ইভেন্টের ফাইনালে না নেমে ফেল্পস নিজের জায়গা ছেড়ে দেন টিমমেট ইয়ান ক্রুকারকে। কারণ তার মনে হয়েছিল যে, ইয়ান এই ইভেন্টে তার চেয়ে ভাল করবেন। যথারীতি সোনা জেতে আমেরিকা। তবে যেহেতু ফেল্পস প্রিলিমিনারিতে নেমেছিলেন, তাই সোনার পদক ঝোলে তার গলাতেও।
অনেকেই ভেবেছিলেন, ফেল্পস এথেন্স অলিম্পিকেই স্পিৎজের অনেক দিনের পুরনো রেকর্ড ভেঙে ফেলবেন। কিংবদন্তী সাঁতারু মার্ক স্পিৎজ ১৯৭২ সালের অলিম্পিকে সাতটি সোনা জিতে ইতিহাস গড়েন। ফেল্পসের লক্ষ্যও ছিল তা-ই। অস্ট্রেলিয়ান ইয়ান থর্প বা হল্যান্ডের হুগেনব্যান্ডকে হারিয়ে খানিকটা সফল হলেও সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেননি তিনি।
তবে ফেল্পস পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন তা বলা যাবে না। স্পিৎজের রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও রাশিয়ান জিমনাস্ট আলেকজান্ডার দিতিয়াতিনের সমান উচ্চতায় অবশ্য পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিকে আটটি পদক জিতেছিলেন এই জিমনাস্ট। তবে ফেল্পসের মতো ছয়টি সোনা ছিল না তার ঝুলিতে। সেই হিসেবে দেখা গেলে বোধহয় খানিকটা এগিয়েই ছিলেন এই সাঁতারু।
২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে আসার আগেই ফেল্পস সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন যে, এবার তিনি স্পিৎজের রেকর্ড ভেঙে দেবেন। নিজের ওপর কতটুকু বিশ্বাস ও আস্থা থাকলে এমন ঘোষণা দেয়া যায় তা ভাবিয়ে তোলে বৈকি! ফেল্পসের পক্ষেই তা সম্ভব। ঘোষণা মতো বেইজিংয়ে এসে ৮টি বিভাগে স্বর্ণ জিতে ফেল্পস ভেঙে দেন স্পিৎজের ৪০ বছরের রেকর্ড। এই অলিম্পিকের ৭টি ইভেন্টে করেন বিশ্ব রেকর্ড এবং আরেকটি ছিল অলিম্পিক রেকর্ড। অলিম্পিকের ইতিহাসে এই কীর্তি খুবই বিরল।
২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে আসার আগে আবার তার ঘোষণা। এবার ভাঙতে চান জিমন্যাস্ট লারিসা লাতিনিনার ১৮ অলিম্পিক পদকের রেকর্ডটি। এবারও তার কথার হেরফের হলো না। ৪টি সোনা ও ২টি রৌপ্য পদকসহ ২০০৪-১২ এর এই তিন অলিম্পিকে প্রাপ্ত পদক মিলে তার মোট পদক সংখ্যা দাঁড়াল ২২ এ। অবলীলায় ভেঙে দিলেন ৪৮ বছর ধরে টিকে থাকা লাতিনিনার রেকর্ডটি। ২০১৬-তে তিনি রেকর্ডটি আরো নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান।
লন্ডন অলিম্পিকের শেষে ঘোষণা দেন সুইমিং থেকে বিদায়ের। চারদিকে বিদায়ের বিষাদমাখা সুর। কিন্তু সুইমিং পুলের চিরচেনা উত্তেজনা থেকে নিজেকে বেশিদিন দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। কারণ জল ছাড়া তিনি তো বাঁচতেই পারেন না, বলেছেন, “আমি নিজেকে ভালোবাসি না। শুধু সাঁতারকেই ভালবাসি।”
এক বছর পরেই ঘোষণা দেন আবার সুইমিং পুলে ফেরার। কিন্তু অবসর থেকে ফিরে আসার পর জড়িয়ে পড়তে থাকেন একের পর এক নানা বিতর্কে। ২০১৪ সালে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য তাকে যেতে হয় জেলে। এরপর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন যে, সেই ফেল্পস আর ফিরে আসতে পারবেন না। কিন্তু তিনি ফেল্পস। ফিনিক্স পাখির মতোই আবার জেগে উঠলেন ২০১৬ সালের ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত রিও অলিম্পিকে। ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই নিজের জীবনকে আবার নতুনভাবে সাজাতে থাকেন। মদ ছাড়েন, দীর্ঘদিনের ভালোবাসার সঙ্গী প্রেমিকা নিকোলের সঙ্গেও সম্পর্ক মজবুত করতে সচেষ্ট হন। এ সময় পৃথিবীতে আসে তাদের প্রথম সন্তান বুমার। নিকোলকে কথা দিয়েছিলেন, রিও শেষেই বিয়ে করবেন দুজনে।
রিও অলিম্পিকের সুইমিং পুলে যখন পা রাখছিলেন, ফেল্পসের বয়স তখন ৩১। বেশিরভাগ ক্রীড়াবিদের কাছে তা পড়ন্ত বিকেল। তার সুইমিং টিমের অধিকাংশই নবীন। অনেক বিশেষজ্ঞই খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলেন না ফেল্পসের ওপর। কারণ সুইমিংয়ে নবীনদের জয়ের হারই বেশি। সেখানে ৩১ বছরের ফেল্পস কী আর করে দেখাতে পারবেন! কিন্তু ৩১ বছরে পা দেওয়া ফেল্পস দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে সেদিন জানিয়েছিলেন, “আগের চেয়েও অনেক ফিট আমি। এবারও সোনা জয়ের জন্য আমি প্রস্তুত।”
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে নবীনদের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রমাণ করলেন, বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখানোর এখনও অনেক কিছু বাকি। সবার হিসেবকে এলোমেলো করে দিয়ে রিও অলিম্পিকে জিতে নেন ৬টি পদক, যার মধ্যে ৫টি স্বর্ণ এবং ১টি রৌপ্য পদক।
প্রাচীন এবং আধুনিক অলিম্পিক মিলে সবচেয়ে বেশি সোনা জেতার রেকর্ড ছিল লিওনাইডাস রোডস নামে এক দৌড়বিদের। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৪-১৫২ সালে পরপর ৪টি অলিম্পিকে ৩টি করে মোট ১২টি সোনা জিতেছিলেন তিনি। আর ২০০৪-১৬ এই চার অলিম্পিকে ফেল্পসের সংগ্রহ মোট ২৩টি সোনা, যার মধ্যে ব্যক্তিগত ইভেন্টে জেতা সোনার পদক ১৩টি। বাকি ১০টি বিভিন্ন রিলে রেসে জেতা।
২০০০ সালে ১৫ বছরের যে কিশোরের অলিম্পিকের যাত্রা শুরু, ২০১৬-তে শেষ অলিম্পিকে অংশ নিয়ে তার মোট পদকের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮ এ। পুরো অলিম্পিক ক্যারিয়ারে এই পুল সম্রাট সর্বাধিক ২৩টি অলিম্পিক সোনা জিতে নিয়েছেন, যার মধ্যে ৭টি বিশ্বরেকর্ড এখন তার নামে। অলিম্পিক গেমস, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ এবং প্যান প্যাসিফিক চ্যাম্পিয়নশিপ মিলিয়ে ফেল্পস মোট ৬৫টি সোনার পদকসহ ৮২টি পদক জিতেছেন। তার রেকর্ডের হিসেবের তালিকাও বেশ দীর্ঘ।
এটি যথার্থ যে, রক্তমাংসের শরীরে অধ্যবসায়, নিয়ম, কঠোর অনুশীলন, জীবনের অনুশাসনে সাফল্য আসে। এমনকি ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতা, পায়ের পাতা বড়, তাই সাঁতারে বাড়তি সুবিধে পান, তা-ও ঠিক। কিন্তু অবসর ভেঙে ফিরে এসে দু’হাজার বছরের পুরনো রেকর্ড যিনি ভাঙতে পারেন, তা যে বিশেষণেই বিশেষায়িত করা হোক না কেন, সবকিছুই কম পড়ে যায়।
অলিম্পিকের পর অবসর নিয়ে কোচিং করবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন এই ‘ফ্লাইং ফিশ’। কিন্তু রিওতে ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে দ্বিতীয় হওয়া যদি আবার ফেল্পসকে তাতিয়ে দেয়, আবার যদি তাকে দেখা যায় ২০২০ এর টোকিও অলিম্পিক পুলে, তবে খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং তার ভক্তদের মধ্যে খুশির জোয়ারই বয়ে যাবে। আর যদি তা না হয়, তাহলে তার ভক্তরা আশায় থাকবেন, কখন ফেল্পসের প্রশিক্ষণে নতুন কোনো ফেল্পস সুইমিংপুলে আবার ঝড় তুলবে!
ফিচার ইমেজ- Sporting News