দুর্ঘটনা কখনও কাউকে কোনো আগমনী বার্তা দিয়ে আসে না। হঠাৎ করে এসেই সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। ক্রিকেটারদের ক্রিকেটীয় জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হলো ইনজুরি এবং শারীরিক অসুস্থতা, যা তাদের সম্ভাবনাময় ক্রিকেট ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয়। এমন অনেক ক্রিকেটার আছেন, যারা ইনজুরির কারণে ক্রিকেটকে নিজের পুরোটা উজাড় করে দিতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের মাশরাফি কিংবা নিউজিল্যান্ডের শেন বন্ড, বর্তমানে ডেইল স্টেইন- এরা কেউই ইনজুরির বাধার কারণে নিজেদের সামর্থ্যের পুরোটা কাজে লাগাতে পারেননি। ইনজুরি এবং শারীরিক সমস্যার কারণে ফর্মে থাকা সত্ত্বেও অবসর নেওয়া ক্রিকেটারের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। বয়স ত্রিশ ছোঁয়ার আগেই শারীরিক সমস্যা এবং ইনজুরির কারণে ক্রিকেটকে বিদায় জানানো ক্রিকেটারদেরকে নিয়ে আজকের লেখা।
১. ম্যাট মচন (স্কটল্যান্ড)
কব্জির ইনজুরির কারণে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ক্রিকেটকে বিদায় জানান স্কটল্যান্ড এবং সাসেক্সের প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান ম্যাট মচন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান মচন। ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই তিনি এ ঘোষণা দেন। ২০১৩ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টুয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ করেন মচন। একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ওডিআইতেও অভিষেক ঘটে তার।
২০১৬ সালে যখন ক্রিকেটকে বিদায় জানান, ততদিনে মচন স্কটল্যান্ডের আশার প্রতীক হয়ে উঠছিলেন । নিজের খেলা শেষ আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে ২৬ রান দিয়ে দুই উইকেট এবং শেষদিকে মাত্র চার বলে ১৫* রান করে বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্টে স্কটল্যান্ডকে প্রথম জয়ের মুখ দেখান মচন। ব্যাটে-বলে কার্যকরী নৈপুণ্যের দরুন নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন তিনি। এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ইংল্যান্ডের সাসেক্সে জন্মগ্রহণ করেন। সাসেক্সেই তিনি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেন। তার মাতার জাতীয়তা স্কটল্যান্ডের হওয়ার কারণে ২০১২ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের হয়ে খেলার জন্য ছাড়পত্র পান।
ম্যাট মচন ২৩টি ওডিআইতে ৩৩.৩৬ ব্যাটিং গড়ে ৭৩৪ রান করেছিলেন। টি-টুয়েন্টিতে ১৩ ম্যাচ খেলে ৪০.৭০ ব্যাটিং গড়ে ৪০৭ রান করেছিলেন। এছাড়া এই দুই ফরম্যাটে যথাক্রমে নয়টি এবং পাঁচটি উইকেট শিকার করেছেন।
২. জেমস টেইলর (ইংল্যান্ড)
ইংল্যান্ডের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান জেমস টেইলর মাত্র ২৬ বছর বয়সে হৃদরোগজনিত কারণে ক্রিকেটজগত ছেড়ে দেন। তিনি ‘Arrhythmogenic Right Ventricular Cardiomyopathy’ রোগে ভুগছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এ রোগের কারণে ২০১২ সালে ফুটবলার ফ্যাব্রিস মুয়াম্বা মাঠেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী, জেমস টেইলরকেও ব্যাট-প্যাড তুলে রাখতে হবে। জেমস টেইলর ২০১২-১৬ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের হয়ে সাতটি টেস্ট এবং ২০১১-১৬ পর্যন্ত ২৭টি ওডিআই খেলেছিলেন। সাতটি টেস্টে ২৬.০০ ব্যাটিং গড়ে ৩১২ রান এবং ২৭টি ওডিআইতে একটি শতক এবং সাতটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪২.২৩ ব্যাটিং গড়ে ৮৮৭ রান করেছেন।
জেমস টেইলর ২০১৬ সালের এপ্রিলে ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। এর আগে বেশ ভালো ফর্মেই ছিলেন তিনি। ২০১৫-১৬ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সবক’টি টেস্টে মূল একাদশে ছিলেন। নিজের খেলা শেষ লিস্ট-এ ম্যাচে ১১৬ রান করেছিলেন জেমস টেইলর। ক্রিকেটের এই ফরম্যাটে বরাবরই দুর্দান্ত ছিলেন তিনি। ১৩৬টি লিস্ট-এ ম্যাচে ৫৩.১১ ব্যাটিং গড়ে ৫,৩৬৫ রান করেছেন। ১৫টি শতক এবং ৩০টি অর্ধশতকের সাহায্যে তিনি এই রান করেছিলেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও নয় সহস্রাধিক রান করেছিলেন ৪৬.০৬ ব্যাটিং গড়ে এবং ২০টি শতক ও ৪৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে।
৩. ক্রেইগ কিসওয়েটার (ইংল্যান্ড)
২০১০ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছিল ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের শিরোপা জয়ের নায়ক ছিলেন ঐ বছরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত কিসওয়েটার। তার ৪৯ বলে সাতটি চার এবং দু’টি ছয়ের সাহায্যে করা ৬৩ রানের ইনিংসের উপর ভর করে অস্ট্রেলিয়াকে সাত উইকেটে পরাজিত করে ইংল্যান্ড। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান কিসওয়েটার অভিষেকের পর থেকে দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন কিসওয়েটার। জাতীয় দলে জায়গা হারানোর পর কাউন্টি ক্রিকেটে মনোনিবেশ করেন তিনি। ২০১৪ সালে সমারসেটের হয়ে খেলার সময় নর্থহ্যাম্পটনশায়ারের পেসার ডেভিড উইলির শর্ট বলে তার হেলমেটের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বল তার নাক এবং চোখে আঘাত করে। এতে করে তার অক্ষিকোটর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কয়েকমাস পর মাঠে ফিরে আসলেও নিজের পুরোনো ছন্দ ফিরে পাননি। শেষপর্যন্ত ২০১৫ সালে ২৭ বছর বয়সে ক্রিকেট থেকে অব্যাহতি নেন কিসওয়েটার। অবসর নেবার সময় কিসওয়েটার বলেছিলেন, “আমি অনুভব করছি, আমি কখনোই মানসিকভাবে আগের রূপে ফিরে যেতে পারবো না, যেমনটা আমি ছিলাম”। ক্রেইগ কিসওয়েটার ইংল্যান্ডের হয়ে ৪৬টি ওডিআইতে ৩০.১১ ব্যাটিং গড়ে ১,০৫৪ রান এবং ২৫টি টি-টুয়েন্টিতে ২১.৯১ ব্যাটিং গড়ে ৫২৬ রান করেছেন। উইকেটের পিছনেও বেশ সাবলীল ছিলেন তিনি। ওডিআইতে ৫৩টি ক্যাচ এবং ১২টি স্ট্যাম্পিংয়ের পাশাপাশি টি-টুয়েন্টিতে ১৭টি ক্যাচ এবং তিনটি স্ট্যাম্পিং করেন কিসওয়েটার।
৪. ডেভিড লরেন্স (ইংল্যান্ড)
ডেভিড ভ্যালেন্টাইন লরেন্স ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তার বলে প্রচণ্ড গতি থাকলেও ঠিকঠাক জায়গায় বল করতে পারতেন না। ১৯৮৮ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটলেও দলে নিয়মিত ছিলেন না তিনি। ১৯৯১ সালে গতির পাশাপাশি বোলিংয়েও নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হন লরেন্স।
সবকিছু যখন অনুকূলে যাচ্ছিলো, তখনই ইনজুরি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯২ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে নিজের তৃতীয় ওভারের দ্বিতীয় বল করার সময় পড়ে যান লরেন্স। এতে করে তার হাটুর হাড় ভেঙে যায়। মাটিতে পড়ার পর ব্যথায় কান্না করছিলেন তিনি, মুহূর্তেই চারদিক মলিন হয়ে যায়। উপস্থিত দর্শকরা জানায়- হাড় ভাঙার শব্দ এতোটাই প্রকট ছিলো যে, মনে হয়েছিলো পিস্তলের গুলি ছোঁড়ার শব্দ! সেখানেই ২৮ বছর বয়সী লরেন্সের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। এরপর ১৯৯৭ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিলেন। খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। ইংল্যান্ডের হয়ে পাঁচ টেস্টে ১৮টি উইকেট এবং একটি ওডিআইতে চার উইকেট শিকার করা লরেন্সের সম্ভাবনাময় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে ভয়ানক ইনজুরিতে।
৫. বেও ক্যাসন (অস্ট্রেলিয়া)
ব্রাড হগের অবসরের পর তার সাম্রাজ্য ধরে রাখার দায়িত্ব পড়েছিল নিউ সাউথ ওয়েলসের চায়নাম্যান বোলার বেও ক্যাসনের হাতে। কিন্তু তার ভাগ্য খুব একটা সুপ্রসন্ন ছিলো না। জন্মগত হৃদরোগ ছিলো তার। খুব অল্প বয়সেই সার্জারি করতে হয় ক্যাসনকে। সার্জারি করার পরেও হার্টের অবস্থার উন্নতি হয়নি।
বেও ক্যাসন ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট ম্যাচ খেলেন। চায়নাম্যান অ্যাকশনে বল করে নিজের প্রথম উইকেট শিকার করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জ্যাভিয়ার মার্শালের। নিজের একমাত্র টেস্ট ম্যাচে তিন উইকেট শিকার করেন ক্যাসন। শেষপর্যন্ত ২০১১ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে সবধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি।
৬. জিওফ অ্যালট (নিউ জিল্যান্ড)
নিউ জিল্যান্ডের পেসার জিওফ অ্যালটের নাম অনেকের কাছেই পরিচিত। এখনও যে একটি বিশ্বরেকর্ড তার দখলে! তবে সেটি বল হাতে নয়। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অকল্যান্ড টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১০১ মিনিট এবং ৭৭ বল মোকাবেলা করে শূন্য রানে আউট হন তিনি। সবচেয়ে বেশি বল খেলে রানের খাতা খোলার আগেই আউট হওয়ার বিশ্বরেকর্ড এখনও তার দখলে।
আরও একটি কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে শেন ওয়ার্নের চেয়ে এক ম্যাচ কম খেলে ২০ উইকেট শিকার করে ঐ আসরের যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন অ্যালট। তার বোলিং নৈপুণ্যে নিউ জিল্যান্ড সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছায়। ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ করা অ্যালট দুরন্ত গতিতে ছুটছিলেন। কিন্তু পিঠের ইনজুরির দরুন বেশি দূর এগোতে পারেননি। ২০০০ সালেই মাত্র ২৯ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। জিওফ অ্যালট নিউ জিল্যান্ডের হয়ে ১০ টেস্টে ১৯টি উইকেট এবং ৩১টি ওডিআইতে ৫২ উইকেট শিকার করেন। তার স্বল্পদৈর্ঘ্য ক্যারিয়ারেই নিজেকে স্মরণীয় করে রেখে গেছেন।
৭. নরি কন্ট্রাক্টর (ভারত)
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুর্ভাগা ক্রিকেটারদের একজন হলেন নরি কন্ট্রাক্টর। মাত্র ২৮ বছর বয়সে ভারতের অধিনায়ক থাকাকালীন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে বাধ্য হন তিনি। ১৯৬২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম দুই টেস্টে পরাজিত হওয়ার পর বার্বাডোসে সিরিজের তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামে ভারত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং অ্যাটাকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন চার্লি গ্রিফিথ, ওয়েস হল এবং জর্জ রক। ২৩ বছর বয়সী চার্লি গ্রিফিথ ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কাছে অচেনা মুখ।
চার্লি গ্রিফিথ বোলিংয়ে আসলে ভারতীয় ক্রিকেটাররা অভিযোগ করে, তিনি অবৈধ বোলিং অ্যাকশনে বল করছেন। তার বলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যান্য পেসারদের মতো প্রচণ্ড গতি ছিলো। ভারতীয় অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টর, চার্লি গ্রিফিথের বাউন্সারে বসে না গিয়ে খেলতে চেয়েছিলেন। ব্যাটে-বলে না হওয়ার কারণে বল তার মাথার খুলিতে আঘাত হানে। যার ফলে তার জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। খুব দ্রুত অপারেশন করার ছ’দিন পর নরি কন্ট্রাক্টর কিছুটা স্বাভাবিক হন। নরি কন্ট্রাক্টর অভিষেক প্রথম শ্রেণীর ম্যাচের দুই ইনিংসেই শতক হাঁকান। ১৯৬১-৬২ মৌসুমে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্মরণীয় সিরিজ জয়ের অধিনায়কও তিনি ছিলেন। ভারতের হয়ে ৩১টি টেস্ট ম্যাচে ৩১.৫৮ ব্যাটিং গড়ে ১,৬১১ রান করেছিলেন।