আহত বাঘের ‘গলার কাঁটা’ জিম্বাবুয়ে সিরিজ

ভারী কভার পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।  উইকেটের আশেপাশের জায়গাটুকুও ঢেকে দেওয়া। বাতাসে যেন উড়ে না যায়, সেজন্য এখানে-সেখানে টায়ার ফেলে রাখা। তার উপরে কিউরেটর গামিনি ডি সিলভা জনাদশেক মাঠকর্মীদের নিয়ে ছাতা মাথায় আলোচনা করছেন।  হয়তো ছক আঁকছেন আসন্ন রণক্ষেত্রের জন্য। এই তো, হাতে মেরে-কেটে আর সপ্তাহ দুয়েকও নেই। আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরবে ঘরের মাটিতে। আবারও পানিতে ভিজে লুটোপুটি খাওয়া সাদা, সবুজ, আর গোলাপী গ্যালারির ফাঁকা চেয়ারগুলোতে বসে হবে গলা ফাটানো উল্লাস।  আবারও জেগে উঠবে বাংলাদেশের হোম অব ক্রিকেট, মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামেও ছড়াবে ক্রিকেটের আমেজ।

সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে ঘরের মাঠে ক্রিকেট খেলতে নেমেছিলো বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজারা।  সেবার ফাইনালে উঠতে না পেরে আগেই বিদায় নিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। অন্যদিকে, বাংলাদেশকে হারিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপা জিতেছিলো চান্দিকা হাতুরুসিংহের শ্রীলঙ্কা দল। সেই সিরিজশেষে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট সিরিজ, যার একটি চট্টগ্রামের সাগরিকায় এবং অপরটি মিরপুরে। তারপর কেবলই বিদেশ সফর। সেসব পিছনে ফেলে আবার বাংলাদেশ সফরে আসছে জিম্বাবুয়ে।

লম্বা বিরতির পর ‘হোম অফ ক্রিকেট’-এ আবারও ফিরছে ক্রিকেট ; Image Credit : The Daily Star

চলতি অক্টোবর ও আসছে নভেম্বর মিলিয়ে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ তিনটি ওয়ানডে ও দুটি টেস্ট ম্যাচ খেলবে।  মাত্রই এশিয়া কাপে রানার্সআপ হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ফিরেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ খেলছে জিম্বাবুয়ে।

এরই মধ্যে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের জন্য ১৬ সদস্যের দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। যেখানে তরুণদের উপর গুরুত্ব দিয়েছে নির্বাচকরা। বলা যায়, দিতে বাধ্য হয়েছে। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালদের ইনজুরি; সবমিলিয়ে নতুনদের উপরই ভরসা করতে হচ্ছে বিসিবিকে। কেবল তা-ই নয়, ভবিষ্যতের জন্য দলের পাইপলাইন ঠিক রাখাও উদ্দেশ্য হতে পারে।

১.

নতুন মুখ বলতে কেবল ফজলে রাব্বি ; Image Credit : BCB PHOTO

জিম্বাবুয়ে সিরিজে নতুন মুখ বলতে কেবল ফজলে রাব্বি। তামিম ইকবালকে আদর্শ মানা এই টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানকে জাতীয় দলের জার্সিতে পরীক্ষা করতে চায় টিম ম্যানেজমেন্ট। অবশ্য ১৪ বছর ধরে ঘরোয়া ক্রিকেট লিগ খেলতে থাকা রাব্বিকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে গুঞ্জনটা আগে থেকেই ছিল। বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে ভালো করেছেন, এরপর চলতি জাতীয় ক্রিকেট লিগের (এনসিএল) প্রথম রাউন্ডে রংপুর বিভাগের বিপক্ষে ১৯৫ রানের ইনিংস খেলার পর নতুন করে আলোচনায় আসেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ডাবল সেঞ্চুরি মিসের আক্ষেপ থাকলেও প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পাওয়াটা হয়তো খানিকটা হলেও সেই দুঃখ ভুলিয়েছে বরিশালের এই ক্রিকেটারের। খুলনায় চলমান লিগ থেকে উড়ে এসে সরাসরি তাই যোগ দিচ্ছেন জাতীয় দলের ক্যাম্পে।

এখন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৬৮ ম্যাচ খেলা রাব্বি সাতটি সেঞ্চুরি ও ১৭টি হাফ সেঞ্চুরিসহ তুলেছেন মোট ৩,৭১৫ রান। কেবল ব্যাটিং নয়, দলের প্রয়োজনে বল হাতেও বেশ কার্যকরী এই ৩০ বছর বয়সী ক্রিকেটার। এরই মধ্যে এই ফরম্যাটে ঝুলিতে পুরেছেন ২৮ উইকেট। লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারে ৮০ ম্যাচে রাব্বির রয়েছে ২,২০০ রান, সঙ্গে উইকেট শিকার করেছেন ২৭টি।

প্রথমবার দলে জায়গা পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন,

‘জাতীয় দলে ডাক পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় সারপ্রাইজ। আমি আসলে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে আরো বেশি রান করতে পারতাম। কিন্তু কেন পারিনি, সেটা এখন বুঝতে পারি। আমাকে আরও ফিট হতে হবে। জাতীয় দল কিংবা ঘরোয়া লিগ – ক্রিকেটই একমাত্র জিনিস, যেটা আমি করতে পারি।’

এদিকে, জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে ১০ মাস পর আবারও জাতীয় দলের স্কোয়াডে ফিরেছেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। জাতীয় দলের হয়ে শেষবার গেল জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন সাইফউদ্দিন। জিম্বাবুয়ে সিরিজে বাদ পড়েছেন এশিয়া কাপ দিয়ে দীর্ঘদিন পর ওয়ানডে দলে ফেরা মুমিনুল হক, নাম কাটা গেছে ওপেনার সৌম্য সরকারেরও। বাজে পারফরম্যান্সের কারণে এমনিতেই দলের বাইরে ছিলেন তিনি, খেলছিলেন ‘এ’ দলের হয়ে। কিন্তু এশিয়া কাপের মাঝপথে হঠাৎ তাকে উড়িয়ে নেওয়া হয় আরব আমিরাতে।

স্কোয়াডে ফিরলেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ; Image Credit : A.M. Ahad

২.

লিটন কুমার দাস, নাজমুল হোসেন শান্ত, মোহাম্মদ মিঠুন, আরিফুল হক, মেহেদী হাসান মিরাজ, নাজমুল ইসলাম অপু, আবু হায়দার রনির সঙ্গে মুস্তাফিজুর রহমান ও রুবেল হোসেন। তরুণ ও ‘সেমি-তরুণ’ এর এই মিশেলের সঙ্গে দলের মাথার উপরে ছায়া হবেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও ইমরুল কায়েস।

কেবল সাকিব ও তামিম নন, মুশফিকুর রহিম ভুগছেন পাঁজরের ব্যথায়, মাশরাফি নিজেও কব্জিতে চোট পেয়েছেন। তারপরও এভাবেই এগোতে হবে সবাইকে। নিজেকে শতভাগ ফিরে পেতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মুশফিক, অন্যদিকে মাশরাফিও প্রায় সেরে উঠেছেন।

কিন্তু দল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নিন্দুকরা বলছেন, এ যেন কচিকাঁচার মেলা। নামগুলোও সে কথারই প্রমাণ দেয়। সব মিলিয়ে দল অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী মনে হলেও তা মানতে নারাজ নির্বাচকরা। তাদের মতে সেরা দলটিই দেওয়া হয়েছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেছেন,

‘আমরা সেরা দলটাই দিয়েছি। কিছু নতুন খেলোয়াড়, দুয়েকজনকে তো আমরা দেখেছিই। আমাদের তিনটা ওয়ানডে ম্যাচ আছে। তিনটাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্কোয়াডটা দেখলেই বুঝতে পারবেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য আমাদের ভালো পারফর্মার আছে। ঘরোয়াতেও অনেকে পারফর্ম করছে। দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবকিছুই বিবেচনায় আনা হয়েছে।’

প্রশ্ন উঠেছে আরিফুল হককে দলের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও। ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিতি পেলেও মিডিয়াম পেসার হিসেবেও মোটামুটি কার্যকর তিনি, কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে ৬টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা এই ক্রিকেটার নিজেকে এখনও মেলে ধরতে পারেননি। এটাও বলা চলে, সুযোগ পাননি মেলে ধরার।

তারপরও আরিফুল কেন? উত্তরে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছেন, পেস বোলিং অলরাউন্ডারের কথা মাথায় রেখেই তাকে দলে নেওয়া। তিনি বলেন,

‘একটা বোলিং অলরাউন্ডার দরকার, আরিফুলের কথা হচ্ছে। কিন্তু মাশরাফি তাকে বল করে দেবে বলে মনে হয় না। আরিফুল এখনও পরীক্ষিত না। এই ফাইনালে (এশিয়া কাপ) তার খেলার কথা ছিল। আরিফুল ও সৌম্যকে দিয়ে পাঁচ ওভার বল করানো হবে। বাকিটা রিয়াদ দেখবে।  আমরা সাইফউদ্দিনের অনেক প্রতিভা দেখেছিলাম, সে ওই জায়গায় আদর্শ ক্রিকেটার আমাদের জন্য। কিন্তু ওর বোলিং নাকি খুবই খারাপ হয়ে গেছে। ওর খোঁজখবর নিলেই শুনি, সে বল করা ভুলে গেছে। এখন বল করা ভুলে গেলে কীভাবে হবে, আমার তো বোলিং অলরাউন্ডার দরকার। সে নাকি বল ফেলতেই পারে না জায়গামতো।’ 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখনো সেভাবে আলো ছড়ানোর সুযোগ পাননি আরিফুল ; Image Source : DSC Sports

৩.

মাশরাফি জিম্বাবুয়ে সিরিজে ওয়ানডে দলকে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু সাকিবের ইনজুরিতে টেস্ট দলের নেতৃত্ব নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও বিসিবি সভাপতি নাজমুল ইসলাম পাপনের ইঙ্গিত, টেস্টে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হতে পারেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এর আগে বছরের শুরুতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রামে সাকিবের অনুপস্থিতিতে দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই ম্যাচ ড্র করে বাংলাদেশ।

মাহমুদউল্লাহ ও জিম্বাবুয়ে সিরিজে টেস্ট অধিনায়কত্ব প্রসঙ্গে পাপন বলেছেন,

‘এখন নতুন কাউকে অধিনায়ক নিয়োগ দিলাম, তারপর সাকিব ফিট হয়ে গেলে তাকে বাদ দেবো? এভাবে ভালো দেখায় না। আমার মনে হয়, সাকিব ফিট না হওয়া পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহ’র (সহকারী অধিনায়ক) অধিনায়কত্ব করা উচিত।’

জিম্বাবুয়ে দল ১৬ তারিখে ঢাকায় নামবে। এরপর ১৯ তারিখে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) একদিনের প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে। এরপর ২১ অক্টোবর থেকে শুরু হবে ওয়ানডে সিরিজ। দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে ঢাকায়। প্রথম টেস্ট ম্যাচটি সিলেটে শুরু হবে ৩ নভেম্বর থেকে, সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে ১১ নভেম্বর।

সাকিবের অনুপস্থিতিতে টেস্ট অধিনায়কত্ব পেতে পারেন মাহমুদউল্লাহ ; Image Credit : Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images

র‍্যাংকিংয়ে জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশের চেয়ে অনেকটা নিচে হলেও তারুণ্যনির্ভর এই বাংলাদেশ হয়তো ঘরের মাঠেও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়বে। সেটা কাটিয়ে উঠতে পারলে, নিজ নিজ দায়িত্ব নিয়ে সেরাটা উজাড় করতে পারলেই হাসবে বাংলাদেশ। মোদ্দা কথা, র‍্যাংকিং ও পয়েন্টের ব্যাপার থাকার কারণে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারলে চাপে পড়বেন মাশরাফি-মুশফিকরাই।

Featured Image Credit : RATON_GOMES@BCB

Related Articles

Exit mobile version