আমাদের চারপাশের দৃশ্যপট বা জীবনযাত্রা খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়। এই বদল ফুটবলের সাথেও তুলনা করা যেতে পারে। আজ যে খেলোয়াড় গোল করে ম্যাচ জেতাচ্ছেন, আগামী ম্যাচের নায়কের স্থানে তিনি না-ও থাকতে পারে। তবে অক্টোবর মাসে যারা সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, আর নভেম্বর মাসের পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে রোর বাংলা যাদের মনোনীত করতে যাচ্ছে, তাদের অনেকেই অক্টোবর মাসের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর শুধু একটিই কারণ, অক্টোবর মাসজুড়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তারা ধরে রেখেছেন পরের মাসেও।
চলুন, দেখে নেওয়া যাক, নভেম্বর মাসের জন্য ইউরোপের প্রত্যেক লিগ ও প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সেরা সাতজনকে।
প্রিমিয়ার লিগ – জেমি ভার্ডি
২০১৬-২০১৭ মৌসুমে লেস্টার সিটি প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ পেয়েই যে রূপকথার রচনা করেছিল, তার পেছনে অন্যতম নায়ক ছিলেন রিয়াদ মাহরেজ ও জেমি ভার্ডি। সেই মাতাল করা মৌসুমের পর ‘ফক্সবাহিনী’ অনেক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে। সে মৌসুমের অর্ধেক খেলোয়াড় ক্লাব ছেড়ে গেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্লাবকে আঁকড়ে ধরে আছেন ইংলিশ স্ট্রাইকার ভার্ডি। ম্যাডিনসন, পেরেজ, তিলেমান্স ও বের্নেসের মতো তরুণদের সাথে নিয়ে ভার্ডি তাই জ্বলে উঠেছেন আরও একবার।
অক্টোবর মাসে তিন ম্যাচে চার গোল করেছিলেন ভার্ডি, তার দলও ছিল তালিকার তৃতীয় স্থানে। নভেম্বর মাসেও তিনি খেলেছেন মোট তিনটি ম্যাচ। প্রত্যেকটি ম্যাচে টেনে নিয়ে এসেছেন অক্টোবর মাস থেকে শুরু হওয়া আগুনে ফর্ম। ক্রিস্টাল প্যালেসের মাঠে গিয়ে ২-০ গোলে হারানোর ম্যাচে ভার্ডি শেষ সময়ে করেছিলেন এক গোল। নিজেদের মাঠে বিহ্বল আর্সেনালকে হারানোর পেছনের নায়কও তিনি। দারুণ এক গোলের পাশাপাশি ম্যাডিনসনকে দিয়ে করিয়েছিলেন দ্বিতীয় গোল। নভেম্বর মাসের শেষ ম্যাচেও জ্বলে ওঠেন তিনি। প্রথমে পেরেজকে দিয়ে একটি গোল ও শেষ সময়ে পেনাল্টি থেকে সহজ গোল করে ব্রাইটনকে একাই হারিয়ে দেন ভার্ডি। তাই, ১৩ গোল করে প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাই শুধু নয়, ৩ গোল ও ২ অ্যাসিস্টের বদৌলতে নভেম্বর মাসের প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়ও তিনি।
লা লিগা – লিওনেল মেসি
ইনজুরির কারণে মৌসুমের শুরু থেকে দলের বাইরে ছিলেন মেসি। তাকে ছাড়া বার্সেলোনাও সেভাবে সুবিধা করতে পারছিল না। তাই অক্টোবর মাসে এসে দলের হাল পুনরায় এসে ধরেন। সেই যে ধরলেন, আর তার মেসিসুলভ পারফরম্যান্স শুরু হলো, তা এখনও চলছে।
নভেম্বর মাসের প্রথম ম্যাচে বার্সেলোনা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ৩-১ গোলে এইবারের মাঠে লজ্জাজনক হার নিয়ে ফেরত আসলেও একমাত্র গোল পেয়েছিলেন মেসি। পরের ম্যাচে ঘরের মাঠে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে স্লাভা প্রাহার সাথে ড্র। তাই এই দুই ম্যাচের ক্ষোভ গিয়ে পড়ল সেল্টা ভিগোর উপর। দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিক করে বার্সেলোনাকে আবারও লা লিগার শিরোপা লড়াইয়ে ফেরত আনলেন। মাঝে আন্তর্জাতিক বিরতি কাটিয়ে আসলেও মেসির ফর্মে মরচে পড়েনি। বিরতিশেষে লেগানেসের মাঠে গিয়েও খেলেছেন দারুণ ফুটবল, সুয়ারেজকে দারুণ একটি অ্যাসিস্টও করেছিলেন এই আর্জেন্টাইন সুপারস্টার।
মৌসুমের শুরু থেকে মেসি খেলেননি। অথচ দেরিতে শুরু করেও এখনই ছুঁয়ে ফেলেছেন করিম বেনজেমাকে। লা লিগায় এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোল করেছেন রিয়াল মাদ্রিদ স্ট্রাইকার বেনজেমা, আর সমানসংখ্যক ৯ গোল করে দ্বিতীয় পজিশনে আছেন মেসি। যদিও সর্বোচ্চ ৫টি অ্যাসিস্ট করে তালিকার প্রথমে আছেন মেসিই।
বুন্দেসলিগা – রবার্ট লেভানডোস্কি
বুন্দেসলিগায় শেষ হয়েছে মাত্র ১৩টি সপ্তাহ। লিগের অর্ধেকও এখনও শেষ হয়নি। প্রথম থেকে এ লিগে রাজত্ব করা ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের দাপট টের পাওয়া না গেলেও তাদের পোলিশ গোলমেশিনকে আটকানো যাচ্ছে না। একের পর এক গোল করেই চলছেন তিনি। তাই মাত্র ১৩ ম্যাচ খেলেই লেভান্ডস্কি করেছেন ১৬ গোল, যা বর্তমান চলতি মৌসুমে বুন্দেসলিগায় সর্বোচ্চ।
গত নভেম্বর মাসটি স্বভাবসুলভ যায়নি বাভারিয়ানদের জন্য। ফ্রাঙ্কফুর্টের মাঠে লজ্জাজনকভাবে হেরেছে তারা। তার উপর নিকো কোভাচ বিদায় নিয়েছেন। নতুন কোচের অধীনে অবশ্য পরের দুই ম্যাচ ভালোই খেলেছে তারা। ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ৪-০ এর বড় জয় সেই স্বস্তির কথাই বলে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বলে ছিলেন লেভান্ডস্কি। ফ্রাঙ্কফুর্টের বিপক্ষে ৫-১ হারের ম্যাচে একমাত্র গোলটি এসেছিল লেভানডোস্কির পা থেকে। ডর্টমুন্ডকে নিজেদের মাঠে হারানোর ম্যাচে করেছিলেন জোড়া গোল। ফরচুনা ডুসেলডর্ফের বিপক্ষেও একটি অ্যাসিস্ট আছে তার। তাই ৩ গোল ও ১ অ্যাসিস্ট মিলিয়ে বুন্দেসলিগায় গত মাসের সেরা খেলোয়াড় লেভানডোস্কি। তবে তিন ম্যাচ বাদ দিয়ে ঐ ডর্টমুন্ডের বিপক্ষের ম্যাচের জন্যও তাকে গত মাসের সেরা খেলোয়াড় ঘোষণা করা যায়।
সিরি এ – পাওলো দিবালা
শুধুমাত্র তার নিজের সিদ্ধান্ত বাকি ছিল। দিবালা যদি একবার ‘হ্যাঁ’ বলতেন, হয়তো এবার অন্য কোনো ক্লাবের জার্সিতে দেখা যেত তাকে। কিন্তু তিনি জুভেন্টাসেই থাকতে চেয়েছেন। এবং তিনি যে দলের সেরা খেলোয়াড়দের একজন, তার প্রমাণ তিনি গত মাসে ‘তুরিনের বুড়ি’দের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
নভেম্বরে জুভেন্টাসের অন্যতম কঠিন ম্যাচ ছিল মিলানের সাথে। সেখানে দলের সেরা খেলোয়াড় প্রথমার্ধে ব্যর্থ। প্রথমার্ধ শুরু হতে না হতেই কোচ মরিসিও সারি রোনালদোকে উঠিয়ে নামালেন দিবালাকে। ৭৭ মিনিটে করা তার একমাত্র গোলেই সে ম্যাচ জেতে জুভেন্টাস। অ্যাওয়ে ম্যাচে আটালান্টার বিপক্ষে ছিলেন না রোনালদো। আর সবসময় নিজেদের মাঠে আটালান্টা ছন্দে থাকে। কিন্তু এসব কোনো জুজু মানেননি দিবালা ও তার সতীর্থ হিগুয়েইন।
নভেম্বর মাসে সিরি এ’তে মোট তিন ম্যাচ খেলে দুই গোল করেছেন দিবালা। একাই হারিয়েছেন মিলানের মতো প্রতিপক্ষকে। তাই শুধু গোল বা অ্যাসিস্টের তুলনা নয়, সিরি এ’তে দিবালা গত মাসের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন একমাত্র তার ধারাবাহিকতা ও পারফরম্যান্সের জন্য।
লিগ ওয়ান – দিমিত্রি পায়েত
অলিম্পিক মার্সেই এবার মৌসুমের প্রথম থেকেই দারুণ ছন্দে আছে। পয়েন্ট ব্যবধান পিএসজির প্রায় সমান হলেও তারা বেশি খেলেছে দু’টি ম্যাচ। তবে তারপরও লিগ রেসে টিকে আছে তারা। আর এই লড়াইয়ের প্রধানতম সৈনিক হলেন ফরাসি মিডফিল্ডার দিমিত্রি পায়েত, যিনি মার্সেইকে চালনা করছেন একদম দলনেতার বেশে, সামনে থেকে।
গত মাসে তাদের বড় একটি লড়াই ছিল অলিম্পিক লিঁও’র বিপক্ষে। যদিও লিঁও এ মৌসুমে সেভাবে ফর্মে নেই। তবে পুরনো দ্বৈরথ তো আর ভুলে যাবার মতো নয়! এই দ্বৈরথের জন্যই এ ম্যাচটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
লিঁওকে হারানোর ম্যাচে সব গোলই করেছিলেন পায়েত। লিঁও-পরবর্তী ম্যাচে তুলুজের বিপক্ষে গোল পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল মার্সেইকে। কিন্তু ৭৬ মিনিটে দারিও বেনেদেত্তোকে দিয়ে প্রথম গোলটা কিন্তু পায়েতই করেছিলেন। এর মিনিট চারেক পর নেমানিয়া রাদনজিচ জয়সূচক গোলটি করতে সক্ষম হন। স্টেদ ব্রেসটোইসের বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলেছিলেন পায়েত। প্রায় ৯০ মিনিট জুড়ে প্রতিপক্ষের ডানপাশ দিয়ে আক্রমণ গড়ে গেছেন তিনি। শুধু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে কাঙ্ক্ষিত গোলটি পাননি পায়েত। তবে সে ম্যাচে তার পারফরম্যান্স মনে রেখেছে মার্সেই সমর্থকেরা।
গত মাসের সেরা নির্বাচিত হবার দৌঁড়ে পায়েতের পাশাপাশি এগিয়ে ছিলেন পিএসজির আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার মাউরো ইকার্দিও। তবে ইকার্দি প্রতি ম্যাচে নজরকাড়া পারফরম্যান্স উপহার দিতে পারেননি, আর বিগ ম্যাচে গোল করার উদাহরণ তো বাদই দিলাম।
চ্যাম্পিয়নস লিগ – রবার্ট লেভানডোস্কি
চ্যাম্পিয়নস লিগের পঞ্চম সপ্তাহে অবিশ্বাস্য কিছু ম্যাচ দেখেছে ফুটবল বিশ্ব। লুকাকু থেকে মেসি বা হাকিম জিয়েখের পায়ের কারুকার্য যেমন উপভোগ করেছে সবাই, তেমনই উপভোগ করেছে নাভাসের গোলবার সামলানোর অসামান্য দক্ষতা। কিন্তু সবাইকে পেছনে ফেলে সব আলো কেড়ে নিয়েছে রবার্ট লেভানডোস্কির অবিশ্বাস্য গোল করার ক্ষমতা। কারণ, বায়ার্নের এই স্ট্রাইকার এক ম্যাচে করেছেন চার গোল।
গত মাসে চ্যাম্পিয়নস লিগে বায়ার্ন মিউনিখের প্রতিপক্ষ ছিল বেলগ্রেড রেডস্টার, ম্যাচটাও তাদের মাঠে। হোক দল ছোট, মাঝে মাঝে ছোট দলের মাঠে খেলতে গিয়ে অনেক বড় দলই খেই হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এসব ইতিহাস ও পরিসংখ্যানকে পাত্তাই দিলেন না লেভানডোস্কি। প্রথমার্ধে তিনি কোনো গোল না করলেও ৫৩ মিনিটে শুরু হয় তার গোল-উৎসব, এবং তা গিয়ে থামে ৬৭ মিনিটে। ততক্ষণে ম্যাচের অবস্থা, ৪-০ গোলে এগিয়ে আছে বাভারিয়ানরা। আর মাত্র ১৫ মিনিটের ভেতরই লেভানডোস্কি করে ফেলেছেন সুপার হ্যাটট্রিক!
ছোট, মধ্যম বা বড় যে সারির ক্লাবই হোক না কেন, এক ম্যাচে ৪ গোল করা মানে অকল্পনীয় কিছু। তাই লেভানডোস্কির ৪ গোলের এই পারফরম্যান্সের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি মেসি ও লুকাকুরা।
ইউরোপা লিগ – ব্রুনো ফার্নান্দেজ
উয়েফা ইউরোপা লিগে গ্রুপ ‘ডি’তে লড়ছে পর্তুগিজ ক্লাব স্পোর্টিং সিপি। গ্রুপে প্রথম পজিশনে থাকলেও পয়েন্ট ব্যবধান বাড়িয়ে প্রথম স্থান পাকাপোক্ত করতে পিএসভির বিপক্ষের জয়ের বিকল্প ছিল না তাদের জন্য। আর এ ম্যাচে জিততে না পারলে গ্রুপের সমীকরণ জটিল হয়ে উঠতে পারত।
হল্যান্ডের ক্লাব পিএসভির বিপক্ষে ম্যাচে ছিলেন না সেবাস্টিয়ান কোয়েটস ও মিডফিল্ডার রদ্রিগো বাটাগ্লিয়া। তবে এ ম্যাচে কোনো ভুল হতে দেননি তাদের দলের সেরা খেলোয়াড় ব্রুনো ফার্নান্দেজ। ৪ গোলের বিরাট ব্যবধানের জয় মূলত এসেছে এই পর্তুগিজ মিডফিল্ডারের বদৌলতে। ম্যাচের মাত্র নবম মিনিটের মাথায় লুইজকে দিয়ে প্রথম গোল করান ব্রুনো। তার পাঁচ মিনিট পর তার শটও খুঁজে পায় পিএসভির জাল। প্রথমার্ধ শেষের তিন মিনিট আগে ব্রুনোর পাস থেকে তৃতীয় গোল করেন ডিফেন্ডার জেরেমি ম্যাথু। আর ৬৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে পিএসভির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন তিনি। আর তখনই লেখা হয়ে যায় এ ম্যাচের ভাগ্য। কারণ, স্পোর্টিং সিপির মাঠে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না পিএসভির জন্য।
ইউরোপা লিগে পঞ্চম রাউন্ডে ব্রুনোর পাশাপাশি দুর্দান্ত খেলেছেন উলভের রাউল হিমিনেজ ও রোমার লরেঞ্জো পেল্লেগ্রিনো। কিন্তু তার ২ গোল ও ২ অ্যাসিস্টের বিধ্বংসী পারফরম্যান্সের সামনে তা নেহায়েত নস্যি।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ