ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসটা খুব বেশি দিনের নয়। প্রথম ম্যাচটি হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৫ই জানুয়ারি। সময়ের হিসাবে প্রায় ৪৬ বছর। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম ম্যাচের সর্বোচ্চ স্কোরারই ইতিহাসের প্রথম সর্বোচ্চ স্কোরারের খাতায় নাম লেখাতে পেরেছেন। কিন্তু কালক্রমে রেকর্ডটি হাত বদল হয়েছে। কিছু রেকর্ড টিকে ছিল এক দশকেরও বেশি, আবার কিছু রেকর্ডের আয়ু ছিল মাত্র ১ ম্যাচ। সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড হাত বদল হয়েছে এই পর্যন্ত মাত্র ১২ বার। এই ১২টি ইনিংস নিয়েই আজকের আয়োজন।
জন এডরিচ: ৮২ রান
ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচটি ছিল ৪০ ওভারের। সেই ম্যাচে ইংল্যান্ড দলের হয়ে প্রথম ইনিংসে ৮২ রানের একটি ইনিংস খেলেন এডরিচ। ইংল্যান্ড অলআউট হয় ১৯০ রানে।
সেই ম্যাচটি পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া জিতে নেয়, কিন্তু ম্যাচের সর্বোচ্চ ইনিংস হিসাবে এডরিচেরটাই টিকে যায়। এই কারণে ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ডের খাতায় এডরিচের নামটিই উঠে যায়।
ডেনিস অ্যামিস: অপরাজিত ১০৩ রান
এডরিচের সর্বোচ্চ ইনিংসটি রেকর্ডবুকে টিকে ছিল মাত্র ৭ মাস। সেটিও আসলে এই সময়ের মাঝে আর কোনো ম্যাচ না হওয়ার জন্য। একদিনের আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় ম্যাচটি হয় ৭ মাস পর এবং সেই ম্যাচেই সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড নতুনভাবে গড়েন ইংলিশ ব্যাটসম্যান অ্যামিস। অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২২৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে গিয়ে অ্যামিস ১০৩ রান করে অপরাজিত থাকেন ১৩৪ বলে।
অ্যামিসের সেটি আবার ওয়ানডেতে অভিষেক ম্যাচ ছিল। অভিষেকেই ওয়ানডে ম্যাচে সেঞ্চুরি করা প্রথম ব্যাটসম্যানও অ্যামিস।
রয় ফ্রেডেরিকস: অপরাজিত ১০৫ রান
অ্যামিসের ইনিংসটিও খুব বেশিদিন টিকে থাকেনি। সময়ের হিসাবে প্রায় ১ বছর। ম্যাচটি ছিল ওয়ানডে ইতিহাসের নবম ম্যাচ। ইংল্যান্ডের দেওয়া ১৯০ রানের টার্গেট খুব সহজেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেরিয়ে যায়, ব্রায়ান লারার আদর্শ হিসেবে পরিচিত রয় ফ্রেডরিক্সের ১২২ বলে অপরাজিত ১০৫ রানের ইনিংসের সুবাদে।
ডেভিড লয়েড: অপরাজিত ১১৬ রান
পরের রেকর্ড ইনিংসটি আসে ওয়ানডের ১৪তম ম্যাচে। সময়ের হিসেবে প্রায় ১২ মাস পর। ওপেনিংয়ে নেমে লয়েড ১৫৯ বলে অপরাজিত ১১৬ রানের ইনিংস খেলেন। ম্যাচটি অবশ্য ইংল্যান্ডকে হারতে হয়েছিল মাজিদ খানের ৯৩ বলে ১০৯ রানের একটা দুর্দান্ত ইনিংস খেলার কারণে।
গ্লেন টার্নার: অপরাজিত ১৭১ রান
ওয়ানডে ইতিহাসে দেড়শ’ ছাড়ানো ইনিংস এটি প্রথম। এর বিশেষত্ব ছিল এই, ম্যাচটি বিশ্বকাপের। দুর্বল পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে ওপেনিংয়ে নেমে ২০১ বলে অপরাজিত ১৭১ রানের ইনিংস খেলেন টার্নার। সেটি ছিল ওয়ানডে ইতিহাসের ২০তম ম্যাচ।
কপিল দেব: অপরাজিত ১৭৫ রান
টার্নারের রেকর্ডটি অনেকদিন টিকে ছিল। সময়ের হিসাবে আট বছর। ইতিহাসের ২১৬তম ওয়ানডে ম্যাচে রেকর্ডটি ভাঙেন কপিল দেব। পরিস্থিতির কারণে ম্যাচটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেটি হেরে গেলে ভারত বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে যেত। এই অবস্থায় কপিল ক্রিজে এসেছিলেন ১৭ রানে ৫ উইকেট পড়ার পর। ৭৮ রানে ৭ উইকেট পড়ার পরে মদন লালকে সাথে নিয়ে ৬২ রানের জুটি করেন কপিল, যেখানে মদন লালের অবদান ছিল ১৭ রান। এরপর কিরমানিকে নিয়ে ১২৬ রানের জুটিতে কিরমানির অবদান ছিল ২৪ রান। প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচে কপিল করেন অপরাজিত ১৭৫ রান। এই ইনিংসটি গত শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে ইনিংসের তালিকায় চার নম্বরে আছে।
এছাড়া এটি আরেকটি কারণে বিশেষত্ব লাভ করে। এর আগের যারা সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েছিলেন, তারা সবাই ছিলেন ওপেনার। কপিল রেকর্ডটি গড়েছিলেন ছয় নম্বরে নেমে। ছয় নম্বরে নামা একজন ব্যাটসম্যানের এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ স্কোর।
ভিভ রিচার্ডস: অপরাজিত ১৮৯ রান
ভিভ রিচার্ডসকে ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান বলে মনে করেন অনেকে। তবে সেরা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও, তার এই ইনিংসটি নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। রিচার্ডসের এই ইনিংসটি গত শতাব্দীর সেরা ইনিংসের তালিকায় এক নম্বরে ছিল।
ওল্ড ট্রাফোর্ডে ১৯৮৪ সালের সেই ম্যাচে ইংল্যান্ড বিধ্বংসী বোলিং করছিল। ১০২ রানেই উইন্ডিজের ৭ উইকেট পড়ে যায়। প্রথমে ব্যাপটিস্টকে নিয়ে ৫৯ রানের জুটি গড়েন ভিভ, যাতে ব্যাপটিস্টের অবদান ছিল ২৬ রান। ১৬৬ রানে যখন গার্নার আউট হন, তখন একপ্রান্ত ধরে রেখে ভিভ খেলে যান। ৫৫ ওভার শেষে (তখন ওয়ানডে ৫৫ ওভারে হতো) হোল্ডিংকে নিয়ে যখন ফেরত আসেন ভিভ, তখন উইন্ডিজের রান ২৭২। ১০৬ রানের শেষ জুটিতে হোল্ডিংয়ের অবদান ছিল ১২ রান। ভিভ অপরাজিত থাকেন ১৮৯ রানে, বল খেলেন ১৭০টি।
ভিভের সেই ইনিংসের দিনে গ্রিনিজ, হেইন্স, গোমেজ, রিচি রিচার্ডসন, ডুজন আর লয়েডের মতো সেরা খেলোয়াড়েরা মিলে করেছিলেন ২৮ রান। ইংল্যান্ডের ইনিংসেও ল্যাম্ব বাদে কোনো স্বীকৃত ব্যাটসম্যান ১৫ রানের বেশি করতে পারেননি। এ থেকেই বোঝা যায়, সেই পিচটি ব্যাটসম্যানদের জন্য অনাবাদীই ছিল। আর এমন পিচেই ভিভের সেই তাণ্ডব! তার সেই ইনিংসের কারণেই ৩ ম্যাচের সিরিজটি ২-১ এ জিতে নেয় উইন্ডিজ।
কপিলের রেকর্ডটিকে ভাঙতে সময় লাগে মাত্র ১ বছরের মতো। পরবর্তীতে ভিভের এই রেকর্ডটি টিকে থাকে টানা ১৩ বছর। এছাড়া চার নম্বর পজিশনে ব্যাট করে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস এখন পর্যন্ত এটিই।
সাঈদ আনোয়ার: ১৯৪ রান
ম্যাচটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, দুই দলের জন্যেই। শক্তির দিক থেকে ভারত একটু এগিয়ে ছিল। নিজ মাঠে খেলা, তার উপর পাকিস্তান দলে খেলছেন না ফর্মে থাকা ওয়াসিম আর ওয়াকার ইউনুসের মতো দুজন বোলার। নিজ দেশের স্বাধীনতা কাপ উপলক্ষ্যে তাই ভারত একটু হলেও ফেভারিট ছিল। এর চেয়েও বড় সমস্যা ছিল, চার জাতির এই টুর্নামেন্টে সবচেয়ে দুর্বল দল হিসেবে বিবেচিত নিউজিল্যান্ডের কাছে প্রথম ম্যাচেই হেরে যায় পাকিস্তান। সমীকরণটা এমন ছিল, যে দল জিতবে সেই দলই ফাইনাল খেলবে।
এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে যেকোনো দলই প্রথমে ব্যাট করতে চায়। রান তাড়া করার চাপটা কেউ নিতে চায় না। পাকিস্তানও তাই টস জিতে অনুমিতভাবেই ব্যাটিং নিল। পাকিস্তানের ব্যাটিংয়ের মূল ভরসা সাঈদ আনোয়ার সেই টুর্নামেন্টে ফর্মে ছিলেন না। আগের দুই ম্যাচে তার রান মাত্র ১৭ আর ৩৬। তুলনামূলকভাবে আফ্রিদী সেই মুহূর্তে ধারাবাহিক ছিলেন (৪৬ বলে ৫৯ আর ২৯ বলে ৫২)। কিন্তু দলীয় মাত্র ৮ রানেই আফ্রিদি বিদায় নিলে পাকিস্তান চাপে পড়ে যায়।
সেই চাপ থেকে মোটামুটি এক হাতে ম্যাচটিকে বের করে নিয়ে আসেন সাঈদ আনোয়ার। করেন ১৯৪ রান, সেটিও মাত্র ১৪৬ বলে। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল ৩৯ রান। আনোয়ার বাউন্ডারি মেরেছিলেন ২২টি, ওভার বাউন্ডারি ৫টি। বাকি সবাই মিলে বাউন্ডারি মারতে পেরেছিলেন ১১টি। দলীয় ৩২৯ রানের মাঝে ১৯৪ রানই তার। যখন আউট হলেন, তখনও বল বাকি ছিল দুই ওভারের বেশি। টিকে থাকলে ডবল সেঞ্চুরিটা হয়তো হয়েই যেত।
তবে ডবল সেঞ্চুরি করতে না পারলেও এই ইনিংসটি খেলেই ভিভের অপরাজিত ১৮৯ রানের রেকর্ডটি ভাঙেন তিনি। আনোয়ারের রেকর্ডটি টিকে ছিল টানা এক যুগ।
চার্লস কভেন্ট্রি: অপরাজিত ১৯৪ রান
এক যুগ পর সাঈদ আনোয়ারের রেকর্ড ভাঙেন কভেন্ট্রি। তবে ভাঙেন না বলে স্পর্শ করেন বলাটাই হয়তো যুক্তিযুক্ত হতো, দুজনের রানই যে ১৯৪! তবে কভেন্ট্রি একটু এগিয়ে থাকেন, কারণ, তিনি অপরাজিত ছিলেন আর আনোয়ার আউট হয়ে গিয়েছিলেন।
এই ম্যাচটির পরিস্থিতিও কিছুটা জটিল ছিল। ৫ ম্যাচ সিরিজের এটি ছিল চতুর্থ ম্যাচ, আগের তিন ম্যাচে বাংলাদেশ ২-১ এ এগিয়ে। কভেন্ট্রির অপরাজিত ১৯৪ রানের সুবাদেই বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩১৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড় করাতে পারে জিম্বাবুয়ে। তবে তামিম ইকবালের ১৩৮ বলে ১৫৪ রানের ইনিংসের সুবাদে ম্যাচটি জিতে নেয় বাংলাদেশ।
হেরে যাওয়া ম্যাচে সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ডে কভেন্ট্রির নাম ঢুকে গিয়েছে এই ইনিংসের কল্যাণে। এছাড়া তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে সবচেয়ে বেশি রান করার কীর্তিও এটি।
শচীন টেন্ডুলকার: অপরাজিত ২০০ রান
ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি রান, শতক, অর্ধ শতক, ম্যান অব দি ম্যাচ- সব রেকর্ডই তার ঝুলিতে। ওয়ানডের প্রথম দ্বিশতকটা লিটল ম্যাজিশিয়ানের ব্যাটেই তাই মানায়। মজার বিষয় হচ্ছে, কীর্তিটা তিনি গড়েছিলেন ৩৬ বছর বয়স পার হবার পর। সেটিও যেনতেন বোলিং লাইন আপের বিপক্ষে নয়। সময়ের সেরা পেসার ডেল স্টেইনের দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। অপরাজিত ২০০ রান করার পথে মাত্র ১৪৭টি বল খেলেন তিনি।
বীরেন্দ্র শেবাগ: ২১৯ রান
ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্বিশতক করার সামর্থ্য রাখেন এমন ব্যাটসম্যানদের তালিকায় শেবাগের নামটিও ছিল। ইতিহাসের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ১৪৯ বলে ২১৯ রান করেন তিনি। শচীন টেন্ডুলকারের কীর্তি ভাঙেন তিনি মাত্র ২২ মাসের ব্যবধানেই। অবশ্য তার কীর্তিটিও টিকে ছিল মাত্র ৩ বছরের মতো।
রোহিত শর্মা: ২৬৪ রান
প্রায় দুই বছর পর রেকর্ডটি নিজের করে নেন রোহিত শর্মা। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ওয়ানডে ক্রিকেটে যেখানে একটি গোটা দলের স্কোরই ২৬০ অতিক্রম করলে সেটিকে লড়াই করার মতো স্কোর বলা যায়; সেখানে রোহিত একাই খেললেন ২৬৪ রানের ইনিংস।
তবে রোহিত শর্মার শুরুটা দেখে বোঝা যায়নি যে শেষটা এমন হবে। প্রথম অর্ধশত করেছিলেন ৭২ বলে, ১০০ রান করেন ঠিক ১০০ বলে। পরের ৫০ রান করেন মাত্র ২৫ বলে, ১৫০ থেকে ২০০ রানে পৌঁছুতে বল খরচ করেন মাত্র ২৬টি । ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ২৫০ রান করতে তার বল লেগেছে মাত্র ১৬৬টি। ইতিহাসের ৩,৫৪৪তম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ১৭৩ বলে ২৬৪ রান করে ইনিংসের শেষ বলে আউট হয়ে যান তিনি।
তবে এই রেকর্ড গড়তে ভাগ্যের পর্যাপ্ত সহায়তা পেয়েছেন তিনি। মাত্র ৪ রানেই ফিরে যেতে পারতেন তিনি, পেরেরার ক্যাচ মিসে সুযোগ পান। ২০১ রানে প্রসন্ন আর ২২২ রানে থিরিমান্নে ক্যাচ ছাড়ার পর বোঝাই যাচ্ছিল, আরও বড় কিছু করতে যাচ্ছেন রোহিত।
শেষ পর্যন্ত এমন একটি কীর্তি গড়লেন যেটা হয়তো আরও অনেক অনেক দিনের জন্য ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে স্থায়ী রেকর্ড হয়েই রইলো।
পরিশিষ্ট
ইতিহাস সবসময় বলে, রেকর্ড গড়া হয় ভাঙার জন্যই। তবে কিছু কিছু রেকর্ড ভাঙা অসম্ভব না হলেও খুবই কঠিন, সেটি বলা যায়। রোহিত শর্মার ২৬৪ রানের ইনিংসটিও অনেকটা সেরকমই। আধুনিক যুগে রান করা আগের তুলনায় কিছুটা সহজ। তবে এরপরও ভাগ্যের সহায়তা ছাড়া এত বড় একটি ইনিংস খেলে রেকর্ড ভাঙেতে চাইলে প্রায় অতিমানবীয় কিছু একটাই করতে হবে।
দেখা যাক, কত দিন টিকে থাকে এই রেকর্ডগুলো।
বি.দ্র: সকল পরিসংখ্যান ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখ পর্যন্ত।
ফিচার ইমেজ: Pinterest