ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, নাকি লুইস সুয়ারেজ?

ফার্নান্দো সান্তোস নাকি অস্কার তাবারেজ? রোনালদো, কারেসমার পর্তুগাল নাকি সুয়ারেজ, কাভানির উরুগুয়ে? রাশিয়া বিশ্বকাপের অন্যতম দুই ডার্ক হর্স মুখোমুখি হচ্ছে রাউন্ড অফ সিক্সটিনেই। শেষ ষোলতেই তাই ঝরে পড়বে যেকোনো একদল। রাশিয়া বিশ্বকাপের নক আউট স্টেজের প্রথম দিনের দ্বিতীয় ম্যাচেই ফুটবলপ্রেমীরা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে এক আগুন গরম ম্যাচ। চলুন ম্যাচের আগে দেখে আসা যাক দুই মহাদেশীয় জায়ান্টের ট্যাকটিকস, সম্ভাব্য ফর্মেশন ও অন্যান্য।

মুখোমুখি পরিসংখ্যান

বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, ১৯৭২ সালের পর থেকে এই দুই দল কেউ কারো মুখোমুখি হয়নি। আর আজকে এই দুই দল সবেমাত্র তৃতীয়বারের মতো একে অপরের মুখোমুখি হবে। সর্বশেষ ১৯৭২ সালে রিও ডি জেনেইরোর মারাকানায় পর্তুগাল ও উরুগুয়ে একে অন্যের মোকাবিলা করে। সেই ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র হয়। আর অন্য একটি ম্যাচে জেতে পর্তুগাল। মুখোমুখি হওয়া দুই ম্যাচে তাই পর্তুগালের কোনো হার নেই।

উরুগুয়ের গ্রুপ পারফরম্যান্স

রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে পূর্ণ ৯ পয়েন্ট পাওয়া তিন দলের একটি হলো উরুগুয়ে। প্রথম ম্যাচে ম্যাড়ম্যাড়ে খেলা উপহার দিলেও ডিফেন্ডার জোসে গিমেনেজের হেডের কল্যাণে মিশরের বিপক্ষে মূল্যবান তিনটি পয়েন্ট আদায় করেই বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করে এই ল্যাটিন পরাশক্তি। দ্বিতীয় ম্যাচে সুয়ারেজের গোলে সৌদি আরবকে ১-০ গোলের ন্যূনতম ব্যবধানে হারায় অস্কার তাবারেজের দল। সেই ম্যাচেও উরুগুয়ে তাদের নিজস্ব খেলা খেলতে ব্যর্থ হয়। তবে তাদের চমকের দেখা মিলে শেষ ম্যাচে। যে স্বাগতিক রাশিয়া সৌদি আরব ৫ ও মিশরের বিপক্ষে ৩ গোল করেছিল, তাদের উপরই ছড়ি ঘুরিয়ে ২-০ গোলের জয় তুলে নেয় উরুগুয়ে। গোল করেন দলের দুই প্রাণভোমরা সুয়ারেজ ও কাভানি।

উরুগুয়ে দল; Image Source: Getty Image

তবে গ্রুপপর্বে নজর কেড়েছে উরুগুয়ের রক্ষণ। বিশ্বকাপের একমাত্র দল হিসেবে এখনো কোনো গোল হজম করেনি উরুগুয়ে। রক্ষণে নেতা হয়ে ছিলেন দিয়েগো গডিন। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন গিমেনেজ, ক্যাসেরাসরা। সেই সুবাদে তিন ম্যাচ জিতে পূর্ণ ৯ পয়েন্ট নিয়েই ‘এ গ্রুপ’ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে জায়গা করে নেয় উরুগুয়ে।

পর্তুগালের গ্রুপ পারফরম্যান্স

অন্যদিকে পর্তুগাল তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয় স্পেনের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ এক ম্যাচের মাধ্যমে। দলের তারকা অধিনায়ক ক্রিস্টিয়ানোর অনবদ্য হ্যাটট্রিকের সুবাদে ৩-৩ গোলে স্পেনের সাথে ড্র করে এক পয়েন্ট আদায় করে নেয় তারা। দ্বিতীয় ম্যাচে ধাক্কা খায় পর্তুগিজরা। মরক্কোর সাথে নিজেদের সেরটা খেলতে পারেনি তারা। বরং পুরো ম্যাচে মরক্কোই ছড়ি ঘুরিয়েছে পর্তুগিজদের উপর। তবে এই ম্যাচেও ত্রাতা হিসেবে পর্তুগালকে রক্ষা করেন ক্রিস্টিয়ানো। ম্যাচের ৬ মিনিটের মাথায় তার হেড থেকে পাওয়া গোলে তিন পয়েন্ট নিয়েই মাঠ ছাড়ে ফার্নান্দো সান্তোসের দল। শেষ ম্যাচেও পর্তুগাল ইরানের সাথে প্রাধান্য বিস্তার করে খেলতে পারেনি। রিকার্ডো কারেসমার গোলে ১-১ গোলে ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে তারা। স্পেনের সাথে পয়েন্ট সহ গোল ব্যাবধান সমান হওয়ায় বেশি গোল করায় স্পেন গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়। আর গ্রুপ রানার্স আপ হয়ে পর্তুগাল আসে দ্বিতীয় রাউন্ডে।

পর্তুগাল দল; Image Source: Getty Image

উরুগুয়ের ফর্মেশন ও ট্যাকটিকস

অস্কার তাবারেজ সাধারণত উরুগুয়েকে খেলান ৪-৪-২ ফর্মেশনে। তবে খেলার সময় ফ্লুইড ফর্মেশনে তা অনেকটা ৪-৩-১-২ এ রুপান্তরিত হয়। তবে লো স্কোরিং ম্যাচের আশঙ্কায় হয়তো পর্তুগালের সাথে দলে দেখা যাবে গুইলার্মো ভারেলা, মার্টিন ক্যাসেরাস আর ক্রিশ্চিয়ান রদ্রিগুয়েজের। স্পেনের সাথে একমাত্র দল হিসেবে একটিমাত্র হলুদ কার্ড দেখেছে উরুগুয়ে। হলুদ কার্ড দেখা সত্ত্বেও দলে দেখা যাবে জুভেন্টাস মিডফিল্ডার রদ্রিগো বেন্তাকুরকে।

গোলের পর কাভানি ও গডিনের উল্লাস; Image Source: Goal.com

সে হিসেবে উরুগুয়ের দলে মুসলেরার সামনে দুই সেন্টারব্যাক হিসেবে থাকবেন অধিনায়ক দিয়েগো গডিন আর ভারেলা। দুই ফুলব্যাকে তাবারেজ ভরসা করবেন ক্যাসেরেস আর গিমেনেজের উপর। মিডফিল্ডে রাশিয়ার সাথে খেলা নান্দেজকে হয়তো পর্তুগালের সাথেও আবার দেখা যেতে পারে। রক্ষণে জমাট আনার জন্য নান্দেজই খেলার সম্ভাবনা বেশি। সাথে ম্যাতিয়াস ভেসিনো আর রদ্রিগুয়েজকে দেখা যাবে। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে রদ্রিগো বেন্তাকুরের কাজ হবে সামনে থাকা সুয়ারেজ আর কাভানিকে বল যোগান দেওয়া। তবে তাবারেজের দলে সুয়ারেজের ভূমিকা অনেক বেশি। নিচে নেমে এসে মোটামুটি ফলস নাইনের ভূমিকায় থাকবেন বার্সেলোনার এই স্ট্রাইকার। শেষ ম্যাচে গোল পাওয়ায় অনেকটা ফুরফুরে মেজাজেই মাঠে নামবেন দলের দুই প্রাণ ভোমরা সুয়ারেজ ও কাভানি।

সম্ভাব্য একাদশ

মুসলেরা, গডিন – ভারেলা – ক্যাসেরেস – গিমেনেজ, নান্দেজ – ভেসিনো – রদ্রিগুয়েজ – বেন্তাকুর, সুয়ারেজ – কাভানি

পর্তুগালের সম্ভাব্য ফর্মেশন ও ট্যাকটিকস

ফার্নান্দো সান্তোসের পছন্দের ফর্মেশন ৪-৪-২ এই দেখা যাবে রোনালদো বাহিনীকে। তিন ম্যাচেই মিডফিল্ডে কিছু অদল বদল করেছেন সান্তোস। তবে পর্তুগালের জন্য খুশির খবর হলো জোয়াও মৌতিনহোর দলে ফেরা। ইনজুরির জন্য দ্বিতীয় ম্যাচ মিস করা মৌতিনহো সাব হিসেবে খেলেছেন ইরানের সাথে। ইরানের সাথে গঞ্জালো গুইদেসের জায়গায় খেলতে নামা আন্দ্রে সিলভার খেলা সন্তুোষজনক ছিল না। সেক্ষেত্রে নিজের জায়গা ফিরে পেতে পারেন গুইদেস। শেষ ম্যাচে গোল পাওয়ায় রিকার্ডো কারেসমার দলে থাকার সম্ভাবনাও প্রবল।

উরুগুয়ের বিপক্ষে শক্ত পরীক্ষা দিতে হবে পর্তুগালের ডিফেন্সকে; Image Source: The Telegraph

তবে রোনালদোসহ ছয়জন খেলোয়াড়ের হলুদ কার্ড থাকায় কিছুটা সতর্ক হয়েই খেলতে হবে পর্তুগালকে। তিনটি ম্যাচেই একই ডিফেন্স খেলিয়েছেন সান্তোস। সেই হিসেবে প্যাট্রিসিওর সামনে দুই সেন্টার ব্যাক হিসেবে থাকবেন দুই অভিজ্ঞ সেনানি জোসে ফন্ট ও পেপে। দুই ফুলব্যাকে থাকবেন সেড্রিক আর গুরেরো। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে অটো চয়েজে দলে জায়গা পাবেন উইলিয়াম কারভালহো। বাকি তিনজন হবেন মৌতিনহো, মারিও আর কারেসমা। সামনে রোনালদোকে সঙ্গ দেবেন গুইদেস।

পর্তুগালের ভরসা রোনালদো; Image Source: The Sun

সম্ভাব্য একাদশ

প্যাট্রিসিও, পেপে – ফন্ট – গুরেরো – সেড্রিক, কারভালহো – মারিও – মৌতিনহো – কারেসমা, রোনালদো – গুইদেস

উরুগুয়ের মূল শক্তি হলো রক্ষণ। এর পাশাপাশি ম্যাচ বাই ম্যাচ ফরোয়ার্ডরাও নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন। উরুগুয়েও শেষ ম্যাচে খেলেছে দুর্দান্ত। ঠিক উল্টো চিত্র পর্তুগাল শিবিরে। প্রথম ম্যাচে স্পেনের সাথে পাল্লা দিয়ে খেললেও পরের দুই ম্যাচে নিষ্প্রভ ছিলো আক্রমণভাগ। এক রোনালদো ছাড়া কেউ তেমন কিছু করতে পারেননি। তবে রোনালদো নিজের সেরাটা এ দিনের জন্য জমিয়ে রাখলে সর্বনাশ হতে পারে উরুগুয়ের। সেক্ষেত্রে টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত সেরা ডিফেন্ডার দিয়েগো গডিনের উপর ভরসা করতে পারেন অস্কার তাবারেজ। ম্যাচের মধ্যে গডিন রোনালদোকে কতটুকু বোতল বন্দি করে রাখতে পারে তার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। একইভাবে অন্যদিকে পেপে-ফন্টদের সামলাতে হবে সুয়ারেজ, কাভানির মতো গোলস্কোরারদের। তাই লড়াইটাও হবে সমানে সমানে

চোখ থাকবে এই তিন তারকার উপর; Image Source: Pinterest

ম্যাচ ট্রিভিয়া

  • পেনাল্টি শুট আউট বাদ দিয়ে পর্তুগাল তাদের সর্বশেষ ১৬টি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে অপরাজিত (৮ জয়, ৮ ড্র )। ২০১৪ সালে জার্মানির বিপক্ষে ৪-০ তাদের সর্বশেষ হার।

  • এই বিশ্বকাপে উরুগুয়ের করা ৫টি গোলই এসেছে সেট পিস থেকে। কর্নার থেকে তিনটি, সরাসরি ফ্রি কিকে একটি। অন্যটিও ফ্রি কিকে মাথা ছুঁইয়ে।

  • বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে পর্তুগালের হয়ে এখনো কোনো গোল পাননি রোনালদো। ৪২৪ মিনিট খেলে তার গোলসংখ্যা শূন্য।

  • ১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপের পর উরুগুয়ে কখনোই বিশ্বকাপে টানা চার ম্যাচ জিততে পারেনি।

আজ সোচিতে শুরু হতে যাওয়া ম্যাচে রোনালদোর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে এই মাঠেই স্পেনের সাথে সেই অনবদ্য হ্যাটট্রিক। রোনালদো কি পারবেন আরেকবার পর্তুগিজদের উৎসবে ভাসাতে? নাকি সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে ক্লাব প্রতিদ্বন্দ্বী লুইস সুয়ারেজ? উত্তরটা জানা যাবে আর কয়েক ঘন্টা পরই।

This Bangla article is about the match preview between Portugal and Uruguay in world cup. Necessary sources are hyperlinked in the article.

Feature Image: Fifa wallpaper

Related Articles

Exit mobile version