সময়ের পরিক্রমায় আমরা আরেকটি দশকের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। দশ বছর নেহায়েত কম সময় নয়, তাই প্রতিটি দশকই নানা বিচিত্র ঘটনায় পরিপূর্ণ থাকে। তবে ক্রিকেটের ক্ষেত্রে এই দশক একটু বেশিই ঘটনাবহুল ছিল। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আরো মজবুত স্থানে যাওয়া, বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আবির্ভাব, খুঁটিনাটি নিয়মে পরিবর্তন সাথে বিভিন্ন দলের উত্থান-পতনে বেশ কিছু রদবদল গত এক দশকে এসেছে।
‘ক্রিকেটের বাইবেল’ হিসেবে পরিচিত জনপ্রিয় ম্যাগাজিন উইজডেন এই দশকের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে বিভিন্ন তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় তারা টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটের সেরা ইনিংসের তালিকা করেছে। দেখে নেওয়া যাক, উইজডেনের সেই তালিকায় কোন কোন ইনিংস জায়গা করে নিয়েছে।
টেস্ট
এই দশকে সেরা টেস্ট ইনিংস হিসেবে বেন স্টোকসের ১৩৫ রানের অনবদ্য ইনিংসটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই বছরের আগস্টে অনুষ্ঠিত হেডিংলি টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ১৭৯ রানের জবাবে ইংল্যান্ড যখন মাত্র ৭৯ রানে গুটিয়ে গেল, তখন ইংলিশদের হার অনেকের কাছেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। চতুর্থ ইনিংসে অজিরা যখন ৩৫৯ রান ছুঁড়ে দিল, তখন সেই সম্ভাবনা আরো বেড়ে গেল।
দলীয় ১৪১ রানে তৃতীয় উইকেটের পতনের পর স্টোকস যখন ক্রিজে এলেন, তখন অপর প্রান্তে রুট বেশ ভালো লড়াই চালাচ্ছিলেন। কিন্তু দলীয় ১৫৯ রানে দলের অধিনায়কও যখন সাজঘরে ফিরলেন, তখন কাজটা আরো অনেক কঠিন হয়ে যায়। তবে পরিস্থিতির চাপে ঘাবড়ে না গিয়ে অবিচল ভঙ্গিতে ব্যাট চালাচ্ছিলেন স্টোকস, প্রথম দুই রান নিতে তিনি সেদিন খেলেছিলেন ৬৬ বল!
এরপর আস্তে আস্তে খোলস থেকে বের হয়ে বেয়ারস্টোকে নিয়ে রানের চাকা ঘুরাতে লাগলেন স্টোকস, গড়লেন ৮৬ রানের জুটি। কিন্তু বেয়ারস্টোর বিদায়ের সাথে সাথে ইংল্যান্ডের ইনিংসে রীতিমত মড়ক লেগে যায়। নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্রড যখন সাজঘরে ফিরছিলেন, জয় থেকে তখনও ৭৩ রানে দূরে ইংল্যান্ড।
অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন স্টোকস, টানা চার-ছক্কা মারার মাধ্যমে রানের চাকাটা দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিতে থাকলেন। জ্যাক লিচের সাথে ৭৬ রানের জুটি গড়ে ইংলিশদের এনে দিলেন এক অকল্পনীয় জয়, যেখানে লিচের অবদান ছিল মাত্র এক রান। পুরো ইনিংস জুড়ে সাথে পরিস্থিতির মানিয়ে নিয়ে যেভাবে ভিন্ন তালে ব্যাট চালিয়েছিলেন স্টোকস, তাতে এই দশক তো বটেই, হয়তো ক্রিকেট ইতিহাসেরই সেরা ম্যাচজয়ী ইনিংস হিসেবে জায়গা করে নেবে এই ইনিংস।
উইজডেনের দৃষ্টিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইনিংসটিও এসেছে এই বছরে, ডারবান টেস্টে কুশল পেরেরার অপরাজিত ১৫৩ রানের ইনিংসটি অনেক দিক থেকেই স্টোকসের ইনিংসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ইংল্যান্ডের মতো শ্রীলঙ্কাও চতুর্থ তিন শতাধিক রানের পেছনে ছুটছিল। স্টোকস জুটি গড়েছিলেন বেয়ারস্টোর সাথে, পেরেরার সঙ্গী ছিলেন ধনঞ্জয় ডি সিলভা। ডারবান টেস্টেও জুটি ভাঙার পর ছোটখাট মড়ক লাগে, নবম উইকেটের যখন পতন ঘটে তখনো জয় থেকে ৭৮ রান দূরে লঙ্কানরা।
এক্ষেত্রে লিচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্ব ফার্নান্দো। তাকে সাথে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়েন কুশল পেরেরা। অ্যাওয়ে ম্যাচ, সাথে শ্রীলঙ্কা দলের ভঙ্গুর অবস্থা– সবমিলিয়ে অনেকে স্টোকসের চেয়ে কুশলের ইনিংসকে এগিয়ে রাখার ব্যাপারে পক্ষপাতী। কিন্তু অ্যাশেজের আবহটা যে বাকি সবকিছুর চেয়ে ভিন্ন, তাই উইজডেনের বিচারে অল্প কিছু নম্বরের ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে পেরেরাকে দ্বিতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
ভারতের বিপক্ষে কেভিন পিটারসেনের ১৮৬ রানের ইনিংসটি রয়েছে তালিকার তৃতীয় স্থানে। মুম্বাই টেস্টে তার এই অনবদ্য ইনিংসটি দু’দলের মাঝে ব্যবধান গড়ে দেয়, যা ২৮ বছর পর ভারতের মাটিতে ইংল্যান্ডের টেস্ট সিরিজ জয়ের পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
ওয়ানডে
সাঈদ আনোয়ারের ১৯৪ রানের ইনিংসটি এক যুগেরও বেশি সময় ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস হিসেবে নিজের জায়গা ধরে রেখেছিল। মাঝে অনেকেই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সাঈদের রেকর্ডটি ভাঙা হয়নি, সাথে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের দেখাও মেলেনি। এই দশকের শুরুতেই সেই অপেক্ষার অবসান ঘটে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অপরাজিত ২০০ রানের ইনিংস খেলে ওয়ানডে ফরম্যাটের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান হয়ে যান শচীন টেন্ডুলকার।
এরপর অনেকেই ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন, আধুনিক ক্রিকেটে রানের ফোয়ারা যেভাবে ছুটছে তাতে সামনেও আরো নতুন ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের খোঁজ মিলবে। তবে ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যে মহাকাব্য রোহিত শর্মা গড়েছেন, তা হয়তো আরো অনেকদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। যেখানে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি পাওয়াটাই দুষ্কর, সেখানে ইডেন গার্ডেন্সের ওই ম্যাচে ১৭৩ বলে রোহিত করেছিলেন ২৬৪ রান! রোহিতের এই অবিশ্বাস্য কীর্তিকে এই দশকের সেরা ওয়ানডে ইনিংস হিসেবে বেছে নিয়েছে উইজডেন।
সাঈদ আনোয়ারের স্বদেশী শহীদ আফ্রিদির একটি রেকর্ড দীর্ঘদিন অটুট ছিল। ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৩৭ বলে সেঞ্চুরি করে ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরির যে রেকর্ড গড়েছিলেন আফ্রিদি, তা প্রায় দেড় যুগ অক্ষুণ্ণ ছিল। এছাড়া ওই বছরেই জয়াসুরিয়ার ১৭ বলে ফিফটির রেকর্ডও অটুট ছিল। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩৬ বলে সেঞ্চুরি করে আফ্রিদির দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে দেন কোরে অ্যান্ডারসন। তার ঠিক এক বছর পর একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আরেক বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন এবি ডি ভিলিয়ার্স, যাতে সব রেকর্ড ভেঙে তছনছ হয়ে যায়।
জোহানেসবার্গে সেদিন ডি ভিলিয়ার্স যখন ব্যাটিংয়ে নামেন, তখন দুই ওপেনারের জোড়া সেঞ্চুরিতে ৩৮.৩ ওভারে মাত্র এক উইকেট হারিয়ে ২৩৮ রান সংগ্রহ করে ফেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। দারুণ এই ভিত পেয়ে ক্রিজে এসে শুরু থেকেই তাণ্ডবলীলা চালাতে থাকেন তিনি। মাত্র ১৬ বলে হাফসেঞ্চুরি করে ভেঙে দেন জয়াসুরিয়ার দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড। পরের ফিফটি তুলেন আরো দ্রুতগতিতে, ৩০ বলে সেঞ্চুরি করে দ্রুততম সেঞ্চুরির অনন্য এক নজির গড়েন ডি ভিলিয়ার্স। নয়টি চার ও ষোলটি ছক্কায় মাত্র ৪৪ বলে ১৪৯ রান করে সেদিন থেমেছিলেন এই প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান। ৩৩৮.৬৩ স্ট্রাইক রেটের এই ইনিংসটিকে এই দশকের দ্বিতীয় সেরা ইনিংস হিসেবে আখ্যায়িত করেছে উইজডেন।
উইজডেনের তালিকায় তিন নম্বরে রয়েছে কেভিন ও’ব্রায়েনের ১১৩ রানের ইনিংসটি। ব্যাঙ্গালোরে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ইংল্যান্ডের ছুঁড়ে দেওয়া ৩২৮ রানের পাহাড়সম লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ১১১ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল আয়ারল্যান্ডে। সেখান থেকে দলকে একা টেনে নেন ও’ব্রায়েন, মাত্র ৫০ বলে সেঞ্চুরি করে গড়েন বিশ্বকাপে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। তার এই ইনিংসের কল্যাণেই প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের দেখা পেয়েছিল আয়ারল্যান্ড।
টি-টুয়েন্টি
২০১৬ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও উইন্ডিজ। ইডেন গার্ডেন্সে আগে ব্যাট করতে নেমে ক্যারিবিয়ানদের ১৫৬ রানের মাঝারি মানের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁড়ে দেয় ইংলিশরা। তবে শুরু থেকেই নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে নিজেদের কাজটি কঠিন করে ফেলেছিল উইন্ডিজ। একপ্রান্তে একা লড়ে যাচ্ছিলেন স্যামুয়েলস, তবে শেষদিকে তিনিও রানের সাথে সেভাবে পাল্লা দিতে পারছিলেন না। ফলে শেষ ওভারে ক্যারিবিয়ানদের প্রয়োজন ছিল ১৯ রান।
ক্রিজে তখন কার্লোস ব্রাথওয়েট। শেষ ওভার করার দায়িত্ব ছিল বেন স্টোকসের। বাকিটুকু ইতিহাস, স্টোকসের করা চার বলে চার ছক্কা হাঁকিয়ে উইন্ডিজকে দ্বিতীয়বারের মতো টি-টুয়েন্টির বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করতে বড় ভূমিকা রাখেন ব্রাথওয়েট। তার করা ১০ বলে ৩৪ রানের ক্যামিওটি উইজডেনের মতে এই দশকের সেরা টি-টুয়েন্টি ইনিংস।
তবে অনেকের মতে ব্রাথওয়েটের ইনিংসের চেয়ে এগিয়ে থাকবে তার আরেক স্বদেশীর অনবদ্য এক ইনিংস। সেটি দেখা গিয়েছিল আরেক টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে। ২০১২ সালে কলম্বোয় শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আগে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই বেশ চাপে ছিল উইন্ডিজ। ১০ ওভার শেষে ২ উইকেট হারিয়ে তাদের সংগ্রহ ছিল মাত্র ৩২ রান, তখন মনে হচ্ছিল একশ পার হতেই বুঝি তাদের দম বের হয়ে যাবে।
তবে পাশার সব দান উল্টে দেন মারলন স্যামুয়েলস। শ্রীলঙ্কার সেরা বোলার মালিঙ্গাকে পাড়ার বোলার বানিয়ে শুরু করেন তাণ্ডবলীলা। তার ৫৬ বলে ৭৮ রানের ইনিংসে ১৩৭ রানের পুঁজি পায় ক্যারিবিয়ানরা, যা কলম্বোর স্লো পিচে উইন্ডিজের জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল। সেদিন একা যেভাবে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন স্যামুয়েলস, তাতে ব্রাথওয়েটকে টপকে তার এই ইনিংসটিরই দশকের সেরা টি-টুয়েন্টি ইনিংস হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে উইজডেন তাদের তালিকায় স্যামুয়েলসের ইনিংসটিকে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে। ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টুয়েন্টি ম্যাচে ১৫৬ রানের অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলেছিলেন অ্যারন ফিঞ্চ, উইজডেনের তালিকায় এই ইনিংসটি রয়েছে তৃতীয় স্থানে।