ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর বলতে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপকে নয়, ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগকেই বোঝানো হয়ে থাকে। কারণ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অংশ নেয়া দলগুলো শুধু ইউরোপেরই নয়, গোটা বিশ্বেরই সেরা। তাই নিজ দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্যুতি ছড়ানোর পর, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সাফল্যকেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মানসূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আর এই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় কে? নিঃসন্দেহে নামটি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ব্যক্তিগত কিংবা দলীয়, দুই ক্ষেত্রেই তার থেকে বেশি অর্জন নেই আর কারোই। একাধারে তিনি যেমন রেকর্ড পাঁচবার শিরোপা জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের, ঠিক তেমনই ১২৬ বার বল জালে জড়ানোর মাধ্যমে এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনিই।
এখানেই শেষ নয়। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নক আউট পর্বে ৬০টির বেশি গোল দেয়া প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র খেলোয়াড়ও তিনিই। তার ১২৬টির মধ্যে ৬৫টিই, অর্থাৎ ৫২ শতাংশ গোলই এসেছে নক আউট পর্বে। মূল টুর্নামেন্টের টানা ১১টি ম্যাচে গোল করার রেকর্ড আছে তার। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে গোল পেয়েছেন তিনটি ফাইনালেও। ২০১৭/১৮ মৌসুম পর্যন্ত টানা সাতবার এক আসরে ১০টির বেশি গোল করেছেন। আর এর সুবাদে টানা আট মৌসুম সাবেক ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে অন্তত সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলেছেন তিনি। শিরোপা জিতেছেন চারবার, যার মধ্যে গত মৌসুম পর্যন্ত পরপর তিনবার।
সুতরাং এখন পর্যন্ত রোনালদোই যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের অবিসংবাদিত সেরা, সে ব্যাপারে দ্বিমত পোষণের সুযোগ খুবই কম। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, রোনালদোর এই শ্রেষ্ঠত্ব কতদিন স্থায়ী হবে? অদূর ভবিষ্যতেই কি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট তিনি হারিয়ে ফেলবেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসির কাছে?
নতুন করে এসব প্রশ্ন উদয়ের কারণ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের চলতি মৌসুমে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই রোনালদোর বর্তমান ক্লাব জুভেন্টাসের ছিটকে পড়া। প্রথম লেগে ১-১ গোলে ড্র করার পর, তুরিনে দ্বিতীয় লেগে ২-১ ব্যবধানে হেরে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে জুভেন্টাসের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের স্বপ্ন। সেই সাথে, অন্তত এই মৌসুমের মতো, ভস্মীভূত হয়েছে ক্লেয়ারেন্স সিডর্ফের পর দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে রোনালদোর তিনটি পৃথক ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি উঁচিয়ে ধরার সুযোগও।
অথচ জুভেন্টাস ও রোনালদোর স্বপ্নভঙ্গের দিনেও নিজের ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে ভুল করেননি বার্সেলোনার আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকর মেসি। নিজে মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে দুটি গোল করে, এবং কৌতিনহোর পা থেকে আসা তৃতীয় গোলটির বিল্ড আপেও দারুণ ভূমিকা রেখে, আরো একবার নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি। দুই লেগ মিলিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ৪-০ ব্যবধানে হারিয়ে, তিন মৌসুম পর বার্সাকে তুলেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ চারে। পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ইংলিশ ক্লাবগুলোর বিপক্ষে সর্বোচ্চ গোলের ট্যালিকেও নিয়ে গেছেন আরো উপরে। ইংলিশ ক্লাবগুলোর বিপক্ষে ৩২ ম্যাচ খেলে তার গোলসংখ্যা এখন ২৪। আর ১০ গোল নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের চলতি মৌসুমের শীর্ষ গোলদাতাও তিনিই।
বার্সার সামনে খুব ভালো রকম সুযোগ আছে এবারের মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের। আর সেক্ষেত্রে রোনালদোর মতো মেসির নামের পাশেও জ্বলজ্বল করতে থাকবে পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। অর্থাৎ গত মৌসুমে রোনালদো পঞ্চম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ের পরের মৌসুমেই, মেসি আবারও ছুঁয়ে ফেলবেন তাকে। অর্থাৎ দলীয় সাফল্যের ভিত্তিতে রোনালদোর এগিয়ে থাকার দিনও ফুরোবে।
অন্যদিকে ব্যক্তিগত গোলের ক্ষেত্রে মেসি রোনালদোর চেয়ে বেশ অনেকটাই পিছিয়ে থাকলেও, ম্যাচপ্রতি গোল গড়ে এগিয়ে থাকায়, সামগ্রিকভাবে তাকে রোনালদোর সমকক্ষ বিবেচনা করাই যায়।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রোনালদোর থেকে ১৬ গোলে পিছিয়ে আছেন মেসি। কিন্তু তিনি ১১০টি গোল করেছে ১৩৩ ম্যাচ থেকে, অর্থাৎ প্রতি ম্যাচে গোলের হার ০.৮৩। ওদিকে রোনালদো ১৬২ ম্যাচ থেকে গোল করেছেন ১২৬টি, ম্যাচপ্রতি ০.৭৭ হারে। গাণিতিক হিসেব বলছে, মেসি এখন পর্যন্ত ম্যাচপ্রতি যে হারে গোল করেছেন, তাতে রোনালদোর সমান ম্যাচ খেললে তার গোলসংখ্যা হতো ১৩৪। অর্থাৎ রোনালদোর চেয়ে আট গোলে এগিয়ে থাকতেন মেসি।
কিন্তু হ্যাঁ, ফুটবল অবশ্যই এত সহজ কোনো বিষয় না যে এরকম দুই-একটা গাণিতিক সমীকরণ দিয়েই সব হিসাব মিলিয়ে ফেলা যাবে। তাহলে তো ব্যালন ডি’অর জয়ের ক্ষেত্রে রোনালদোর ৪-১ থেকে উঠে এসে ৫-৫ করে ফেলার কোনো সুযোগই থাকত না। কিংবা উদাহরণ হিসেবে আমরা মেসি-রোনালদোর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ গোলের ইতিহাসকেও টেনে আনতে পারি।
এখন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গোলের দিক থেকে মেসি রোনালদোর চেয়ে ১৬ গোলে পিছিয়ে থাকলে কী হয়েছে, ২০১১-১২ মৌসুমের শেষ পর্যন্ত কিন্তু মেসিই এগিয়ে ছিলেন। তা-ও আবার পুরো ১৩ গোলে! কিন্তু ওই মৌসুম থেকে গত মৌসুম পর্যন্ত প্রতি মৌসুমে অন্তত ১০টি করে গোল করে পাশার দান উল্টে ফেলেছেন রোনালদো। এর ভেতর ২০১৩-১৪ মৌসুমে তো ছিল রেকর্ড ১৭টি গোলও।
তবে এখানে প্রাসঙ্গিক আরেকটি বিষয়ও চলে আসে, তা হলো: বয়স। ৩৪ বছর বয়সী রোনালদোর চেয়ে ৩১ বছর বয়সী মেসি তিন বছরের বড়। আবারো গাণিতিক সরলীকরণের মাধ্যমে বলে দেয়াই যায়, রোনালদোর চেয়ে মেসি তিনটি মৌসুম বেশি খেলবেন। সেই সাথে চলতি মৌসুমেও, সবকিছু ঠিক থাকলে, তিনি আরো দুটি ম্যাচ খেলবেন। বার্সা ফাইনালে উঠলে আরেকটি ম্যাচ বেশি খেলারও সুযোগ থাকবে তার সামনে।
কিন্তু এখানেও চাইলে গণিতকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো যায়। রোনালদো মেসির চেয়ে তিন বছরের বড় হয়েছেন তো কী হয়েছে, শারীরিকভাবে তো রোনালদো এখনো দারুণ ফিট। তাই মেসি রোনালদোর চেয়ে আরো তিনটি মৌসুম বেশি খেলবেন, এমন সম্ভাবনা কাগজে-কলমে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, বাস্তবে ততটা সহজ নয়। মেসি বড়জোর রোনালদোর চেয়ে একটি বা দুইটি মৌসুম বেশি খেলতে পারেন। কিংবা দুইজন একই মৌসুমেও বিদায় নিতে পারেন। কিংবা শেষ পর্যন্ত যদি দেখা যায় রোনালদোর আগেই মেসি অবসর নিয়ে ফেলেছেন, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!
কিন্তু সে যা-ই হোক, আমাদের কাছে যেহেতু গাণিতিক হিসাব-নিকাশ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, তাই চলুন আবার গণিতেই ফিরে যাই। ধরুন, এখন থেকে রোনালদো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে আর কোনো গোল করলেন না। কিন্তু মেসি তার বর্তমান হারেই গোল করে চললেন। তাহলেও রোনালদোকে টপকাতে করতে মেসির আরো অন্তত ২০টি ম্যাচ খেলা লাগবে। বার্সা যদি এই মৌসুমে ফাইনাল খেলে, এবং পরের মৌসুমেও ফাইনাল খেলে, এবং মেসি বার্সার হয়ে প্রতিটি ম্যাচেই খেলেন, তারপরও রোনালদোকে ছাড়িয়ে যেতে মেসির অপেক্ষা করতে হবে ২০২০-২১ মৌসুমের গ্রুপ পর্ব পর্যন্ত।
এবার চলুন বাস্তবতার নিরিখে বিচার করা যাক। প্রথমত, রোনালদো ২০২০-২১ মৌসুমের গ্রুপ পর্ব পর্যন্ত খেলবেন কিন্তু গোল পাবেন না, তা অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, এই মৌসুম ও আগামী মৌসুমের ফাইনাল পর্যন্ত মেসি সকল ম্যাচই খেলবেন, তা-ও খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর তৃতীয়ত, ২০২০-২১ মৌসুমের গ্রুপ পর্বের সময় মেসির বয়স হবে ৩৩। ঐ বয়সে পৌঁছেও তিনি ম্যাচপ্রতি ০.৮৩ হারে গোল করে যাবেন, তা-ও অসম্ভব।
সুতরাং, খুব শীঘ্রই মেসি রোনালদোর সাথে থাকা ১৬ গোলের ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলবেন, এমনটা যদি কেউ আশা করে থাকেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে আশাবাদী মানুষদের একজন। বাস্তবসম্মত শর্ত হতে পারে এটি যে, রোনালদোকে পেছনে ফেলতে মেসিকে অবশ্যই রোনালদোর চেয়ে একটি বা দুটি মৌসুম বেশি খেলতে হবে। সেটি কীভাবে সম্ভব? হয় রোনালদোর ইনজুরির কারণে পুরো একটি মৌসুম মাঠের বাইরে থাকা, অন্য একটি মৌসুমেও খুব বেশি ম্যাচ খেলতে না পারা; কিংবা রোনালদোর অবসরের পরও মেসির একটি বা দুটি মৌসুম খেলা চালিয়ে যাওয়া।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতার লড়াই কি শুধু মেসি ও রোনালদোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? অন্য কারোই কি এই লড়াইয়ে সামিল হওয়ার সুযোগ নেই?
প্রথম প্রশ্নটির উত্তর: হ্যাঁ। দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর: না। অন্তত অদূর ভবিষ্যতে এই হ্যাঁ ও না’র কোনো নড়চড় হবে না।
এখনো সক্রিয় আছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে মেসি ও রোনালদোর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন রিয়াল মাদ্রিদের করিম বেনজেমা। অথচ তার গোল মাত্র ৬০টি। পরবর্তী অবস্থানে আছেন বায়ার্ন মিউনিখের রবার্ট লেভানডস্কি। তার গোলসংখ্যা ৫৩। দুজনেই ত্রিশোর্ধ্ব, তাই তাদের পক্ষে আর কোনো সম্ভাবনাই নেই।
বয়সের কারণে থমাস মুলার, সার্জিও আগুয়েরো, এডিনসন কাভানি ও আরিয়েন রোবেনের সম্ভাবনাও আমরা নাকচ করে দিতে পারি। ২৭ বছর বয়সী নেইমার রোনালদোর চেয়ে পিছিয়ে আছেন ৯৪ গোলে। তার পক্ষেও আগামী নয় মৌসুম টানা ১০-১১টি করে গোল করে যাওয়া অসম্ভব। ২৫ বছর বয়সী হ্যারি কেইনকেও রোনালদোর বর্তমান গোলে পৌঁছাতে টানা ১০ মৌসুম ১১ বা ততোধিক গোল করে যেতে হবে, যেটিও এককথায় অসম্ভব।
তাই মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়া যায়, আরো অন্তত ১০ বছর চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদো-মেসির শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব করার মতো কারো আবির্ভাব ঘটবে না। এই দুজন খেলোয়াড় নিজেদেরকে এভারেস্টসম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাই তাদের তুলনা কেবল তারা দুজনই। লড়াইটাও চলবে কেবল তাদের দুজনের মধ্যেই। শেষ পর্যন্ত জয়টা কার হবে, আমরা নিশ্চিত নই। তবে এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, পরাজয় হবে না কারোই।
না মেসির, না রোনালদোর, না ফুটবলের।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/