সবেমাত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো। কিছু যুবক রাউন্ডার্স খেলছে পানামা নামের এক গ্রামে। রাউন্ডার্স খেলাটা কিছুটা বেসবলের মতো। আমাদের গ্রাম-বাংলার লাঠিখেলার সাথেও এর কিছু মিল পাওয়া যায়। যখন যুবকেরা রাউন্ডার্স খেলছিল, তখন মাঠের এককোণ থেকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল একটি বালক। শর্ট প্যান্ট পরিহিত বালকটির বয়স তখন বড়জোর আট হবে। হঠাৎ করে তার দিকে একটা বল তেড়ে আসতে লাগলো। একজন চেঁচিয়ে তাকে বললো বলটি ধরার জন্য। বালকটি প্রস্তুত ছিল না। তবুও ঝাঁপিয়ে পড়ে বলটি দক্ষতার সাথে তালুবন্দী করল সে। মাঠে যারা দর্শক ছিল, সবাই বিস্মিত হলো ছেলেটির এই অদ্ভুত দক্ষতা দেখে। যুবকদের মধ্যে একজন তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, আগে কখনও খেলেছে কিনা। সে জানালো, এর আগে কখনও খেলা হয়নি তার। তবুও তাকে প্রস্তাব দেওয়া হলো পরের রবিবারে বড় একটি ম্যাচে খেলার জন্য। মা-বাবাকে জিজ্ঞেস করে নিজের উত্তর জানাবে বলে সেখান থেকে বিদায় নিল ছেলেটি
তারা মা-বাবা দোটানায় ছিলেন তাকে খেলতে দেবেন কিনা তা নিয়ে। শেষপর্যন্ত অনুমতি দিয়ে দিলেন ছেলেকে, খারাপ কিছু তো আর করছে না। আর সেই রবিবার থেকেই শুরু হলো ছোট্ট ‘জর্জ হ্যাডলির’ পথ চলা। সেদিন প্রথম ম্যাচেই তার দিকে যতবার বল এসেছে, তালুবন্দী করেছে সে দুর্দান্ত দক্ষতা আর ক্ষিপ্রতার সাথে। এই পারফর্মেন্স দেখে ম্যাচ শেষে তাকে কাঁধে তুলে নেন দলের আরেকজন সদস্য।
জর্জ হ্যাডলি কিন্তু ইতিহাসে রাউন্ডার্স খেলে নন, অমর হয়ে আছেন ক্রিকেট খেলেই। ১৯০৯ সালের ৩০ মে পানামার কোলন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তারা বাবা ডিকোর্সি হ্যাডলি পানামা খালের অবকাঠামো নির্মাণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। হ্যাডলির যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন খাল খননের কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর চাকরির সন্ধানে তার পরিবার কিউবায় চলে যায়। জর্জ হ্যাডলি আগে থেকেই স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষ ছিলেন, ১৯১৯ সালে তার মা তাকে নিয়ে জ্যামাইকায় ফিরে আসেন। ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হওয়ার জন্য তাকে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। জর্জ হ্যাডলি কালাবার এলিমেন্টারি স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় স্কুল দলের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসাবে খেলতেন। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হবার কারণে গ্লাভস ছাড়াই তিনি উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পালন করতেন। হ্যাডলির সবচেয়ে প্রিয় ব্যাটিং পজিশন ছিলো ‘তিন’। ১৬ বছর বয়সে রেটাউন ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দেওয়ার পর তিনি নিজের প্রথম শতক হাঁকান তিন নাম্বারে ব্যাটিং করে। সেবারে প্রতিপক্ষ ছিল ক্লোভেলি ক্রিকেট ক্লাব।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শুভসূচনা
মাত্র ১৮ বছর বয়সে জ্যামাইকার হয়ে প্রথমবারের মতো প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেন হ্যাডলি। লর্ড টেনিসন্স একাদশের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে তিনি ১৬ এবং ৭১ রানের ইনিংস খেলেন তিন নাম্বারে ব্যাটিং করে। পরের ম্যাচে তিনি ২১১ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন, যেটি তৎকালীন সময়ে কোনো ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানের ইংলিশ ক্লাবের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। একই সিরিজের শেষ ম্যাচে ৪০ এবং ৭১ রানের ইনিংস খেলে সবার নজর কাড়েন তিনি। লর্ড টেনিসন্স একাদশের বিপক্ষে তিনি তিন ম্যাচের সিরিজে ৮১.৮০ ব্যাটিং গড়ে ৪০৯ রান করার পর ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ড সফরের জন্য আলোচনায় আসেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি সুযোগ পেলেন না। সেটিই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট সিরিজ। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজের সবকটি ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হ্যাডলির পথচলা
১৯২৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে দলে জায়গা না পেলেও, দু’বছর পর ঠিকই জায়গা করে নেন হ্যাডলি। ১৯৩০ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি অভিষেক টেস্ট ম্যাচ খেলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। অভিষেক টেস্ট ম্যাচের প্রথম ইনিংসে তিনি ২১ রান করে ফিরে গেলেও পরের ইনিংসে ১৭৬ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেক টেস্টে শতক হাঁকানোর কীর্তি গড়েন। তার দুর্দান্ত শতকের কল্যাণে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট ক্রিকেট প্রথম ম্যাচ ড্রয়ের স্বাদ পায়। চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় পোর্ট অফ স্পিনে। এই ম্যাচে আর জর্জ হ্যাডলির ব্যাট কথা বলেনি। প্রথম ইনিংসে মাত্র আট রান করে আউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৯ রান করে সাজঘরে ফেরেন। ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটি ১৬৭ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়।
জর্জটাউনে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে জর্জ হ্যাডলির ব্যাটে চড়ে ঘুরে দাঁড়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টস ভাগ্যে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান রোচের দ্বি-শতকের পাশাপাশি জর্জ হ্যাডলির ১১৪ রানের উপর ভর ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংসে ৪৭১ রান সংগ্রহ করে। জবাবে ইংল্যান্ড মাত্র ১৪৫ রানে অল আউট হয়ে যায়। দ্বিতীয় ধাপে ব্যাট করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সংগ্রহ করে ২৯০ রান। এর মধ্যে জর্জ হ্যাডলি একাই করেন ১১২ রান। জর্জটাউন টেস্টের দুই ইনিংসে শতক হাঁকান হ্যাডলি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এই কীর্তি গড়েন তিনি। তার জোড়া শতকে ইংল্যান্ডকে ২৮৯ রানের বড় ব্যবধানে পরাজিত করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজ তখন ১-১ এ সমতায়।
এমতাবস্থায় দুই দল সিদ্ধান্ত নিলো, ম্যাচের ফলাফল না আসা পর্যন্ত ম্যাচটি চলতে থাকবে। অর্থাৎ ‘টাইমলেস টেস্ট ম্যাচ’। জ্যামাইকার কিংস্টনে চতুর্থ এবং শেষ টেস্টে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় ইংল্যান্ড। ওপেনার অ্যান্ড্রু সান্দহামের ট্রিপল সেঞ্চুরিতে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ২৫৮.২ ওভার ব্যাট করে ৮৪৯ রান করে। জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাত্র ২৮৬ রানে গুটিয়ে যায়। জর্জ হ্যাডলি করেন মাত্র ১০ রান। ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসে ২৭২ রান করলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৮৩৬ রানের! এই ম্যাচে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে জয় ছাড়া আর কোনো বিকল্পও নেই। তখনই দলের হাল ধরেন জর্জ হ্যাডলি। ৩৮৫ বল খেলে করেন ২২৩ রান। ম্যাচের সপ্তম দিন শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৫ উইকেটে ৪০৮ রান সংগ্রহ করেছিলো। জয়ের জন্য তখনও ৪২৮ রান দরকার। কিন্তু পরবর্তী দুদিনে বৃষ্টির কারণে বল মাঠে না গড়ালে দুই দলের সম্মতিতে ম্যাচ ড্র ঘোষণা করা হয়। জর্জ হ্যাডলি চার ম্যাচের সিরিজে ৮৭.৮৭ ব্যাটিং গড়ে ৭০৩ রান করেন।
ব্ল্যাক ব্রাডম্যানের প্রতিদ্বন্দ্বী ডন ব্রাডম্যান
জর্জ হ্যাডলি তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মাত্র একবার অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়াও সেসময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে আসেনি। অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথম চারটি অস্ট্রেলিয়া বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে জিতে নেয়। জর্জ হ্যাডলিও ব্যাট হাতে ছিলেন অসফল। সিরিজের প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংসে গোল্ডেন ডাক মারার পর প্রথম আট ইনিংসে মাত্র একটি শতক হাঁকান তিনি।
সিডনীতে সিরিজের পঞ্চম এবং শেষ টেস্টে জর্জ হ্যাডলি প্রথম ইনিংসে ১০৫ ও ৩০ রানের ইনিংস খেলেন। সেই সুবাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩০ রানের জয় পায়। জর্জ হ্যাডলি ঐ সিরিজের পাঁচ ম্যাচে ৩৭.৩৩ ব্যাটিং গড়ে ৩৩৬ রান করেছিলেন। অন্যদিকে ডন ব্রাডম্যান ৭৪.৫০ ব্যাটিং গড়ে ৪৪৭ রান করেছিলেন সে সিরিজে। দুজনেই দুটি করে শতক হাঁকিয়েছিলেন। ব্র্যাডম্যান দুটি শতককেই বড় ইনিংসে পরিণত করেন। তার দুটি ইনিংস ছিল ২২৩ এবং ১৫২ রানের। অন্যদিকে হ্যাডলির দুটি শতক ১০২* এবং ১০৫ রানেই থেমে যায়।
জর্জ হ্যাডলির কীর্তি গাঁথা
জর্জ হ্যাডলি তার ক্যারিয়ারের প্রথম সিরিজ খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। নিজের অভিষেক টেস্ট সিরিজে ৮৭.৮৭ ব্যাটিং গড়ে ৭০৩ রান করেছিলেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩৩, ১৯৩৫ এবং ১৯৩৯ সালে আরো তিনটি সিরিজ খেলেছিলেন হ্যাডলি।
১৯৩৩ সালের ইংল্যান্ড সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তিনটি টেস্ট ম্যাচ খেলে। কুখ্যাত বডি লাইন সিরিজের পরপরই এই সিরিজটি অনুষ্ঠিত হয়। সিরিজটি জর্জ হ্যাডলি ভালো-খারাপে কাটান। লর্ডসে প্রথম টেস্টে ১৩ এবং ৫০ রানের ইনিংস খেলার পর, ম্যানচেস্টারে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৬৯* রানের ইনিংস খেলেছিলেন। যোগ্য সঙ্গীর অভাবে শেষপর্যন্ত তাকে অপরাজিত থেকেই মাঠ ছাড়তে হয়। দুর্দান্ত এই ইনিংস খেলার পর সিরিজের বাকি তিনটি ইনিংসে ২৪, ৯ এবং ১২ রান করে সাজঘরে ফিরে যান তিনি। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে তিনি ৫৫.৪০ ব্যাটিং গড়ে সংগ্রহ করেছিলেন ২৭৭ রান।
দু’বছর পর ১৯৩৫ সালে আবারো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজ আয়োজন করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই সিরিজটি ছিল জর্জ হ্যাডলির ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য একটি সিরিজ। সিরিজের প্রথম তিন ম্যাচে দুটি অর্ধশতক হাঁকালেও শতকের দেখা পাননি হ্যাডলি। কিংস্টনে একাই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেন তিনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টসে জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ইনিংসে জর্জ হ্যাডলির নান্দনিক ২৭০* রানের ইনিংসের উপর ভর করে সাত উইকেটে ৫৩৫ রান সংগ্রহ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্যক্তিগত কীর্তির কথা না ভেবে দলের প্রয়োজনে সেদিন ট্রিপল সেঞ্চুরির মায়া করেননি তিনি। শেষপর্যন্ত ইংল্যান্ডকে ইনিংস ও ১৬১ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে সিরিজ জয় নিশ্চিত করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টেস্ট ইতিহাসে এটিই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম সিরিজ জয়ের রেকর্ড। চার ম্যাচের এই সিরিজে জর্জ হ্যাডলি ৯৭ ব্যাটিং গড়ে ৪৮৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
সেসময় খুব বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো না। হলেও ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেই সেগুলো সীমাবদ্ধ থাকতো। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৩৫ সালের পর পরবর্তী সিরিজ খেলে চার বছর পরে, ১৯৩৯ সালে। এবারও প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিল ইংল্যান্ড। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জর্জ হ্যাডলির শেষ টেস্ট সিরিজ ছিল। নিজের শেষ টেস্ট ইনিংসে ২৭০* রান করার চার বছর পর লর্ডসে খেলতে নেমে জোড়া শতক হাঁকান হ্যাডলি। তার জোড়া শতকের পরও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটি আট উইকেটে হেরেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো থাবায় কবলিত হ্যাডলির ক্যারিয়ার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জর্জ হ্যাডলির ১৯টি টেস্ট ম্যাচের ক্যারিয়ার বেশ সমৃদ্ধ এবং উজ্জ্বল ছিল। তিনি এই ১৯ ম্যাচে ৬৬.৭১ ব্যাটিং গড়ে করেছিলেন ২,১৩৫ রান। পাঁচটি অর্ধশতকের সাথে হাঁকিয়েছিলেন ১০টি শতক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে নয় বছরের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে ছিলেন। বয়স তো আর থেমে থাকে না। নিজের সেরা সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই খেলতে পারেননি। নয় বছর পর হ্যাডলি যখন পুনরায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেলেন, তখন তার বয়স ৪০ ছুঁইছুঁই।
অতঃপর ক্রিকেট থেকে বিদায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালের শুরুর দিকে ব্রিজটাউনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচ খেলেন হ্যাডলি। ঐ ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ২৯ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে করেন অপরাজিত সাত রান। একই বছরের শেষদিকে ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম এবং শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেন হ্যাডলি। ঐ ম্যাচেও সুবিধা করতে পারেননি, মাত্র দুই রান করেই সাজঘরে ফিরে গিয়েছিলেন। নিজের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেন আরও ছয় বছর পর, ১৯৫৪ সালে। এবারও প্রতিপক্ষ সেই ইংল্যান্ড। নিজের শেষ টেস্ট ম্যাচে ৪৫ বৎসর বয়সী হ্যাডলি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। প্রথম ইনিংসে ১৬ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে করলেন মাত্র এক রান। বিশ্বযুদ্ধের পর তিনটি টেস্ট খেলে সংগ্রহ করেছিলেন মাত্র ৫৫ রান। এতে করে তার ব্যাটিং গড় কমে ৬৬ থেকে ৬০-এ নেমে দাঁড়িয়েছিল। তবুও তিনি তার সময়কার একজন দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান ছিলেন। তাকে ‘দ্য ব্ল্যাক ব্রাডম্যান’ উপাধি দেওয়া হয়েছিলো।
গ্রেটনেসের সূচক কোনো একটি বিষয় সবার সামনে সহজভাবে উপস্থাপন করার জন্য উদাহরণ এবং তুলনা করে ব্যাখ্যা করলে খুব সহজেই বোঝানো যায়। যেমন- জর্জ হ্যাডলি সেসময় দলের কতটা গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন সেটা বোঝাতে হলে তার পারফর্মেন্সের সাথে দলের অন্য সদস্যের পারফর্মেন্স তুলনা করলেই সবার কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আর ক্রিকেটে কে কতটা ভালো পারফর্মেন্স করেছিলো সেটা পরিসংখ্যান দিয়েই ব্যাখ্যা করা হয়। হ্যাঁ, শুধুমাত্র পরিসংখ্যান দিয়ে একজন ক্রিকেটারকে বিচার করা যায় না। এমন অনেক ক্রিকেটার আছেন, যাদের পক্ষে পরিসংখ্যান কথা বলে না; কিন্তু তারাও ক্রিকেট বিশ্বকে তাক লাগিয়ে গিয়েছেন।
জর্জ হ্যাডলির ব্যাপারটা ভিন্ন, পরিসংখ্যান এবং ক্লাস দুটোই তার পক্ষে কথা বলে। শর্ট বলে তার হুক শট বোলারদের মনোবল নিমিষেই ভেঙে দিতো। জর্জ হ্যাডলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯ ম্যাচে ৬৬.৭১ ব্যাটিং গড়ে ২,১৩৫ রান করেছিলেন। এই ১৯ ম্যাচে পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল করেছিলো ৮,৩৩৫ রান। অর্থাৎ দলের ২৫.৬১% রান এসেছে হ্যাডলির ব্যাট থেকে। সেসময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন ক্লিফোর্ড রোচ। তিনি ৩২ ইনিংসে করেছিলেন ৯৫২ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানদের প্রথম ১৪টি শতকের মধ্যে ১০টিই হ্যাডলির দখলে ছিল। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ডন ব্র্যাডম্যানের পর সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড়ে রান করেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনটি টেস্ট খেলার কারণে তার ব্যাটিং গড় কমে ৬০.৮৩ এ দাঁড়িয়েছিল। তবুও সেসময় দ্বিতীয় সেরা ব্যাটিং গড় তার দখলে ছিল। এরপরে গ্রায়েম পোলক এসে তাকে তৃতীয় স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে দুই অজি ব্যাটসম্যান অ্যাডাম ভোজেস এবং স্টিভ স্মিথ যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছেন।
টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় (কমপক্ষে ২০ ইনিংস)
জর্জ হ্যাডলির প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারও বেশ সমৃদ্ধ। তিনি ১০৩টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৬৯.৮৬ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৯,৯২১ রান। হ্যাডলি ৩৩টি শতকের বিপরীতে ৪৪টি অর্ধশত রানের ইনিংস খেলেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কমপক্ষে ৫০টি ইনিংসে ব্যাট করা ক্রিকেটারদের মধ্যে তার ব্যাটিং গড় তৃতীয় সর্বোচ্চ। তার উপরে আছেন ডন ব্র্যাডম্যান এবং ভারতীয় ওপেনার বিজয় মারচ্যান্ট।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় (কমপক্ষে ৫০ ইনিংস)
জর্জ হ্যাডলির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তিনি পঞ্চাশ রান করেই সন্তুষ্ট থাকতেন না। সেটাকে একশতে পরিণত করতেন নিয়মিত। তার আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ারে ৫টি অর্ধশতকের বিপরীতে আছে ১০টি শতক। মাত্র ৪০ ইনিংসে তিনি এই ১০টি শতক হাঁকিয়েছেন। তার মানে, প্রতি চার ইনিংসের মধ্যে একটি শতক। ডন ব্র্যাডম্যানের ২.৭৬ ইনিংস প্রতি শতক হাঁকানোর রেকর্ডের পরই জর্জ হ্যাডলি অবস্থান করছেন। টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার গড়ে ৫.৭৭টি ইনিংসে একটি শতক হাঁকিয়েছিলেন। জর্জ হ্যাডলি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ২২টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন। এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাঁচটিতে জয় পেয়েছিল। এই পাঁচ জয়েই বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন হ্যাডলি। চারটি শতকের সাহায্যে ৯৫.৭৫ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৭৬৬ রান। এখানেও তার উপরে শুধুমাত্র ডন ব্র্যাডম্যান। ব্র্যাডম্যান ১৩০.০৮ ব্যাটিং গড়ে করেছিলেন ৪,৮১৩ রান।
জর্জ হ্যাডলির ক্যারিয়ার ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যান্য ক্রিকেটারের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ। সেসময় ওয়েস্ট ইন্ডিজে তারকা ব্যাটসম্যান বলতে হ্যাডলিই ছিলেন। তার দেখাদেখি ওয়েস্ট ইন্ডিজে আরও অনেক প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানের জন্ম হয়েছিলো। জর্জ হ্যাডলি ৩০ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, আর এই ৩০ তারিখেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ১৯৮৩ সালের ৩০ নভেম্বর জ্যামাইকার কিংস্টনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ক্রিকেটের ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান।
ফিচার ছবিসূত্র: Jamaica Gleaner