ইনকা মমি ‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকোর উৎসর্গ’ ও ফিফা কর্তৃক গুরেরোর শাস্তি হ্রাস

আর্জেন্টিনার লুইয়াইয়াকো আগ্নেয়গিরির নিকটে একটি চূড়ায় মাটির ১.৫ মিটার গভীর প্রকোষ্ঠে দুই পা ভাজ করে বসে আছে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরী, সাথে রয়েছে ৪/৫ বছর বয়সী আরও দুই শিশু। প্রত্যেকের হৃদপিণ্ডে এখনও রক্তের চিহ্ন, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত। মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন বলে ভ্রম হতে পারে এই শিশুদের দেখে, কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

নিষ্পাপ এই শিশুরা প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার, যাদের বর্তমানে ডাকা হয় ‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকো’। ইনকা সভ্যতায় তাদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিনে, বিশাল রাজ্য সুরক্ষার ও অখণ্ডতা রক্ষার খাতিরে কিংবা মহামারি বা বিপর্যয় রোধে শিশু উৎসর্গের রীতি প্রচলিত ছিলো। ‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকো’রা হচ্ছে এমনই বিসর্জিত বা উৎসর্গ করা অগুনিত শিশুদের মধ্যে কয়েকজন। ‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকো’দের ১৯৯৯ সালে একদল অভিযাত্রী ও প্রত্নতত্ত্ববিদ যখন খুঁজে পায়, বরফাবৃত পর্বতে ততদিনে তারা সম্ভবত সবচেয়ে সেরা সুরক্ষিত মমিতে পরিণত হয়েছে।

নির্মম পরিণতির শিকার ‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকো’; Source: kadinsite.com

লুইয়াইয়াকোর চূড়ায় এই ইনকা শিশুদের হত্যা করে রেখে আসা হয়েছিলো বা সেখানে জীবিত উৎসর্গ দিয়ে এসেছিলো স্বজাতি লোকেরা মহান কিছু অর্জনের আকাঙ্ক্ষায়। বিশেষ যে উদ্দেশ্যে ইনকা এই শিশুদের বিসর্জন দেওয়া হয়েছিলো মৃত্যুর দুয়ারে, ঠিক সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছিলো কিনা তা হয়তো অজানাই থেকে যাবে। কিন্তু এই ‘চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকোদের’ কল্যাণে পেরুর তারকা খেলোয়াড় পাওলো গুরেরো বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরে খেলার স্বপ্ন বিপর্যস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পান। পেরুর কুসকো একসময় ছিলো বিশাল ইনকা সভ্যতার রাজধানী, সেই অর্থে বলা যায় সবকিছুর শুরু এখান থেকেই।

১৯৮২ সালের পর এই প্রথম বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে পেরু। বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করা সহজ কথা নয়, তা-ও আবার প্রায় ৩৫ বছর পর। যেকোনো দেশ কিংবা খেলোয়াড়ের জন্য ফুটবল বিশ্বকাপের মঞ্চ চির আরাধ্য, ব্যতিক্রম নন পাওলো গুরেরোও। হাতের মুঠোয় ধরা দেওয়া স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায় যখন ফিফা কর্তৃক ১ বছর যেকোনো ধরনের ফুটবলে গুরেরো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচের পর ৫ই অক্টোবরের অনুষ্ঠিত ড্রাগ পরীক্ষায় ব্যর্থ হয় পাওলো গুরেরো। তার শরীরে পাওয়া যায় কোকেনের উপজাত বেনজোয়লেকগোনিন, যা ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি ডোপিং এজেন্সির (WADA) কর্তৃক নিষিদ্ধ তালিকার অন্তর্ভুক্ত।

৩৫ বছর পর বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে পেরু; Source: the18.com

গুরেরো অবশ্য নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, “আমার মনে হচ্ছে যে আমার প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। আমি নির্দোষ। আমি এমন কিছুই করিনি। আমি রাগান্বিত।” তিনি জানান, পরিপাক ক্রিয়ার সমস্যার কারণে পেরুতে তিনি মৌরি চা এবং আর্জেন্টিনায় থাকাকালীন সময়ে জ্বরের কারণে কালো চায়ের সাথে লেবু ও মধু মিশিয়ে তা পান করেছিলেন। কোকেনের যে উপজাত তার শরীরে পাওয়া গিয়েছে তা হয়তো কোনো বয়াম বা কাপে ছিলো। তিনি আরও যোগ করেন, “আমি কোনো ধরনের কোকেন গ্রহণ করিনি। আমি এতটা পাগল নই যে আমি কোকা চা পান করবো, কারণ আমি জানি এটি আমাকে বিপদে ফেলবে।”

পেরুর অন্যতম ভরসা ও তারকা স্ট্রাইকার পাওলো গুরেরো; Source: fourfourtwo.com

গুরেরো নামটির অর্থ ‘যোদ্ধা’। গুরেরো ফিফার নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন এবং বিচারা নেতো নামের ব্রাজিলিয়ান উকিল নিয়োগ দেন। তার পেরুর হয়ে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের স্বপ্ন সত্যি করতে ফিফার ডিসিপ্লিনারি কমিটির সামনে নেতো এমন সাক্ষীর অবতারণা করলেন যা ছিলো এককথায় অবিশ্বাস্য।

নেতো ফিরে গিয়েছিলেন প্রায় ৫০০ বছর পূর্বের দৃশ্যপটে এবং ‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকো’র কাছে। ‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকো’দের উৎসর্গ করা হয়েছিলো দেবতাদের উদ্দেশ্যে এবং ইনকা সভ্যতায় এই নিষ্ঠুর উৎসর্গকে বলা হয় কাপাকোচা। কাপাকোচার জন্যে নির্বাচিত শিশুদের তৈরি করা হতে থাকে প্রায় ১ বছর ধরে, এরপর প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরে কোনো স্থানে নিয়ে তাদের হত্যা করা হয় কিংবা রেখে আসা হয় মৃত্যুর অপেক্ষায়। অনেকক্ষেত্রে শ্বাসরোধ করে, মাথায় আঘাত করে কিংবা জীবিত কবর দিয়ে দেওয়া হতো উৎসর্গ অনুষ্ঠান শেষে

আন্দিজ পর্বতের লুইয়াইয়াকোর চূড়ায় পাওয়া গিয়েছিলো ‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকো’দের; Source: penn.museum

‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকো’দের সাথেও এরকম কিছু একটা ঘটেছিলো, তাদের রেখে আসা হয়েছিলো সুদীর্ঘ পর্বতের শীর্ষে। এদের মধ্যে সবার বড় ও কিশোরী মেয়েটিকে ডাকা হয় ‘লা ডনসেইয়া’ নামে। ২০১৩ সালে ব্রাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ অ্যান্ড্রু উইলসন একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, সেখানে উঠে আসে ‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকো’দের জীবনের শেষ সময়ের করুণ, হৃদয়বিদারক ও নিষ্ঠুর পরিণতি। সিটি স্ক্যান এবং চুলে প্রাপ্ত কার্বন ও নাইট্রোজেনের আইসোটোপ পরীক্ষা করে জানা যায়, লা ডনসেইয়ার মৃত্যুর এক বছর পূর্বে খাদ্যাভ্যাসে আমূল পরিবর্তন আসে।

মাত্র একটি আলু খেয়ে জীবন ধারণ করা কিশোরীটি খাদ্য হিসেবে পেতে থাকে উন্নতমানের খাবার অর্থাৎ মাংস, শাকসবজি, এমনকি ইনকাদের অভিজাত পানীয় ‘চিচা’ও। চিচা শস্য থেকে তৈরিকৃত একধরনের নেশাজাতীয় পানীয়, যা ইনকাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে পান করা হতো। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে লা ডনসেইয়ার চিচা পান করার হার অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়, যা সম্ভবত তাকে অধিক মাত্রায় পান করানো হয়েছিলো নির্জন পর্বতে উৎসর্গ করার উদ্দেশ্যে, যেন সে অনুভূতিহীন, বোধশক্তিহীন এক নির্বাক মানুষে পরিণত হয়।

১৩ বছর বয়সী কিশোরী ‘লা ডনসেইয়া’র মমি; Source: megavselena.bg

একইসাথে কিশোরী মমির শরীরে বেনজোয়লেকগোনিনও পাওয়া যায়, আগেই বলা হয়েছে যা কোকেন গ্রহণের ফলে তৈরি একটি উপজাত। অবশ্যই লা ডনসেইয়া কোকেন ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রহণ করেনি। ইনকা রাজ্যে কোকেন ছিলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, যা শুধুমাত্র রাজ্যের অভিজাতরা ব্যবহার করতে পারতো। যেহেতু লা ডনসেইয়া ছিলো ইনকাদের নির্বাচিত একজন এবং উৎসর্গের জন্য তাকে তৈরি করা হচ্ছিলো সেহেতু তাকে কোকা পাতা খেতে দেওয়া হতো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। চূর্ণীকৃত লেবুর সাথে কোকা পাতা চিবুতে দেওয়া হতো, যা ক্লান্তি, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ব্যথা এবং উচ্চতার কারণে বিভিন্ন উপসর্গের বিরুদ্ধে কাজ করে। লা ডনসেইয়ার দাতেও কোকা পাতার অবশিষ্ট অংশ আটকে ছিলো বলে জানা যায়।

ফিফার আপিল কমিটির কাছে বিচারা নেতো লা ডনসেইয়ার ব্যাপারটি তুলে ধরেন, গুরেইরোর ড্রাগ পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া এবং লা ডনসেইয়ার চুলে প্রাপ্ত কোকেনের উপজাত একটি নির্দিষ্ট উপসংহার টেনে দেয়। ২০১৩ সালে উইলসনের প্রকাশিত গবেষণা পত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে কোকেনের উপজাত বেনজোয়লেকগোনিন মানুষের শরীরের শত বছর ধরে থাকতে পারে অর্থাৎ একটা দীর্ঘ সময় পরও তা শরীরে পাওয়া যেতে পারে। হয়তো গুরেইরো বহুদূরবর্তী কোনো এক অতীতে কোকা পাতা গ্রহণ করেছিলো যা একসময় ধর্মীয় ও পবিত্র উদ্দেশ্যে (!) চাষ করা হতো। যা-ই হোক, যুক্তির সাথে বিজ্ঞানের কল্যাণে প্রাপ্ত ফলাফল গুরেইরোর পক্ষেই গিয়েছে।

বিশাল ইনকা সভ্যতার একটি অংশের বর্তমান অবস্থা; Source: io9.gizmodo.com

২০১৭ সালের ২০ই ডিসেম্বর ফিফার আপিল কমিটি গুরেইরোর শাস্তি কমিয়ে ১ বছর থেকে ৬ মাসে কমিয়ে আনে। নভেম্বরের ৩ তারিখ থেকে গুরেইরোর নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ায় ৬ মাসের শাস্তি শেষ হবে এপ্রিলে এবং বাছাইপর্বে পেরুর হয়ে সর্বোচ্চ ৬ গোল করা এই স্ট্রাইকারের রাশিয়া বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করায় আর কোনো সংশয় থাকলো না। বিবৃতিতে ফিফা জানায় যে শাস্তি কমিয়ে অর্ধেক করার ক্ষেত্রে তারা সব ধরনের পরিস্থিতি ও খেলোয়াড়ের ভুলের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়েছে।

‘দ্য চিলড্রেন অব লুইয়াইয়াকোর’ ৫০০ বছর পূর্বের উৎসর্গ হয়তো পরোক্ষভাবে গুরেইরোর ভাগ্যে সুফল বয়ে এনেছে। কিন্তু এই নিরীহ শিশুদের প্রতি ইনকাদের নিষ্ঠুর আচরণ যতটা অমানবিক, তার চেয়ে কোনো অংশে ছিলো না গুরেইরোর শাস্তি কমানোর প্রক্রিয়ায় নেতো যেভাবে তাদের নির্মম ভাগ্যকে ব্যবহার করেছে।

ফিচার ইমেজ- youtube.com

Related Articles

Exit mobile version