আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সহজ ও সস্তা জয়। টেস্ট ক্রিকেট এমন হওয়া উচিৎ — যেখানে জয়টা আপনাকে অর্জন করে নিতে হবে। কাঠখড় পুড়িয়ে, সামর্থ্যের সবটা দিয়ে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি-ই বেস্ট। কিন্তু এই ম্যাচটা কেমন যেন খুব সহজে জিতে গেছি আমরা।
— মাইক আথারটন
সেঞ্চুরিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০০০ সনের জানুয়ারি মাস চলছে। সাধারণত এই সময়টা বর্ষা মৌসুম নয়, ক্রিকেটের মৌসুম। কিন্তু পাঁচদিনের টেস্ট ক্রিকেটের সাড়ে তিনদিনই গেছে বৃষ্টির পেটে। দেরিতে শুরু হওয়া ম্যাচে, প্রথম দিন আধবেলা খেলা হয়েছে শুধু। তারপর থেকে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। দক্ষিণ আফ্রিকা টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে ১৫৫ করেছে ৬ উইকেটে। ক্যাডিক-গফ-মুলালি-সিলভারউড ইংলিশ পেস চতুষ্টয়ের তোপে স্বাগতিকদের অবস্থা বেগতিক, সেঞ্চুরিয়নের মেঘলা কন্ডিশন যেন চিরপরিচিত ইংলিশ কন্ডিশন হয়ে উঠেছে। আগের চার টেস্টে ২-০তে হেরে সিরিজ খোয়া গেছে আগেই। পাঁচ টেস্টের শেষটিতে ইংল্যান্ড আশা করে ঝুলিতে কিছু পুরবে। হুঁহ, সে আশায় গুড়েবালি। পরের তিন দিনের টানা বৃষ্টিতে মাঠে একটি বলও না গড়ালে শেষদিনের খেলাটা নিছক নিয়ম রক্ষার হয়ে দাঁড়ায়। দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক হান্সি ক্রনিয়ে ‘আউট অব দ্য বক্স’ চিন্তা করতে অভ্যস্ত। কখনো মাঠে ইয়ারফোন নিয়ে ঢুকে পড়েন, কখনো কোচের সঙ্গে মিলে ল্যাপটপ প্রযুক্তি দেখিয়ে তুলকালাম কান্ড করেন। পঞ্চম দিনের সকালে ফকফকা রোদে ইংলিশ ড্রেসিংরুমের দিকে হেঁটে যান তিনি। পথিমধ্যে দেখা হয় অ্যালেক স্টুয়ার্টের সঙ্গে। তাকে সহ নিয়ে নাসের হুসেইনের সঙ্গে দেখা করেন হান্সি।
‘নাসের, একটা প্রস্তাব নিয়ে এলাম তোমার কাছে।’ ক্রনিয়ে বলেন।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কিচ্ছু বুঝতে পারেন না নাসের। হান্সির পুরো প্রস্তাব শোনার অপেক্ষা করেন তিনি।
‘শোনো, এই ম্যাচটা তো প্রায় মৃত বলা চলে। চলো নতুন করে জাগিয়ে তুলি এটাকে। তোমরা ৭৩ ওভারে ২৭০ রান চেজ করো। জিততেও পারো, হারতেও পারো। কিন্তু ম্যাচটা বেঁচে যাবে। দর্শক কিছু বিনোদন পাবে। বেশ অন্যরকম একটা ম্যাচ হবে। টেস্ট ক্রিকেটের আকর্ষণ জিঁইয়ে থাকবে।’
যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। সব মাথার উপর দিয়ে গেছে। নাসের সময় নিলেন। সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। হান্সি ফিরে গেলেন। নাসের ড্রেসিংরুমে গিয়ে আলোচনায় বসলেন।
আমি ও ফ্লেচ (ডানকান ফ্লেচার। তৎকালীন ইংল্যান্ডের ক্রিকেট কোচ।) দু’জনই কিছুটা রক্ষণশীল ঘরানার। পঞ্চম দিনের পিচ কেমন আচরণ করছে তা না দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া আমাদের কাছে আত্মাহুতির শামিল মনে হলো। আথারটন, স্টুয়ার্ট ও সিনিয়রদের কোর গ্রুপও সেরকমই মত দিল। তো আমরা জানিয়ে দিলাম, আগে পিচ দেখব, তারপর সিদ্ধান্ত নেব।
হানসি ক্রনিয়ে দুঃসাহসী ক্রিকেটার, আক্রমণাত্মক, যেকোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা হন না। সবাই তার মতো হবে তেমন তো কথা নেই। মরা গাঙে জোয়ার আনার চেষ্টা করেছেন তিনি। একা তো সম্ভব না, প্রতিপক্ষের সহযোগিতা না পেলে কী করে আর এগুবেন! তাই দক্ষিণ আফ্রিকার অপরাজিত দুই ব্যাটসম্যান ল্যান্স ক্লুজনার ও শন পোলক ব্যাটিংয়ে।
ড্যারেন গফ আগের রাতে একটি বারে ছিলেন। রঙিন তরল গিলেছেন প্রাণ ভরে। মাথা কেমন জ্যাম হয়ে গেছে। কিচ্ছু কাজ করছে না মাথায়। দৌড়ে গিয়ে বলটা ছুঁড়ছেন শুধু। কী ছুঁড়ছেন, কেন ছুঁড়ছেন, কীভাবে ছুঁড়ছেন… জানেন না কিছু। গফের বোলিং দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে অধিনায়ক নাসের হুসাইনের। তিনি জানেন, ব্যাটা সারারাত ইচ্ছেমতো গিলেছে, এখন তো বল করছে না যেন গোবর ছুঁড়ছে। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা। তাকে দিয়ে একটানা বল করালেন নাসের — এই হচ্ছে বল করার নামে গোবর ছোঁড়ার শাস্তি। ক্লুজনার ও পোলক বেশ জমে গেছেন ইতঃমধ্যে। জুটিটা দাঁড়িয়ে গেছে, রানও হয়ে গেছে অনেক। নাসের ও ইংলিশ টিম ম্যানেজমেন্ট বুঝল, পিচে আহামরি কিছু নেই। পঞ্চম দিন হলেও আদতে তো টেস্টের দ্বিতীয় দিন; যা গেলার তো বৃষ্টিই গিলে নিয়েছে। বার্তা পাঠালেন হুসাইন।
“হানসি কি তার প্রস্তাব নিয়ে এখনো অপেক্ষায় আছে? আড়াইশো চেজ করতে চাই আমরা।”
বিন্দুমাত্র দেরি না করে ‘হ্যাঁ’ বললেন ক্রনিয়ে। আশ্চর্য হলেন ইংলিশ ক্যাপ্টেন। যেন দোকানদার দরাদরি ছাড়াই প্রথম দরেই পণ্য বেঁচে দিচ্ছে। এ কেমন দুঃসাহসী রে বাবা! ভয়ডর নেই। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
ইংল্যান্ডের টার্গেট দাঁড়ালো ৭৬ ওভারে ২৪৯। প্রথম প্রস্তাব থেকে ওভার বেড়ে গেল তিন, রান কমে গেল ২১।
দুই দলেরই সুযোগ ছিল। যে কেউ জিততে পারত। আমি জানি, মাঠের প্রত্যেকটা খেলোয়াড়ই জিততে চেয়েছে। প্রত্যেকেই ইতিবাচকভাবে চেষ্টা করেছে। আমি নিজের কাছে পরিষ্কার — সমর্থকদের আমাদের প্রতি যে অকুণ্ঠ সমর্থন, তার বিনিময়ে এইরকম ম্যাচই ওরা ডিজার্ভ করে।
– হানসি ক্রনিয়ে
প্রস্তাব বিনিময় সহজ হলেও নিয়মের মারপ্যাচ জটিলতর। আইসিসির নীতিমালায় ইনিংস ছেড়ে দেয়ার বিধান নেই। তাই দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ইনিংস ডিক্লেয়ার করলেও ইংল্যান্ডের দু-দুটো ইনিংস… দক্ষিণ আফ্রিকার এক ইনিংস নিয়ে কী করা যাবে? ম্যাচ রেফারির সঙ্গে ক্রনিয়ের বিস্তর আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো, ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস ডিক্লেয়ার করতে হবে। কারণ, প্রথম ইনিংস ছেড়ে দেয়ার নিয়ম নেই। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ইনিংস ছেড়ে দিতে পারবে। তাছাড়া দর্শক ও টেস্ট ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় ম্যাচ রেফারি ব্যারি জার্মেইন নিয়মের শিথিলতার পক্ষে রায় দেন। তার রাজি হওয়ার কারণ উল্লেখ করেন তিনি — স্পিরিট অফ দ্য গেম।
ব্যস, অনুমোদনের পর শুরু হয়ে গেল ব্যাট-বলের লড়াই। নান্টি হাওয়ার্ড ম্যাচের দিন উড়ে এসেছেন। অ্যালান ডোনাল্ডের ইনজুরিতে দলে ঢুকেছেন। একাদশে থাকা পল এডামস পড়েছেন ইনজুরিতে। পিটার স্ট্রাইডম অভিষিক্ত। দক্ষির আফ্রিকার বোলিং কিছুটা নড়েবড়ে হলেও, পোলক-হাওয়ার্ড-ক্লুজনারের সঙ্গে ক্যালিস-ক্রনিয়ে নিজেও হাত লাগালে খুব একটা দুর্বলও নয় এই বোলিং লাইনআপ।
ক্রনিয়ে সবার থেকে নিংড়ে নিলেন। আগেই সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলে এই প্রস্তাব পাশ করিয়ে নিয়েছিলেন। ক্রনিয়ের প্রতি অগাধ আস্থা খেলোয়াড়দের। অধিনায়কের সিদ্ধান্তে তারাও সহমত। সর্বস্ব ঢেলে দিলেও শেষ রক্ষা হলো না ।
৩৭ ওভারে ১০২ রানে চার উইকেট হারানো ইংল্যান্ডকে পরের ৩৯ ওভার থেকে ১৪৭ রান করতে হবে। ওভার প্রতি তিন-এর একটু উপরে থাকা রানরেট প্রায় চার ছোঁয়ার পথে। চার উইকেট হাওয়া। স্টুয়ার্টের সঙ্গে জুটি বাঁধলেন ব্যাটিংয়ে ‘ডিমোশন’ পেয়ে ছয় নাম্বারে নামা মাইকেল ভন। আর ভন নেমেই স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছোটাতে শুরু করলেন। স্টুয়ার্ট ও ভনের ১২৬ রানের পার্টনারশিপে যখন মনে হচ্ছিল ইংল্যান্ডের জয় সময়ের ব্যাপার, তখনই হাওয়ার্ডের আঘাত। প্রথমে ফিরলেন স্টুয়ার্ট, পোলকের এক ওভারে গেলেন ম্যাডি ও ক্যাডিক। হাওয়ার্ডের পুনরায় আঘাতে ফিরলেন ভনও।
দুই উইকেট হাতে নিয়ে তখনো ইংল্যান্ডের দরকার নয় রান। বল বাকি ১৩টি।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ভিন্ন কিছুর চেষ্টা করতে গিয়ে যেকোনো প্রস্তাবেই রাজি হয়ে গেছেন। প্রস্তাবটা ইংল্যান্ডের অনুকূলে হলেও আমলে নেননি তা। যারা ক্রনিয়ের দুঃসাহসিক ও অভিনব অধিনায়কত্ব দেখতে অভ্যস্ত, তাদের জন্যও এই ব্যাপারটা নতুন। এটা কমপ্লিটলি আউট অব ক্যারেকটার। মনে হচ্ছে, যেন এক ক্যাপ্টেন তার টিম চাপের মুহূর্তে কেমন করে, তা দেখার জন্য কোনো রোমাঞ্চকর অভিযানে বেরিয়েছে।
– ড্যারেক প্রিঙ্গল
হানসি ক্রনিয়ের সিদ্ধান্তের পক্ষে অনেকেই পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন, বাহবা দিয়েছেন। তবে বিপক্ষেও উচ্চকিত ছিলেন কেউ কেউ। অনেকেই মানতে চাননি ক্রিকেটের প্রথাগত ধারণার বাইরে যাওয়া। টেস্ট ক্রিকেটকে এত হালকা, এত সস্তা করা উচিৎ নয়। একটি টেস্ট ম্যাচ সবসময়ই আলাদা গৌরব ও ভিন্ন মর্যাদা দাবি করে। টেস্ট জয়ও তেমনি। এক ইনিংসের ম্যাচ দিয়ে একদিবসী ক্রিকেটের মতো এত ঠুনকো করে ফেলা? শতবর্ষী টেস্ট ক্রিকেটের অহংয়ে ঘা দেয়ার মতো ব্যাপার!
তারপরও অধিকাংশ ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের উৎসাহ যায় হানসি ক্রনিয়ে ও নাসের হুসাইনের পক্ষে। বব উলমার রীতিমতো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। অর্জুনা রানাতুঙ্গাও হাততালি দেন। যারা রক্ষণাত্মক, যারা আগে নিজের পরাজয় এড়ানোর কথা ভাবেন, যারা হারকে ভয় পান, যারা জেতার চেয়েও নিশ্চিত করতে চান ড্র হোক, তবু হার যেন না হয়; তাদের জন্য দুর্দান্ত একটা শিক্ষা। যদি ক্রিকেট খেলতে চাও, টেস্ট ক্রিকেটার হও, টেস্ট ক্রিকেটের মঙ্গল চাও — তবে খেলাটাকে খেলতে হবে এভাবেই।
সেঞ্চুরিয়নের দর্শক বিপুল আনন্দে উপভোগ করে ম্যাচ। শেষের ক’মিনিটে নানান নাটকীয়তা। সিলভারউড ও গফ রান আউট হতে হতেও বেঁচে যান। চুরি করে সিঙ্গেল নেন, থ্রো ঠিকমতো হয় না, দর্শকের হর্ষধ্বনি, টানটান উত্তেজনা পেরিয়ে ৭ বল বাকি থাকতে ইংল্যান্ড ম্যাচ জিতে নেয় দুই উইকেটে। পরাজয়ের পরও স্বাগতিক দর্শকদের চোখেমুখে অদ্ভুত উত্তেজনা, অন্যরকম আনন্দ। স্বদেশী ক্রিকেটারদের জন্য প্রাণভরা ভালোবাসা। ক্রনিয়ের জন্য তারা বরাদ্দ রাখে অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা। ভাগ্যিস, হানসি অমন এক প্রস্তাব দিয়েছিল!
আমি কোনো অন্যায় করিনি। কক্ষনো না। তথ্য আদান প্রদান দোষণীয় কিছু নয়। আমি এখনো মনে করি, ক্রিকেট ম্যাচ বা দলের কোনো তথ্য নেয়ার মধ্যে বা দেয়ার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। – মারলন অ্যারনস্টম
শুরু থেকেই কানাকানি-ফিসফিস-গুঞ্জন। একটা সন্দেহ, একটা খচখচানি ছিল। যেন কেউ একজন মরিয়া ছিল ম্যাচের রেজাল্ট পাওয়ার জন্য। হানসি ক্রনিয়ে যেন কারো হয়ে চাইছিলেন যেকোনো মূল্য ম্যাচের ফলাফল এনে দিতে। দক্ষিণ আফ্রিকা জিতুক বা ইংল্যান্ড জিতুক — ম্যাচে ফলাফল চাই-ই চাই।
মারলন অ্যারনস্টম একজন বাজিকর। ক্রিকেট নিয়ে জুয়া ধরেন। সেঞ্চুরিয়ন টেস্টের ফলাফলের পক্ষে বাজি ধরেছিলেন তিনি, প্রায় সাড়ে তিন দিন বৃষ্টিতে ভেসে গেলে একটা টেস্ট ম্যাচে কিছুই থাকে না আর। টেস্টটা ড্র হলে কিছু থাকবে না মারলনেরও, সর্বস্ব হারাতে হবে। তিনি ক্রনিয়ের দ্বারস্থ হলেন। ক্রনিয়ের মস্তিষ্ক ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা। সাড়ে তিন দিন খেলা না হওয়া ম্যাচের ফলাফল আনার উপায়ও বের করে ফেললেন দক্ষিণ আফ্রিকার দলপতি। শর্ত ছিল দেড় লক্ষ রেন্ড (দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা — রেন্ড।) চ্যারিটি ফান্ডে জমা দিতে হবে। মারলন অ্যারনস্টম শর্ত নিয়ে দরাদরির অবস্থায় ছিলেন না, অনায়াসে রাজি হন তিনি।
হুসাইন যখন রাজি হলেন, ক্রনিয়ে কেবল একটা টেক্সট লিখলেন — দ্য গেম ইজ অন!
ম্যাচ শেষের পর বাজিকর দেখা করেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়কের সঙ্গে। অনন্য বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা দিয়ে ম্যাচের রেজাল্ট এনে দেয়ার উপহারস্বরূপ হানসি ক্রনিয়ে পান পঞ্চাশ হাজার রেন্ড ও একটি চামড়ার জ্যাকেট।
যে টেস্টটিকে বলা হচ্ছিল ইতিহাসের প্রথম টাই টেস্টের পর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর টেস্ট, বেনো ও ওরেলের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের সঙ্গে তুলনীয় হচ্ছিলেন ক্রনিয়ে ও হুসাইনের, ব্রিসবেনের পাশে উচ্চারিত হচ্ছিল সেঞ্চুরিয়নের নামও। সেই টেস্টটির মূল্য নাকি পঞ্চাশ হাজার রেন্ড ও একটি চামড়ার জ্যাকেট!
হায়, ক্রনিয়ে!
যাদের অধিনায়কত্বে খেলেছি তার মধ্যে ক্রনিয়েই সেরা। ওর সঙ্গে খেলেছে এমন সবার সঙ্গে কথা বলে দেখুন, ৯৯.৯৯ শতাংশের উত্তরই হবে এমন। ম্যাচ পাতানোয়ও (ক্রনিয়ে) জড়িত ছিল, তা আমাদের বিশ্বাস হয় না। বরং সে হয়তো এমন কিছু তথ্য দিয়েছে, যা দেয়া উচিৎ হয়নি। কিন্তু পুরো ঝড়টা গেছে হানসির উপর দিয়ে, আর বেঁচে গেছে সত্যি সত্যি ম্যাচ পাতানো বহু ক্রিকেটার। হানসি শুধু আমাদের অধিনায়কই ছিল না, সে ছিল আমাদের ভাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওর সঙ্গে আন্তরিক যোগাযোগ ছিল আমাদের।
নাসের হুসাইন জানতেন না ম্যাচের ফলাফল দরকার মারলনের। মাইক আথারটন কল্পনাও করেননি, এই টেস্ট নিয়ে বাজি ধরেছে কেউ। অ্যালেক স্টুয়ার্টের দাঁতে দাঁত চাপা লড়াই, মাইকেল ভনের অসাধারণ স্ট্রোকপ্লে, গফ-সিলভারউডের প্রাণান্ত চেষ্টা ও বুনো উল্লাস; আগাগোড়া প্রচেষ্টায় অসততার বিন্দুমাত্র নেই। পোলক, হাওয়ার্ড, ক্লুজনারদের সর্বস্ব উজার করে দেয়া, গ্যালারিতে গলা ফাটানো দর্শক, কোথাও লেশমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তবুও ম্যাচটার আকর্ষণ, নখ কামড়ানো উত্তেজনা, ক্রিকেটারদের নিজেদের নিংড়ে দেয়া… কিছুই গল্প করার মতো নেই। গল্প একটিই — ম্যাচটা ছিল ফিক্সড। ম্যাচটার সমস্ত রোমাঞ্চ যেন গিলে নিয়েছে পঞ্চাশ হাজার রেন্ড ও একটি লেদার জ্যাকেট।
তবু কারো কারো কাছে ম্যাচটা আকর্ষণীয়। ম্যাচের গল্পটা, ক্রিকেটারদের সংগ্রাম, লড়াই, চেষ্টা কিছুই ফিকে হয় না। হান্সি ক্রনিয়েও যেমন ফিকে হন না তার সতীর্থদের কাছে।