মাইক্রোফোনের সামনে থেকে মুখটা নামিয়ে নিলেন শোয়েব আল বুখারি। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়ল চোখ থেকে। আর কথা বলতে পারছেন না। কান্না ছাড়া যে আর কিছুই করার নেই তার। কারণ সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় মাশরাফি বিন মুর্তজার বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে, তখন গ্যালারিতে নেই শোয়েব ওরফে ‘টাইগার শোয়েব’। অর্থাভাবে প্রিয় লাল-সবুজ জার্সিধারী দলকে মাঠে থেকে সমর্থন দিতে পারছেন না! তাই সমর্থকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন ডাকা।
শেষ পর্যন্ত তার জন্য পাসপোর্ট সহ সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। কিন্তু ভিসা না পাওয়ায় অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়া হয়নি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ‘আইকন’ সমর্থক টাইগার শোয়েবের। মাশরাফি-সাকিবরাও দূরদেশে বাঘের মতো ডোরা কাটা টাইগার শোয়েবকে গ্যালারিতে হয়তো মিস করেছেন।
ক্রিকেট বিশ্বের প্রতিটি দলই তাদের নিজ নিজ সমর্থকদের কাছে সেরা। কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। কখনও কখনও ক্রিকেট দলের কাছে তাদের নির্দিষ্ট সমর্থক সেরা। গ্যালারিতে যাদের উপস্থিতি মানেই দলের বাড়তি প্রেরণা। সেটা যেমন বাংলাদেশ দলের টাইগার শোয়েব, তেমনি পাকিস্তানের বশির চাচা কিংবা ভারতের সুধীর। আজকের আয়োজন ক্রিকেটের এমন সবচেয়ে আলোচিত পাঁচ সমর্থক ও বা সমর্থক গোষ্ঠীদের নিয়ে।
টাইগার শোয়েব (বাংলাদেশ)
সারা শরীরে বাঘের মতন ডোরা কাটা রং করে যে লোকটি বাংলাদেশের পতাকা হাতে সাকিব-মুশফিকদের ম্যাচে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তার নামই টাইগার শোয়েব। তাকে বলা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আইকনিক সমর্থক। পেশায় মোটর মেকানিক শোয়েবের আর্থিক জটিলতা শুরু থেকেই। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশের খেলা দেখা নিয়ে তার আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু দেশের এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যু কিংবা এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে হলে যে অর্থ প্রয়োজন, সেটা কখনোই ছিল না শোয়েবের। এমনকি টাকার অভাবে শরীরে বাঘের মতো ডোরা কাটা রং করতে বেছে নিয়েছিলেন ঘর কিংবা গ্রিলের জন্য ব্যবহৃত রং। সেটাও আবার নিজে নিজেই করতেন। পরবর্তীতে সাবেক কিংবা বর্তমান ক্রিকেটার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংগঠন তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর থেকেই মূলত দেশের বাইরেও বাংলাদেশ দলকে সমর্থন দিতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন শোয়েব।
কিন্তু এগুলো থাক আর না থাক, বাংলাদেশের খেলা হলে শোয়েবের থাকা চাই। এমনও হয়েছে, বিদেশে বাংলাদেশ দলকে সমর্থন দিতে গিয়েছেন শোয়েব কিন্তু কী খাবেন কোথায় ঘুমাবেন তার কিছুই ঠিক নেই। তারপরও গ্যালারিতে থেকেছেন, ‘বাঘ’ হয়ে সমর্থন দিয়েছেন উপমহাদেশের এই উঠতি ক্রিকেট পরাশক্তিকে। গ্যালারিতে বসেই খবর পেয়েছেন আত্মীয় মারা গেছে, কিন্তু শোয়েব মাঠ ছাড়েননি। পাগলা সমর্থকরা যেন এমনই হয়।
সুধীর কুমার গৌতম (ভারত)
আজকের যে টাইগার শোয়েব, তাকে পাওয়া গেছে সুধীরের কারণেই। একবার এক সাক্ষাতকারে শোয়েব জানিয়েছিলেন, ভারতের সুধীর আছে। বাংলাদেশের কেউ নেই। তাই সুধীরের মতোই হতে চেয়েছেন তিনি।
কিন্তু ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের সমর্থক বিহারে জন্মগ্রহণকারী সুধীরের সংগ্রাম যেন সবকিছুকেই ছাড়িয়ে যায়। ক্রিকেট মানে তার কাছে শুধুই ক্রিকেট না। তার কাছে ক্রিকেটের মূল অর্থ, কিংবদন্তী শচীন টেন্ডুলকার। ১৯৮১ সালে জন্মগ্রহণ করা সুধীর মাত্র ছয় বছর বয়সে শচীনের খেলা দেখা শুরু করেন। সেই থেকে শুরু। এখন তিনি বিসিসিআইয়ের অফিশিয়াল ‘আইকন’ সমর্থক। ম্যাচ দেখতে তার যাবতীয় খরচ এখন দেশটির সর্বোচ্চ ক্রিকেট সংস্থা বহন করে।
কিন্তু পথটা সহজ ছিল না। সারা গায়ে ভারত জাতীয় পতাকার তিন রঙে রাঙিয়ে বুকে লেখা, শচীন টেন্ডুলকার ১০ (জার্সি নম্বর)। সঙ্গে ন্যাড়া মাথায় ভারতের মানচিত্র, কাগজের বিশ্বকাপ, শঙ্খ আর তিন মিটারের জাতীয় পতাকা মিলিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের যে ‘ট্রেডমার্ক’ সমর্থক হয়েছেন সুধীর, তার পিছনে শুধুই ছিল ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা। সেটা করতে গিয়ে পড়াশোনা ছেড়েছেন, কাজকর্ম ছেড়েছেন। এমনকি ক্রিকেট দেখতে সমস্যা হবে, এই ভয়ে বিয়ে করেননি!
টাকার অভাবে হাজার হাজার মাইল সাইকেল চালিয়ে পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় খেলা দেখতে গিয়েছেন। চুরি করে ট্রেনে চেপে যেভাবেই হোক পৌঁছে গিয়েছেন ভারত দলের কাছে। টিকিট কাটার টাকায় সঙ্কট পড়বে, সেই ভয়ে খাওয়া বাদ দিয়েছেন। ভারতের ক্রিকেট তার জাতীয়তাবোধের সঙ্গে এতটাই মিশে গিয়েছে যে, শচীন একবার তাকে নিয়ে বললেন, “গ্যালারিতে যখন এমন কোনো দর্শক দেখি তখন অনুপ্রাণিত হই।”
শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সাল থেকে তার ম্যাচ দেখার যাবতীয় খরচ যোগাচ্ছে বিসিসিআই। এর পিছনেও রয়েছেন শচীন। একই বছরে কিংবদন্তী সাবেক ক্রিকেটারের সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে পুলিশের কাছে হেনস্তা হয়েছিলেন সুধীর। পরে শচীনই তাকে সামনে আনেন। তার কষ্টের কথা শুনে বোর্ডের কাছে আর্জি জানান।
শচীন অবসরের পরও তার বুক থেকে মুছে যায়নি নামটা। শুধু জার্সি নাম্বারের জায়গায় বসেছে,”শচীন উই মিস ইউ।”
ভারতীয় ক্রিকেট দলকে কতটা ভালবাসেন সুধীর? এক প্রামাণ্যচিত্রে এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন,”আমি আজীবন ভারত দলের হয়ে গ্যালারিতে পতাকা ওড়াবো। টাকার অভাব পড়লে দরকার হয় কিডনি বেঁচে দেব।”
ক্রিকেট চাচা (পাকিস্তান)
পাকিস্তানের আইকনিক সমর্থকদের মধ্যে এই মুহূর্তে সবাই মোহাম্মদ বশির বোজাইকে চিনে থাকবেন। অনেকে মোহাম্মদ জামান খানের (টি-টোয়েন্টি চাচা) কথাও বলবেন। কিন্তু এদের সবাই এসেছে চৌধুরী আব্দুল জলিল ওরফে ক্রিকেট চাচার অনেক পরে। পাকিস্তান জাতীয় পতাকার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে সবুজ রঙের ঢোলা পাঞ্জাবী-পায়জামা, মাথায় সাদা রঙের ক্যাপ, হাতে পতাকা আর মুখে শ্বেত-শুভ্র দাড়ি। সব মিলিয়ে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে নিবেদিত সমর্থক।
অবশ্য তার শুরুটা পাকিস্তান থেকে হয়নি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন তিনি, ছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেটের ভীষণ রকম সমর্থক। এরপর ১৯৮০ সালের শারজাহ কাপের মাধ্যমে তিনি আলোচনায় আসেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) তাকে দলের সমর্থনের জন্য পৃথিবীর যে প্রান্তেই পাকিস্তানের ম্যাচ থাকুক, ক্রিকেট চাচাকে নিয়ে যায়। সব কিছু ঠিকই ছিল। ২০১৫ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ব্যর্থতার জের এসে পড়েছিল জলিল চাচার উপরেও। পাকিস্তানের ম্যাচ দেখার জন্য তার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেয় পিসিবি।
ঐ বছরই আবার গ্যালারিতে ফিরেন আব্দুল জলিল। শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের উপর জঙ্গি হামলার কারণে ২০০৯ সাল থেকে ঘরের মাঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজনে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ পাকিস্তান। তারপরও ২০১৫ সালে পাকিস্তানের লাহোরে সফর করতে যায় জিম্বাবুয়ে জাতীয় দল। দেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ফেরার দিন সবার চোখ যায় ক্রিকেট চাচার দিকে।
সবুজ পতাকার মাঝে সাদা তারকার পতাকা নিয়ে গ্যালারিময় ঘুরছেন আর চিৎকার করছেন, “জিতবে রে ভাই জিতবে, পাকিস্তান জিতবে”।
পার্সি আবেসেকারা (শ্রীলঙ্কা)
তাকে বলা হয় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের ‘ওয়ান ম্যান সাপোর্টার’। জাতীয় দলের ক্রিকেটার না হয়েও ক্রিকেটের কারণেই যদি কেউ কিংবদন্তী হয়ে থাকেন সেটা পার্সি। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট আর পার্সি, দুজন দুজনার যেন সমার্থক। পার্সি শুধু সমর্থকই নন, ক্রিকেট বিশ্লেষক ও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সাক্ষাৎ এনসাইক্লোপিডিয়া বললেও ভুল হবে না। পার্সি তার দলকে সমর্থন করেন তখন থেকে যখন শ্রীলঙ্কার নামের পাশে টেস্ট স্ট্যাটাস তকমাটা লাগেনি। তবে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে যখন শিরোপা জিতল দলটি, আন্তর্জাতিকভাবে ঠিক তখনই আলোচনায় আসেন পার্সি। শুধু ক্রিকেট দল নয়, ক্রিকেটারদের সঙ্গেও যেন ছিল তার ‘টেলিপ্যাথি’।
এক সাক্ষাতকারে বলছিলেন, “আমি কখনো মনে মনে বলতাম গ্যালারি থেকে। কখনও বা চেঁচিয়ে বলতাম। সাঙ্গাকারাকে যখন বলতাম এভাবে খেল, সে শুনতে পেত। চামিন্দা ভাসকে বলতাম চার উইকেট নিতে হবে। সেটা মনে মনে বললেও সে শুনতে পেত, চেঁচিয়ে বললেও পেত।” ভারত ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের সঙ্গেও ছিল তার সুসম্পর্ক।
পার্সি দাবি করেন, সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের এক হাজারেরও বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ মাঠে থেকে দেখেছেন। ২০১৪ সালে যখন শ্রীলঙ্কা জাতীয় দল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতল, সেইবার ‘গ্যালারি থেকে অবসর’ নিলেন পার্সি। ৭৭ বছর বয়সে মাঠ ছাড়ার এটা একমাত্র কারণ ছিল না তার। মূলত, অসুস্থ বোনের সেবা করতেই এই সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
বার্মি আর্মি (ইংল্যান্ড)
অনেকে আড়ালে বলেন, ইংল্যান্ড যদি মঙ্গল গ্রহে খেলতে যায় সেখানেও পৌঁছে যাবে বার্মি আর্মি। সমর্থক হলে এমনই হওয়া চাই; এই মন্ত্রে বিশ্বাসী বার্মি আর্মি। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের কট্টর এই সমর্থক গোষ্ঠী পৃথিবীর যে প্রান্তেই খেলা হোক না কেন, তাদের দলকে সমর্থন দিতে ঠিকই পৌঁছে যাবে। মজার ব্যাপার হলো, এই নামটা কিন্তু তাদের নিজেদের বা ইংল্যান্ড থেকে দেওয়া নয়। বার্মি আর্মি নাম তারা পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে!
ঘটনাটা ছিল ১৯৯৪-৯৫ অ্যাশেজে। অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে গেছে ইংল্যান্ড। সঙ্গে গেছে বার্মি আর্মি। সেইবার অজিদের কাছে শোচনীয়ভাবে হেরেছিল ইংলিশরা। তাতে কী! গ্যালারিতে ইংল্যান্ড সমর্থক তিন বন্ধুর উল্লাস চলছেই। শুধু কি তা-ই! বাকিদের নিয়ে হেরে যাওয়া ইংল্যান্ডের তুমুল প্রশংসার পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার সমালোচনা চলছিল তুঙ্গে। এটাই নাকি তাদের সমর্থনের ‘স্টাইল’। এহেন কাণ্ডে অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম তাদেরকে নাম দিল বার্মি আর্মি। দল খারাপ খেলুক অথবা ভালো, বার্মি আর্মি ইংল্যান্ডকে উপরে তুলবেই।
ইংল্যান্ড দলকে ব্যতিক্রমীভাবে সমর্থন দেওয়ার কারণেও সুপরিচিত বার্মি আর্মি। দল বেধে দেশে কিংবা দেশের বাইরে খেলা দেখতে যাওয়াটাই তাদের নেশা। ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডও (ইসিবি) বার্মি আর্মির গুরুত্ব (মতান্তরে ঝুঁকি) বোঝে। সে কারণেই কিনা লর্ডস ছাড়া বাকি সব ভেন্যুতে তাদের জন্য গ্যালারিতে নির্দিষ্ট জায়গা করে দিয়েছে।
ফিচার ইমেজ: Times of India