আবার ভোর হলো, এবার তবে দোর খোলো!

অমন ভোরের দেখা তো এদেশ আগেও একবার পেয়েছিল।

আকরামের ব্যাটে যেদিন লেখা হয়েছিল সুগোই-বুলোর মহাকাব্য, কিলাত কেলাব মাঠে ইতিহাস লিখেছিলেন পাইলট-বুলবুলরাও। বাংলাদেশ জিতেছিল ১৯৯৭ আসরের আইসিসি ট্রফি, পেয়েছিল ওয়ানডে স্ট্যাটাস, পাঁচবার ব্যর্থ হয়ে ষষ্ঠবারে নাম তুলেছিল বিশ্বকাপের মঞ্চে। চারিদিকে রব উঠেছিল বেশ, ‘ভোরের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ!’

সেবার বেলা ফুরোবার আগেও তো মিললো কত-শত অর্জন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের রানার্সআপ পাকিস্তান পা হড়কালো সাতসকালেই, নবপ্রভাতের আলোয় জয় এলো কেনিয়া-স্কটল্যান্ডের বিপক্ষেও। টেস্ট মর্যাদা এলো মায়াবী দুপুরে, সাঁঝের আগে-আগে দেখা মিলেছিল এক মহাতারকার, মোহাম্মদ আশরাফুল রূপে।

সন্ধ্যা নামলো এরপরই। বিশাল সব পরাজয়ে রাত্রিও নামলো খুব সহসাই। শুরু হলো প্রতীক্ষা, নতুন ভোরের জন্য।

প্রতীক্ষা, নতুন ভোরের জন্যে; Image credit: Michael Steele/Getty Images

***

আভাস পাওয়া যাচ্ছিল সে বছরের গোড়াতেই। ২০০৪ সালে খেলা প্রথম ম্যাচেই জিম্বাবুয়েকে হারানো গিয়েছিল ৮ রানে। তখন অবশ্য হারারেতে পাওয়া ওই জয়কে দুর্যোগকালীন ত্রাণ-অনুদান বলেই চালাতে হচ্ছিল। নর্দাম্পটনে পাকিস্তান-বধের পরে ততদিনে বাংলাদেশের ঝুলিতে অভিজ্ঞতা জমেছিল আরও ৪৭ ম্যাচের, এবং কোনোটিতেই জয়ী দলের নাম বাংলাদেশ নয়!

জিম্বাবুয়ের সঙ্গে পাওয়া জয়ের কিছুদিন বাদে জয় এসেছিল হংকংয়ের বিপক্ষেও, বেশ কয়েক বছরের তমসাচ্ছন্ন সময়ের পর দেশের ক্রিকেটে যেন ফের ঊষালগ্নের পূর্বাভাস। নতুন ভোরের সূর্যের দেখা অবশ্য মিলেছিল আরও কিছুদিন বাদে, ডিসেম্বরের এক শিশিরভেজা রাতে।

নামে-ভারে বড় দলকে না হারালে কি আর নতুন দিনের ঘোষণা দেয়া চলে?

যে রাতে ভোর আসে; Image credit: FARJANA K. GODHULY/AFP via Getty Images

***

২৬ ডিসেম্বর, ২০০৪-এর সকালটা অবশ্য শুরু হয়েছিল বেশ নিস্তরঙ্গই। তৎকালীন বিরোধী দলের ডাকা বারো ঘণ্টার হরতালই যার একমাত্র কারণ। খেলা শুরুর মিনিট পনেরো আগেও তাই ধারণা করা যায়নি, গোটা দেশটাই সেদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভেঙে পড়তে চলেছে। কে জানে, জ্যোতিষী বনে গিয়ে আগেভাগেই সবাই জেনে গিয়েছিলেন কি না, আজ কিছু হতে চলেছে!

টসে জিতেছিলেন হাবিবুল বাশারই। একে তো সময় গড়ানোর সাথে সাথে উইকেট মন্থরতর থেকে মন্থরতম হবে বলে আভাস ছিল, সাথে আগের ম্যাচে ভারতের দেয়া মাঝারি লক্ষ্য তাড়া করতে নেমেও গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছিল তার দল, মাথায় রাখতে হয়েছিল সেটিও। বাশার সেদিন তাই ব্যাটিং বেছে নিতে দ্বিধা করেননি সুযোগ পেয়ে। আর ডেভ হোয়াটমোর তো ততদিনে বুঝিয়েই দিয়েছিলেন, শ্রীলঙ্কার ছিলেন সনাৎ জয়াসুরিয়া, বাংলাদেশের হবেন মোহাম্মদ রফিক।

বুঝলেন না কেবল জহির খান। রফিককে দিয়ে পিঞ্চ হিটিং করানোর চেষ্টা আগের তিন ম্যাচের মতো বৃথা গেল সেদিনও, তিনি ফিরলেন শূন্যতেই, দলীয় ১ রানে। রফিকের কিছু পরে নাফিস ইকবাল ফিরলেন অজিত আগারকারের আউটসুইংয়ে কট বিহাইন্ড হয়ে। ৩৩ মিনিট স্থায়ী ওই ইনিংস দেখা প্রতিটি দর্শক অবশ্য মনে মনে মেনেই নিয়েছেন ততক্ষণে, এমন কিছুই হবার ছিল। বাংলাদেশের রান তখন ২৬। ওহ, আগারকার হাজার রান পূর্ণ করেছিলেন এর আগেই, আর নাফিসের উইকেটটি ছিল একদিনের ক্রিকেটে তার ২০০ তম। ভারতীয় ক্রিকেটে এ দুইয়ের যোগ ঘটাতে পেরেছিলেন এর আগে কেবল একজনই, কপিল দেব।

***

উইকেট খুইয়ে বাশার বিমূঢ়; Image credit: FARJANA K. GODHULY/AFP via Getty Images

হাবিবুল বাশার এর আগের ম্যাচেই দেখে পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের নবম অর্ধশতকের। সেদিনও শুরু করেছিলেন বেশ আত্মবিশ্বাসীভাবেই। মোহাম্মদ রফিক আউট হয়েছিলেন যে ওভারে, ওই ওভারেই তার ব্যাট থেকে এসেছিল তিন চারের মার। কে ভেবেছিল, অমন দর্শনীয় অন ড্রাইভ আর কাভার ড্রাইভের ইনিংসটি ফুরিয়ে যাবে কেবল ১৭ রানেই!

চল্লিশের কমেই টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান হারানোর পরে জয়-পরাজয়ের চেয়েও বড় প্রশ্ন দেখা দেয় সম্মানজনক স্কোরে পৌঁছানো নিয়ে। মোহাম্মদ আশরাফুল আর আফতাব আহমেদ মিলে তাই ইনিংস মেরামতের চেষ্টাই করেছিলেন খানিকটা, দুজনে মিলে স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় বেয়েছিলেন ঠিক দশ ওভার। তাতে রান এসেছিল ৪৪, স্বভাবসুলভ ক্লাসের চিহ্ন রেখে আশরাফুল করেছিলেন ২৮ রান। জহির খানকে মারা স্ট্রেইট ড্রাইভ কিংবা মুরালি কার্তিকের একই ওভারে মারা চার-ছক্কা দেখে খুব সম্ভবত ঈর্ষা হচ্ছিল সেদিন বেঞ্চে বসে থাকা ক্রিকেট ঈশ্বরেরও।

আশরাফুলকে ফিরিয়েছিলেন সেই মুরালি কার্তিকই। আরও বহুবারের মতো আশরাফুল করিয়েছিলেন ক্যাচিং প্র‍্যাকটিস, যাতে বোলারের ভূমিকার চেয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ধীরগতির উইকেটের অবদানই সামান্য বেশি। যুবরাজ সিংয়ের অব্যর্থ নিশানায় রাজিন সালেহ সেদিন দশ বল খেলেও পারেননি রানের খাতা খুলতে। একশ পেরোনোর আগেই বাংলাদেশের অর্ধেক ব্যাটসম্যান সীমানাদড়ি পেরিয়ে গিয়েছেন দুবার, বিধাতার এমন গৎবাঁধা চিত্রনাট্যে বাংলাদেশের সমর্থকেরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন ততদিনে।

রাজিনের পর সেদিন রানআউট হয়েছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজনও, তবে মধ্যিখানে যোগ হয়েছিল ৯৯ রান। খালেদ মাসুদ দ্রুতগতিতে তুলেছিলেন ২০ রান, ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতকের দেখা পেয়েছিলেন আফতাব আহমেদ। আজ বহু বছর বাদে তার ৯১ বলে করা ৬৭ রানের চেয়েও বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে অবশ্য তার চতুর্থ, ষষ্ঠ আর সপ্তম উইকেটে গড়া ৪৪, ৪৪ আর ৩৬ রানের জুটিগুলোকে। একই কারণে দুই চারে খালেদ মাহমুদের করা সংগ্রামী সতেরো রানকেও এ পর্যায়ে এসে দিতে হচ্ছে মর্যাদা, তখন যে ইনিংস বিরক্তি ছড়িয়েছিল দর্শক-মনে।

আফতাব লড়াই করার মতো রান এনে দিয়েছিলেন সেদিন; Image credit: FARJANA K. GODHULY/AFP via Getty Images

***

ভারত সেদিন মাঠে নেমেছিল চার পরিবর্তনে। শচীনের নাম তো নেয়া হয়েছে আগেই, তার সঙ্গে বিশ্রামে পাঠানো হয়েছিল রাহুল দ্রাবিড়, ইরফান পাঠান আর হরভজন সিংকে। বাংলাদেশের তো সেই বিশ্রাম-জাতীয় বিলাসিতা দেখাবার সুযোগ ছিল না, মাশরাফি বিন মুর্তজাকে তাই দলে ফেরানো হয়েছিল মুশফিকুর রহমানের জায়গাতে।

সেদিন তিনি খেলতে নেমেছিলেন ক্যারিয়ারের ১৩তম ম্যাচ, ব্যাটিং পরিসংখ্যানে চোখ ফেরালে যার স্ট্রাইকরেটটাই কেবল উল্লেখ করার মতো, ৭৬.৬০। খুব আহামরি না হলেও তখন তো এটিই ছিল বাংলাদেশ-সর্বোচ্চ। মাশরাফি সেদিনও ব্যাট করেছিলেন ৮০ ছুঁই-ছুঁই স্ট্রাইকরেটে, ১৩০ স্ট্রাইকরেটে তাপস বৈশ্য। দুজনে মিলে নবম উইকেট জুটিতে যোগ করেছিলেন ৩৯ রান, বাংলাদেশের ইনিংস থামলো ২২৯ রানে। বাংলাদেশ শিবিরে তখন যা বয়ে এনেছিল স্বস্তির বাতাবরণ, আর ঘণ্টা তিনেক বাদে লিখেছিল ইতিহাস।

***

”We never thought he could return to cricket after all that he had to endure.”

কথাগুলো ম্যাচশেষে যিনি বলেছিলেন, সম্পর্কে তিনি মাশরাফির বাবা। আর যার সম্পর্কে বলা, সেই মাশরাফি একদিনের একাদশে সেদিনই ফিরেছিলেন ১৫ মাসের বিরতি শেষে, চোটাঘাতের সঙ্গে এক গভীরবন্ধনে যার গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গিয়েছে ততদিনে। ব্যাট হাতে ৩৯ বলে ৩১ রান করে মাশরাফি বুঝিয়েছিলেন নিজের মূল্য, তবে মূল কাজটা তো তাকে বল হাতেই করতে হতো। মাশরাফি সময় নিলেন তিন বল। বীরেন্দর শেবাগ ডিফেন্সমতোই কিছু করতে চেয়েছিলেন ভারতীয় ইনিংসের তৃতীয় বলে, তবে ব্যাট-প্যাডের মাঝে ফাঁক রেখেছিলেন অনেকটা। মাশরাফির ভেতরে ঢোকা বলটিকে স্ট্যাম্পে আঘাত হানতে তা ছিল যথেষ্ট। ভারত তখনো রানের খাতা খোলেনি।

মাশরাফির আরও একটি আবেদন; Image credit: FARJANA K. GODHULY/AFP via Getty Images

পরের আঘাত এলো তাপস বৈশ্যর হাত ধরে, এর আগের বলেই যাকে চার মেরে যুবরাজ সিং আভাস দিয়েছিলেন ভিন্ন কিছুর। যে বলে উইকেট মিললো, তাকেও হয়তো যুবরাজ সীমানাছাড়া করবেন অন্য যেকোনোবার। উইকেটের ধীরগতির কারণেই হোক, কিংবা সুনীল গাভাস্কারের উল্লেখ করা ‘কেয়ারলেসনেস’, যুবরাজের ব্যাকফুট ড্রাইভ সেদিন খুঁজে নিয়েছিল রাজিন সালেহকে। রাজিন সালেহ ভুল করেননি।

***

শুরুর ওই দুই উইকেট পতনেই বোধকরি ভারত ঢুকে গেল খোলসে, সে পরিস্থিতিতে আরেকটি উইকেট হারানো মানেই তো ম্যাচ হারার যাবতীয় যোগাড়যন্ত করে ফেলা। শুরুর দশ ওভারে রান এসেছিল ৩৪, সৌরভ গাঙ্গুলি আর শ্রীধরন শ্রীরাম মিলে ৮৩ বলে জুটি করলেন ৪৬ রানের। ভারতের প্রথম পঞ্চাশ এলো সতেরো ওভারে। খালেদ মাহমুদ সুজন তার স্লোয়ার বলের জাদু দেখালেন এরপরই।

১২২ কি.মি/ঘণ্টার বলটি সৌরভ চেয়েছিলেন ডাউন দ্য উইকেটে এসে খেলতে। এসেছিলেনও, তবে বলের পেসটা বোকা বানিয়ে গেল তাকে। শেষ মুহূর্তে সৌরভ চেয়েছিলেন শট না খেলতে, তবে ততক্ষণে বল উড়ে গিয়েছে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে, সেখানে ক্যাচ নেবার জন্যে মাশরাফি ছিলেন দাঁড়িয়ে। ভারত ৫১/৩।

দাদা, গন; Image credit: FARJANA K. GODHULY/AFP via Getty Images

হাবিবুল বাশার তখন চেষ্টা করছেন নতুন নামা মোহাম্মদ কাইফকে চেপে ধরতে। এক স্লিপসহ ত্রিশ গজি বৃত্তের ভেতর সাত ফিল্ডারকেও তো রাখলেন কিছুক্ষণ। সে লড়াইতে অবশ্য জিতলেন কাইফই। সুজনকে সীমানাছাড়া করলেন বার তিনেক, বাউন্ডারি আসতে শুরু করলো অপর প্রান্তেও। ভারতের ইনিংসের উজ্জ্বলতম অধ্যায় রচিত হলো ওই ১৮-২৯ ওভারের মাঝেই।

কাইফ ম্যাচসেরা হয়েছিলেন চট্টগ্রামে এর আগের ম্যাচেই। ঢাকার ম্যাচেও শুরু করলেন সেখান থেকেই, শ্রীরামও উইকেটে খুঁটি গেড়ে পড়ে রইলেন তার সঙ্গে। একবার অবশ্য তিনি স্ট্যাম্পিংয়ের সুযোগ দিয়েছিলেন রফিকের বলে, ধারাভাষ্যে থাকা সুনীল গাভাস্কারের কাছে যা আউট বলে মনে হলেও টিভি আম্পায়ার ওই আবেদনে ‘হ্যাঁ’ বলার দেবার কারণ দেখেননি।

শুরুতে বেশ সংযত থাকা শ্রীরাম হাত খুলতে শুরু করলেন এরপরই। রফিককে রিভার্স সুইপ করে সীমানাছাড়া করলেন পরপর দুই বলে, যার প্রথমটি তাকে এনে দিয়েছিল ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক। ভারতের তখন ৭ উইকেট হাতে রেখে চাই ১১৬ রান, বলসংখ্যা তখনও বাকি ১২৯টি।

বাংলাদেশের তখন এক জাদু চাই।

শ্রীরাম ‘ম্যাজিক’ দেখালেন, ওই ওভারেই। বল না দেখেই দৌড় শুরু করলেন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে, খালেদ মাসুদ স্ট্যাম্প উপড়ে বাংলাদেশকে এনে দিলেন লাইফলাইন।

না পারার কষ্টে পুড়ছেন শ্রীরাম, সাথে গোটা ভারত; Image credit: FARJANA K. GODHULY/AFP via Getty Images

বাংলাদেশের অবশ্য তখনো ম্যাজিক দেখানো বাকি ছিল কিছুটা। ফিল্ডিংয়ে সেদিন যেন দেখা মিলেছিল অন্য এক বাংলাদেশের, সৌরভ গাঙ্গুলি ম্যাচ শেষে স্বীকারও করে নিয়েছিলেন তা। প্রতি রান তুলতেই ভারতকে ঘাম ঝরাতে হচ্ছিল প্রচণ্ড। দীনেশ মঙ্গিয়া ফেরত গিয়েছিলেন শ্রীরামের কিছু পরেই। বাংলাদেশের ফিল্ডাররা মিলে জাদুর শেষ অংশ মেলে ধরলেন অবশেষে।

জাদুই তো, নইলে হাবিবুল বাশারের ওই বুড়ো শরীরে অমন ডাইভিং ক্যাচ নেবার ব্যাখ্যা কী! ১৭ বল পরে রাজিন সালেহ’র করা অদ্ভুত ভঙ্গির আন্ডারআর্ম থ্রোও যে বোলিং প্রান্তের স্ট্যাম্পে লেগে যাবে, আর তা বাজিয়ে দেবে দারুণ খেলতে থাকা মোহাম্মদ কাইফের বিদায়ঘণ্টা, এরও তো কোনো ব্যাখ্যা হয় না ‘জাদু’ শব্দের প্রয়োগ ছাড়া!

ব্যাট হাতে কোনো রান না করে, একটি ওভার বল না করেও ম্যাচের ভাগ্য বাংলাদেশের দিকে ঘুরিয়ে দেন রাজিন। মোহাম্মদ কাইফ বিদায় নেন ১০৩ মিনিটের লড়াই শেষে, ব্যক্তিগত ৪৯ রানে। ভারতের চাই তখনো আরও ৬০ রান, ক্রিজে আসার অপেক্ষায় তিন বোলার। যুবরাজের আউট হতে বাংলাদেশের সমর্থকদের উল্লাস দেখে হার্শা ভোগলের আউরানো বাক্যটি যেন আরও বেশি সত্য হয়ে দেখা দেয় ওই ক্ষণে,

“I don’t know they know what Christmas is, but this is something bigger!”

***

Image credit: FARJANA K. GODHULY/AFP via Getty Images

মাঠের বাইরে মোটরবাইক নিয়ে ততক্ষণে জড়ো হয়ে গিয়েছে হাজারখানেক তরুণ, টিম হোটেল অব্দি দলকে সংবর্ধনা দিতে হবে তো। টিএসসিও তখন লোকে লোকারণ্য, যেকোনো উপলক্ষ উদযাপনের অলিখিত প্রাণকেন্দ্র তো ওটাই।

একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের শততম ম্যাচ ছিল সেদিন, উদযাপনের বাড়াবাড়ি প্রত্যাশিতই ছিল। তবে ও যে শুধুই উদযাপনের আকাঙ্ক্ষা ছিল না, তার অনেকটা জুড়েই তো মিশে ছিল কোটি মানুষের জয় দেখবার হাহাকার। ৯৯ ম্যাচ খেলে ফেলার পরেও তো বাংলাদেশ জানেনি, ঘরের মাঠে আন্তর্জাতিক ম্যাচ জেতার স্বাদ কেমন হয়!

যোগিন্দর শর্মা সেই উৎসবে জল ঢালতে চেয়েছিলেন। জহির খানকে সাথে নিয়ে গড়েও ফেলেছিলেন ৩২ রানের জুটি। শেষ অব্দি অবশ্য বাংলাদেশের উৎসব খানিকটা বিলম্ব করা ছাড়া আর কোনো দুর্যোগ ঘটাতে পারেননি। যোগিন্দর শর্মা ব্যাট করতে চাচ্ছিলেন ২৯ রানে, তবে বাংলাদেশের বোলাররা তার জন্যে কোনো সঙ্গী রাখেনি।

পুরো ম্যাচের সঙ্গে শেষ দৃশ্যটাও কেমন যেন মিলে গেল প্রতীকী হয়ে। বাংলাদেশের ইনিংসের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন যে আফতাব আহমেদ, শেষটাও হলো পয়েন্ট থেকে করা তার রানআউটে। ভারত-বাংলাদেশের ব্যবধানটা তখনো পনেরো রানে। হার্শা ভোগলের কথা মানলে যে ফল আপনি বাঁধাই করে রেখেছেন সযতনে।

***

আশরাফুল-আফতাব মিলে যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন জিমন্যাস্টদের, একের পর এক ডিগবাজি দিয়ে গেলেন গোটা মাঠজুড়ে। হাবিবুল বাশারের বয়সটাও যেন কমে গেল হুট করে, তখন তিনি রীতিমতো লাফাচ্ছেন। ম্যাচসেরা মাশরাফির বাবাকে এক কোণে ছেঁকে ধরলেন সংবাদকর্মীরা, যিনি তার সন্তানকে বাংলাদেশের নামে লিখে দিয়েছেন ততক্ষণে।

ম্যাচসেরার ট্রফি হাতে মাশরাফি; Image credit: FARJANA K. GODHULY/AFP via Getty Images)

টেকনাফ-তেতুলিয়া উৎসবের নগরী হয়ে গিয়েছে সে ক্ষণে, রাবীদ ইমামের লেখা লাইনটিকে আবেগের বাড়বাড়ন্তি না ভাবলেই যার মর্ম বুঝবেন এ ক্ষণে,

“If the fairy godmother was to grant Bangladeshis one wish this very moment, you can bet your last dollar that they will want the night of December 26 to never end.”

অমন ধোঁয়া-ওঠা কুয়াশাচ্ছন্ন রাত্রিতেও যেন সূর্যটা দেখা গেল স্পষ্ট। ভিক্টোরি ল্যাপের নামে সূর্যের পানে ধাওয়া করতে করতে বাশার-মাশরাফিরা যেন বলছিলেন,

অনেক সাধনায় ভোর এলো, এবার তবে দোর খোলো!’

This article is in Bangla language. This article is on Bangladesh's victory against India in 2004. Necessary hyperlinks are attached inside.

Featured image © Getty Images           

Related Articles

Exit mobile version