‘হেক্সা’ জয়ের মিশন নিয়ে এবারের বিশ্বকাপ খেলতে কাতারে পা রেখেছিল ব্রাজিল। শেষ ১৬’তে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ ব্যবধানে বিধ্বস্ত করে কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখার পর ব্রাজিলকে ঘিরে আশার পারদ আরো বাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে গতবারের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়ার সাথে হেরে বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে পড়েছে নেইমাররা।
এবারের বিশ্বকাপের ফেভারিটদের তালিকায় ব্রাজিলের নাম প্রথম সারিতেই ছিল৷ এর কারণও আছে বৈকি; নেইমার-রাফিনহা-ভিনিসিয়াস-রিচার্লিসনদের নিয়ে গড়া ব্রাজিলের আক্রমণভাগ যেকোনো দলের রক্ষণকেই দুমড়ে-মুচড়ে দিতে সক্ষম। তাছাড়া ব্রাজিলের বেঞ্চে বসে ছিল অ্যান্থনি, রদ্রিগো, মার্টিনেল্লি, জেসুসের মতো তারকারা। তাই এই ব্রাজিল দল নিয়ে বাজি ধরার মানুষের অভাব ছিল না।
এত তারকাবহুল দল নিয়েও তাহলে ব্রাজিলকে কেন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হলো? এর পেছনে সম্ভাব্য অনেক কারণ উঠে আসলেও মূলত ব্রাজিলের কোচ তিতের কিছু ভুল কৌশলের কারণেই ব্রাজিলকে ছিটকে পড়তে হয়েছে।
ফুটবলে একটা দলের খেলাকে মোট চারটি ভাগে ভাগ করা যায়: ডিফেন্স, অ্যাটাক, ডিফেন্স-টু-অ্যাটাক ট্রানজিশন, এবং অ্যাটাক-টু-ডিফেন্স ট্রানজিশন। এর মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে অ্যাটাক-টু-ডিফেন্স ট্রানজিশন। কোনো দল আক্রমণে থাকার সময় হুট করে বলের দখল হারালে তখন তাদের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের অবস্থান অনেকটাই অগোছালো থাকে। এই অল্প সময়টাতে প্রতিপক্ষের প্রতিআক্রমণ আটকাতে তারা কীভাবে অবস্থান করে, সেটাই হচ্ছে মূলত অ্যাটাক-টু-ডিফেন্স ট্রানজিশন।
তিতের অধীনে প্রায় পুরোটা সময়ই ব্রাজিলের অ্যাটাক-টু-ডিফেন্স ট্রানজিশনে দুর্বলতা চোখে পড়েছে। এর পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে।
এই বিশ্বকাপে ব্রাজিল কাগজে-কলমে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে খেলতে নামলেও মাঠে তাদের ফর্মেশন ছিল ৪-১-৪-১। মিডফিল্ডে ক্যাসেমিরো খেলেছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের ভূমিকায়। মিডফিল্ডে ক্যাসেমিরোর উপরে অপর দু’জন ছিলেন নেইমার এবং পাকেতা; যাদের কেউই তেমন পরিশ্রমী নন; যে কারণে আক্রমণের সময় বলের দখল হারালে প্রতিপক্ষের পক্ষে খুব সহজেই ব্রাজিলের মাঝমাঠকে বাইপাস করে আক্রমণে উঠে পড়া সম্ভব হয়েছে।
গ্রুপপর্বে ব্রাজিলের মুখোমুখি হওয়া সার্বিয়া বা সুইজারল্যান্ডের কেউই ব্রাজিলের বিরুদ্ধে দ্রুতগতিতে প্রতিআক্রমণে উঠার সাহস করেনি; যে কারণে তাদের বিপক্ষে ব্রাজিলকে তেমন একটা বিপদে পড়তে হয়নি৷ শেষ ১৬’তে কোরিয়ার ভুল ট্যাকটিক্সের কারণে তাদের মিডফিল্ডাররাও নেইমার-পাকেতাদের বিপক্ষে সুবিধা করতে পারেনি। এরপরও দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিলের ডিফেন্স এবং মিডফিল্ডের মধ্যবর্তী ‘বিটুইন দ্য লাইনে’ দক্ষিণ কোরিয়ার স্ট্রাইকাররা প্রচুর ফাঁকা জায়গা খুঁজে বের করতে পেরেছেন, তাদের একমাত্র গোলটাও এসেছে ‘বিটুইন দ্য লাইন’-এর ফাঁকা জায়গা থেকে লং শটের মাধ্যমে।
ক্রোয়েশিয়ার কোচ দালিচ এই সুযোগটা খুব ভালোভাবেই কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছেন। ক্রোয়েশিয়ার কোভাচিচ-ব্রোজোভিচ-মদরিচ মিডফিল্ডত্রয়ীর বিপক্ষে ম্যাচের শুরু থেকেই সুবিধা করতে পারছিল না ব্রাজিলের মিডফিল্ডাররা। এজন্য বারবার তাদের সহজাত বিল্ডআপ বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এই সমস্যা সমাধানে তিতে তার দুই ফুলব্যাক দানিলো এবং মিলিতাওকে মাঠের আরেকটু মাঝের দিকে চাপিয়ে দেন, যাতে করে তারা নেইমার-পাকেতাদের সামনে বাড়তি পাসিং অপশন তৈরি করতে পারেন।
দানিলো লেফটব্যাক পজিশনে খেললেও তিনি মূলত একজন রাইটব্যাক। আবার ব্রাজিলের লেফট উইঙ্গার ভিনিসিয়াস জুনিয়র নিচে নেমে রক্ষণে কোনোরকম সহায়তা না করায় নিচে দানিলো বেশ কয়েকবারই চাপের মুখে পড়েছেন। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার রাইট উইঙ্গার পাসালিচ খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় পুরো ম্যাচে এইদিক দিয়ে বেশি আক্রমণ করলেও এদিকে ব্রাজিলকে বিপদের মুখোমুখি হতে হয়নি।
ব্রাজিলের রাইটব্যাক মিলিতাও মূলত একজন সেন্টারব্যাক। কিন্তু ব্রাজিলের রাইট উইঙ্গার রাফিনহা রক্ষণে বেশ সহায়তা করায় তাকেও তেমন একটা বিপদের মুখে পড়তে হয়নি।
অতিরিক্ত সময়ে গোল করার পর তিতে মিলিতাওকে তুলে আলেক্স সান্দ্রোকে নামান, এবং দানিলোকে রাইটব্যাক পজিশনে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন৷ তখন ব্রাজিলের রাইট উইঙ্গার হিসেবে ছিলেন অ্যান্থনি। মাঠের এইপাশে তাদের মধ্যকার বোঝাপড়ার অভাব ছিল স্পষ্ট, ক্রোয়েশিয়া এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ম্যাচটা ব্রাজিলের হাত থেকে বের করে নেয়।
সাধারণত অ্যাটাক ডিফেন্স ট্রানজিশনে প্রতিপক্ষের প্রতিআক্রমণের সময় রক্ষণকারী দলের রাইটব্যাক বল পায়ে থাকা খেলোয়াড়কে সরাসরি চার্জ না করে তার জোন আটকে রেখে মুভমেন্ট ধীরগতির করে দিতে চেষ্টা করেন, যাতে করে এই অল্প সময়ে উইঙ্গার নিচে নেমে বলবাহককে প্রেস করে বল ছিনিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতিতে ব্রাজিল বেশ কয়েকবারই দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে।
ম্যাচের তখন ১০৭ মিনিটের খেলা চলছে। ক্রোয়েশিয়ার সেন্টারব্যাক গাভার্দিওল পেরিসিচকে লক্ষ্য করে লেফট উইংয়ে পাস বাড়ান।
পেরিসিচ তখন মিলিতাওয়ের সাথে ওয়ান-অন-ওয়ান অবস্থানে। ক্রোয়েশিয়ার লেফটব্যাক সোসা উইং ধরে কোনো ওভারল্যাপিং রান না নিয়ে পেরিসিচের অনেকটা নিচেই অবস্থান করেন। এরপরও অ্যান্থনি দানিলোর সাপোর্টে যাননি; ফলস্বরূপ, পেরিসিচ দানিলোকে বিট করে বক্সে ক্রস করার সুযোগ পেয়ে যান।
এর ঠিক কিছুক্ষণ পরই আবারও পেরিসিচ উইংয়ে বল পান, এবার অ্যান্থনির সাথে ওয়ান অন ওয়ান ব্যাটলে। এবারও দানিলোর সাথে অ্যান্থনির কোনো কানেকশন নেই; যে কারণে এবারও পেরিসিচ ব্যাটলে জিতে যান।
আবারও টাচলাইন এরিয়ায় সোসার কাছ থেকে পেরিসিচ বল রিসিভ করেন। এসময় মদরিচ থার্ড ম্যান রান নেন। ফ্রেড ডিফেন্সে নেমে কর্ণারের বিনিময়ে এবারের মতো ব্রাজিলকে বিপদমুক্ত করেন। কিন্তু এবারও অ্যান্থনি কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
এবার ক্রোয়েশিয়ার গোলের সময়টাতে আসা যাক। মিডফিল্ড ব্যাটেলে জিতে বল মদরিচের পায়ে আসার পর ক্যাসেমিরো তাকে প্রেস করতে উপরে উঠে আসে। বলাই বাহুল্য, ক্যাসেমিরোই ব্রাজিলের রক্ষণভাগের সামনে একমাত্র ঢাল হিসেবে ছিলেন; তাই তাকে অতিক্রম করতে পারলে ব্রাজিলের রক্ষণে ঢুকে পড়া খুবই সহজ ব্যাপার। মদরিচও সাথে সাথেই ভ্লাসিচের আড়াআড়ি রান লক্ষ্য করে পাস বাড়ান।
এ মুহূর্তে ব্রাজিলের রক্ষণভাগের অর্গানাইজেশনের দিকে খেয়াল করি। ভ্লাসিচ বল রিসিভ করার পর ক্রোয়েশিয়ার ৩ স্ট্রাইকারকে আটকানোর জন্য ব্রাজিলেরও ছিল তিনজনই ডিফেন্ডার। তিনজনের কেউই ভ্লাসিচকে আটকাতে সামনে এগিয়ে আসেননি, সবাই নিজের পেছনের স্পেস কভার করতে রান নিয়েছেন। আলেক্স সান্দ্রো কিছুটা চেষ্টা করলেও তার পক্ষে এতোটা জায়গা কভার করা সম্ভব ছিল না।
এবার ক্রোয়েশিয়ার স্ট্রাইকার ভুদিমির ইনসাইড এরিয়ায় রান নিয়ে দানিলোকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসেন। ফলে টাচলাইনে লেফট উইঙ্গার ওরসিচের সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়।
বক্সের ভেতর থেকে ওরসিচের কাটব্যাক থেকে বল জালে জড়িয়ে দিতে কোনো ভুলই করেননি ক্রোয়াট স্ট্রাইকার ব্রুনো পেৎকোভিচ।
ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের দুর্বল ট্রানজিশনের প্রমাণ তো পাওয়া গেল। এবার টাইম মেশিনে করে চার বছর আগের রাশিয়া বিশ্বকাপের সময়ে ফিরে যাওয়া যাক।
রাশিয়া বিশ্বকাপে ব্রাজিল বাদ পড়েছিল আরেক ইউরোপীয় দল বেলজিয়ামের কাছে ২-০ গোলে হেরে। সে ম্যাচেও ব্রাজিলের হারের পেছনে সবচেয়ে বড় দায় ছিল তিতের দুর্বল ট্রানজিশন সিস্টেমের।
প্রথম উদাহরণটি ম্যাচে শুরুতে ব্রাজিলের আক্রমণের সময়কার। বেলজিয়ামের বক্সের বাইরে আক্রমণের সময় ব্রাজিল বলের দখল হারায়।
এ সময় ব্রাজিলের দুই মিডফিল্ডার ফার্নান্দিনহো এবং পাউলিনহো বেলজিয়ামের আক্রমণ রুখে দিতে প্রেস করতে আসে। কিন্তু তখনো লেফটব্যাক মার্সেলো নিচে নেমে তার জোন কভার করেননি; যে কারণে সহজেই ব্রাজিলের মিডফিল্ড লাইন বাইপাস হয়ে যায়। ব্রাজিলের সেন্টারব্যাক মিরান্ডা ফাউলের বিনিময়ে এ যাত্রায় দলকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন।
এবার বেলজিয়ামের দ্বিতীয় গোলের সময় ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের অবস্থানের দিকে খেয়াল করা যাক। নিজেদের থার্ডে বলের দখল ফিরে পাবার সাথে সাথে বেলজিয়াম কাউন্টার অ্যাটাকে উঠতে শুরু করে। এ সময় ফার্নান্দিনহো লুকাকুকে প্রেস করতে গেলে লুকাকু ড্রিবল করে তাকে অতিক্রম করে ফেলেন। বেলজিয়ামের রাইট উইংয়ে তখন দুইজন ম্যানমার্কিং-ফ্রি খেলোয়াড়, অন্যদিকে থিয়াগো সিলভা এবং মার্সেলো তখনও নিজেদের মধ্যকার অবস্থান ঠিক করতে পারেননি।
এ সময় লুকাকু বল সুইচ করে ডি ব্রুইনাকে পাস বাড়ালে ডি ব্রুইনা একেবারেই ফাঁকা জায়গা পেয়ে যান, মার্সেলো সেন্টার এরিয়ায় চেপে থাকায় তিনিও ডি ব্রুইনার কাছে পৌঁছাতে দেরি করে ফেলেন। এই সময়ের মধ্যে ডি ব্রুইনা কাট-ইন করে শট নেন এবং দ্বিতীয় গোলের মাধ্যমে ব্রাজিলকে ম্যাচ থেকে একেবারেই ছিটকে দেন।
এই বিশ্বকাপের ক্রোয়েশিয়া এবং গত বিশ্বকাপের বেলজিয়ামের ম্যাচে ব্রাজিলের পরাজয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায় ছিল তাদের দুর্বল ট্রানজিশনের। ক্যাসেমিরো ট্রানজিশন সামলানোয় এ সময়ের সেরা ফুটবলার, তিনিই সবসময় প্রতিপক্ষের আক্রমণের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ান; যে কারণে ট্রানজিশনে ব্রাজিলের দুর্বলতা লাতিনের প্রতিপক্ষদের বিপক্ষে খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু ইউরোপীয় অর্গানাইজড দলগুলোর বিপক্ষেই ট্রানজিশন সামলানোয় ব্রাজিলের ফুলব্যাক-উইঙ্গারের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে।
ক্রোয়েশিয়ার সাথে হেরে বিদায়ের পরপরই ব্রাজিল বোর্ড তিতেকে চাকুরিচ্যুত করে৷ তার জায়গায় ব্রাজিলের কোচ হিসেবে ইউরোপের প্রথম সারির অনেক কোচের নামই শোনা যাচ্ছে। তিতে যেই ট্রানজিশনের দুর্বলতার নিরাময় করতে পারেনি, নতুন কোচ তা করে দেখাতে পারেন কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে ট্রানজিশনের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ব্রাজিলের হেক্সা জয়ের স্বপ্ন যে স্বপ্নই থেকে যাবে, সেটা বলাই বাহুল্য!