বেশ কেতাদুরস্ত হয়েই সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। শরীরে জড়ানো ব্লেজার অনেক নস্টালজিয়ার ধারক। ব্লেজারটা যে ছিল ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের। বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ সেরার পুরস্কার পাওয়া নান্নু সেই গৌরবের স্মারককে কোন উচ্চতায় মূল্যায়ন করেন, তার নিদর্শনই যেন এই ব্লেজার। সময়ের চাকা ঘুরে ২০ বছর পর প্রধান নির্বাচক হিসেবে প্রথম কোনো বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করতে এসে গত ১৬ এপ্রিল নান্নু স্মরণ করালেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপকে।
ইংল্যান্ডের মাটিতে ওই বিশ্বকাপে পাকিস্তান, ইংল্যান্ডকে হারিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল আমিনুল ইসলাম বুলবুলের দল। এত বছর পর আবার ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নান্নু যেন ইংলিশ কন্ডিশনের সুখস্মৃতির আবেশই ছড়িয়ে দিতে চাইলেন হাল সময়ের দলের মাঝেও।
ক্রিকেটের জন্মদাতা দেশটি বাংলাদেশের জন্য অপয়া নয়, অন্তত বড় বড় টুর্নামেন্টের ক্ষেত্রে। দুই বছর (২০১৭ সাল) আগে ইংল্যান্ডেই আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেমিফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। আইসিসির টুর্নামেন্টগুলোর সিনিয়র ক্রিকেটে এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য। যদিও বিশ্বকাপের মঞ্চে টাইগারদের সেরা সাফল্য ২০১৫ সালে, সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছিল মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল। আগের পাঁচ বিশ্বকাপে এটিই সবচেয়ে বড় অর্জন।
আসন্ন ২০১৯ বিশ্বকাপে অতীতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। কিন্তু ঘোষিত ১৫ সদস্যের দলটাই কি বাংলাদেশের সেরা বিশ্বকাপের দল? বিশ্বকাপের জন্য দল ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে কয়েকবার উঠে এসেছে এই প্রসঙ্গ। প্রধান নির্বাচক বলছেন, অভিজ্ঞতা, আত্মবিশ্বাস মিলিয়ে এটিই সেরা দল। তবে অনেকে আবার প্রশ্ন তুলছেন, সাফল্য বিচারে কোথায় ঠাঁই পায় এবারের দল, সেটিই নির্ধারণ করে দেবে বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই দলের অবস্থান। তার আগে নান্নু-হাবিবুল বাশার সুমনের নির্বাচন করা দলটাকে সময়ের সেরা মানতে দ্বিমত নেই কারো।
মাশরাফির নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের চূড়ান্ত দলটা ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে চমক ডানহাতি পেসার আবু জায়েদ রাহী। সিলেটের এই পেসার ছাড়া দলটা প্রায় অনুমিতই ছিল। গণমাধ্যমে গত কয়েকদিনের আলোচনায় ঘুরেফিরে এসেছে সবার নাম। সম্ভাব্য ক্রিকেটারদের মধ্যে বাদ পড়েছেন শুধু ইমরুল কায়েস ও তাসকিন আহমেদ। তারা দু’জন ছাড়া দেশের আর কোনো ক্রিকেটারকে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ার বড় কষ্ট বয়ে বেড়াতে হচ্ছে না।
বাংলাদেশের বিশ্বকাপের ১৫ স্বপ্নসারথী হচ্ছেন: মাশরাফি বিন মুর্তজা (অধিনায়ক), তামিম ইকবাল, লিটন কুমার দাস, সৌম্য সরকার, সাকিব আল হাসান (সহ-অধিনায়ক), মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, মেহেদী হাসান মিরাজ, রুবেল হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান, সাব্বির রহমান, মোহাম্মদ মিঠুন, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও আবু জায়েদ রাহী।
সময়ের, নাকি ইতিহাসের সেরা?
নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে রেজাল্ট করেছিল বাংলাদেশ ২০০৩ সালে। বিপর্যস্ত বিশ্বকাপে সেবার কানাডার কাছেও হেরেছিল খালেদ মাসুদ পাইলটের দল। আশরাফুল, মাশরাফিরা থাকলেও এহসানুল হক সেজান, সানোয়ার হোসেনদের মতো মিডিওকার ক্রিকেটারও ছিলেন ওই দলে। বাকি চারটি আসরে কম-বেশি সুখস্মৃতি রয়েছে বাংলাদেশের। ‘৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তান, স্কটল্যান্ডকে হারানো ছিল নবাগত বাংলাদেশের বড় অর্জন। বুলবুলের নেতৃত্বে প্রথম বিশ্বকাপে একঝাঁক অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ছিলেন দলে। শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, মেহরাব হোসেন অপি, আকরাম খান, নান্নু, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাহমুদ সুজন, খালেদ মাসুদ পাইলট, হাসিবুল হোসেন শান্ত, শফিউদ্দিন বাবু খেলেছিলেন ওই বিশ্বকাপে।
হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে বিদায় করে দেয় বাংলাদেশ। মাশরাফির দুর্দান্ত বোলিং, আশরাফুল-আফতাবদের ব্যাটিং, মোহাম্মদ রফিক-আব্দুর রাজ্জাকের স্পিন জাদু, তামিম-সাকিব-মুশফিকের তারুণ্য দারুণ সাফল্য এনে দিয়েছিল ক্যারিবিয়ানে। সুপার এইটে দক্ষিণ আফ্রিকাকেও হারিয়েছিল দলটি।
২০১১ বিশ্বকাপে অনেকটাই তারুণ্যনির্ভর দল ছিল সাকিবের অধিনায়কত্বে। তারপরও ইংল্যান্ডকে হারানোর মতো অর্জন ছিল সেবার। মাশরাফির হাত ধরে ২০১৫ বিশ্বকাপে ওই ইংল্যান্ডকেই ভূপাতিত করে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহর অভিজ্ঞতার সাথে সৌম্য, সাব্বির, রুবেল, তাসকিনদের উজ্জীবিত পারফরম্যান্স এনে দিয়েছিল মধুর স্মৃতির উপলক্ষ।
সেই তুলনায় এটুকু সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, এবারের দলটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দল, যেখানে পাঁচজন সিনিয়র ক্রিকেটার রয়েছেন। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে খেলছেন। একশ’র বেশি ওয়ানডে খেলেছেন তারা সবাই। তাদের পেছনে থাকলেও রুবেল হোসেনও অনেকটাই অভিজ্ঞ। তিনিও ১০ বছর পার করেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তপ্ত জমিনে। রয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ক্রিকেটার। সাত ক্রিকেটার আছেন, যারা প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন-চার বছর পার করে দিয়েছেন। সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমানের এটি দ্বিতীয় বিশ্বকাপ হবে।
মুস্তাফিজ, সাইফউদ্দিন, মিঠুন, মোসাদ্দেক, মিরাজ, লিটন দাস ও রাহীরা বিশ্বকাপের তরীতে প্রথমবার উঠছেন। রাহী ছাড়া সবাই নিয়মিত ওয়ানডে খেলছেন। প্রতিভার বিচারেও তারা দেশের সময়ের সেরা ক্রিকেটার।
প্রধান নির্বাচক তাই রায় দিচ্ছেন এটাই সেরা দল। নান্নু বলেছেন,
‘অবশ্যই সেরা দল। বিশ্বকাপের জন্য আমরা দল তৈরি করেছি, অবশ্যই এই মুহূর্তে এটা সেরা দল। এখানে কিন্তু একজন বাদে বাকি সবারই অভিজ্ঞতা আছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার। আবু জায়েদ রাহীরই শুধু অভিষেক হয়নি। সেই হিসেবে আমি মনে করি যে, এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারলে ইনশাল্লাহ আমরা ভালো করবো।’
টার্গেট সেরা চার
গত কয়েক মাস ধরে মিরপুর স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ দলকেন্দ্রিক আলোচনায় মাশরাফি সবসময় বলে আসছেন,
‘ভাই আপনি কি করতে যাবেন বিশ্বকাপে? ভালো কিছু করতেই তো। এখন যেই দল, ওয়ানডেতে যেই অবস্থান তাতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছাড়া আর কোনো চিন্তা করে লাভ নেই। দল যাই হোক, সামর্থ্য যাই হোক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার টার্গেট নিয়েই যেতে হবে।’
ওয়ানডে অধিনায়কের মতোই প্রধান নির্বাচকের চাওয়া। তবে তার প্রত্যাশার পারদ কয়েকটা ঘরের মাঝে উঠানামা করছে। নান্নুর বিশ্বাস, ঘোষিত দলটা বিশ্বকাপে সেরা চারে অবস্থান করে নিতে পারবে। সাবেক এই অধিনায়ক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বকাপ দল নিয়ে প্রত্যাশা জানাতে গিয়ে বলেছেন,
‘এক থেকে চারের মধ্যে যাওয়ার প্রত্যাশা থাকবে সবসময়। আর আমি মনে করি, এখন যে অভিজ্ঞ দল ওয়ানডের, আমরা কিন্তু ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫১ শতাংশ ম্যাচ জিতেছি। এটা কিন্তু একটা প্লাস পয়েন্ট। যতগুলো ওয়ানডে খেলেছি, তার মধ্যে ৫১ শতাংশ ম্যাচ জিতেছি। এই অভিজ্ঞতার কারণেই আমাদের প্রত্যাশা বেশি। আমি মনে করি, এই দলের অবশ্যই সামর্থ্য আছে এক থেকে চারের মধ্যে থাকার।’
নেই বড় কোনো বিতর্ক
দল গঠন নিয়ে এবার বড় কোনো বিতর্ক হয়নি। টপ-অর্ডারে ইমরুলের না থাকা এবং তাসকিনের বাদ পড়া নিয়ে কম-বেশি আলোচনা হয়েছে। তবে দল নিয়ে সন্তুষ্ট প্রধান নির্বাচক। নান্নু বলেছেন,
‘এই দল গঠনে অবশ্যই সন্তুষ্টি আছে। কারণ, আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, যেহেতু ইংল্যান্ডে খেলা। সুতরাং এই অভিজ্ঞতার সাথে কোনও আপোষ হয় না। অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করেই এই দলটি গঠন করা হয়েছে। সেই হিসেবে আমি মনে করি যে, এই অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারবো। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি আমরা। আমাদের ক্রিকেট এখন এগিয়ে যাওয়ার পথে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আমরা একটি ভালো ফলাফল করেছিলাম ইংল্যান্ডে। আমি মনে করি, এবারও একটি লক্ষ্য আছে, এক থেকে চারের মধ্যে থাকা। আমি আত্মবিশ্বাসী যে, আমরা ভালো করবো ইনশাল্লাহ।’
ভারসাম্যপূর্ণ দল হয়েছে বলেই রায় দিয়েছেন নির্বাচকরা। ব্যাটিংয়ে টপ-অর্ডারে অভিজ্ঞ তামিমের সঙ্গে লিটন দাস, সৌম্য। তিনে সাকিবের ব্যাটিং করাটা প্রায় নিশ্চিত। পরে মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, মিঠুনরা নামবেন। সাব্বির, সাইফউদ্দিন, মিরাজরা পরের স্থানগুলোতে ব্যাটিং করবেন। স্পিনে সাকিব, মিরাজ, মোসাদ্দেকের উপরই ভরসা। পেস বোলিংয়ে মাশরাফি, মুস্তাফিজ, সাইফউদ্দিন, রুবেল রয়েছেন। রাখা হয়েছে দুই দিকেই সুইং করাতে পারদর্শী রাহী।
নান্নুর মতে,
‘আমি মনে করি, পুরো ব্যালান্সড দল এটি। যেহেতু একটি লম্বা সফরের টুর্নামেন্ট, এই কারণে ধারাবাহিক পারফর্ম অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু বিশ্বকাপে নয়টি ম্যাচ শুরুতেই, এবং এখানে (ত্রিদেশীয় সিরিজ) ফাইনালসহ পাঁচটি ম্যাচ হবে, সুতরাং ১৪টি ম্যাচে পারফরম্যান্স ধারাবাহিক থাকতে হবে। এই কারণে অভিজ্ঞতার গুরুত্বটা বেশি। আমার কাছে মনে হয় যে, আমাদের খেলোয়াড়েরা এখন যথেষ্ট অভিজ্ঞ এবং অনেকগুলো খেলোয়াড়ের ১০০-র উপরে ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। আমি মনে করি, এই দলটি অনেক ব্যালান্সড দল এবং আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী যে, ইনশাল্লাহ আমরা ভালো করবো।’
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে প্রথমে ঘোষিত দলে ছিলেন না নান্নু। পরে অনেক বির্তক, মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদের মুখে জাহাঙ্গীর আলমকে সরিয়ে দলে নেয়া হয় নান্নুকে। ২০ বছর পর প্রধান নির্বাচক হিসেবে তার ঘোষিত দলে অবশ্য ‘বিতর্ক’ বলতে কিছু সেভাবে চোখে পড়েনি কারোই।
তাসকিন ছাড়া পছন্দের সব অস্ত্রই বিশ্বকাপ দলে পেয়েছেন মাশরাফি। এই দলটা সময়ের সেরা কিংবা ইতিহাসের সেরা যা-ই হোক, কন্ডিশন বিরুদ্ধ হলেও ইংল্যান্ডের মাটিতে অভিজ্ঞতা-সামর্থ্য কাজে লাগাতে পারলে এবার বিশ্বকাপে নিজেদের সেরা সাফল্য পাওয়ার আশা করতেই পারে বাংলাদেশ।