ইংরেজিতে একটি কথা আছে- “Morning shows the day”। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও এই কথা অনেকখানিই সত্য। একজন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারের সূচনা দেখলেই সে কত দূর যাবে সেটার আভাস পাওয়া যায়। তবে এমন কিছু ব্যতিক্রমধর্মী খেলোয়াড় আছেন, যাদের ক্যারিয়ারের শুরুটা তেমন আহামরি না হলেও পরে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের দ্বারা সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছেন। এমন একজন খেলোয়াড় হচ্ছেন তিলকারত্নে দিলশান, যার ক্যারিয়ারের প্রথম দশ বছর ভীষণ সাদামাটাভাবে কাটলেও পরের ৭ বছরের অভাবনীয় সাফল্যে ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন একজন কিংবদন্তির মর্যাদা নিয়ে।
১৯৭৬ সালের ১৪ অক্টোবর কালুতারায় জন্মগ্রহণ করেন তিলকারত্নে মুদিয়াসেলাগে দিলশান। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটকে ভালোবেসে খেলাটার সাথে জড়িয়ে যান তিনি। ১৯৯৬ সালে কালুতারা ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। মিডল অর্ডারে ব্যাট করার সাথে অফ স্পিনটাও বেশ ভালোই করতে পারতেন দিলশান। পেশাদার ক্যারিয়ার শুরুর তিন বছরের মাথায় শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের হয়ে ডাক পেয়ে যান তিনি। তবে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে পাঁচ নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৯ রানে সাজঘরে ফিরে যান এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান।
অবশ্য হারারেতে পরের টেস্টেই জ্বলে ওঠেন দিলশান। ১৬৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে দলের জয়ে বড় অবদান রাখায় ম্যাচসেরার পুরস্কারটা জিতে নেন তিনি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই সফরেই ওয়ানডেতে অভিষেক ঘটে তার, ৪৯ বলে ৩৫ রান করেছিলেন তিনি। তবে ধারাবাহিকতার অভাবে টেস্ট কিংবা ওয়ানডে- কোনো ফরম্যাটেই নিজের জায়গা পাকা করতে পারেননি তিনি। ২০০৩ সাল পর্যন্ত দলে যাওয়া-আসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন তিনি।
২০০৩ বিশ্বকাপের পর জাতীয় দল থেকে অরবিন্দ ডি সিলভা ও হাসান তিলকারত্নে অবসর নিলে দিলশানের দলে জায়গা পাওয়ার পথটা সুগম হয়ে যায়। কিন্তু সেই সুযোগকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারছিলেন না তিনি। ২০০৫ সালের আগপর্যন্ত ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি দূরে থাক, ফিফটিই ছিল মাত্র দুটো! অবশ্য এমন সাদামাটা পারফর্মেন্সের পিছনে মূল কারণ ছিল সবসময় ছয় নাম্বারে ব্যাট করা। সেসময়ে তিন ও চার নম্বর জায়গা দুটো তার সমবয়সী সতীর্থ মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকারার জন্য বরাদ্দ ছিল। এই দুজনের প্রতিভার ঝলকানির জন্যেই দিলশান যেন কিছুটা আড়ালে চলে যাচ্ছিলেন।
২০০৫ সালে নিজের জাত চেনাতে শুরু করেন দিলশান। সেই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে ১৭৯ বলে ১৬৮ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। একই বছরের শেষদিকে ভারতের বিপক্ষে টানা তিন ওয়ানডেতে ফিফটি করেন এই মারকুটে ব্যাটসম্যান। এর মধ্যে একটি ম্যাচে ২৮৬ রান তাড়া করার সময়ে অপরাজিত ৮৬ রানের ইনিংস খেলে দলকে জেতানোয় ম্যাচসেরার পুরস্কারও জিতে নেন তিনি।
২০০৬ সালে নিজের নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৭৯ বলে ১১৭ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান দিলশান। পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার হয়ে সবগুলো ম্যাচে খেলেছিলেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান, ছয় নাম্বারে ব্যাট করে বেশ কিছু ক্যামিও ইনিংস খেলে দলকে ফাইনালে তুলতে ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে সেবার রানার্স-আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় শ্রীলঙ্কাকে।
এরপরের দু’বছর দিলশানের ক্যারিয়ার একই স্রোতে গিয়েছে। ছয় নাম্বারে ব্যাট করে টুকটাক রান, সাথে অফ স্পিনার হিসেবে কিছু ওভার বল করা- এর বাইরে বিশেষ কিছু সেভাবে আর এ সময়ে করতে পারেননি তিনি। তাই দলে সাধারণ স্কোয়াড মেম্বার হিসেবেই তার পরিচিতি হয়ে গিয়েছিলো। দিলশানও যে মাহেলা কিংবা সাঙ্গাকারার মতো দলের স্তম্ভ হতে পারেন- এ কথাটা তখন কেউ চিন্তাও করেনি। কিন্তু ২০০৯ সালে ছোট্ট একটি সিদ্ধান্তের ফলে এই অভাবনীয় ব্যাপারটাই সত্যি হয়ে যায়।
বাংলাদেশের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করে ২০০৯ সালের শুরুটা বেশ ভালোভাবেই করেছিলেন দিলশান। সেসময়ে উদ্বোধনী জুটি নিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে গিয়েছিলো শ্রীলঙ্কা। জয়াসুরিয়ার সঙ্গী হিসেবে উপযুক্ত কাউকে না পেয়ে একপর্যায়ে সাঙ্গাকারাকেও ওপেনার হিসেবে চেষ্টা করা হয়েছিলো! শেষপর্যন্ত তিলকারত্নে দিলশানকে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ওপেনার হিসেবে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেয় বোর্ড। প্রথম ম্যাচেই ৩৩ বলে ৪২ রান করে ওপেনার হিসেবে নিজের শুরুটা বেশ ভালোভাবেই করেন তিনি।
দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৮৮ বলে ৭৬ রান করে দলের জয়ে বড় ভূমিকা রাখায় ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতে নেন দিলশান। আসল চমকটা দেখান সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ওয়ানডেতে; ১৩৭ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে ওপেনার হিসেবে নিজের জায়গাটা পাকা করে ফেলেন তিনি। এমন অসাধারণ ইনিংস খেলার সুবাদে সেই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পাশাপাশি প্রথমবারের মতো সিরিজসেরার পুরস্কারটাও জিতে নেন দিলশান।
২০০৯ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপেও অসাধারণ এই পারফর্মেন্সের ধারা ধরে রাখেন দিলশান। নিজের দিনে তিনি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারেন সেটা এই আসরেই স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এই বিশ্বকাপে ‘দিলস্কুপ’ নামক নতুন এক শট আবিষ্কার করে পুরো ক্রিকেটবিশ্বে তোলপাড় তৈরি করে ফেলেন তিনি। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফর্মেন্সে ৫২.৮৩ গড়ে ৩১৭ রান করে সেই আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন দিলশান। এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ৫৭ বলে ৯৬ রানের অপরাজিত ইনিংসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয়। এই ইনিংসে ভর দিয়েই প্রথমবারের মতো টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে চলে যায় শ্রীলঙ্কা।
তবে ফাইনালে দিলশানের ব্যাট আর জ্বলে ওঠেনি, শূন্য রানেই সেই ম্যাচে সাজঘরে ফিরে যান তিনি। শ্রীলঙ্কাও আর পেরে ওঠেনি পাকিস্তানের সাথে। দল বিশ্বকাপ না জিতলেও দিলশান ঠিকই ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্টের পুরস্কার জিতে নেন। যে খেলোয়াড় ক্যারিয়ার শুরুর দশ বছর পরেও গড়পড়তা একজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন, সেই তিনিই শুধুমাত্র ওপেনার হওয়ার সুযোগ পেয়ে বৈশ্বিক একটা আসরে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নিলেন! কিন্তু এমন অভাবনীয় পরিবর্তনের মূল কারণ আসলে কী ছিল?
স্কয়ার কাট আর পুল- এই দুটি শট ছিল তিলকারত্নে দিলশানের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। ছয় নাম্বার পজিশনে তিনি যখন খেলতে নামতেন, তখন বিপক্ষ দল পুরোপুরি রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতেই ফিল্ডারদের সাজাতো। ফলে এই দুটো শটে বাউন্ডারি আদায় করাটাও তখন বেশ দুরূহ হতো। কিন্তু যখন তাকে ওপেনার হিসেবে খেলানো শুরু হলো, তখন প্রথম ১০ ওভারের পাওয়ার প্লের সুবিধা নিয়ে এই স্কয়ার কাট আর পুল দিয়ে খুব সহজেই বাউন্ডারি আদায় করতে শুরু করলেন তিনি। এ কারণে ওপেনার হিসেবে খেলার পর থেকে তার ক্যারিয়ারের গতিপথটাই আমূল পাল্টে যায়।
সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে ওপেনার হিসেবে সাফল্য পাওয়ার পর টেস্টেও ওপেনার হিসেবে খেলতে আরম্ভ করেন দিলশান, আর সেখানেও তিনি সফল হন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গল টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৯২ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৩ রান করে জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। সেই বছরের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে শ্রীলঙ্কা গ্রুপপর্বের বৈতরণী পার হতে ব্যর্থ হলেও দিলশান ছিলেন উজ্জ্বল। সেই আসরের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে যায় শ্রীলঙ্কা। সেখানে প্রথম ম্যাচে ভারতের করা ৪১৪ রানের পাহাড়সম সংগ্রহ তাড়া করতে নেমে দিলশান খেলেন ১২৪ বলে ১৬০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। তবে এমন দুর্দান্ত ইনিংস সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা মাত্র ৩ রানে ম্যাচটা হেরে যায়। পরের ম্যাচেও দিলশান সেঞ্চুরি করেন, এ ম্যাচ শ্রীলঙ্কা জিতে নেয় ৩ উইকেটে। সব মিলিয়ে ২০০৯ সালে চারটি ওয়ানডে সেঞ্চুরির দেখা পান এই মারকুটে ওপেনার।
বছরের প্রথম ওয়ানডেতেই ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে ২০১০ সালের শুরুটাও দারুণভাবে করেন দিলশান। সেবছর জিম্বাবুয়েতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনে বিশ্রামে থাকায় দিলশানকে অধিনায়ক করে দল পাঠায় শ্রীলঙ্কা। ফাইনালে অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করে দলকে শিরোপা জেতান দিলশান। সেবছরের আরেক ত্রিদেশিয় সিরিজের ফাইনালে ঘরের মাঠে ভারতের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা আর সেখানেও জ্বলে ওঠেন এই মারকুটে ব্যাটসম্যান। তার ১১০ রানের ঝকঝকে ইনিংসে ভর করে ভারতকে ৭৪ রানে হারিয়ে এই টুর্নামেন্টের শিরোপাও জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। সব মিলিয়ে মাত্র দু’বছরের মধ্যেই মাহেলা ও সাঙ্গাকারার মতো দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে ওঠেন তিনি।
২০১১ বিশ্বকাপেও নিজের এই ফর্ম ধরে রাখেন দিলশান। দুই সেঞ্চুরিতে ৫০০ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে শ্রীলঙ্কাকে ফাইনালে তুলতে বড় ভূমিকা রাখেন তিনি। তবে স্বাগতিক ভারতের কাছে ফাইনালে হেরে যায় শ্রীলঙ্কা। এদিকে ফাইনালে হারার জের ধরে তৎকালীন লঙ্কান অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা ও সহ-অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনে পদত্যাগ করলে দিলশানকে পূর্ণমেয়াদে অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয় লঙ্কান বোর্ড।
অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে ইংল্যান্ড সফরে যান দিলশান। অধিনায়ক হিসেবে নিজের দ্বিতীয় টেস্টেই ইংলিশদের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা ১৯৩ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস খেলেন তিনি। এরপর ঘরের মাঠে টি-টুয়েন্টিতে অজিদের বিপক্ষে ১০৪ রানের ইনিংস খেলে অধিনায়ক হিসেবে তিন ফরম্যাটেই সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়েন দিলশান। তবে সব মিলিয়ে অধিনায়ক হিসেবে তার সময়টা মোটেও ভালো যায়নি। তার আট মাসের অধিনায়কত্বে শ্রীলঙ্কা টেস্ট বা ওয়ানডে কোনো সিরিজই জিততে পারেনি!
সবচেয়ে বড় কথা- অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর ব্যাট হাতেও দিলশানের সময়টা ভালো যাচ্ছিলো না। পূর্ণ মেয়াদে অধিনায়ক হওয়ার পর ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে একটা ম্যাচেও সেঞ্চুরির দেখা পাননি তিনি! আসলে স্বভাবজাত নেতৃত্বের ব্যাপারটা তার মধ্যে ছিল না। তাছাড়া বোর্ডের সাথে ঝামেলার জের ধরে সেই সময়ে দুই সিনিয়র খেলোয়াড় মাহেলা ও সাঙ্গাকারাও সেভাবে তাকে সমর্থন দেননি। এ কারণে ২০১২ সালের শুরুতেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ শেষে অধিনায়কের পদ থেকে সরে যান দিলশান।
তবে অধিনায়কের পদ থেকে সরে যাওয়াটা দিলশানের জন্য শাপে বর হয়েই আসে। ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত সিবি সিরিজে দুই সেঞ্চুরিতে টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৫১৩ রান করে জিতে নেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। সেই বছরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ১১৯ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলে বহুদিন পর শ্রীলঙ্কাকে সিরিজ জেতানোয় বড় অবদান রাখেন তিনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজটাও দারুণ কাটে দিলশানের। সেই সিরিজে দুটি সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। ২০১২ সালের শেষদিকে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে আবারো এক বছরে চার ওয়ানডে সেঞ্চুরির দেখা পান দিলশান।
ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টিতে আরো মনোযোগ দেওয়ার জন্য ২০১৩ সালে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নেন দিলশান। সেই বছর ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে গল টেস্টেও সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। পরিকল্পনা ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলেই এই ফরম্যাটকে বিদায় জানাবেন দিলশান, কিন্তু সেই সিরিজটা বাতিল হয়ে গেলে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলা কলম্বো টেস্টই তার বিদায়ী টেস্ট হয়ে যায়। টেস্ট ক্যারিয়ারে ৮৭ ম্যাচ খেলে ১৬ সেঞ্চুরিতে প্রায় ৪১ গড়ে ৫,৪৯২ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
দিলশানের ২০১৪ সালটা সেভাবে ভালো কাটেনি। তবে এ বছরেই শ্রীলঙ্কা দলের হয়ে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের স্বাদ পান তিনি। টানা চার ফাইনাল হারার পর এই বিশ্বজয়টা তার জন্য বিশেষ কিছুই ছিল। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে দুটি সেঞ্চুরি করে ২০১৫ সালের শুরুটা দারুণভাবে করেন তিনি। নিজের এই ফর্ম বিশ্বকাপেও টেনে নিয়ে যান এই মারকুটে ওপেনার। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ১৬১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন তিনি। সেই আসরে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষেও সেঞ্চুরি করেন তিনি। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কা আর পেরে ওঠেনি।
এই বিশ্বকাপের পরেই দুই মহারথী মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকারা অবসরে চলে যান। সবাই ধারণা করছিলেন, দিলশানও হয়তো শীঘ্রই অবসরে চলে যাবেন। আসলে তখন দিলশানের খেলা চালিয়ে যাওয়ার মূল লক্ষ্য ছিল দশ হাজার রানের কোটা পূরণ করা। সেই বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে সেই লক্ষ্য পূরণ করে চতুর্থ লঙ্কান ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে দশ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন দিলশান। এরপর ব্যাট হাতে সময়টা তেমন ভালো যাচ্ছিলো না, আসলে বয়সের ভারে ধার অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।
শেষপর্যন্ত ২০১৭ সালে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ শেষেই সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান দিলশান। বিদায়বেলায় তার পরিসংখ্যানের খাতাটা বেশ সমৃদ্ধই ছিল, ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৩৩০ ম্যাচে ৩৯.২৭ গড়ে ১০,২৯০ রান, সাথে ১০৬ উইকেট। যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য এটা বেশ অসাধারণ অর্জন। শুধু ব্যাট কিংবা বল হাতেই নয়, ফিল্ডিং দিয়েও দলকে অনবদ্য সেবা দিয়েছিলেন দিলশান। সবসময় পয়েন্ট পজিশনেই ফিল্ডিং করতেন, অবসরের আগপর্যন্ত দলের সেরা ফিল্ডারের জায়গাটা নিজের দখলেই রেখেছিলেন তিনি।
সাদামাটা একজন খেলোয়াড় থেকে কীভাবে নিজেকে কিংবদন্তিতে পরিণত করা যায় তার অনন্য দৃষ্টান্ত দিলশান। যে ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারের প্রথম ৯ বছরে ওয়ানডে সেঞ্চুরির সংখ্যা ছিল মোটে একটি, সেই ব্যাটসম্যানই পরের ৯ বছরে ২১টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেছিলেন! ক্যারিয়ারের মাঝপথে এমন অভাবনীয় উন্নতি সত্যিই বিস্ময়কর। নিজেকে উন্নত করে সেরার আসনে বসানোর ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমানা যে নেই- তারই এক অনন্য দৃষ্টান্ত এই তিলকারত্নে দিলশান।