ইতালির রূপান্তরের গল্প

বুফনের চোখে আজ অশ্রু। তার বিশাল এই ক্যারিয়ারে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন তিনি আগে কখনও হননি। ক্লাব ও দেশের হয়ে মোটামুটি সব শিরোপাই জিতেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ ছুঁয়ে দেখতে না পারার আক্ষেপ অবশ্য রয়েছে, কিন্তু নতমুখে ক্রন্দনরত বুফনের দেখা যে আগে কখনও মেলেনি।

ইতালি পায়নি ‘১৮ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলতে পারার টিকেট। অবশ্য শেষ একটা সুযোগ তাদের ছিল। ইতালির সাথে প্লে-অফ ম্যাচে সুইডেনকে হারাতে পারলেই মিলবে রাশিয়া যাওয়ার সুযোগ। কিন্তু জিয়ান পিয়েরো ভেনতুরার শিষ্যরা ব্যর্থ হলো। প্রথম ম্যাচে ১-০ গোলে পরাজয় এবং দ্বিতীয় ম্যাচে ০-০ গোলে ড্র’র ফলে রাশিয়া যাবার প্লেনে উঠল সুইডেন। ৬০ বছর পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে না খেলে ইতালিকে ঘরে ফিরতে হলো শূন্য হাতে।

বুফন কাঁদছেন;  Image Source: Getty Images

বুফন কাঁদছেন, হতাশ চোখে তাকিয়ে আছেন বারজাই, কিয়েলিনি ও বোনুচ্চি। চার বছর পর এই বুফন ও বারজাই ঘরে বসে করেছেন উল্লাস। আর ইউরো জয়ের ট্রফিটা বুকে চেপে আনন্দের মিছিলে সামিল হয়েছেন কিয়েলিনি ও বোনুচ্চি। চার বছরে এমন অভূতপূর্ব পরিবর্তন কীভাবে? যে দল খাদের তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল, এত অল্প সময়ে তাদের টেনে ওঠাল কোন বুনো শক্তি?

গল্পটা শুনতে ইচ্ছা করছে, তাই তো? তবে সে গল্প শুরু করতে হলে পেছনের কাহিনীর সারাংশ জানা প্রয়োজন। তাই ফিরে যেতে হবে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে, যে ম্যাচে জিদান মাতেরাজ্জিকে তার কুখ্যাত ঢুঁস মেরেছিলেন।

গোলবারে বুফন, রক্ষণে মাতেরাজ্জি, ক্যানাভারো আর নেস্তা। মধ্যমাঠে আছেন টট্টি, গাত্তুসো আর পিরলো। স্ট্রাইকার লুকা টনি। আজ্জুরিদের বেঞ্চও আপনার চোখ কপালে তুলে দেবে; নেস্তা, দেল পিয়েরো, ইনজাগি, বারজাই, ডি রসিদের নিয়ে এই দল পুরো বিশ্ব শাসন করার মতো। ইতালির হাতে সেবার যখন বিশ্বকাপ ট্রফি উঠল, ফুটবলবোদ্ধারা ধরেই নিয়েছিল, আগামী অর্ধযুগ এই দেশের শক্তিমত্তার কাছে ভিড়তে পারবে না অন্য কেউ।

কিন্তু সময়ের চাকা ঘুরতেই পাশার ডান উলটে গেল। ২০০৮ সালে ইউরোতে ইতালির দলগত খেলা ভিন্ন এক বার্তা এনে দিল। দলে বিশ্বকাপ জেতা অনেকেই নেই, তাও বেশ কয়েকজন নামকরা খেলোয়াড় থাকলেও। মার্সেলো লিপ্পির বানানো দলের মতো নেই, কোথাও সুর কেটে যাচ্ছে।

২০১০ বিশ্বকাপে ধরা পড়ল আসল সমস্যা। চার বছর পার হয়ে গেছে, বিশ্বকাপ জেতা তারকাদের বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের স্থানে নতুন খেলোয়াড়দের আনা যাচ্ছে না। কারণ ইতালি নতুন খেলোয়াড় তৈরি করতে ব্যর্থ। সেবারের আসরে ব্যাটে-বলে হলো না। পিরলো-গাত্তুসোরা আবার দলে ফিরেছিলেন, ছিলেন জামব্রোত্তা ও কিয়েলিনিরা, কিন্তু স্পেনের ঈর্ষা জাগানো ফুটবলের সামনে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারল না তারা।

নাহ, হলো না; Image Source: Getty Images

এরপর? সবকিছুর সমাপ্তি। জৌলুস হারিয়ে গেল একেবারে। ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে তারা ফিরল লজ্জা ও অপমান নিয়ে। কন্তে হাল ধরার পর কিছুটা ফেরার আভাস দিলেও শেষে গিয়ে কিছুই হলো না। কারণ ততদিনে আজ্জুরি তাদের সব তারকা হারিয়েছে, একটি স্বর্ণালী যুগের অবসান ঘটেছে, প্রয়োজন পরিবর্তনের। কিন্তু পরিবর্তনের দেখা নেই। ভেনতুরা এলেন, মাঠে মিডফিন্ডারদের সাথে আক্রমণের যোগসূত্র করতে পারলেন না, যদিও সে কাজ করার মতো খেলোয়াড়ও নেই তখন। রক্ষণে কিয়েলিনি, বারজাই আর বোনুচ্চি ছিলেন বলে রক্ষা। উপরন্তু, ৩-৫-২ ছকে খেলার কারণে ইতালির কপালে সেঁটে গেল রক্ষণাত্মক খেলার তকমা।

কন্তে বা ভেনতুরাদের আমলে ইতালিতে সে রকম খেলোয়াড় পর্যাপ্ত ছিল না, যেমনটা দেখে অভ্যস্ত ইতালির সমর্থকেরা। মধ্যমাঠে পিরলো ও গাত্তুসো, আক্রমণে টট্টি বা লুকা টনি, রক্ষণে নেস্তা, ক্যানাভারো বা জামব্রোত্তা – প্রত্যেকের শূন্যস্থান সেভাবেই ছিল। এটা সত্য যে, দ্বিতীয় পিরলো বা টট্টিদের পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তাদের উত্তরসূরী বের করার প্রয়োজন ছিল, যেটা ইতালি কখনোই পারেনি। ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত যারা এসেছিলেন, যেমন থিয়াগো মোত্তা, মার্কো পারোলো, আন্তোনিও কান্দ্রেভা বা সিমোনে জাজা কখনোই নিজের দেশের হয়ে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি।

২০১৮ সালে ইতালির কোচের চেয়ারে বসেন মানচিনি। পুরো ক্যারিয়ারে মিলান, লাৎসিও, ম্যানসিটি, ফ্লোরেন্তিনা, জেনিত ও গ্যালতাসারাইয়ের মতো দলকে কোচিং করিয়েছেন তিনি। তবে তার নাম প্রশংসার সুরে উচ্চারণ করা হয় সিটির ইতিহাসকে আমূল বদলে দেবার জন্য। ব্যক্তিগত জীবনে মানচিনি বেশ কুসংস্কারাচ্ছন্ন। একবার কিছু একটা করে সাফল্যের দেখা পেলে পরবর্তীতে ঐ কাজ পুনরায় করে সফলতার দেখা পাওয়া যাবে, এমন ধারণায়ই বিশ্বাসী মানুষ তিনি। যদিও ফুটবলে এমনটা নতুন কিছু নয়।

মানচিনি অবশেষে পারলেন; Image Credit: Reuters

মানচিনিকে কি ভেবে ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশন কোচ করে এনেছিলেন, সেটা জানবার উপায় এখন নেই। তবে এই দলের কোচের আসন তাকে জীবনযুদ্ধে নামিয়ে দেয়। তিনি জানতেন, এই দলকে নিয়ে যদি তিনি টিকে থাকেন, তবে প্রথম অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে ২০২০ সালের ইউরোর মঞ্চে। আর এই ইউরোতে তিনি খুঁজে পান তার ফুটবল খেলোয়াড়ি জীবনের এক আক্ষেপের অতীত।

নিজের দেশের হয়ে তার এক আক্ষেপ তার ছিল, কিছু জিততে না পারার আক্ষেপ। সাম্পদোরিয়াতে ক্যারিয়ারের যখন সোনালী সময় কাটছে তার, সে সময়েই বসেছিল ‘৮৮ ইউরোর আসর। ইতালির কোচ তখন ভিসিনি, যিনি একসময় আজ্জুরিদের বয়সভিত্তিক দলের কোচ ছিলেন। মানচিনির অভিষেকও তার হাত ধরে। সে আসরে মানচিনিকে দলে ডাকলেন ভিসিনি, নামিয়ে দিলেন প্রথম ম্যাচে, মানচিনি গোলও পেলেন। কিন্তু অজানা কোনো কারণে, আসরে বাকি সব ম্যাচে দর্শক হয়ে থাকতে হলো তার। বছরদুয়েক পর ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ; এবারও কোচের চেয়ারে ভিসিনি। মানচিনিকে ডাকলেন, কিন্তু ম্যাচের পর ম্যাচ যায়, মাঠে আর নামা হলো না। ইতালি বিদায় নিল সেমিফাইনাল থেকে। আর মানচিনি এক মিনিট না খেলে বিশ্বকাপ শেষ করলেন।

ইতালির দায়িত্ব পেয়ে হয়তো তার স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠেছিল এই আক্ষেপের কাব্য। তখনই হয়তো শপথ করেছিলেন খেলোয়াড় হিসেবে হয়নি, এবার কোচ হয়ে নতুন এক স্বপ্নজয়ের গল্প রচনা করা যাক।

মানচিনির ভাগ্য ভালো ছিল। ২০১৮ সালের শুরু থেকেই ইতালির আনাচে-কানাচে বেড়ে উঠেছিল আনকোরা অনেক প্রতিভাবান মুখ। মানচিনি শুরু করলেন তার দল তৈরির বাছাইপর্ব। ৪-৩-৩ বা ৪-২-৩-১ ছকে তার দলকে তিনি খেলাতে পছন্দ করেন, এছাড়াও স্কোয়াড-ডেপথকে মনে করেন অন্যতম বড় শক্তি। তাই ইউরোকে সামনে রেখে অসংখ্য খেলোয়াড়কে দলে ডেকে যাচাই-বাছাই করা শুরু করলেন তিনি।

পুরো ইউরোতে এই কৌশলই ব্যবহার করেছেন মানচিনি; Image Source: themastermindsite

মানচিনির ইতালির ডাগআউটে প্রথম দাঁড়ান ২০১৮ সালের সৌদি আরবের সাথে এক প্রীতি ম্যাচে। ৪-৩-৩ ছকে খেলা সে দলের একাদশ আর আজকের ইতালির একাদশের আকাশ-পাতাল তফাৎ। রক্ষণে কিয়েলিনিকে কিন্তু তিনি প্রথম থেকেই পাননি, কিন্তু তিনি মাথায় রেখেছিলেন, আর যা-ই হোক, কিয়েলিনি-বোনুচ্চি জুটিকে ভাঙা যাবে না। তাই কিয়েলিনি যখন ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে মাঠের বাইরে, মানচিনি ডেকেছেন গোটাচারেক ডিফেন্ডারকে; যাদের ভেতর থেকে ইউরোর মঞ্চে দলে থাকলেন আচেরবি আর বাস্তোনি।

ভেনতুরির সময়ে ইতালির প্রধান সমস্যা ছিল আক্রমণভাগ। গোল যেন তাদের জন্য অমাবস্যার চাঁদ; অথচ রক্ষণভাগ কিন্তু ঠিকই আছে। এজন্য মানচিনি এসে এদিকে পরিবর্তন আনলেন। যদিও তিনি তার দর্শন থেকে সরে যাননি। হাইলাইন ডিফেন্ডিং কৌশলের সাথে ইতালিকে মানিয়ে নিতে বাধ্য করেছেন, যেখানে তাদের পদ্ধতি ছিল নিচে থেকে রক্ষণের ব্যাটন ধরে রাখা। যথারীতি তার একাদশে উইঙ্গাররা সুযোগ পেল। যাদের গতি আছে, দ্রুততার সাথে আক্রমণে যেতে পারেন, আবার ভিশন ভালো বলে খেলা গড়ে দেবার সক্ষমতাও আছে। কিন্তু খেলবে কে? আক্রমণে যুক্ত হলো ইনসিনিয়ে, যিনি জামপাওলোর দলে ছিলেন উপেক্ষিত। স্ট্রাইকার হিসেবে বেলোত্তিকেই ব্যবহার করলেন। কিন্তু সমস্যা তৈরি হলো রাইট উইং পজিশন নিয়ে।

ইনসিনিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন; Image Source: Twitter

 

মানচিনি ২০১৯ সালের বেশ কিছু ম্যাচে ৪-২-৩-১ কৌশল ব্যবহার করেছেন, যেখানে ছিলেন না কোন প্রথাগত নাম্বার টেন। ডাবল পিভটের উপরে একজন নাম্বার এইটকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে চেয়েছেন, যেখানে এই পজিশনের প্রথম পছন্দ ছিলেন ইন্টারের তরুণতুর্কি বারেল্লা। কিন্তু আক্রমণের ডানপাশে নানা সময়ে নানান খেলোয়াড় এসেছে। মইস কিন থেকে বার্নাদেস্কি, নিকোলা জানিওলো থেকে কিয়েসা। কিন্তু কেউই থিতু হতে পারেননি নানা কারণে। ইনজুরি ছিটকে দিয়েছে জানিওলোকে, এবং মইস কিন প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স করে উঠতে পারেননি। তাই আক্রমণের ডানপাশের দায়িত্ব এবার পেয়েছিলেন কিয়েসা। অথচ ইউরো শুরু করলেন বেরার্দি। এর কারণ, ক্লাবের দিক থেকে ফর্মে কিয়েসা থেকে বেরার্দি বেশ এগিয়ে ছিলেন।

মানচিনি কখনোই ডাবল পিভট কৌশলে থিতু হতে চাননি। তাই ৪-৩-৩ ছকেই দলকে মানিয়ে নিতে বাধ্য করেছেন। মধ্যমাঠে একসময় প্রায় নিয়মিত হয়েই গিয়েছিলেন ইন্টারের সেনসি। কারণ একজন প্রথাগত ডিফেন্সিভ মিডফিন্ডারের পাশে সেনসি যেন খোলস থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু ইনজুরি তাকে দল থেকে ছিটকে ফেলেছে। তাই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হলেন পাঁচজন – ভেরাত্তি, জর্জিনহো, লোকাতেল্লি, ক্রিস্তান্তে ও বারেল্লা।

ইউরোতে গোলরক্ষক হিসেবে মানচিনি রেখেছেন ডোনারুমাকে। আসলে আর কাকেই বা রাখবেন? বর্তমানে পুরো ইউরোপের সেরা গোলরক্ষকদের একজন তিনি। ৩৭ ও ৩৬ বছর বয়সী কিয়েলিনি ও বোনুচ্চি রক্ষণ সামলানোর দায়িত্ব দিলেও তিনি জানতেন কিছু দিকে তারা আশাতীত পারফরম্যান্স করতে পারবে না। বয়সের কারণে তাদের গতি নেই, কিন্তু পজিশনিং সেন্স এখনও বিশ্বমানের, তাই তাদের বেশি উপরে উঠতে হলো না। হাই লাইনে রক্ষণের কাজ করলেও তাদের বিশেষ নজর ছিল পজিশনের দিকে। এছাড়াও কিয়েলিনি দিয়েছেন বাড়তি সুবিধা, মাঝে মাঝেই নিচ থেকে পাস এসেছে কিয়েলিনির পা থেকে।

আজ্জুরিদের রক্ষণদেয়াল ; Image Credit: Chris Ricco

রাইটব্যাক ফ্লোরেঞ্জি তেমন আক্রমণের দিকে যেতে পছন্দ করেন না। তার পাসিং ভালো, সুন্দর ক্রসও দিতে পারেন। কিন্তু সবই করেন ঠিক মধ্যমাঠের ডান পাশ থেকে। কিন্তু লেফটব্যাক স্পিনাৎজোলার নজর বেশি আক্রমণে, বাম পাশ দিয়ে বল নিয়ে ছুটে যান দ্রুত গতিতে, ফলে আক্রমণের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পায়। মানচিনি বেশি কিছু ভাবেননি, যে খেলোয়াড় যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাকে সেই ভূমিকাই দিয়েছেন। ফ্লোরেঞ্জি নিচে থেকে তিনজনের রক্ষণ তৈরি করেছেন, আর বল নিয়ে স্পিনাৎজোলা ঢুকে গেছেন প্রতিপক্ষের আক্রমণে। ফ্লোরেঞ্জির ইনজুরির পর ডি লোজানো খেললেও এই কৌশলের ব্যতিক্রম হয়নি।

মানচিনির স্কোয়াডের মধ্যমাঠ খুবই বুদ্ধিদীপ্ত খেলোয়াড়ে ভরা। চেলসির জর্জিনহো একাই প্রতিপক্ষের চাপ শুষে নিয়েছেন। তাদের আক্রমণ গুড়িয়ে দিয়ে বল কেড়ে নিয়েছেন সুনিপুণভাবে। এক কথায় মাঝমাঠের প্রাণ তিনি। আজ্জুরিদের আক্রমণের সময় ফ্লোরেঞ্জি চলে এসেছেন মাঝমাঠে, জর্জিনহোর নিচে বোনুচ্চি ও পাশে কিয়েলিনি থাকায় এখানে তৈরি হয়েছে ডায়মন্ড শেইপ। ফলে মাঝমাঠে নিজেদের ভেতর পাস দেবার প্রবণতা আরও বেড়েছে। কিয়েসা-বেরার্দি চলে গেছেন নিজেদের উইং পজিশনে, অনেকটা দূরে সাইড লাইনের কাছাকাছি। স্ট্রাইকার হিসেবে ইমোবিলে ঠিক ডি-বক্সে। আর লেফট উইংগার হিসেবে খেলা ইনসিনিয়ে চলে এসেছেন মাঠের হাফ স্পেসে। তার ঠিক পাশেই স্পিনাৎজোলা। এজন্য আক্রমণভাগের বল পেতে একদমই সমস্যা হয়নি। 

ক্যারিয়ার সেরা পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন স্পিনাতজোলা; Image Credit: Fabio Ferrari/LaPresse/Sipa USA

জর্জিনহোকে মূল চাবিকাঠি ধরে গড়া ডায়মন্ড শেইপের উপরে তৈরি হওয়া ফাঁকা স্থান থেকে বল দেওয়া-নেওয়ার দায়িত্ব ছিল বারেল্লা ও ভেরাত্তি কিংবা লোকাতেল্লির। আর মাঝমাঠ থেকে কোণাকুণি বরাবর লং বলগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য তো স্পিনাৎজোলা ও কিয়েসা আছেনই। হয় তারা বল রিসিভ করে ডি-বক্সে পাস দিয়েছেন, অথবা আবার লং বলে ভেতরে ডি-বক্সে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও, ছিল কাট-ইন করে হাফব্যাকে চলে আসার পরিকল্পনা, যেখানে আক্রমণ গড়ার আরও অনেক সুযোগ থাকছে।+

কিন্তু মানচিনি যে শক্তিশালী বেঞ্চ নিয়ে ইউরোতে গেলেন, এই বিজয়ের গল্পে তাদের অবদান কতখানি? বলতে গেলে মূল একাদশের থেকে কোনো অংশেই কম নয়। ইমোবিলের সাথে বদল করে খেলেছেন বেলোত্তি। শেষ দিকে বদলি নেমে ম্যাচে নতুন করে গতির সঞ্চার করেছেন বার্নাদেস্কি, ক্রিস্তান্তে ও তোলোই। আর মাত্তেও পেসিনা তো বেঞ্চ থেকে নেমে ১০৫ মিনিটে গোল করে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে ইতালিকে জয় এনে দিলেন। ওদিকে মানচিনিও তার দলের একজন খেলোয়াড়কেও আশাহত করেননি। নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারে ইউরো ও বিশ্বকাপে খেলতে না পারার যে আক্ষেপ তিনি বয়ে নিয়ে চলেন, ঠিক একই আক্ষেপ যেন তার শিষ্যদের ভেতর না জন্ম হয়, এজন্য পুরো ইউরোরে স্কোয়াডে থাকা প্রত্যেক খেলোয়াড়কে কিছুটা হলেও সময় দেবার চেষ্টা করেছেন; যাতে তারা আক্ষেপ না করে গর্ব করতে পারে, ইতালির এই ইউরো জয়ের রোমাঞ্চকর গল্প রচনার আমারও কিছুটা অবদান আছে।

এভাবেই ‘ডিফেন্সিভ’ খেতাব পাওয়া একটি দলকে বদলে গেল পুরোদমে, এবং তারাই ২১ ইউরোর অন্যতম আক্রমণাত্মক দলের মর্যাদা জুটিয়ে, জিতে নিয়েছে তাদের ইতিহাসের দ্বিতীয় ইউরো শিরোপা।

ইতালির বিজয় উল্লাস; Image Source: Getty Images

তবে ট্যাকটিক্সের জটিলতা বাদেও আরও একটি দিকের জন্য মানচিনির প্রশংসার দাবিদার। তিনি নিশ্চিত করতে পেরেছেন, ম্যাচ জিতুক বা হারুক, ইউরোতে এই দলের প্রত্যেকে যেন নিজের সেরাটা দিয়ে খেলে; নিজেকে উজাড় করে দেয় শতভাগ দিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন, তার অধীনে ইতালি হবে একটি পরিবারের মতো, যেখানে সবাই সবার দেখভাল করবে। শিরোপার লড়াইয়ের যুদ্ধে নেমেও, একটি কথাই হবে দল তথা পরিবারের মূলমন্ত্র — সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।

This article is in Bangla language. It is about the transformation of Italy under Roberto Manchini and explains his football philosophy and tactics.

Featured image: Getty Images

Background Image: Getty Images

Related Articles

Exit mobile version