২০ আগস্ট, ১৯৭১ সাল। মার্সেসাইডে লিভারপুলের অ্যানফিল্ড স্টেডিয়ামে লাল ও সাদা রঙের স্কার্ফ জড়িয়ে দলে দলে সমর্থকরা জমায়েত হওয়া শুরু করেছে। অ্যানফিল্ডের বিখ্যাত স্পিয়ন কপ স্ট্যান্ডে স্বাগতিক দলের সমর্থকরা জড়ো হয়েছে প্রিয় দলের খেলা দেখতে। তৎকালীন ডিভিশন ওয়ান লিগের ম্যাচে ঘরের মাঠে দলটি মুখোমুখি হবে আর্সেনালের। দলটি অবশ্য লিভারপুল ছিলো না, সেদিন অ্যানফিল্ডে স্বাগতিক দল হিসেবে মাঠে নেমেছিলো লিভারপুলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ফুটবলের একটি চিরস্মরণীয় দিন, তাই না?
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুলের মাঠে স্বাগতিক দল হিসেবে ইউনাইটেডের মাঠে নামা অবশ্যই ফুটবলের একটি বিশেষ দিন, ইউনাইটেড ভক্তদের জন্য না হলেও লিভারপুল ভক্তদের জন্য তো অবশ্যই। কিন্তু এই ইতিহাস সম্ভবত ইউনাইটেড ভক্তরা কিছুতেই মনে করতে চায় না, ঠিক যেমন স্বীকার করতে অনাগ্রহ সেই ম্যাচে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ ইউনাইটেডের খেলোয়াড়দের।
ইউনাইটেড যখন অ্যানফিল্ডে আর্সেনালের মুখোমুখি হয়, সেই সময়ে লিভারপুলের মতোই তাদেরও অর্জন সমান ৭টি লিগ শিরোপা। ১৯৭১ সালের জুনে স্যার ম্যাট বাসবি ক্লাবের দায়িত্ব ছেড়ে দিলে, তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন ফ্রাঙ্ক ও’ফ্যারেল। নতুন ম্যানেজারের অধীনে ইউনাইটেডের অবস্থা বেশ টালমাটাল, তখনো বলার মতো করে দল সাম্যাবস্থা অর্জন করতে পারেনি। তার উপর বিগত মৌসুমে উগ্র সমর্থকদের ভয়ংকর আচরণ ইউনাইটেডের উপর নিয়ে আসে অপমানজনক(!) এক নিষেধাজ্ঞা। ১৯৭০-৭১ মৌসুমে নিউক্যাসলের বিপক্ষে নিজেদের মাঠে খেলা চলাকালীন সময়ে অতিথি স্ট্যান্ডের দিকে ইউনাইটেডের কিছু উগ্র সমর্থক চাকু ও ডার্ট নিক্ষেপ করে।
বিপদজনক এই আচরণের কারণে শাস্তিস্বরুপ ইংলিশ ফুটবলের অভিভাবক এফএ ইউনাইটেডকে পরবর্তী মৌসুমে প্রথম দুইটি হোম ম্যাচ নিরপেক্ষ ভেন্যুতে আয়োজনের নির্দেশ দেয়। ইউনাইটেডের প্রথম দুইটি হোম ম্যাচের ভেন্যু নির্বাচন করা হয় লিভারপুলের অ্যানফিল্ড ও স্টোক সিটির ভিক্টোরিয়া গ্রাউন্ড। স্টোক সিটির ভিক্টোরিয়া গ্রাউন্ড নিয়ে সমর্থকদের খুব একটা সমস্যা না থাকলেও, লিভারপুলের অ্যানফিল্ডে স্বাগতিক দল হিসেবে ইউনাইটেডকে খেলতে হবে এমন ঘটনা অনেক সমর্থকই তখন মানতে রাজি ছিলো না।
এই নিষেধাজ্ঞার পর প্রাক মৌসুমে ওয়াটনি কাপে একটি ম্যাচে পরাজিত হবার পর ইউনাইটেড সমর্থকরা হ্যালিফ্যাক্সে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং শহরের প্রায় ১,৫০০ ইউরোর মূল্যের ক্ষতি করে। ইউনাইটেডের উগ্র সমর্থকদের ধ্বংসাত্মক আচরণের পর সেই সময়ে ডেইলি মিরর উল্লেখ করে যে, “দুর্বৃত্তরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।” অ্যানফিল্ডে ম্যাচটির একটি রিপোর্টে বলা হয়, ম্যাচ শুরু হতে দেরি হয়েছিলো, কারণ প্রায় শ’খানেক সমর্থক এক স্ট্যান্ড থেকে অন্য স্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য মাঠের উপর দিয়েই দৌড় দিয়েছিলো। সামগ্রিক এই পরিস্থিতিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ঐ বছরে দুটি শিরোপাজয়ী দারুণ ফর্মে থাকা আর্সেনালকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে।
এবারে আসি স্মরণীয় এই জয়টিকে কিভাবে এবং কতটা মনে রেখেছে ঐ ম্যাচে অংশ নেওয়া ইউনাইটেড খেলোয়াড়েরা। নতুন কোচের অধীনে ম্যাচের প্রথমার্ধে ইউনাইটেডের পারফর্মেন্স তেমন একটা আশাব্যঞ্জক ছিলো না। ম্যাচের মাত্র চার মিনিটের মাথায় ফ্রাঙ্ক লিঙ্কটকের গোলে পিছিয়ে পড়ে স্বাগতিক দল। ইউনাইটেড দলে তখনো খেলছে ১৯৬০ এর দলের ব্রায়ান কিড, ববি চার্লটন এবং ইউরোপিয়ান কাপজয়ী অ্যালেক্স স্টেফানি ও ডেভিড স্যাডলার। যা-ই হোক, ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে অসাধারণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় ইউনাইটেড, যার অনেকটা কৃতিত্ব ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জর্জ বেস্টের। এরপরই অ্যালান গাওলিঙের গোলে সমতায় ফেরে ইউনাইটেড। অ্যানফিল্ডে স্বাগতিক সমর্থকরা ইউনাইটেডের গোল উদযাপন করছে, ফুটবলের ইতিহাসে কতটা স্মরণীয় ঘটনা তা বলা বাহুল্য। তেমনি গাওলিঙের জন্যও ঘটনাটি খুবই মনে রাখার মতো, কিন্তু আদৌ কি মনে রেখেছেন তিনি?
২০১০ সালে দ্য গার্ডিয়ানের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে ম্যাচটির কথা তুললে গাওলিঙের উত্তর ছিলো সম্পূর্ণ নেতিবাচক। “আমার মনে নেই। কার সাথে খেলেছিলাম?”, বলেছিলেন গাওলিঙ। রিপোর্টার গ্রেগ রাফলি তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে ম্যাচটি ছিলো আর্সেনালের বিপক্ষে এবং অ্যানফিল্ডে। অ্যালান গাওলিঙ প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, “অ্যানফিল্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হোম ম্যাচ?” অ্যালানের কাছে নাকি পুরো ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য! কিন্তু সমতাসূচক গোলের পর অ্যালানের উদযাপনের ছবি বলে ভিন্ন কথা যা সেই সময়ে ম্যাচের পরবর্তী দিনে দ্য গার্ডিয়ানে ছাপা হয়েছিলো।
এই ম্যাচে ইউনাইটেডের রক্ষণভাগের দায়িত্ব ছিলেন ডেভিড স্যাডলার। ম্যাচটির ব্যাপারে স্যাডলারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তার বক্তব্য ছিলো অ্যালানের চেয়েও নেতিবাচক। “আমি কি খেলেছিলাম? আমি আসলে মনে করতেই পারছি না। অ্যালেক্সের স্মরণে থাকতে পারে। ম্যাচ মনে রাখায় সে আমার চেয়ে ভালো,” বলেছিলেন স্যাডলার।
অ্যালেক্স স্টেপনি এই ম্যাচে ইউনাইটেডের গোলবার সামলিয়েছিলেন, ম্যাচের পুরো একটা অর্ধ বিখ্যাত কপ স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কতটা উপভোগ করেছিলেন স্বাগতিক সমর্থকদের উল্লাস? সাক্ষাৎকারে স্টেপনি বলেন, “আমার খুব অস্পষ্টভাবে মনে আছে যে ওল্ড ট্রাফোর্ডের বাইরে আমরা মাত্র দুইটি ম্যাচ খেলেছিলাম, কিন্তু এই ম্যাচের কথা মনে করতে পারছি না।” স্টেপনি আরও যোগ করেন, “আমি ভেবেছিলাম অ্যানফিল্ডে আমি মাত্র একটি ম্যাচই জিতেছিলাম, যখন আমরা লিভারপুলকে ৪-১ গোলে হারিয়েছিলাম (ডিসেম্বর, ১৯৬৯)। তাহলে এখন আমি আরেকটি জয় যোগ করতে পারি।”
ম্যাচের দ্বিতীয় গোলটি এসেছিলো অ্যানফিল্ড রোড এন্ডে ববি চার্লটনের অসাধারণ বাঁকানো ফ্রি কিক থেকে। বর্তমানে ম্যানচেস্টার সিটির সহকারী কোচ ব্রায়ান কিডের শেষ মুহূর্তের গোল ম্যাচে ইউনাইটেডের জয় নিশ্চিত করে দেয়। ৩-১ গোলের অসাধারণ জয় নিয়ে অ্যানফিল্ড ছেড়েছিলো স্বাগতিক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
অসাধারণ ও স্মরণীয় এই জয়ের কথা ইউনাইটেডের কারো মনে না থাকলেও মনে রেখেছেন লিভারপুলের স্টেডিয়াম ঘোষক ‘ভয়েস অব অ্যানফিল্ড’ জর্জ স্টেফটন। গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, “আমি এখনো অর্ধেক ফাঁকা স্টেডিয়াম দেখতে পাই।” ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই হোম ম্যাচে কি লিভারপুলের বিখ্যাত গান ‘You’ll never walk alone’ বাজানো হয়েছিলো? স্টেফটন বলেন, “আমার ক্যারিয়ারের মাত্র তৃতীয় ম্যাচ ছিলো এটি। আমি বাইবেলের শপথ করে বলতে পারবো না যে খেলায় আমি প্রায় ‘You’ll never walk alone’ বাজিয়ে দিচ্ছিলাম না।”
লিভারপুলের সাবেক সেক্রেটারি পিটার রবিনসন মনে করেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও লিভারপুলের বর্তমান যে বৈরিতা তা ঐ সময়ে এতটা তীব্র ছিলো না। ১৯৬০ এ লিভারপুলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো একই শহরের দল এভারটন। কিন্তু সময়ের সাথে যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের উত্থান ঘটলো, তখনই লিভারপুল ও ইউনাইটেডের মধ্যে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বৈরিতা শুরু হয়ে গিয়েছিলো। ম্যাচটির ফিক্সচার তৈরিতে সাহায্য করা পিটারসন বলেন, “আমারও মনে আছে কপ স্ট্যান্ডে ইউনাইটেড সমর্থকরা দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে এমনটা ঘটবে না, তাই নয় কি?”
কড়া নিরাপত্তা সত্ত্বেও ম্যাচটিতে সমর্থকদের উগ্রতা ও বেপরোয়া আচরণ বন্ধ ছিলো না। প্রায় ১০০ জন সমর্থককে স্টেডিয়াম থেকে বের করে দিয়েছিলো পুলিশ। ম্যাচ শেষে দেখা অ্যানফিল্ডের অনেক জানালা ভাঙ্গা পাওয়া গিয়েছিলো। তাছাড়া প্রায় ৬০০ জনকে বিশেষ নজর দাড়িতে রেখেছিলো পুলিশ, যারা ইউনাইটেড সমর্থকদের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারছিলো। পুলিশি পাহাড়ায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থকদের ম্যানচেস্টারে যাওয়ার ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়েছিলো।
অ্যানফিল্ডে এই ম্যাচে মাত্র ২৭,৬৪৯ জন দর্শক হয়েছিলো, এর মধ্য থেকে ১৫% আয় লিভারপুলকে দিতে হয়েছিলো ইউনাইটেডকে। তাছাড়া তৎকালীন নিয়মানুসারে ম্যাচের দর্শক উপস্থিতি ৪৮,০০০ এর কম হওয়ায় এফএ’র নির্দেশ অনুযায়ী আর্সেনালকেও ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছিলো স্বাগতিক ইউনাইটেড।
সব মিলিয়ে ব্যাপক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলো স্বাগতিক হিসেবে অ্যানফিল্ডে খেলতে আসা ইউনাইটেড। সামগ্রিক বিবেচনায় ৩-১ গোল জয় ব্যতীত ম্যানচেস্টারের বলার মতো আর কোনো অর্জন নেই অ্যানফিল্ডের এই ম্যাচটিতে। লিভারপুলের ঘরের মাঠে ইউনাইটেডের হোম ম্যাচ! ম্যাচটিতে অংশ নেওয়া ও গোল দেওয়া খেলোয়াড়েরাই যখন মনে রাখতে চায় না অবিস্মরণীয়(!) ম্যাচটির কথা, তখন ইউনাইটেড সমর্থকরাও যে দীর্ঘ দিন ইতিহাসের ধুলাময় পাতার নিচে লুকিয়ে থাকা এই ম্যাচটির কথা বিশেষ করে মনে রাখবে না তা খুবই স্বাভাবিক।
ফিচার ইমেজ- liverpoolecho