বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ক্রীড়াকাহিনীকার মতি নন্দী রচিত বিখ্যাত উপন্যাস ‘কোনি’ অবলম্বনে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্রে কোনির শিক্ষক ক্ষীতীশের মুখে একটি সংলাপ ছিল, “একটি দেশের কাছে একজন বড় স্পোর্টসম্যানের যা দাম, তা একজন বড় সেনাপতির চেয়ে কম নয়। দুজনেই দেশের কাছে হিরো। কিন্তু একজন হলো যুদ্ধ, ধ্বংস আর মৃত্যুর প্রতীক, আর একজন, স্পোর্টসম্যান, সে হলো প্রাণের প্রতীক, দেশের জীবনীশক্তির প্রতীক।“
সংলাপটিতে সাঁতারের কোচ ক্ষীতীশ খেলার ময়দান এবং যুদ্ধের ময়দানের চারিত্রিক পার্থক্য খুব সূক্ষ্মভাবে বোঝাচ্ছেন। সৈন্যকেও তার সর্বস্ব ত্যাগ করে লড়তে হয় শুধুমাত্র দেশকে রক্ষার স্বার্থে, খেলোয়াড়কেও তার সবটা উজাড় করে দিতে হয় দেশকে গর্বিত করার স্বার্থে। যুদ্ধজয়ে গর্ব এবং মৃত্যুর গ্লানি দুই-ই মিশে থাকে ওতপ্রোতভাবে, সেখানে ক্রীড়াক্ষেত্রে জয় সর্বতোভাবেই আনন্দের বার্তাবহ। তবে পার্থক্য শুধুই প্রতীকী ন্যারেটিভে, অগাধ সম্মানের অধিকারী দুই ভিন্ন পেশার মানুষই। আবার মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধের কলাকৌশল থেকেই জন্ম হয়েছে জনপ্রিয় যত খেলার। সময় যত এগিয়েছে, তত যুদ্ধের কৌশল বদলেছে, বদল এসেছে অস্ত্রেও। পাল্লা দিয়ে উদ্ভূত হয়েছে আধুনিক খেলার। যেমন, একসময়ে তীরধনুকই ছিল যুদ্ধের অস্ত্র, সেখান থেকে জন্ম নিয়েছে তীরন্দাজি। পরে যখন বন্দুকের ব্যবহার শুরু হয়েছে, খেলার তালিকায় যুক্ত হয়েছে শ্যুটিং।
প্রাচীন ভারতবর্ষের ক্রীড়া সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে উঠে আসবে নানা জাতি ও তাদের সংস্কৃতির ইতিহাস। যে ইতিহাসে যুদ্ধবিগ্রহ তো বটেই, সাথে লোকাচারের বর্ণনাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে উদ্ভূত জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে প্রথমেই যার নাম আসবে, তার সম্পর্কে বহুদিন অবধি মানুষ জানতেন খেলাটি বিদেশ থেকে আমদানি হয়েছে। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, ইরান থেকে। কিন্তু ‘শতরঞ্চ কে খিলাড়ি’র মুন্সি নন্দলালের সৌজন্যে এখন হয়তো সকলেই জানেন, ‘ইয়ে হিন্দুস্তান কি ইয়াদ হ্যায়।’
এতক্ষণে সকলেই বুঝে গিয়েছেন, খেলাটি হলো দাবা। আধুনিক দাবার চেয়ে প্রাচীন ভারতীয় দাবা ছিল অনেকটাই অন্য রকমের। ৮x৮ মোট চৌষট্টি খোপে খেলা হতো বলে এর নাম ছিল ‘অষ্টপদ’। কোথাও কোথাও একশো খোপের দশপদের প্রচলনও ছিল। একটি কাপড়ের ওপর খোপ এঁকে খেলা হতো। দুই থেকে চারজন অংশ নিতে পারতেন খেলায়। সবচেয়ে অবাক করা তথ্যটি হলো, অন্যান্য প্রাচীন ঘুঁটি সাজানোর খেলা, যেমন- লুডু, সাপলুডু বা পাশার মতোই দাবাও খেলা হতো একটি ছক্কার সাহায্যে। এখন যেমন বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ঘুঁটির চাল দেন দাবাড়ুরা, তখন ছক্কা চালার ওপর নির্ভর করত খেলার গতি, অর্থাৎ খেলায় হারজিত নির্ভর করত অনেকটাই ভাগ্যের ওপর। পরে অষ্টপদের নাম হয় ‘চতুরঙ্গ’। ‘চতুরঙ্গ’ অর্থে তৎকালীন ভারতীয় সেনানীতির চারটি মূল অঙ্গ বা স্তরবিন্যাস অনুযায়ী ঘুঁটিসজ্জা- হস্তীবাহিনী, রথে আরোহী সেনা, অশ্বারোহী সেনা এবং পদাতিক সেনা।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে পারসিকরা ভারতীয়দের কাছ থেকে এই খেলাটি রপ্ত করে এবং নিজেদের দেশে খেলাটির প্রচলন করে। পারস্যেই এটি ‘শতরঞ্চ’ নাম নিয়ে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। জেতার পর ইংরেজিতে ‘চেকমেট’ বা বাংলায় যে ‘কিস্তিমাত’ বলেন বিজয়ী দাবাড়ু, তার উৎপত্তি মনে করা হয় পারসিক ‘শাহ-মাত’ থেকে, যে শব্দের অর্থ ‘রাজা এবার মৃত’। বলতে গেলে, পারস্য থেকেই বিশ্বমঞ্চে পরিচয় ঘটে দাবার। যারা ‘শতরঞ্চ কে খিলাড়ি’ দেখেছেন, তারা লক্ষ্য করে থাকবেন, দুই খিলাড়ি অর্থাৎ মীর এবং মির্জা দুজনেরই এই ধারণাই ছিল, ইরান থেকেই ভারতে আমদানি হয়েছিল দাবার। মুন্সি নন্দলালের তথ্যে তাই দুজনেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ভারতীয় দাবার থেকে ইউরোপীয় দাবার নিয়মে সামান্য পার্থক্য আছে। সেটি হলো, ভারতীয় দাবায় যেটিকে মন্ত্রী ধরা হয়, সেটি ইউরোপীয় দাবায় রানি এবং ইউরোপীয় দাবায় পদাতিক সৈন্য এগোতে পারে একেবারে দু’ঘর। উদ্দেশ্য, যত তাড়াতাড়ি খেলা শেষ করা যায়। দাক্ষিণাত্যেও চতুরঙ্গের নানা সংস্করণ প্রচলিত ছিল। যেমন, পুলিয়াট্টম, নক্ষত্রাট্টম এবং দয়াকাট্টম।
দাবার পাশাপাশি একইসাথে উঠে আসবে পাশা, লুডু এবং সাপলুডুর নাম। পাশা বা দ্যুতক্রীড়ার চরিত্র কীরকম হতে পারে, মহাভারতের সৌজন্যে সকলের কাছেই তা মোটামুটি পরিষ্কার। এখানেও ওই বোর্ডের ওপর ঘুঁটি সাজিয়ে খেলা এবং ছক্কা চালার ভাগ্যকৌশলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে হারজিতের খতিয়ান। লুডু নামটি ব্রিটেনে উনবিংশ শতকে চালু হলেও লুডুর পূর্বতন সংস্করণটির নাম পচিসি, যা কি না মধ্যযুগীয় ভারতে উদ্ভূত হয়েছিল।
ছক্কাটি তৈরি হতো একপ্রকার সামুদ্রিক শামুকের খোলস দিয়ে। ‘পচিসি’ অর্থে পঁচিশ, ছক্কার একটিবারের চালে সর্বাধিক স্কোর। পচিসির সমগোত্রীয় আরেকটি খেলা জনপ্রিয় ছিল, যেটির নাম চোপার বা চৌপার। ষষ্ঠ বা সপ্তম শতাব্দীর একটি চিত্রে হরপার্বতীকে চোপার খেলতে দেখা গেছে। অজন্তা গুহাচিত্রে পচিসি ক্রীড়া অঙ্কিত হয়েছে। তবে পচিসি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে। আকবরের রাজধানী ফতেপুরের প্রাসাদ চত্বরে লালপাথরের ওপর পচিসির একটি বিশাল বোর্ড খোদাই করা রয়েছে। বলা হয়, ষোড়শ শতকে এখানে আকবর পচিসি খেলার রাজকীয় আয়োজন করেছিলেন। পচিসিকে নকল করে আমেরিকায় পাচিসি বা ‘দ্য গেম অফ ইন্ডিয়া’ নামের একটি খেলার সরঞ্জাম বাজারে নিয়ে আসে পার্কার ব্রাদার্স এবং উইনিং মুভিজ গেমস।
সাপলুডু খেলা আবার অনেকটাই বেশি নৈতিকতায় পরিচায়ক। শিশুদের মধ্যে সনাতন ধর্মীয় নীতিজ্ঞান প্রচার করতে ত্রয়োদশ শতকে সন্ত জ্ঞানদেব এই খেলার প্রচলন করেন এমন বলা হলেও খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে এর উৎপত্তি হয়েছে, এই প্রমাণও পাওয়া গেছে। প্রাচীন ভাষায় মোক্ষপট বা পরমা পদম নামে প্রচলিত ছিল এই খেলা। পরে ব্রিটিশদের মুখে মুখে ‘স্নেক্স অ্যান্ড ল্যাডার্স’ নাম ছড়িয়ে পড়ে, তারই মিশ্র বাংলা সংস্করণ সাপলুডু।
সিঁড়ি অর্থে উত্তরণ, অর্থাৎ জীবনের সৎকাজের পুরস্কার, আর সাপের মুখ মানে অসততার ফলস্বরূপ অধঃপতন। প্রাচীনতম সংস্করণে যে চৌকো খোপগুলোতে সিঁড়ি বা সাপ থাকত, সেগুলোর আলাদা আলাদা গুরুত্ব ছিল। সিঁড়ি অঙ্কিত কোনো খোপের অর্থ বিশ্বাস, কোনোটায় আবার ভরসা, কোনোটায় বদান্যতা তো কোনোটায় জ্ঞান। একইভাবে সাপের মুখ থাকত যে খোপগুলোতে সেগুলোর মধ্যে কোনোটায় অসততা, কোনোটি ক্রোধ, কোনোটি চুরি, কোনোটি মিথ্যাচার। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সিঁড়ির চেয়ে সাপের সংখ্যাই বেশি। এই অসামঞ্জস্য জীবনের একটি ধ্রুব সত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তা হলো, জীবনে ভালো কাজের চেয়ে খারাপ কাজ করা অধিকতর সহজ এবং মরণশীল মানুষ সেই খারাপের প্রতিই অধিক আকৃষ্ট হয়, নিয়তির পতনের কথা চিন্তা না করেই। ১০০ নম্বর খোপে পৌঁছনো অর্থে নির্বাণ বা মোক্ষ লাভ। আবার এই পাপ-পুণ্যের হিসাব যদি বা না-ও করা হয়, যদি খেলাটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ মানবজীবনের সাথে তুলনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, এই সিঁড়ি দিয়ে উত্তরণ বা সাপের মুখে পড়া এ যেন সাধারণ মানবজীবনের ক্রমাগত উত্থান-পতনের পরিসংখ্যান। এই সমস্ত চড়াই-উতরাই পেরিয়েও যে মানুষ নিজের কাছে আজীবন সৎ থাকতে পারেন, মোক্ষলাভ তাঁরই সম্ভব। সাধে কী বলে, জীবন আসলে সাপলুডুর মতোই!
পাশার কথা তো হলো, এই পাশার পাশেই আরও একটি খেলার নাম বসে, যে খেলার কপালেও জুটেছে সর্বনাশার তকমা। তাসের খেলারও প্রচলন এই ভারতবর্ষেই। রাজারাজড়াদের রাজসভায় পারিষদবর্গের মধ্যে আয়োজিত হতো তাসের প্রতিযোগিতা। ক্রীড়াপত্রম নামের এই প্রাচীন খেলায় তাস তৈরি করা হতো কাপড় কেটে, তার ওপর আঁকা হতো রামায়ণ, মহাভারতসহ নানা কাহিনীচিত্র। তাসগুলোকে যথাসম্ভব মোটা করতে কাপড়ের একাধিক টুকরোও ব্যবহার করা হতো। গঞ্জিফা নামে পরিচিত এই তাসের খেলার প্রচলন ছিল রাজপুতানা, উৎকল, দাক্ষিণাত্য এবং নেপালেও। আধুনিক তাসে যে ধরনের ছবি আঁকা থাকে, সেই ফুল, লতাপাতার ধারণা গঞ্জিফার চিত্রাঙ্কন থেকেই।
দেশীয় রাজাদের সভায় যে ধরনের তাসের প্রচলন ছিল, সেটা পরিবর্তিত হয় মুঘল আমলে। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ থেকে জানা যায়, বারো সেটের তাস ব্যবহৃত হতো। প্রতি সেটে তাসের সংখ্যাও হতো বারো। সেখানে দ্বিতীয় স্থানে সবসময় থাকতেন সেনাপতি এবং তার নীচে দশজন সাধারণ সৈনিক। প্রথম স্থানে যিনি থাকতেন তার নাম সেট ভেদে আলাদা হতো, যেমন- অশ্বপতি, গজপতি, নরপতি, ধনপতি, দলপতি, নবপতি, সুরপতি, অস্রপতি, বনপতি, অহিপতি ইত্যাদি। কাপড় ছাড়া কচ্ছপের খোল দিয়েও তৈরি হতো তাস। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয়রা কাগজের তাস আমদানি করলে প্রাচীন পদ্ধতিটি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে থাকে। বদল আসে নিয়মেও। বাহান্ন তাসের খেলা শুরু হয়। সাহেব-বিবি-গোলাম-টেক্কার দাপটে হারিয়ে যেতে থাকে নরপতি, গজপতি, ধনপতিরা।
ঘরোয়া খেলাগুলো ছেড়ে এবার যদি একটু ঘরের বাইরের খেলাগুলোর দিকে নজর দেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে সেখানেও ওই একই যুদ্ধের কৌশলেরই একটু পরিমার্জিত সংস্করণ এবং মানবতান্ত্রিক লোকাচারের ছোঁয়া। এখানে সকলের আগেই নাম আসবে পোলোর। ঘোড়ার পিঠে বসে খেলা হতো এই পোলো। মুঘল আমলে, বিশেষত বাবরের শাসনকালে, খেলাটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে। তবে মূলত রাজাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল পোলো।
ঘোড়সওয়ার খেলোয়াড়দের হাতে থাকত গলফ স্টিকের মতো একটি স্টিক। বল মারার জন্য স্টিকটি ব্যবহৃত হতো। পোলোর মতোই আরেকটি খেলা, যেটির প্রবর্তন হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে, তার নাম চৌগান। কথিত আছে, সুলতানি আমলের প্রথম সম্রাট কুতুবউদ্দিন আইবক চৌগান খেলার সময় ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহন হন ও তারপর মারা যান। ব্রিটিশ-আগমনের পর ‘এলিফ্যান্ট পোলো’র প্রবর্তন হয়। এখানে ঘোড়ার বদলে হাতির ওপর চড়ে খেলা শুরু হয়। হাতির পিঠে খেলোয়াড় ছাড়াও থাকতেন মাহুত। খেলোয়াড়দের পা হাতির পিঠের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হতো খেলোয়াড়দের পতন থেকে রক্ষা নিশ্চিত করতে। বিশ্বদরবারে পোলোকে জনপ্রিয় করার মূলে কিন্তু ব্রিটিশরাই। যে কারণে প্রথমে কাশ্মীর, মণিপুরসহ গুটিকয়েক স্থানে খেলা হলেও পরবর্তীকালে খেলাটি বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আর্জেন্টিনা। বর্তমানে ভারতের রাজস্থান ছাড়াও অন্যান্য দেশের মধ্যে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে এলিফ্যান্ট পোলো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
আচ্ছা, বুলফাইট বললে আগে কোন দেশ মাথায় আসে? স্পেন নিশ্চয়ই। শুনলে অবাক হওয়ার মতো হলেও এটাই সত্য যে, ষাঁড়ের লড়াইও এই দেশেই শুরু হয়েছিল। তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল উৎসবে অনুষ্ঠিত জাল্লিকাট্টুই হলো এই ষাঁড়ের লড়াই। বছর কয়েক আগেই শিরোনামে এসেছিল জাল্লিকাট্টু। সৌজন্যে, পশুর প্রতি নৃশংসতার জন্য সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক খেলাটির নিষিদ্ধকরণ। কিন্তু প্রবল জনরোষের চাপে সেই রায় তুলে নিতে বাধ্য হয় সর্বোচ্চ আদালত। বিশেষ ধরনের ষাঁড় পালন করা হয় খেলাটির জন্য। ইতিহাস অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে প্রথম শতাব্দীর মধ্যকার কোনো এক সময়ে প্রাচীন তামিল রাজ্যের মুল্লাই অঞ্চলের আদিবাসীদের লোকাচারের অংশ হিসাবে খেলাটির উদ্ভব ঘটে।
জাল্লিকাট্টু নামটি ‘জাল্লি’ এবং ‘কাট্টু’ এই দুটি তামিল শব্দের সমন্বয়ে তৈরি। জাল্লি এবং কাট্টু অর্থ সোনা বা রূপোর একটি কয়েন, যা ষাঁড়টির শিঙে বেঁধে দেওয়া হয়। মাদুরাইয়ের কাছাকাছি একটি গুহায় প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো একটি গুহাচিত্রে এই খেলার নিদর্শন মিলেছে। একটি ভাস্কর্য রক্ষিত রয়েছে সালেমের ডিস্ট্রিক্ট মিউজিয়ামেও। তবে শুধু দাক্ষিণাত্যই নয়, সিন্ধু সভ্যতার একটি সিলমোহরেও দেখা মিলেছে ষণ্ড নিয়ন্ত্রণের চিত্র। খ্যাপা ষাঁড়কে বশে আনার এই খেলা ছিল সাহসিকতার প্রতীক। কিন্তু নির্মম সত্য হলো, মানবজাতি-প্রবর্তিত সবচেয়ে নৃশংস খেলাগুলোর মধ্যে বুলফাইট নিঃসন্দেহে অন্যতম। খেলা চলাকালে ষাঁড় এবং মানুষ উভয়েরই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বহুবার। তাই কেবলমাত্র বিনোদনের জন্য একটি পশুকে এভাবে হেনস্থা করায় বহুদিন ধরেই এই প্রাণঘাতী খেলা বন্ধের জন্য আবেদন করে আসছে পশুপ্রেমী সংগঠনগুলো।
জাল্লিকাট্টুর মতো আরও একটি জনপ্রিয় খেলা, বলতে গেলে সর্বাধিক জনপ্রিয় ভারতীয় খেলা, সেই কাবাডির জন্মও তামিলনাড়ুতেই। কাবাডির বয়স প্রায় চার হাজার বছর। দলবদ্ধ শিকার করার পদ্ধতিকে অনুসরণ করে এই খেলার জন্ম। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম হয়েছে তুমুল জনপ্রিয় এই ভারতীয় খেলাটির, যেমন- বাংলাদেশে হাডুডু, মালদ্বীপে বাইবালা, অন্ধ্রপ্রদেশে চেদুগুড়ু, মহারাষ্ট্রে হুটুটু ইত্যাদি।
এখানে প্রতি দলে থাকেন সাতজন করে খেলোয়াড় এবং খেলার সময়কাল হয় চল্লিশ মিনিট। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে দিয়ে তাকে বার করে দেওয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকে হার-জিতের ভাগ্য। তাই এই খেলায় বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতার যতটা প্রয়োজন হয়, ততটাই প্রয়োজন হয় দৈহিক শক্তির। ভারতবাসীর একান্ত আপন এই খেলার বিশ্বমঞ্চের প্রতিযোগিতায় ভারতের সাফল্যও ঈর্ষা করার মতো। প্রতিটি বিশ্বকাপে ছেলে ও মেয়েদের বিভাগে তো বটেই, এশিয়ান গেমসেও নিয়মিত স্বর্ণপদক এনেছেন ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা।
কাবাডির মতোই মহারাষ্ট্রে উদ্ভূত খো-খো আরেকটি অতীব জনপ্রিয় ভারতীয় প্রাচীন খেলা। এই খেলায় বারোজন খেলোয়াড়ের মধ্যে চেজিং টিমে থাকে ন’জন (হাঁটু গেড়ে) এবং ডিফেন্সিভ টিমে থাকে তিনজন। ‘খো’ সম্ভবত সংস্কৃত ‘স্যু’ ক্রিয়া থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ওঠো এবং যাও’। খেলার মধ্যে এঁকেবেঁকে দৌড়ে প্রতিপক্ষকে নাকাল করার যে পন্থাটি নেওয়া হয়, সেটি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ছিল। বলা হয়, অভিমন্যুর চক্রব্যূহে প্রবেশ এভাবে আঁকাবাঁকা পথে রথ ছুটিয়েই। রথে চড়ে খেলা হতো বলে ‘রথেরা’ নামেও অভিহিত করা হতো এই খো-খো-কে। সময়ের সাথে সাথে খো-খোর নিয়মে এসেছে পরিবর্তন। ১৯৮২ সালে একে অলিম্পিক গেমসের আওতায় আনা হয়।
গিলি ডাণ্ডা বা বাংলায় যাকে আমরা ‘ডাংগুলি’ বলে থাকি, তা যে ক্রিকেটের প্রাচীন ভারতীয় সংস্করণ, এ কথা তো অনেকেই স্বীকার করবেন। কিন্তু ক্রিকেটের মতোই আরেকটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় আউটডোর খেলা রাগবির পূর্বপুরুষও যে এ উপমহাদেশেরই বাসিন্দা, তা কি জানেন সকলে? মণিপুর অঞ্চলের ‘ইয়ুবি লাকপি’, যার অর্থ ‘নারকেল কাড়া’, সেই খেলাটি থেকেই নাকি আধুনিক বিশ্ব রাগবির নিয়মকানুন বানিয়েছে, এমন জোরালো দাবী করে থাকেন মণিপুরবাসীরা।
হিন্দুপুরাণে বর্ণিত সমুদ্র মন্থন কালে অমৃতের পাত্র দখল কেন্দ্র করে যে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়েছিল, সেই পৌরাণিক কাহিনীকে অবলম্বন করে শুরু হয় এই খেলা। আধুনিক রাগবির চেয়ে নিয়মকানুন অনেকটাই আলাদা এই স্থানীয় খেলার। রাজার উপস্থিতিতে ইয়াওশাং উৎসবের দিন অনুষ্ঠিত হয় এই খেলা। এখানে প্রতি দলে সাতজন খেলোয়াড় থাকলেও আসলে একজন খেলোয়াড়ই জয়যুক্ত হতে পারেন। রাগবির ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয় না, সেখানে পুরোটাই দলগত খেলার নিয়মে বাঁধা। ইয়ুবি লাকপিতে খেলতে নামার আগে খেলোয়াড়রা সকলে গায়ে তেল মেখে শরীরকে পিচ্ছিল করে নেন, যাতে ঠিকমতো ধরা না যায়। তেল মাখানো হয় নারকেলটিকেও। মাঠের এক প্রান্তে থাকে গোল বক্স। সেখানে পৌঁছতে খেলোয়াড়দের প্রতিপক্ষের হাত থেকে শরীর বাঁচিয়ে ছুটতে হয়। প্রথা অনুযায়ী, খেলার শেষে বিজয়ী খেলোয়াড় নারকেলটি রাজার পায়ের কাছে জমা দেন।
খেলাধুলা যেহেতু লোকসংস্কৃতিরই এক অপরিহার্য অঙ্গ, সেহেতু দেখা গেছে, তা কখনও একটি নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। গ্রাম, শহরের সীমানা ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। বিদেশীরা এদেশকে আক্রমণ করেছে, তারপর ক্রমশ মিশে গেছে এখানকার মানুষজনের সাথে, এখানকার সংস্কৃতিকে তারা প্রথমে হয়তো বর্জন করেছে, কিন্তু পরে গ্রহণ করে নিজভূমিতে বিস্তারে সাহায্য করেছে। অঞ্চলভেদে এই সংস্কৃতির আঙ্গিক হয়তো হয়েছে পৃথক, কিন্তু মূল কাঠামোটি একই রয়ে গিয়েছে। কেবলমাত্র বিবর্তন ঘটেই হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের অভ্যাসে রয়ে গিয়েছে সেই সংস্কৃতি। আবার এমনও হয়েছে, একই সময়ে হয়তো পৃথিবীর দুই অচেনা প্রান্তের মানুষের মনে এসেছে একই ভাবনা। দেশ-কাল-পাত্রের গণ্ডি ক্রমে ক্রমে মুছে গেছে, অদলবদল ঘটেছে পৃথক ভাবনার, সেখান থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন ভাবনা। এভাবেই এগিয়েছে আমাদের খেলা, খেলার বিনোদন।