ওয়াশিংটন সুন্দর। ভারতের অফুরন্ত স্পিনারদের তালিকায় নতুন সংযোজন। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট ও আইপিএল থেকে উঠে এসেছেন এই অফস্পিনার। মাত্রই জাতীয় দলে সুযোগ পেতে শুরু করেছেন। এবার ইংল্যান্ড সফরের সীমিত ওভারের দলে ছিলেন ওয়াশিংটন সুন্দর। কিন্তু ইনজুরিতে পড়ে দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে।
দেশে ফেরার আগে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাথে দীর্ঘ এক কথোপকথন করে এসেছেন। সেই সাক্ষাতকারে বলেছেন আইপিএলে নিজের নাটকীয় অভিষেক আর উঠে আসার গল্প।
২০১৭ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। ওয়াশিংটন সুন্দরের বয়স তখন ১৭। তখনও তিনি তার বোনের সাথে এক রুমে বসবাস করেন। তখনই ওয়াশিংটন একজন প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটার। কিন্তু সম্প্রতি তাকে রাজ্য দল তামিল নাড়ু থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এই সময়টা ছিলো ওয়াশিংটনের জন্য এক চরম অনিশ্চয়তার সময়, “আমি সত্যিই তখন আমার জীবনে কী হবে, এ নিয়ে খুব ভয়ের মধ্যে ছিলাম। আমার ক্যারিয়ারে কী হবে, পাঁচ বছর পর আমি কোথায় গিয়ে দাড়াবো; এসব চিন্তা। আমার তখন অনেক রকম ভয়।”
ওয়াশিংটন চেষ্টা করছিলেন এই ভয়টাকে ঝেড়ে ফেলে নিজের জীবনকে ইতিবাচকভাবে সাজানো যায় কি না। বলছিলেন, “আমি জানতাম যে, আমার হাতে নিজেকে দেওয়ার জন্য কয়েক মাস সময় আছে। আমি স্রেফ মাঠে চলে গেলাম এবং কঠোর অনুশীলন শুরু করলাম। প্রতিদিন আমি মাঠে ছয় থেকে সাত ঘন্টা থাকার অভ্যেস করে ফেলেছিলাম।”
ঠিক এই সময় তামিলনাড়ু দলে ওয়ানডে টুর্নামেন্টের জন্য আবার ডাক পেলেন সুন্দর। আর নিজের অফস্পিন দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে ফেললেন। তখনই আইপিএল দল রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্টের প্রধান স্পিনার, ভারতের তারকা খেলোয়াড় রবিচন্দন অশ্বিন ইনজুরিতে পড়লেন এবং দলে একটা জায়গা খালি হলো। তামিল নাড়ুর কোচ হৃষিকেশ কানিতকার তখন সুপারিশ করলেন, ওয়াশিংটনকে একবার ট্রায়ালের জন্য ডাকা হোক।
ওয়াশিংটন বলছিলেন, “ওখানে আমার সবটাই প্রাপ্তি ছিলো। একেবারে সত্যি বলছি, আমার হারানোর কিছু ছিলো না। আমি কিছু প্রত্যাশা করিনি।”
প্রত্যাশা না করলেও পেয়ে গেলেন ওয়াশিংটন। নেটে স্টিভেন স্মিথ, এমএস ধোনি, বেন স্টোকসদের বারবার পরাস্ত করার পুরষ্কার পেলেন। দ্রুত তার সাথে চুক্তি করে ফেললো পুনে। ওয়াশিংটন অবশ্য ভাবছিলেন, এই চুক্তির ফলে অন্তত দলের সাথে থাকার একটা সুযোগ হলো তার।
কিন্তু পুনের ষষ্ঠ খেলার কয়েক দিন আগের ঘটনা। ওয়াশিংটনকে ডেকে বলা হলো, তিনি খেলছেন। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে ওয়াশিংটন বল করতে এলেন; সামনে তখন ডেভিড ওয়ার্নার। এটাই ছিলো ওয়াশিংটনের পেশাদার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে জীবনের প্রথম ম্যাচ। ওয়াশিংটন বলছিলেন, “আমি কেবল সময়টা উপভোগ করতে চাচ্ছিলাম। মাঠ ভর্তি মানুষ, দারুণ মাঠ আর ডেভিড ওয়ার্নারকে বল করা উপভোগ করতে চাচ্ছিলাম। আমি যখন ওয়ার্নারের দিকে তাকালাম, আমার মনে হলো, ও কী আমাকে সবগুলো বলে ছক্কা মারবে?”
কিন্তু ওয়ার্নার সেটা পারেননি; ছক্কা তো দূরে থাক, কোনো বাউন্ডারিই মারতে পারেননি। সেই ওভারে কেবল ৫ রান এসেছিলো। দুটো লেগবাই, দুটো ওয়াইড এবং ব্যাট থেকে একটা মাত্র রান। ৩ ওভারে ১৯ রান দিয়ে পুনের জয়ের পথে বেশ অবদান রেখেছিলেন।
এটা ছিলো ওয়াশিংটনের স্মরনীয় এই টুর্নামেন্টের শুরু মাত্র। তিনি টানা ১১টি ম্যাচ খেলে ফেললেন। পাওয়ার প্লেতে নিজের দারুণ বোলিং দিয়ে দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেন ওয়াশিংটন। সেই টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা ইকোনমিক বোলার ছিলেন তিনি। পুনেকে ফাইনালে তোলায় বড় অবদান ছিলো তার। ফাইনালে ৪ ওভারে মাত্র ১৩ রান খরচ করেছিলেন। আইপিএল ফাইনালের ইতিহাসে সবচেয়ে ইকোনমি বোলিং এটাই। ওয়াশিংটনের ক্যারিয়ার বদলে গেলো, জীবনও বদলে গেলো।
ওয়াশিংটন বলছিলেন, এটা আসলেই তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিলো, “এটা আমার জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। অনেক কিছু বদলে দিয়েছে এটা। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমার খুব উপকার হয়েছে; বিশেষ করে আমার পরিবারের। সেই থেকে সবকিছু খুব মসৃণ হয়ে গেছে।”
আইপিএল শেষ হতে হতে ওয়াশিংটনের হাতে অনেক টাকা। তখন তিনি একটা নতুন ফ্লাট কিনতে পারেন। কিন্তু পরিবারকে ছেড়ে যেতেও মন চাইছিলো না। তাই আক্ষরিকভাবেই নিজেদের বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট ফ্লাট কিনলেন। ফ্লাটে একটা ছোট হল এবং একটা বেডরুম। এই ফ্লাটের কথা বলছিলেন ওয়াশিংটন, “সারা জীবন আমি আমার বোনের সাথে এক রুমে থেকেছি। এটা একটু বিরক্তিকর। এটাও ঠিক যে, কিছু মজা ছিলো। কিন্তু একটা ভালো রুমে একটা থাকলে একটু শান্তি লাগে, নিজেকে কিছু সময় দেওয়া যায়। আমার নতুন রুমে শুধু একটা বিছানা আছে আর একটা প্লে স্টেশন।”
এর চেয়ে বড় ফ্লাট ওয়াশিংটনের দরকার নেই বলেই তিনি মনে করেন, “আজকের দিনের ক্রিকেটাররা তো লম্বা সময়ের জন্য বাড়িতে থাকেই না। তবে যে কয়েকটা মাস বাড়িতে থাকা হয়, ওটাই সত্যিকারের আনন্দের সময়।”
২০১৭ সাল চলে যাওয়ার আগেই অসাধারণ এই আইপিএল মৌসুম কাটানোর সুবাদে জাতীয় দলের ডাক এসে গেলো। আইপিএলে তার এই পারফর্মেন্সের পর ডাক পাওয়াটা ছিলো একটা স্বাভাবিক ঘটনা। বিশেষ করে তার যেহেতু অনুর্ধ্ব-১৯ দলে খেলার অভিজ্ঞতা ছিলো। মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকে নিয়ে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হলেন ওয়াশিংটন; ভারত শিরোপা জিতলো।
এটা ছিলো অসাধারণ একটা গল্প। ওয়াশিংটনের এই গল্পের বড় ব্যাপার হলো, তিনি আইপিএলের খেলোয়াড় তৈরি করার একটা দারুণ উদাহরণ। তাকে দিয়ে বোঝা যায়, আইপিএল কিভাবে খেলোয়াড় তৈরি করে এবং তাদের দেখাশোনা করে।
এর আগে কখনোই আইপিএল না খেলা ২০ বছর বয়সী মানায়ক মারকান্ডে, ১৮ বছর বয়সী শুভমান গিল ও পৃথ্বি শাউ এবার আইপিএল খেলে তারকা হয়ে গেছেন। আইপিএলের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি দলকে একাদশে ৭ জন ভারতীয় রাখতেই হয়। আর দলগুলো এই জায়গায় তরুণ ক্রিকেটারদের ওপর ভরসা করে। ফলে আইপিএল এখানে পরের প্রজন্মের ক্রিকেটারদের তৈরির ক্ষেত্রে অসাধারণ এক ভূমিকা রাখছে।
ওয়াশিংটন বলছিলেন, “প্রতি বছর আপনি অন্তত ৩৫ জন ক্রিকেটারকে আইপিএলে দেখবেন, যারা ভারতের হয়ে কখনো খেলেনি।”
ওয়াশিংটন বলেন, এই আইপিএলই তাকে ‘দ্বিগুন ভালো’ বোলারে পরিণত করেছে।
এটা ঠিক যে, টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়ের সেরা ৫ বোলার এখন লেগস্পিনার। তারপরও এই ফরম্যাটে প্রচলিত অফস্পিন যে দারুণ কাজ করতে পারে, সেটাই প্রমাণ করতে চান ওয়াশিংটন। তিনি বলছিলেন, “আমাকে একটু বাড়তি চতুরতা দেখাতে হয়। কারণ আমার অনেক বেশি বৈচিত্র নেই। আমি পাওয়ার প্লেতে স্রেফ ব্যাটসম্যান যেভানে আশা করছে না, ওরকম জায়গায় বল করার চেষ্টা করি। এটা করার জন্য আমাকে বল হাত থেকে ছাড়ার আগের সেকেন্ড অবধি ব্যাটসম্যানের পায়ের মুভমেন্ট খেয়াল করতে হয়। আমাকে এটা বুঝতে হয় যে, ব্যাটসম্যান কী করার চিন্তা করছে।”
এই তারুণ্যের পেছনে ছোটার যে ব্যবস্থা, তাতে একটা সমস্যা হলো, কেউ স্থির হওয়ার সময় পাচ্ছে না। সবসময় পেছন থেকে কেউ তাড়া করছে। এই বছর আইপিএলে ওয়াশিংটন প্রায় ৩ লাখ পাউন্ডে বিক্রি হয়েছেন। এবার ৭টা মাত্র ম্যাচ খেলতে পেরেছেন।
এখন তিনি জাতীয় দলে, যদিও ইনজুরি তাকে ছিটকে দিয়েছে। কিন্তু জাতীয় দলেও কোনো কিছু নিশ্চিত নয়। এখানেও প্রতি মুহুর্তে পরীক্ষা দিতে হবে ওয়াশিংটনকে। সেটা অবশ্য মেনেই নিয়েছেন তিনি, “২০ মাস আগে আর পরের এটাই পার্থ্যক্য। জীবন এখন অবশ্যই ভিন্নরকম। কিন্তু জীবন তো এমনই, এটা বদলাতে থাকে। আমাকে এখন নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য আরও পরিশ্রম করে যেতে হবে। কারণ, এই একটা ব্যাপারের ওপরই আমার নিয়ন্ত্রণ আছে।”