মুশফিকুর রহিম বরাবরই লেগ সাইডে শক্তিশালী। তারপরও যে কীভাবে বলটা খেলতে গিয়ে বিপাকে পড়লেন! ব্যাটে আলতো ছুঁয়ে বল চলে গেল উইকেটরক্ষকের হাতে। খালি চোখে দেখলে মনে হবে ওয়াইড বল। আবেদন হতেই আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে ব্যাট হাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে হতাশার দৃষ্টিতে ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন। কেউ না জানুক, তিনি ঠিকই জানেন; বল আসলে ব্যাট ছুঁয়েই গেছে। উইন্ডিজের বিপক্ষে ৩২২ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে সাকিব আল হাসানের সাথে আজও বড় জুটি গড়বেন কী, তার ব্যাট থেমে গেল মাত্র ১ রানে।
অথচ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৪, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯ আর প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলা ৭৮ রানের ইনিংস মুশফিককে তার প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাসের রসদ দিয়ে দিয়েছে।
তবে প্রতিদিনই যে ভালো ইনিংস হবে, এমন ভাবনাটা আবার বাড়াবাড়ি। মুশফিক যখন ফিরে গেলেন, বাংলাদেশ তখন ১৩৩ রানে ৩ উইকেট হারিয়েছে। ১৯তম ওভারের শেষ বলটিও গড়িয়ে গেছে।
তারও আগে সাকিব আল হাসান ৩৩ বল খেলেছেন, চলছে ঝড়; ৪৪ রানে অপরাজিত। দলে পরিবর্তন না এলে কথা ছিল মোহাম্মদ মিঠুন নামবেন। কিন্তু বিশ্বকাপে টানা তিন ম্যাচে সুযোগ পেয়েও তার ব্যাটে ‘আপ টু দ্য মার্ক’ পারফরম্যান্সের দেখা পায়নি টিম ম্যানেজমেন্ট। এবার তাই ভরসা লিটন কুমার দাসের উপর। স্বভাবতই ছিলেন ‘নার্ভাস’। ম্যাচ শেষে সেটা যেমন স্বীকার করেছেন, তেমনই শুরুতে তার ব্যাটিং দেখেও তা টের পাওয়া গেছে বেশ।
শেষ পর্যন্ত ড্রেসিংরুম থেকে আর কোনো ব্যাটসম্যানকে বের হতে হয়নি। এই ‘নার্ভাসনেসকে’ পুঁজি করেই লিটন চড়ে বসেছিলেন ক্যারিবিয়ান পেস দানবদের উপর। অন্যপ্রান্তে সাকিবও ছিলেন ঝড়ো হাওয়ার বদলি বাতাস। শেষ পর্যন্ত ৫১ বল হাতে রেকর্ড ৩২১ রান তাড়া করে ম্যাচ জেতালেন তারা। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তাদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান তুলেছিল চলমান আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। সেই ম্যাচে জয় পেয়েছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। কিন্তু উইন্ডিজের বিপক্ষে ছাড়িয়ে গেল সেই নিজেদেরকেই। ৩২২ রানের লক্ষ্য আগে কখনও তাড়া করে জেতা হয়নি সাকিবদের। সেটা এবার করতে পারাটা যেমন ছিল মর্দাযার, তেমনই জয়ের বন্দরে ৫১ বল হাতে রেখেই পৌঁছে যাওয়ায় লিটনের ৯৪ রানে অপরাজিত থাকার ঘটনা নিয়ে কেন যেন লিখতে হচ্ছে, ‘জয়ের লক্ষ্য কম থাকায়’।
১৫ সদস্যের বিশ্বকাপ দলে থাকা লিটন আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে যে ম্যাচে সুযোগ পেলেন, সেই ম্যাচে খেলেছিলেন ৭৬ রানের ইনিংস। এরপর বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে খেললেন ৭৩ রানের ইনিংস। তারপরও টিম কম্বিনেশনের কাঠগড়ায় আসামী হয়ে ড্রেসিংরুমেই কাটাতে হয়েছে লিটনকে। মিঠুনের ব্যর্থতা যখন শাপে বর হয়ে এলো তার ভাগ্যে, তখনই বাজিমাত। চারবারের বিশ্বকাপ খেলা সাকিবের সঙ্গে গড়লেন ১৮৯ রানের অপরাজিত রেকর্ড জুটি। খেললেন ৬৯ বলে ৯৪ রানের অপরাজিত ইনিংস। নিজের সেঞ্চুরি নয়, বরং দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়ার চেষ্টাটা খুব প্রবল ছিল লিটনের ইনিংসে। হয়তো তার এই ত্যাগ আগামীতে তার জন্যই পুরস্কার হয়ে কাজে লাগবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাকিবের সাথে মুশফিকের গড়া ১৪২ রানের ইনিংসটি ছিল এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে দলের সর্বোচ্চ জুটি। সেই মুশফিক যখন ১ রানে ফিরলেন, তার আফসোসটা যেন কাঁধে তুলে নিলেন লিটন। সেরা ফর্মে থাকা সাকিবের সাথে সমর্থকরা যেন মুশফিককে খুঁজে পেয়েছিল লিটনের মাঝেই। সহজাত ওপেনার লিটন পাঁচ নম্বরে নেমে কতটা সুবিধা করতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা ছিল। শঙ্কা ছিল তার নিজের মনেও। কিন্তু সব শঙ্কা ৬৯ বলে ৮ বাউন্ডারি আর ৪ ছক্কায় অপরাজিত ৯৪ রানের ইনিংসে দূর করলেন।
ম্যাচ শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে নতুন পজিশনে ব্যাট করতে গিয়ে যে খানিকটা ভয়ে ছিলেন তা লুকোনোর চেষ্টা করেননি লিটন। বলেছেন,
ব্যাটিংয়ে যাওয়ার সময় নার্ভাস ছিলাম। যেহেতু এই ভূমিকায় অভ্যস্ত নই। টিম ম্যানেজমেন্ট চেয়েছে, সুযোগটা নিতেই হতো। তারপরও নার্ভাস ছিলাম প্রথমদিকে। কোনো কিছু মনে হচ্ছিল আমার অনুকূলে নেই। ৩০ করার পর মনে হয়েছে উইকেটে মানিয়ে নিয়েছি, এখন ভালো করতে পারবো।
তবে লিটনের নার্ভাসনেস কাটানোর পেছনে টোটকা হিসেবে কাজ করেছে সাকিবের পরামর্শ,
সাকিব ভাই অনেক সাহায্য করেছেন উইকেটে। অনেক কথা বলেছেন যেগুলো নার্ভাসনেস থেকে আমাকে বের করে এনেছে। বলেছেন যে উইকেট অনেক সহজ। স্বাভাবিক খেলা খেললেই হবে। জোরাজুরি না করে যেন সিঙ্গেল খেলি। আরও অনেক কিছু ছিল। তাঁর কিছু বাউন্ডারিও আমাকে সাহায্য করেছে চাপমুক্ত হতে।
বিশ্বকাপে অভিষেক ম্যাচে লিটনের এমন পারফরম্যান্সে কৃতিত্ব দিতে ভুলছেন না বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবও। লিটন প্রসঙ্গে ম্যাচ শেষে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন,
উইকেটের অবস্থা আমি ভালোভাবে জানতাম। আমি লিটনকে বলেছিলাম আমরা যদি ক্রিজে থাকতে পারি, তিন নম্বর জুটিতেই জয় পাওয়া সম্ভব। ১০-১৫ বল খেলার পর সে যেভাবে ব্যাটিং করছিল, আমি খুব উপভোগ করছিলাম। অপর প্রান্ত থেকে তাঁর ব্যাটিং দেখতে খুব ভালো লাগছিল। রান তাড়া করতে গিয়ে ওর জন্য একবারও আমাকে চাপে পড়তে হয়নি। তাঁর ইনিংসে এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। বিশ্বকাপে অভিষেক ম্যাচে এটা খুব কঠিন কাজ।
পর পর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি, বাকি দুই ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি। সাকিব এই মুহূর্তে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান সংগ্রাহক। পেছনে ফেলেছেন অ্যারন ফিঞ্চ, রোহিত শর্মা, ডেভিড ওয়ার্নারসহ বাকি সবাইকে। মোদ্দা কথা, উইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটিতে ভেঙেছেন পুরনো সব রেকর্ড। এই ম্যাচেই বিশ্বকাপে প্রথম চার ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড পার করা চতুর্থ ক্রিকেটার হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছেন সাকিব। বাকিরা হলেন ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটার নভোজ্যোৎ সিং সিধু, শচীন টেন্ডুলকার এবং দক্ষিণ আফ্রিকান গ্রায়েম স্মিথ। ম্যাচে ৮৩ বলে সেঞ্চুরি করা সাকিব বিশ্বকাপের আসরে দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান। বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম।
বাংলাদেশের হয়ে গড়েছেন নতুন রেকর্ড। এই ম্যাচে অপরাজিত ১২৪ রানের ইনিংস খেলতে গিয়ে পেছনে ফেলেছেন তামিম ইকবালকে। সাকিব এখন বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডেতে ৬ হাজার রান পার করা দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান। বল হাতে এই ম্যাচে দুই উইকেট নিয়েছেন তিনি, যা ওয়ানডেতে তার ২৫০ উইকেটের মাইলফলক পার করিয়েছে।
বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ব্যাট হাতে দারুণ ছন্দে সাকিব। আইপিএলে ম্যাচ না পাওয়ার সময়টাকে ভারতে ডেকে নিয়েছিলেন নিজের ‘গুরু’ কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে। সেই সময়ে কাজ করেছেন নিজের ব্যাটিং নিয়ে। ফলাফলটা দেখা গেছে ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকেই। সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে তিন নম্বর পজিশনটা চেয়ে এসেছেন। সেটা মিলেছে বলেই পারফরম্যান্সটা আরও বেড়ে চলেছে এই ক্রিকেটারের।
ম্যাচে জয়ের পর যখন ধারাভাষ্যকার তাকে চেপে ধরলেন, তখনই বলেছিলেন এই তিন নম্বর পজিশনের ‘মাহাত্ম্য’।
সাকিবের ভাষায়,
আমি জানি তিনে ব্যাট করতে নামলে বেশি সুযোগ পাব, বেশিক্ষণ ব্যাট করতে পারব। অনেক সময় পাঁচে ব্যাট করতে নেমেছি ৩০তম কিংবা ৪০তম ওভারে, যেটা আমি মনে করি অনেক রানের ইনিংস খেলার জন্য আদর্শ নয়।
সাকিব-লিটনের ব্যাটে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। টিকিয়ে রেখেছে বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের স্বপ্ন। তবে তরুণদের ব্যাটে বড় রান বারবারই দেখতে চাইবে সমর্থকরা। সেক্ষেত্রে বারবার যে সাকিবদের মতো জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারকে অন্যপাশে পাওয়া যাবে, তেমনটা না-ও হতে পারে। সে কারণেই দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের কাজটা শেষ করতে পারলেই আগামীতেও বাংলাদেশের শক্তির জায়গাটা ‘জায়গামতো’ থাকবে, বাড়বে প্রত্যাশা; বাড়বে প্রত্যাশার বাস্তবায়ন।