আজকাল তাঁকে নিয়ে লেখা শুরু করাটা বেশ বিপদের। অনেক খুঁজে-টুঁজে কোনো অনবদ্য লাইন ভেবেছেন, নিজেই নিজেকে খানিকক্ষণ বাহবা দিয়েছেন, এরপরে গুগল নামক আশ্চর্য যন্ত্র ঘেঁটে দেখেছেন, আজ থেকে এক দশক আগেই তিনি কোনো লেখককে এই একই লাইন লিখতে বাধ্য করিয়েছেন। তাকে নিয়ে নতুন করে লেখার মতো কোন বাক্যই আর অবশিষ্ট আছে?
কিন্তু এই লেখালেখির পুরোটাই বোধহয় আমার-আপনার মতো বাংলাদেশি ভক্ত-সমর্থকদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। নইলে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করার আগে স্টিভ রোডসকে কেন বলতে হবে, ‘তাকে (সাকিব) কিছু জায়গায় এখনো প্রমাণ করতে হবে, আমার মনে হচ্ছে সাকিব নিজেও সেটা জানে।’ কেন মার্ক নিকোলাসকে ধারাভাষ্যে বলতে হবে, ‘বেশিরভাগ মানুষই মনে হয় সাকিবকে এক নম্বর অলরাউন্ডার হিসেবে দেখে অবাক হয়েছেন!’
প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটেই এক নম্বর অলরাউন্ডার হবার কীর্তি গড়েছিলেন ২০১৫ সালে। আইসিসি অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ে প্রথমবারের মতো নাম্বার ওয়ান হয়েছিলেন তো এরও অর্ধযুগ আগে, ২০০৯ সালে। মাঝের এই এক দশকে অলরাউন্ডার তালিকার শীর্ষে তার নাম ছিল না, এমন দিন বিশ্বকে দেখতে হয়নি খুব বেশি৷ এরপরও ক্রিকেট বিশ্বের লাইমলাইটটা তিনি যেন ঠিকঠাক কাড়তে পারেননি। এক প্রজন্ম ধরে ‘সেরা অলরাউন্ডার’ তকমাটাও যেন যথেষ্ট হচ্ছিল না তার দিকে মানুষের মনোযোগ কাড়তে।
অবশেষে তিনি মনোযোগ কাড়লেন। বিশ্বকাপের মঞ্চে অতিমানবীয় পারফরম্যান্সে বিশ্বকে বাধ্য করলেন তার প্রতি দৃষ্টি দিতে। মাইক হাসি তাকে বলছেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়, টিম উইগমোর আবার বলছেন, সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর লেখক জ্যারড কিম্বার এগিয়ে গিয়েছেন আরও একধাপ। তিনি ঘোষণা দিচ্ছেন, একদিবসী ক্রিকেটেই নাকি সাকিবের মতো অলরাউন্ডার খুব একটা আসেননি।
জ্যারড কিম্বারকে গুরু মেনে এই লেখকও প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, ‘সাকিব একজনই!‘
১.
বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিবের ভূমিকা কী, সে তো আর নতুন করে বলার মতো কোনো কথা নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে সাকিব নামটি মুছে ফেলার সাধ্যও কারও নেই। ভক্ত-সমর্থকরাও তাই তার শাস্তির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন কখনো, কখনো আবার তার কোনো কাজ কিংবা সিদ্ধান্ত দু’ভাগ করে ফেলে দেশকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তামিম ইকবাল ধারাবাহিকতা নিয়ে এসেছেন, মুস্তাফিজ এনেছেন রহস্য-রোমাঞ্চ আর বিস্ময়, তবে সব ছাপিয়ে এদেশের ক্রিকেট-দর্শকের কাছে সাকিবই শেষ কথা।
তবে তাবৎ দুনিয়ার দর্শক আর বিশ্লেষকদের কাছে তিনি যেন অদৃশ্য হয়েই ছিলেন। পৃথিবীর প্রায় সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ চষে বেড়ালেও সাকিব আল হাসান আড়ালেই পড়ে ছিলেন। কারণ হয়তো বা আন্দ্রে রাসেলদের মতো মেরেকেটে ম্যাচের বাঁক বদলে দিতে পারেননি বলে, আইপিএলে যে কয় বল ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছেন, তার বেশিরভাগই তো মধ্য ওভারে। কারণ হিসেবে দাঁড় করানো যায়, রাশিদ খান কিংবা অজন্তা মেন্ডিসের মতো তার কোনো ম্যাজিক ডেলিভারি না থাকাকে। ক্ষণে ক্ষণে আর্ম বল ছাড়া চিরাচরিত বাঁহাতি স্পিনারদের সাথে তার পার্থক্যটা কী! নিউ জিল্যান্ডকে একা হাতে বাংলাওয়াশ, অস্ট্রেলিয়াকে ঘোল খাইয়ে টেস্ট পরাজয়ের স্বাদ দেয়া কিংবা তার আরও সব অর্জনকে যেন তারা দেখেও না দেখার ভান করেছেন স্পিন-সহায়ক পিচের দোহাই দিয়ে, বছরের পর বছর ধরে। ক্যারিয়ারের বড় একটা সময় কাটিয়েছেন ‘ছোট দলের বড় তারকা’ তকমা নিয়ে। কিন্তু, ‘সবচেয়ে বড়’ তকমা জোটাতে পারেননি শত কিছু করেও।
২.
কিন্তু সাকিবের মাহাত্ম্য কি ‘ছোট দলের বড় তারকা’ পরিচয়ের চেয়েও ঢের বিশাল নয়? পরিসংখ্যান বলে, ওয়ানডে ক্রিকেটকে তার চেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ করেননি আর কেউ। অভিষেকের পর থেকে ৫০-ওভারি ক্রিকেটে, ব্যাট কিংবা বল হাতে তিনি ম্যাচপ্রতি যুক্ত ছিলেন গড়ে ৮৬.৩ বল। ১৯৯৯ সাল হতে যদি বিবেচনা করা হয়, তিনি ছাড়া আর জ্যাক ক্যালিসই কেবল ম্যাচপ্রতি ৮০-য়ের বেশি বলে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন।
তার অভিষেকের পর হতে বাকি বিশ্বের মিডল অর্ডার (৩-৬) ব্যাটসম্যানরা রান করেছেন ৩৪.২৩ গড়ে, সাড়ে একাশি স্ট্রাইকরেটে। একই সময়ে সাকিব ব্যতীত বাংলাদেশের মধ্যভাগের বাকি ব্যাটসম্যানরা রান করেছেন আরও ধীরগতিতে, প্রতি ৭৫ রান করতেই তাদের খেলতে হয়েছে ১০০ বল, গড়ে রান করেছেন ৩১ করে। সাকিব ছাড়িয়েছেন সবাইকে, সবক্ষেত্রেই। সাড়ে ৩৭ গড় বজায় রেখেছেন ৮২.৬৮ স্ট্রাইক রেটে। ২০০৬ সালের ৬ আগস্টের (সাকিবের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু হয়েছিল সেদিনই) পর থেকে তার চেয়ে বেশি রান করেছেন মোটে ১২ জন।
তার ওপরে অবস্থান করছেন যে ১২ জন, তাদের মাঝে এক তিলকারত্নে দিলশানের হাতেই বহু কষ্টেসৃষ্টে বল তুলে দেয়া যায়। বাকিরা যে নিখাদ ব্যাটসম্যান! দিলশান তার ১৭ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারেই উইকেট পেয়েছেন ১০৬টি, বিপরীতে সাকিব এখন অব্দি উইকেট পেয়েছেন ২৫৯টি। সাকিব আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রাখার পর, দিলশানের সতীর্থ লাসিথ মালিঙ্গাই উইকেট দখল করেছেন তার চেয়ে বেশি। পরিসংখ্যানকে যদি আরও একটু সংকুচিত করা যায়, তালিকা থেকে পেসারদের ছেঁটে ফেলা হয়, তবে দেখা যাচ্ছে, বিগত ১৩ বছরে তার চেয়ে ভালো বোলিং গড় নেই আর কোনো স্পিনারের। বাকি বিশ্বের স্পিনারদের ৩৫.০২ গড়ের বিপরীতে সাকিব প্রতি উইকেটপ্রাপ্তিতে খরচ করেছেন ২৯.৯৫ রান।
৩.
এ তো গেল পরিসংখ্যানের কচকচানি। পরিসংখ্যানের একার সাধ্য কী, সাকিবের মাহাত্ম্য পুরোপুরি ধারণ করে!
পরিসংখ্যান তো আর তাকে বিরাট কোহলির মতো রানমেশিন প্রমাণ করে না, বল হাতে বানায় না মালিঙ্গা-স্টার্ক গোছের কেউ। পরিসংখ্যান তো এটাও প্রমাণ করতে পারে না, সাকিবের মতো করে দলের প্রাণভোমরা হতে পারেননি তাদের কেউ।
এক সাকিব খেলছেন বলে বাংলাদেশ খেলাতে পারছে একজন অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান কিংবা বোলার। সাত নম্বরে খেলাতে হচ্ছে না তর্জন-গর্জনসার কোনো ক্রিকেটারকে, পঞ্চম বোলারের কোটা পূরণের জন্যে তাদের ছুটতে হচ্ছে না কিছুটা ব্যাটিং আর কিছুটা বোলিং জানা অলরাউন্ডারের পিছে।
আজকালকার ক্রিকেটে পঞ্চম বোলারের গুরুত্ব বেশ। তিন-চারজন উইকেট-টেকিং বোলার নিয়ে দল সাজালেও পাটা পিচে পঞ্চম বোলার হতে পারেন ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণী চরিত্র। উইকেট হাতে রেখে বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তোলা শিখে গিয়েছে বিশ্ব ক্রিকেট, পঞ্চম বোলারকে তো ভালো হতেই হবে।
ব্যাপারটা আরও একটু খোলাসা করা যাক। এমন না যে পঞ্চম বোলার অতিরিক্ত রান খরচ করে প্রতিপক্ষকে রান-পাহাড়ে ওঠাবেন৷ এমনও হতে পারে, আপনার দলের ৩য় কিংবা ৪র্থ বোলারের আজ একটা বাজে দিন যাচ্ছে, কিন্তু তারা তুলনামূলক সহজ ওভারগুলো করার সুযোগ পাচ্ছেন না। আপনার দলের পঞ্চম বোলার তাদের চেয়েও নাজুক এবং আপনি যত দ্রুত সম্ভব তার ওভারগুলোই শেষ করতে চাইবেন।
আর আজকের ক্রিকেটে সহজ ওভার বলেই কিছু আছে নাকি! মধ্য ওভারে আইসিসির ‘পাঁচ ফিল্ডার বৃত্তের ভেতর রাখতেই হবে’ নিয়মের বেড়াজালে পঞ্চম বোলারকে লুকিয়ে রাখার সুযোগ কোথায়! ইংল্যান্ড কিংবা উইন্ডিজের মতো পাওয়ার-হিটারদের বিরুদ্ধে খেলতে নামলে তো, ‘যাহা বায়ান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন!’
সব দলই তাই পঞ্চম বোলারের কোটা পূরণে বেশ আঁটসাঁট পরিকল্পনা করেই নামছে। কোনো কোনো দল তো পঞ্চম বোলারকে সাহায্য করতে পারবেন ভেবে ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম বোলিং অপশনও রাখছে। উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে ইংল্যান্ডকে। পঞ্চম বোলার মঈন আলী সুবিধা করতে না পারলে বেন স্টোকস আছেন, উইকেটে স্পিন ধরলে জো রুট আছেন।
৫.
আর ঠিক এ কারণেই আধুনিক ক্রিকেটে অলরাউন্ডারদের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। সব দলই চায় অলরাউন্ডারদের লুফে নিতে। উইন্ডিজের বিপক্ষে ইংল্যান্ড যে একাদশ নিয়ে নেমেছিল, তার মাঝে অলরাউন্ডার বললে আপত্তি আসতে পারতো কেবল তিনজনের নামে- জেসন রয়, ইয়োন মরগান আর মার্ক উড। দলের প্রয়োজনে বাকিদের যে কেউ সেদিন অবদান রাখতে পারতেন দুই ভূমিকাতেই। ক্রিস ওকস তাই সেদিন হয়ে গিয়েছিলেন ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান, আদিল রশিদেরও লিস্ট-এ ক্রিকেটে আছে সেঞ্চুরি।
বিশ্বে এমন ব্যাটিং-বোলিং জানা ক্রিকেটার তো কম আসেননি। তবে প্রশ্নটা হচ্ছে, ব্যাটিং কিংবা বোলিং দুই ভূমিকাতেই দলে জায়গা করে নেয়ার সামর্থ্য আছে, এমন ক্রিকেটার ধরায় এসেছেন কি? উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে শত বছর। অব্রে ফকনার তখনই ক্রিকেট খেলতেন। ব্যাট হাতে ৪০-য়ের বেশি গড় আর বোলিংয়ে ৩০-য়ের কম গড় নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করা একমাত্র অলরাউন্ডার ছিলেন তিনিই।
৫.
ব্যাট হাতে গড় চল্লিশ পেরোলে আর বোলিং গড় ত্রিশের নিচে থাকলেই যে তাকে অলরাউন্ডার বলা লাগবে, এমন দিব্যি তো কেউ দেয়নি। আসলে অলরাউন্ডারদের সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞাটাই যে আজ অব্দি দেয়া যায়নি।
অলরাউন্ডারের দ্বিমাত্রিক সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, যার ব্যাটিং গড় বোলিং গড়ের চেয়ে বেশি, তিনিই অলরাউন্ডার। এই হিসেব মতে, কে কত ভালো অলরাউন্ডার তা বোঝা যাবে ব্যাটিং গড় আর বোলিং গড়ের মধ্যকার ব্যবধান দেখে। স্ট্রাইকরেট কিংবা ইকোনমি রেটকে বিবেচনায় না আনা এই পরিমাপকের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, জ্যাক ক্যালিসের চেয়ে ভালো অলরাউন্ডার আর একজনও নেই। তার ১২.৫৬ পার্থক্যকে ছাড়াতে পারেননি কেউ।
আরও জানা যাচ্ছে, এমন মানদণ্ডে হিসেব করলে জ্যাক ক্যালিসের পরের নামটি আসে ড্যারেন লেহম্যানের। একদিবসী ক্রিকেটে যিনি ১৮০০ বলও করেননি। এমনকি স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকেও আপনি অলরাউন্ডার বলতে বাধ্য।
অলরাউন্ডারের আরও এক সংজ্ঞা আছে। ব্যাটে বা বলে, আলাদাভাবে যেকোনো ভূমিকাতেই দলে যিনি অপরিহার্য, প্রকৃত অলরাউন্ডার বলা যাবে তাকেই। অর্থাৎ, একজন ক্রিকেটার যদি ইনজুরির কারণে কিংবা অন্য কোনো সমস্যায় বোলিং করতে না-ও পারেন, কিন্তু কেবল ব্যাটিং দিয়েই দলে তার জায়গা নিশ্চিত (এর উল্টোটাও হতে পারে), তবেই এমন ক্রিকেটারকেই সত্যিকারের অলরাউন্ডার বলা যাবে। এবার বিশ্বকাপে খেলছেন, এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে এক মোহাম্মদ নবী আর সাকিব আল হাসানই যে সীমারেখায় পৌঁছাতে পারেন।
আপনার মনের দরজায় আরও অনেকের নামই টোকা দিয়ে যেতে পারে। আসতে পারেন মোহাম্মদ হাফিজ, পাকিস্তানি সমর্থকেরা যতই তার ওপরে রুষ্ট হোন। ব্যাটে কিংবা বল হাতে, প্রতি ম্যাচে অন্তত ৬১ ডেলিভারিতে জড়িত থাকেন তিনি, পাকিস্তান দলে তার গুরুত্ব এই ছোট্ট পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। তবে যেকোনো এক নির্দিষ্ট ভূমিকাতে দলে তার ভূমিকা এমনই থাকত কি না, কিংবা দলে তিনি অটোচয়েজ হতেন কি না, তা সন্দেহ জাগায়৷ তার চেয়ে বরং দু’য়ে মিলে যেই প্যাকেজ গড়ে উঠেছে, পাকিস্তান সেই মোহাম্মদ হাফিজেরই খোঁজ করে।
বর্তমান বিশ্বে অবশ্য এমন প্যাকেজ অলরাউন্ডারের অভাব নেই৷ ভারতে হার্দিক পান্ডিয়া আছেন, ইংল্যান্ডে আছেন বেন স্টোকস। আপনি চাইলে আন্দ্রে রাসেল, জেসন হোল্ডার কিংবা মঈন আলীকেও ফেলতে পারেন এই কাতারে।
আবার আরেক ঘরানার অলরাউন্ডারদের দেখা যায়, কোন এক বিভাগে যাদের বিশেষজ্ঞই বলা চলে। বিপরীতে অন্য বিভাগে যাদের পারফরম্যান্স গড়পড়তা কিংবা এরও খানিকটা নিচে। মিচেল স্যান্টনার, ইমাদ ওয়াসিম, আন্দিলে ফেহলুকায়ো, জিমি নিশামদের এই শ্রেণিতেই ফেলা চলে।
ডন ব্র্যাডম্যানকেও যখন অলরাউন্ডার বলা গিয়েছে, তখন মোসাদ্দেক হোসেন, কেদার যাদব, মাহমুদউল্লাহ, অ্যারন ফিঞ্চরাও তো অলরাউন্ডারই। অনেকটা ব্যাটিং আর কিছুটা বোলিং জানা এই ক্রিকেটারদেরও তো অলরাউন্ডারই ডাকতে হয়। আজকালকার ক্রিকেটে তাদের ‘খণ্ডকালীন বোলার’ বলে ডাকা হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার ডেরেক ক্রুকসের চেয়ে তাদের প্রোফাইল বেশি ভারি। ব্যাট হাতে ১৪ আর বোলিংয়ে চল্লিশের মতো গড় নিয়ে ক্রিকেট খেলেন না তাদের কেউই।
তৎকালীন ক্রিকেটে এ ধরনের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স যথেষ্ট হলেও আজকের ক্রিকেটে তা কিছুই নয়। নব্বইয়ের দশকে কোনো নজরকাড়া স্কিল না থাকা সত্ত্বেও রনি ইরানি, গ্যাভিন হ্যামিল্টনরা কেবল অলরাউন্ডার পরিচয়ে খেলে ফেলেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। অথচ আজ ইংল্যান্ড দলে জায়গা পেতে ১১ নম্বরে নামা আদিল রশিদেরও লিস্ট-এ-ক্রিকেটে থাকা লাগছে সেঞ্চুরি। ক্রিকেটে অলরাউন্ডাররা এতটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠতে পারেননি এর আগে কোনোকালে!
৬.
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের এ যুগে রহস্য স্পিনার থেকে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হয়ে যাচ্ছেন সুনিল নারাইন, লেগ স্পিনার পরিচয়ে ক্রিকেট শুরু করা কলিন ইনগ্রাম উইকেটকিপার হয়ে যাচ্ছেন কখনো, পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মারকুটে ব্যাটসম্যান পরিচয়ে। ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাটসম্যান জো রুট অনুশীলনে সময় খরচ করছেন দুসরা, ক্যারম বল শিখতে। জো ডেনলির মতো নিখাদ ব্যাটসম্যানকেও ঝালাই করে নিতে হচ্ছে নিজের ফ্লাইটেড লেগ স্পিনটা।
ক্রিকেটীয় কারণের পাশাপাশি এর পেছনে লুকিয়ে আছে বাণিজ্যিক স্বার্থও। দুটো বিভাগেই কর্তৃত্ব অর্জন করা মানে তো নিজের আরও বেশি চাহিদা বাড়ানো, টি-২০ ক্রিকেটে ২৪ বলের মূল্যই অনেক। বিশ্বজুড়েই এমন অলরাউন্ডারদের বাড়বাড়ন্ত তাই স্পষ্ট৷
যতদিন না ম্যাচে একজন বোলারের সর্বোচ্চ বোলিং কোটা ২০% থেকে ২৫%য়ে উন্নীত করা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে অলরাউন্ডারদের চাহিদার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হতেই থাকবে।
৮.
সবকিছু বিবেচনায় নিয়েও যদি প্রশ্ন তোলা হয়, ক্রিকেটে সত্যিকার অর্থেই কি অলরাউন্ডারদের আধিক্য বেড়েছে?
অলরাউন্ডারদের কোনো ধরাবাঁধা সংজ্ঞা নেই, সুযোগে জ্যারড কিম্বার আর ইএসপিএন ক্রিকইনফোর পরিসংখ্যান বিশ্লেষক শিভা জয়ারমন মিলে অলরাউন্ডারদের জন্যে নতুন এক মানদণ্ড ঠিক করেছেন। তাদের মতে, যে খেলোয়াড় প্রতি ম্যাচে গড়ে অন্তত তিন ওভার বোলিং, সাথে সমান সংখ্যক বল ব্যাটিং করেছেন, তাদের আমরা অলরাউন্ডার বলতেই পারি।
এই নির্ণায়কে জানা যাচ্ছে, একদিবসী ক্রিকেটের ইতিহাসে, কমপক্ষে ২০ ম্যাচ খেলেছেন, এমন ১,০৩৩ জন ক্রিকেটারের ভেতর অলরাউন্ডার বলা যাবে ৩৮ শতাংশ ক্রিকেটারকে, সংখ্যায় ৩১৩ জনকে।
২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে একই মানদণ্ড পূরণ করেছেন এমন ক্রিকেটারের সংখ্যা ১৯৪ জনে ৭৩ জন, শতকরা সেই একই ৩৮ ভাগ ক্রিকেটারকে! পরিসংখ্যান দেখে অন্তত এতটুকু ধারণা তো করাই যায়, অলরাউন্ডারদের চাহিদা বাড়লেও ব্যাটে-বলে প্রতি ম্যাচে ৩৬ বল ভূমিকা রাখছেন, এমন ক্রিকেটার দুই যুগ আগে যেমন ছিল, আজকেও তেমনই আছে।
সাকিব আল হাসানের মূল্যটা তাই এখানেই বেড়ে যাচ্ছে, ম্যাচপ্রতি ৮৬.৩ বল তিনি সরাসরি যুক্ত থাকছেন, ব্যাট কিংবা বল হাতে।
আর এমন সাকিবকে দেখে সব দলই একজন সাকিব আল হাসান চাইছে, দুর্ভাগ্যবশত তাদের চাওয়া একজন জীবন মেন্ডিসকে পেয়ে শেষ হচ্ছে। ক্রিকেট বিশ্বও তাই আরেকজন সাকিবের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে!
সাকিবই সেরা কি না, সে সন্দেহ যদি এখনও থেকে থাকে, একজন সাকিব আল হাসান মাঠের পারফরম্যান্সেই সেটাকে বিস্ময়ে অনূদিত করতে পারেন। আপাতত বরং উপভোগ করা যাক তার খেলা, এমন সৌভাগ্য যে সব কালে সবার হয় না!