খেলাধুলার বিশ্বে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগকে মানা হয় অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রতিযোগিতা হিসেবে। ১৯৫৫-৫৬ মৌসুম থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতা কোনোরকম বিরতি ছাড়াই টানা চলছে এত বছর ধরে। প্রতি বছরই আমরা বড় বড় দলের জমজমাট লড়াই দেখতে পাই এখানে। নতুন নতুন ক্লাবের উঠে আসা, পুরোনো ক্লাবের পতন – এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতা কিন্তু সবসময় একরকম ছিল না। কালের বিবর্তনে নামসহ পরিবর্তন এসেছে প্রতিযোগিতার অনেক ক্ষেত্রেই। এই প্রতিযোগিতাটি শুরু হয়েছিল ১৬টি দলের একটি প্রতিযোগিতা হিসেবে। এরপর ১৯৯৭ সালে দলের সংখ্যা বাড়িয়ে আনা হয় ২৪টিতে। এর দুই বছর পর দলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২টিতে।
মাঝে আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না আসলেও অবশেষে এই প্রতিযোগিতার ফরম্যাটে পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছে উয়েফা। ২০২৪-২৫ মৌসুমের আমরা দেখতে যাচ্ছি একদম নতুন আঙ্গিকে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় এই প্রতিযোগিতাটিকে। নতুন সম্প্রচার চুক্তির নানাবিধ বাণিজ্যিক সন্ধি মোতাবেক এই প্রতিযোগিতাটিকে নানাভাবে পরিবর্তিত করা হচ্ছে। এতে বৃদ্ধি পাবে ম্যাচের সংখ্যা। নতুন এই ফরম্যাটটিকে বলা হচ্ছে ‘সুইস মডেল’। কী থাকছে এই সুইস মডেলে?
সচরাচর আমরা দেখতে পাই চ্যাম্পিয়নস লিগের মূল পর্বে খেলে ৩২টি দল। তারা ৮টি গ্রুপে বিভক্ত হয় আর প্রতিটি গ্রুপে থাকে ৪টি করে দল। এটিকে পরিবর্তন করে এখন গ্রুপ হবে শুধু একটি লিগের মতো করে। সেখানেই র্যাংকিং করা হবে ১ থেকে ৩৬ নাম্বার দলকে। কিন্তু স্বাভাবিক লিগ সিস্টেমের সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে, স্বাভাবিক লিগ সিস্টেমে এই ৩৬টি দলের সবাই একে অপরের মোকাবিলা করে দুইবার। একবার ঘরের মাঠে, আরেকবার প্রতিপক্ষের মাঠে। কিন্তু এই সুইস মডেলে একটি দল কেবল ১০টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে। এই ১০টি ম্যাচ হবে ১০টি ভিন্ন ভিন্ন দলের সাথে, ৫টি ঘরের মাঠে, ৫টি অন্যের মাঠে। অন্যান্যবার যেখানে একটি গ্রুপে ৩টি দলের বিপক্ষে ২ বার করে খেলতে হতো, ২০২৪ সাল থেকে গ্রুপপর্বে আর কোনো দলের সাথে দ্বিতীয়বার খেলতে হবে না। এই ফিক্সচার নির্ধারণে কোয়ালিফাই করা ক্লাবগুলোকে আগে ৪টি গ্রুপে রাখা হবে, যেখানে প্রতি গ্রুপে ক্লাব থাকবে ৯টি। এই গ্রুপগুলো করা হবে উয়েফা কো-এফিশিয়েন্ট পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে।
এইভাবে গ্রুপ পর্বের খেলাগুলো শেষ হওয়ার পর যে ৮টি দল টেবিলের টপে থাকবে, তারা সরাসরি চলে যাবে শেষ ষোল’র লড়াইয়ের জন্য। আর ৯ থেকে ২৪তম অবস্থান থাকবে যাদের, তারা প্লে-অফ রাউন্ডে চলে যাবে। সেখানে ৯ম দলটি মুখোমুখি হবে ১৭তম দলটির, এভাবে ১৬তম দলটি মুখোমুখি হবে ২৪তম দলের। দুই লেগের এই প্লে-অফে ৯ম থেকে ১৬তম দল প্রথম লেগে হোম টিম হিসেবে খেলার সুযোগ পাবে। এখানে যে ৮টি দল জিতবে, তারা চলে যাবে শেষ ষোলতে। আর যে ৮টি দল বাদ পড়বে, তারা চলে যাবে উয়েফা ইউরোপা লিগে। আর ২৫ থেকে ৩৬তম দল যারা থাকবে, তারা পুরোপুরি বাদ পড়ে যাবে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা থেকে। শেষ ১৬ থেকে এরপর স্বাভাবিক হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে খেলা হয়ে ফাইনাল হবে কোনো একটি নিরপেক্ষ ভেন্যুতে।
এই ফরম্যাটটি যখন অনুমোদন পায়, তখন ইউরোপিয়ান ক্লাব অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ছিলেন জুভেন্টাসের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেয়া আগনেল্লি। সুপার লিগের জন্য পদত্যাগ করার মাত্র সপ্তাহখানেক আগে তিনি এই ফরম্যাটকে অভিহিত করেছিলেন আদর্শ চ্যাম্পিয়নস লিগ হিসেবে। কারণ এই পদ্ধতিতে যারা অংশগ্রহণ করবে, তাদের জন্য সুযোগ আগের চেয়ে অনেক বেশি থাকবে। প্রতিযোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে এখানে বাড়ছে ম্যাচের সংখ্যাও। আগে যেখানে একটি দলকে সর্বনিম্ন ৬টি ম্যাচ খেলে বাড়ির পথ ধরতে হতো, এই পদ্ধতিতে সবারই কমপক্ষে ১০টি ম্যাচ খেলতেই হবে। সেই হিসেবে টেবিলের ৩৬ নাম্বারে থাকা দলটিরও খেলতে হবে আগের থেকে ৪টি বেশি ম্যাচ।
তবে বাণিজ্যিক লাভটা বেশি এতে। ইউরোপের টপ এলিট দল যাদের বলা হয়, তাদের ম্যাচ বেশি পাওয়া যাবে এই সিস্টেমে। কারণ, ফিক্সচার করার জন্য যে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হবে, তা হবে উয়েফা কো-এফিশিয়েন্ট পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে। কথা হচ্ছে, এই উয়েফা কো-এফিশিয়েন্ট পয়েন্ট কী? সহজ করে বলতে হলে, উয়েফার একটি র্যাংকিং পদ্ধতি যেখানে তারা একটি ক্লাবের গত পাঁচ বছরের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আর উয়েফা ইউরোপা লিগের পারফরম্যান্স দেখে তার উপর ভিত্তি করে র্যাংকিং করা হবে। কোনো দল যদি কোনো মৌসুমে এই দুইটি প্রতিযোগিতায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারে, তবে ওই মৌসুমের পয়েন্ট ০ ধরে বাকি ৪ মৌসুম নিয়ে হিসেব হয়। এই র্যাংকিং অনুযায়ীই নির্ধারণ করা হয় গ্রুপপর্বের হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে খেলা ম্যাচগুলোয় কারা আগে ঘরের মাঠে খেলার সুযোগ পাবে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ইউরোপা লিগ, দুই আলাদা প্রতিযোগিতার জন্য আলাদাভাবে পয়েন্টের হিসেব হয়। ২০১৮-১৯ মৌসুমে এসে এই গণনা পদ্ধতিতে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়।
তো স্বাভাবিকভাবেই বড় দলগুলো যখন আরো বেশিবার একে অপরের মোকাবিলা করবে, তখন সেখানে দর্শকদের আকর্ষণও বৃদ্ধি পাবে অনেক বেশি। ফলে ম্যাচের টিকিট বিক্রি বৃদ্ধি পাবে, স্পন্সররা তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য বেশি টিভি দর্শক পাবে; আর সবশেষে ক্লাবগুলো একটি বড় অ্যামাউন্টের প্রাইজমানি পাবে।
তবে বিতর্ক বেশি হচ্ছে যা নিয়ে, তা হলো ৩২ থেকে যে ৪টি দল বৃদ্ধি করা হলো, তারা কীভাবে কোয়ালিফাই করে আসবে? প্রথম ৩২টি দল তো স্বাভাবিকভাবেই আসছে, তাহলে বাকি ৪টি স্পট কারা নেবে?
-
একটি স্লট পাবে উয়েফার ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন র্যাংকিংয়ে পাঁচে থাকা লিগ। আমরা যে ইউরোপের টপ পাঁচ লিগ হিসেবে যাদের চিনি, সেই র্যাংকিংয়ে বর্তমান ৫ নাম্বারে আছে ফ্রান্সের লিগ ওয়ান। বর্তমানে লিগ ওয়ানের এর তৃতীয় হওয়া দলকে প্লে-অফ খেলে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বে জায়গা করে নিতে হয়। কিন্তু নতুন এই পদ্ধতিতে পঞ্চম স্থানে থাকা এই লিগটির তৃতীয় দল সরাসরি চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার সুযোগ পাবে।
-
উয়েফার এই লিগ র্যাংকিংয়ে যে সমস্ত লিগ দশের বাইরে আছে, তাদের চ্যাম্পিয়নদেরকেও বাছাইপর্ব খেলে আসতে হবে। এটিকে বলা হয় ‘চ্যাম্পিয়ন্স পাথ’। এই আলাদা বাছাই পর্বগুলোতে শুধু ১১ম থেকে ৫৫তম পর্যন্ত থাকা লিগের চ্যাম্পিয়নরাই খেলে। এখান থেকে গ্রুপপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে মাত্র ৪টি দল। অন্য লিগ থেকে যেখানে ৪র্থ হলেও সরাসরি গ্রুপ পর্বে খেলা যায়, সেখানে এই সমস্ত লিগের চ্যাম্পিয়নরাও সরাসরি খেলতে পারে না। তাই তাদের জন্য একটি স্লট দেওয়া হয়েছে যেটিতে তারা সরাসরি গ্রুপপর্বে খেলবে। কিন্তু কীভাবে বাছাই হবে এটি? যে দল আগের মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে ভাল করবে, তারাই শুধু এই স্লটটি পাবে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে আয়াক্স সেমিফাইনাল খেললেও পরের মৌসুমে তাদের এই চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার জন্য ২টি বাছাইপর্ব খেলতে হয়। তাদের মতো যারা থাকবে, তারা যেন পরবর্তীতে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বে সহজভাবে ঢুকতে পারে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে ২০২৪ সাল থেকে ‘চ্যাম্পিয়ন্স পাথ’ দিয়ে কোয়ালিফাই করবে ৫টি দল।
-
বাকি দু’টি স্লট নিয়েই বিতর্ক বেশি। এই দু’টি স্লট দেওয়া হচ্ছে যেসব দল চ্যাম্পিয়নস খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু ইউরোপা লিগ বা সামনে অনুষ্ঠিতব্য কনফারেন্স লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে তাদের জন্য। এতগুলো ক্লাবের মধ্যে এই দু’টি ক্লাব বাছাই করা হবে সবচেয়ে বেশি ক্লাব কো-এফিশিয়েন্ট কাদের আছে সেই হিসেবে। এই কো-এফিশিয়েন্টের পয়েন্ট গণনা করা হয় শুধু আগের পাঁচ মৌসুমে ইউরোপীয় টুর্নামেন্টগুলোয় তাদের পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে। যেমন এই গত মৌসুমে টটেনহ্যাম লিগে ষষ্ঠ হয়ে ইউরোপা লিগে চলে গেছে। কিন্তু আগের মৌসুমেই তারা ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের রানারআপ। এই নতুন পদ্ধতিতে তাদের মতো অবস্থায় থাকা অন্যরা কো-এফিশিয়েন্টের পয়েন্ট দিয়েই চ্যাম্পিয়নস লিগে সরাসরি খেলার সুযোগ পাবে। এতে করে টপ চার লিগের যেকোনোটি থেকেই সর্বোচ্চ ৬টি দল খেলার সুযোগ পেয়ে যাবে।
এই নতুন সিস্টেমে তাই টপ চার লিগকে একটু বেশিই সুবিধা দেওয়া হয়ে যায়। টপ চার লিগে একটি সীমা দেওয়া আছে যে সর্বোচ্চ সাতটি দল ইউরোপীয় প্রতিযোগিতাগুলো খেলার সুযোগ পাবে। স্বাভাবিকভাবেই এর মধ্যে চারটি দল যাবে চ্যাম্পিয়নস লিগে, ২টি ইউরোপা লিগে, ও ১টি যাবে কনফারেন্স লিগে। তাই যদি এই নতুন পদ্ধতিতে এই চার লিগের কোনো একটি দল টেবিলের প্রথম সাতের বাইরে থেকেও অতিরিক্ত দল হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে, তবে সাত দলের কোটা পূরণ হয়ে যাওয়ায় তারা কনফারেন্স লিগ বা অনেক সময় ইউরোপা লিগেও কোটা পূরণ করতে দল পাঠাতে পারবে না। এতে কিন্ত অবিচারই বেশি হয়, কারণ যেখানে অন্য লিগের চ্যাম্পিয়নরা খেলার সুযোগ পাবে না কিন্তু প্রধান চার লিগের ৮ম, ৯ম, বা ১০ম হওয়া দলও খেলার সুযোগ পাচ্ছে।
এই অবিচারের ব্যাপারটা ছাড়িয়ে আসছে আরেকটি প্রশ্ন, এমনিতেই এত ব্যস্ত সূচিতে আজকাল ফুটবল খেলা হচ্ছে। লিগের খেলার বাইরে চ্যাম্পিয়নস লিগের ৬টি ম্যাচ খেলতেই যেকোনো দলের খেলোয়াড়েরা হাঁপিয়ে উঠেন। সেখানে এভাবে আরো ৪টি বাড়তি ম্যাচ খেলা কীভাবে সম্ভব? আর উয়েফাই বা কীভাবে এত ব্যস্ত সূচিতে সবগুলো ম্যাচের জন্য জায়গা বানিয়ে দেবে? বর্তমানে মঙ্গলবার আর বুধবার হয় চ্যাম্পিয়নস লিগের খেলা আর বৃহস্পতিবার হয় ইউরোপা লিগের খেলা। সামনে কনফারেন্স লিগের জন্য সপ্তাহের আরেকটা দিন ছেড়ে দিতে হবে। সেই হিসেবে উয়েফার জন্য আরো মুশকিল হয়ে যাওয়ার কথা। এখন দেখার ব্যাপার উয়েফা এই বিষয়টিকে কীভাবে সামাল দেয়।
তবে ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এই ব্যাপারটাকে অনেকটা আশীর্বাদ হিসেবে দেখা যায়। বড় দলগুলোর মধ্যে লড়াই দেখার জন্য আগে সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হতো। চ্যাম্পিয়নস লিগে তো সেটি আরো দুর্লভ। গ্রুপপর্বের প্রতি গ্রুপে বলার মতো বড় দল থাকেই ২টি করে। এছাড়া ভিন্ন লিগের দুই জায়ান্টের মধ্যে দেখা হয় শেষ ষোল বা এরপর থেকে। কিন্তু নতুন ফরম্যাটে গ্রুপপর্বেই ১০টি ম্যাচ থাকায় প্রতি সপ্তাহেই আমরা আশা করতে পারি বড় দলগুলোর মধ্যে লড়াই দেখার। ইউরোপিয়ান সুপার লিগ ফ্যানদের নিয়মিত বড় দলগুলোর লড়াইয়ের যে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল, তা হয়তো বা চ্যাম্পিয়নস লিগের এই নতুন পদ্ধতি অনেকাংশেই পূরণ করতে পারবে। সেই সাথে ছোট দলগুলো যাতে তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত না হয়, সে খেয়ালও রাখতে পারবে।