ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে একটা সময় চলতো দুর্বৃত্তদের গোলাগুলি, পাশাপাশি চলত মাদকের রমরমা ব্যবসা। সেখানেই চার-চারটি গুলি খেয়েও এক ছোট্ট ছেলে শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায়। সেই ছেলেটার মা-বাবা তাকে বানাতে চেয়েছিলেন একজন ডাক্তার কিংবা আইনজীবী। কিন্তু কে কার কথা শোনে? ছেলে শেষমেশ একজন ফুটবলারই হলো, শুধু তার ফুটবল প্রেমের জন্যই। জ্বি, বলছিলাম বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার কথা।
ষাটের দশকে জামাল ভূঁইয়ার বাবা-মা পাড়ি দেন ডেনমার্কের উদ্দেশ্যে। আর সেই সূত্র অনুযায়ী, জামালের জন্মও ডেনমার্কে। ১৯৯০ সালের ১০ এপ্রিল জন্ম নেন জামাল ভূঁইয়া। তিনিই প্রথম প্রবাসী বাংলাদেশি ফুটবলার।
ফুটবলে হাতেখড়ি
অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার ফুটবলের হাতেখড়ি কীভাবে, সে গল্পটা এবার বলা যাক।
ছেলেবেলার ছটফটে মন থেকেই ফুটবলে আসা। কোপেনহেগেন এর বিভিন্ন পর্যায়ের দলের হয়ে ম্যাচ খেলেছিলেন, খেলেছিলেন কোপেনহেগেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও। কিন্তু দেশের মায়া কি ছেলেটা এত সহজেই ভুলে যাবে? তাই নিজের তাগিদেই মা-বাবার কথা উপেক্ষা করেই ২০১০ সালে আসার চেষ্টা করেন বাংলাদেশে। কিন্তু বিধি বাম, পাসপোর্ট জটিলতায় ফিরে যেতে হলো তাকে।
এরপর ২০১১ সালে বাংলার মাটিতে পা রাখলেও এবারও ভাগ্য তার সহায়ক হয়নি। দেশের লোকাল খেলোয়াড়দের সাথে তার অনুশীলনে ব্যাপক পার্থক্য, এমনকি সে হাঁপিয়ে যাচ্ছিল, পানি খাচ্ছিল একটু পর পর। কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে অনেক খেলোয়াড়ই তাকে নিয়ে হাসাহাসি, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিল। এবারও সে জাতীয় দলের কাছে গিয়েও জাতীয় দলের জার্সি পরতে পারলেন না। আর সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করেই তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফের ডাকে সাড়া দিয়ে ২০১৩ সালে ক্যাম্পে ট্রায়াল দিয়েই সবার নজর আসেন এই ফুটবলার।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দেশের হয়ে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে অভিষেকটাও হয়ে যায় নেপালে অনুষ্ঠিত সাফে।
বাংলাদেশে ফুটবল ক্যারিয়ার
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ডেনমার্কের ক্লাব কোপেনহেগেনের বিভিন্ন পর্যায়ের ক্লাব এবং কোপেনহেগেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেছিলেন৷ কিন্তু লাল-সবুজের হয়ে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা প্রথমে কষ্টকরই হয়েছিল। সুযোগ পাওয়ার পর অবশ্য তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। লোডভিক ডি ক্রুইফের মাধ্যমে জাতীয় দলে ২০১৩ সালে নেপালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেই আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক৷
এরপর ২০১৪ সালে শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাব তার সাথে চুক্তি করে। সে সময় টাকার অঙ্কে স্থানীয় ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতনভুক্ত খেলোয়াড়ও ছিলেন তিনি। যদিও তার পরের মৌসুমেই চুক্তি করেন ছন্দে থাকা ক্লাব শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের সঙ্গে। সে সময় জাতীয় দলের অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম বলেছিলেন,
অসাধারণ একজন ফুটবলার। সতীর্থ হিসেবেও দারুণ। ডেনমার্ক থেকে এসে এভাবে আমাদের কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, তারপর ভালো খেলতে থাকা- সত্যিই বিস্ময়কর। দীর্ঘদিন পর এই পজিশনে এরকম মানের একজন ফুটবলার পেল বাংলাদেশ। এখন তো আমাদের লিগেও খেলবে। কোনো সন্দেহ নেই, ওর সামনে ব্রাইট ফিউচার অপেক্ষা করছে।
এরপর বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছিলেন, যেখানে ৮ দল অংশগ্রহণ করেছিল। অনেক বছর পর ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সব দলের অনূর্ধ্ব-২৩ দল অংশগ্রহণ করে। কিন্তু মামুনুল-জামাল ভূঁইয়াদের দল প্রথম ম্যাচেই মালয়েশিয়ার কাছে ১-০ গোলে হারের লজ্জা পায়। এরপরের ম্যাচে ‘বাঁচা-মরার লড়াইয়ে’ একটা জয় তো দরকারই! নিজেদের ২য় ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১-০ গোলে সেই জয় তুলে নিয়েছিল স্বাগতিক বাংলাদেশ। গোলটি করেছিলেন সে সময়ের নাম্বার টেন ‘হেমন্ত’।
উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেমিফাইনালে থাইল্যান্ডকে হারিয়ে দিল ১-০ গোলে, গোল করেছিলেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। বাংলাদেশ পৌঁছে যায় স্বপ্নের ফাইনালে। ফাইনালে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে গোলটা না খেলে হয়তো বাংলাদেশই চ্যাম্পিয়ন হতো। হ্যাঁ, বাংলাদেশ! তবে সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা সমর্থকদের খুশি করতে পেরেছিল। আর সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন আজকের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া।
ঠিক ২০১৫ সাল সময়টায় যেন ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছিল দেশের ফুটবল। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ কোয়ালিফাই রাউন্ডে ঘরের মাঠে তাজিকিস্তান এর সাথে ১-১ গোলে সম্মানজনক ড্র করেছিল। এটি ছাড়া আর কোনো ম্যাচে কি ভালো ফলাফল করেছিল বাংলাদেশের ফুটবল?
ঠিক সে সময়ে এই জামাল-মামুনুলের বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া, জর্ডান, তাজিকিস্তানের বিপক্ষে ঠিক গুনে গুনে ৫, ৪, ৫ গোল হজমই করেছিল। যেন দেশের ফুটবল একদম শেষ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল! ৩ ম্যাচেই হজম করেছিল ঠিক ১৪ গোল, যার বিপরীতে একটি গোলও দিতে পারেনি বাংলাদেশ।
এরপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪ গোল হজম করে বাংলাদেশ, এবং ২০১৬ সালের মার্চে জর্ডানের মাটিতে একটা নয়, দুইটা নয়, ঠিক আট গোল খেয়েছিল! সেবারও ব্যর্থতায় ডুবলো বাংলাদেশ।
সেই ২০১৬ সালেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভুটানের সাথে ড্র করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ভুটান পাড়ি দিয়েছিল বাংলাদেশ। আর যত দুর্ঘটনা, সবই ঘটল একসাথে! কী হয়েছিল তাহলে?
ভুটানের মাটিতে সেই ম্যাচে ৩-১ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ দল। দুই বছরের জন্য নির্বাসনেই যেন চলে গেল দেশের ফুটবল, যেন মরে গেল হঠাৎ। নাম হয়ে গেল সেটার ‘ভুটান ট্র্যাজেডি’। যদিও সেই ম্যাচে দলে ছিলেন না জামাল ভূঁইয়া, নেই আন্তর্জাতিক ম্যাচ, নেই ব্যস্ততা। যা-ই হোক, শেষে ২০১৮-তে ঘরের মাঠে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, কিছু না কিছু করতেই হবে। সমর্থকদের মনে শান্তি আনতে হবে না?
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৮তে ক্যাপ্টেন্সির আর্ম ব্যান্ড উঠল জামাল ভূঁইয়ার হাতে। ঠিক যে ভুটানের সাথে হেরে দুই-দুইটা বছর নির্বাসনে ছিল দেশের ফুটবল, ঠিক সেই ভুটানের বিপক্ষেই দেশের মাটিতে ২-০ গোলে জয় তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ। অনেকটা আনন্দই যেন পেল সমর্থকরা। প্রথম ম্যাচে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যত দর্শক ছিল, তার চেয়ে দ্বিতীয় ম্যাচে আরও বেশি দর্শক হাজির স্টেডিয়ামে। তাছাড়া ম্যাচটিও ছিল পাকিস্তানের সাথে। এ ম্যাচেও জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছিল জামাল বাহিনী। দেশের ফুটবল এবং ফুটবল সমর্থকদের কাছে যেন তখন ঈদের মতোই আনন্দ। যদিও এরপরের ম্যাচেই নেপালের কাছে হেরে যায় বাংলাদেশ। এরপর ২০১৯ সালে লাওসের সাথে ২০২২ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্রথম রাউন্ডে ১-০ গোলের জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ।
সময়টা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে গেল দল। আবারও যেন ব্যাকফুটে চলে এলো দল। দলকে তো আবার উজ্জীবিত করতে হবে, নাকি? ঠিক সেই ম্যাচের পরই ছিল এশিয়ার নাম্বার ওয়ান টিম কাতারের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ। এর আগে ভুটানের সাথে ঘরের মাঠে দুই-দুইটি ম্যাচে জয় পেয়েছিল লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।
প্রথম ম্যাচেই ভুটানকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ, এরপরের ম্যাচে আবার ২-০ গোলে জয়, দল যেন হয়ে উঠল উজ্জীবিত। আর এই দলকে এবং সমর্থকদের মন জয় করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন একজন অধিনায়ক, জামাল ভূঁইয়া। এরপর ঘরের মাঠে কাতারের বিপক্ষে ভালো খেলেও ২-০ গোলে পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছিল। যদিও এই কাতারের বিপক্ষে ১-০ গোলে হারিয়ে এশিয়ান গেমসের নকআউট পর্ব নিশ্চিত করেছিলো বাংলাদেশ, সেখানে গোল করেছে দলের গুরুত্বপূর্ণ মিডফিল্ডার এবং অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। অধিনায়কের শেষ মুহূর্তের সেই গোলটি আজও চোখে ভাসে। আহা, বল পায়ে বাম দিক দিয়ে খানিকটা ডি-বক্সের ভেতরে গিয়েই চোখ-ধাঁধাঁনো গোল!
১৫ অক্টোবর কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে ভারত বাংলাদেশ ম্যাচ, ঘরের মাঠে কাতারের বিপক্ষে ১০ তারিখ ম্যাচের পর ভারত মিশন। ভারতের ফুটবল-নগরী নামে খ্যাত কলকাতায় এত হাজার হাজার দর্শকদের সামনে ভালো খেলবে তো জামাল বাহিনীরা? স্টেডিয়াম এবং স্টেডিয়ামের বাহিরে থাকা ভারতীয় দর্শকদের উল্লাস, আওয়াজে খেলতে পারবে তো বাংলার ছেলেরা?
দেখতে দেখতে ১৫ তারিখের ম্যাচ এসে গেল। বাংলাদেশ থেকে গুটিকয়েক ফুটবল সমর্থক উপস্থিত ছিল স্টেডিয়ামে। ম্যাচের শুরুতেই লেফট উইং দিয়ে একবার না, দুই-দুইবার ভারতীয় ডিফেন্সে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ইব্রাহীম। যা-ই হোক, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের খেলা চলছিল। বাংলাদেশও যেমন আক্রমণে যাচ্ছিল, উল্টোদিক দিয়ে ভারতীয়দের একের পর এক শট যেন থামানোর দায়িত্ব এক আশরাফুল রানা নামের গোলরক্ষকের। সময়টা ম্যাচের ৪২ মিনিট, লেফট উইংয়ে ফ্রি-কিক পেল বাংলাদেশ। ফ্রি-কিকের দায়িত্ব নিলেন স্বয়ং অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। ফ্রি-কিক নিলেন জামাল, সেখান থেকেই সাদ উদ্দিনের গোল! যেন প্রাণ ফিরে পেলো দেশের ফুটবল, সল্ট লেকের হাজার হাজার দর্শকদের নিস্তব্ধতার মধ্যে গুটিকয়েক বাংলাদেশী আনন্দে মাতলো।
সেই রাতে ফুটবল-পাগল বাঙালিরা মুগ্ধ হয়েছিল, সমর্থকদের আনন্দ এবং মন দুটিই কেড়ে নিয়েছিল গোলস্কোরার সাদ উদ্দিন এবং অ্যাসিস্ট করা জামাল ভূঁইয়া। সেই সাথে গোলরক্ষক আশরাফুল রানার নাম তো আছেই! আর আরেকজনের কথা না বললে ভুল হবে। তিনি মাথায় ব্যান্ডেজ লাগিয়ে খেলা ডিফেন্ডার ইয়াসিন খান। বিশেষ করে ইয়াসিন খানের আত্মনিবেদনে যেন মুগ্ধ হয়েছিল পুরো সল্টলেক স্টেডিয়াম।
বাঙালিদের মনে এখনও ফুটবল রয়েছে। হয়তো ক্রিকেটের জমজমাটের ভীড়ে সমর্থকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, কিন্ত বাঙালিদের মনে আছে ফুটবল, প্রাণে রয়েছে ফুটবল, রক্তে মিশে রয়েছে ফুটবল। এগিয়ে যাক দেশের ফুটবল, এটাই প্রার্থনা।