ইতিহাসে মাত্র তৃতীয় ব্যক্তি দেশম, যিনি কোচ ও খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন। বিশ্বকাপ জয়ের পর কয়েকটা দিন পার হয়ে গেছে। এই সময়ের পর এসে শান্ত হয়ে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজের অনুভূতির কথা বলেছেন ফ্রান্সের কোচ
১৯৯৮ সালের ১২ জুলাই সকালেই নাকি আপনি টের পেয়েছিলেন যে, আপনারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালের ১৫ জুলাইও কী এমন কোনো অনুভূতি হচ্ছিলো?
এটা বললে একটু দম্ভ মনে মনে হতে পারে। কিন্তু হ্যাঁ, আমি এটা আগেই টের পেয়েছিলাম। এটা কোথাও লেখা ছিলো। এটাই নিয়তি ছিলো। অবশ্যই আমাদের কাজটা আমাদেরই শেষ করতে হয়েছে। কিন্তু আমি একটা জিনিসে বিশ্বাস করি: নিয়তি। আমাদের নিয়তি লেখা ছিলো। এটা হতেই হতো এবং তাই হয়েছে।
ক্রোয়েশিয়ার নিজেরও তো একটা নিয়তি ছিলো…
হ্যাঁ। কিন্তু প্রত্যেকের যার যার নিয়তি আছে। এটা একেবারেই ব্যক্তিগত। আমার শাশুড়ি আমার সাথে অনেক আগে এ নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, আমরা যেনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হই। কিন্তু উনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এটা আসলে ওপর থেকে ঠিক হয়। যদিও আমি আপনাদের সামনে একজন আধ্যাত্মিক মানুষ হিসেবে উপস্থিত হতে চাচ্ছি না।
১৯৯৮ সালে আপনার প্রয়াত ভাই আপনার শক্তি ছিলো; যিনি ১৯৮৭ সালে মারা গিয়েছিলেন। আপনি যখন ট্রফিটা তুলে ধরলেন, কার কথা ভাবছিলেন?
আসলে আমাদের এই সব নিয়েই বাঁচা শিখতে হবে। এগুলো বেদনার মুহূর্ত। ২০১৬ ইউরোর কয়েক দিন আগে আমি আমার শ্যালককে হারালাম; উনিও একজন ফুটবল পাগল মানুষ ছিলো। জীবন এভাবে কাছের লোকেদের আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়। আবার এটাই আমাদের অপ্রত্যাশিত শক্তি যোগায়।
হুগো লরিস যখন ট্রফিটা তুলে ধরলেন, আপনার কেমন লাগছিলো?
অনেক গর্ব হচ্ছিলো। জাতীয় দলের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। আগামী চার বছর ফ্রান্স বিশ্বে সবার ওপরে থাকবে। এটা বিরাট একটা ব্যাপার। এই স্মৃতি, এই আবেগ রয়ে যাবে। শিরোপা আরও বেশি করে থেকে যাবে। কারণ, আমরা লড়াকু অ্যাথলেট। ক্লাবের চেয়ে জাতীয় দলের হয়ে ট্রফি জেতা অনেক বেশি কঠিন।
জাতীয় দলের হয়ে আপনি কেবল দুই বছরে একবার সুযোগ পাবেন। ২০১৬ সালে আমরা অবিশ্বাস্যভাবে সেই সুযোগ হারিয়েছি। যদিও আমরা বুঝেছি, ওটা আমাদের জন্য বড় একটা শিক্ষা ছিলো। সে জন্য আমরা বিশ্বকাপে ভিন্নভাবে খেলতে পেরেছি। আমাকে যদি বলতে বলা হয়, আমি বলবো, বিশ্বকাপ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ট্রফি।
আপনি খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন। অনুভূতিটা কি ভিন্ন?
অবশ্যই। আপনি যখন খেলোয়াড়, তখন আপনিই মাঠের নায়ক, আপনিই সব প্রয়োগ করেন। আমাদের স্টাফদের প্রচেষ্টা খেলেয়াড়দের মাধ্যমেই বাস্তবে রূপ পায়। এটা ওদেরই কৃতিত্ব। আমি কোচ হিসেবে ওদের জন্য খুশি; এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ফাইনালের আগে কী আপনি ১৯৯৮ বিশ্বকাপ নিয়ে খেলোয়াড়দের সাথে কথা বলেছিলেন?
১২ জুলাই আমি বিশ্বকাপ জয়ের স্মৃতি মনে করছিলাম। কারণ ওটা ছিলো ব্রাজিলকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের বার্ষিকী। দেখুন, আসলে আপনাকে সময়ের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের ওই স্মৃতি কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। কিন্তু এ বছর তো আরেকটা নতুন গল্প। একটা নতুন প্রজন্ম। এই জয়টা তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেঁচে থাকবে, যাদের বয়স এখন ৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে। এটা নতুন একটা গল্প। পুরোনোটাকে না মুছেই নতুন করে লেখা।
আপনি যে বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত তৈরী করেছেন, তা কি নিজে অনুভব করেন?
হ্যা। এটা আমার পেশাগত নিয়তি। আমি ক্যারিয়ারে সবচেয়ে উঁচুতে ওঠার, সব সাফল্য পাওয়ার সব চেষ্টা করেছি। আমাকে অনেকে বলে, আমি খেলোয়াড়ি জীবনে ফিরে যেতে চাই কিনা। আমি বলি, না। কারণ, আমি আরেকবার ওই সাফল্য পাবো কিনা, আমি জানি না।
আপনার পেশাগত নিয়তি কী ব্যক্তিগত ট্রাজেডিগুলোর কষ্ট কমিয়ে দেয়?
না। আমি জীবনে যা সহ্য করেছি, তা কোনোভাবেই কমানো সম্ভব না। ওই কঠিনসময়গুলো থেকেই যায়। অনেক বেদনার সময় আছে, যা এখনও টিকে আছে। কিন্তু আমাকে এ নিয়েই বাঁচতে হবে। অবশ্যই এগুলো আমাকে শক্তি যোগায়।
আপনার খেলোয়াড়রা এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তারা ঠিক কোথায় বাকিদের চেয়ে আলাদা?
আলাদা, কারণ ওরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ওরা ইউরোপিয়ান লিগের বড় বড় ক্লাবের খেলোয়াড় নয় কেবল; ওরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আমি জাতীয় দলের কোচ। আমি সৌভাগ্যবান। ব্যাকেনবাওয়ার যা লিখেছেন, আমি সেটা পড়েছি। তাকে আমাদের ক্লাবে স্বাগত জানাই। আমি আশা করি একদিন তার ও মারিও জাগালোর সাথে ডিনার করতে পারবো। খেলোয়াড় কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা কয়েক জন এক সাথে বসবো। এমন কয়েক জনের সাথে একসাথে নাম উচ্চারণ হওয়াটা বিরাট সম্মানের।
আপনি খেলোয়াড় হিসেবে অনেক শান্ত ছিলেন। কিন্তু কোচ হিসেবে কি মানসিকভাবে একটু অস্থির থাকতে হয় আপনাকে?
তাই? না। আমি কোচ হিসেবেও খুব শান্ত। টুর্নামেন্টজুড়ে আমি শান্ত ছিলাম। কারণ, এই ট্রফিটা তো আমি আগে জিতেছি। আমি মনোযোগ হারাতে চাচ্ছিলাম না। আমি আমার দলের সাথে ছিলাম, আমার স্টাফদের সাথে ছিলাম। আমরা বিশ জন স্টাফ একেবারে একত্রিত ছিলাম। আমি প্রতিরাতে খুব ভালো ঘুমিয়েছি। ২০১৪ সালের চেয়ে অনেক ভালো ঘুম হয়েছে।
মানসিকভাবে কী ক্লান্ত ছিলেন?
না। কারণ, আমি রিকভার করতে পারি। আমি ভালো ঘুমাতে পারি। খুব খারাপ অবস্থাতেও ভালো ঘুমাতে পারি। সব ভুলে যাই আর ঘুমাই। আমার কখনো ঘুমের ওষুধ খেতে হয় না। আমার কখনো নখ কামড়াতে হয় না। ৪৫ বছর ধরে এসব করার পর একটা অবসাদ আসা উচিত। কিন্তু আসে না।
ফ্রান্স কি একটা কুৎসিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল?
কেন? আমাকে দেখতে খারাপ, তাই? দেখুন, প্রতিটা প্রতিযোগিতার পর এসব প্রশ্ন তৈরি হয়। আমার সোজা কথা, চ্যাম্পিয়নরা বাকিদের চেয়ে ভালো বলেই চ্যাম্পিয়ন। যারা যারা সামনে এসেছে, সবাইকে হারিয়েছে তারা। আপনি যখন কাউকে হারাবেন, আপনি ভালো বলেই তাদের হারাবেন।
হ্যাঁ, আমরা আরও ভালো খেলতে পারতাম। আমরা সবসময় খেলার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু শুরু থেকে আমি তরুণদের পক্ষে ছিলাম। এই দলে ১৪ জন ছিলো যারা আগে কখনো মেজর টুর্নামেন্ট খেলেনি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এরা আগামী দুই বা চার বছরে আরও ভালো হয়ে উঠবে।
যারা বলে যে, বেলজিয়াম বা ব্রাজিল ফ্রান্সের চেয়ে ভালো ছিলো, তাদের কী বলবেন?
হতে পারে। আমরা বেলজিয়ামের অসাধারণ একটা দলের সাথে খেলেছি। ওরা আমাদের কঠিন সময় উপহার দিয়েছে। ওদের ভাগ্য খারাপ। এটাই এই বিশ্বকাপের বিশেষত্ব। আমি শুরু থেকে এটা খেয়াল করেছি। যে দল বল পজেশন বেশি রাখে, তারা ম্যাচ জেতে, তা নয়। আমার সহকারী গাই স্টিফান বলে, আমাদের দলটা একজন দক্ষ সার্জনের মতো খেলেছে। আমরা তাদের সত্যিই আহত করতে পেরেছি।
আপনার ১৯৯৮ সালের সতীর্থরা কেউ প্রতিযোগিতার আগে আপনার সাথে কথা বলেছেন?
অবশ্যই। সে সময়ের অনেক খেলোয়াড় ড্রেসিংরুমেও এসেছে। মার্শেল দেশাই, লঁরা ব্লাঁ, লিলিওঁ থুরাম, জাঁ-পিয়েরে পাপিন। আমি খুব খুশি হয়েছি আমার এখনকার খেলোয়াড়রা ওদের খুব সম্মান দিয়েছে দেখে। জিজু (জিনেদিন জিদান) ফাইনালের আগে ও পরে ম্যাসেজ দিয়েছে। থিয়েরি অঁরির সাথে তো সেমিফাইনালেই দেখা হলো। আর অ্যামি জ্যাক পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছে।
আর ক্রিস্টোফি দুগারি?
এবার একটু সিরিয়াস হতে হয়। কেউ যখন তার সীমা অতিক্রম করে এবং ব্যক্তিগত স্তরে কোনো সম্মান না রাখে… আমি একাই তার সাথে যোগাযোগ রাখি না, তা নয়। দুগারি বলেছে, আমি নাকি ফ্রান্সকে জিম্মি করেছি! এটা তো কোনো কথা হলো না। সে যা খুশি বলতে পারে। নিজের রেডিও শোতেও বলেছে।
যাই হোক, সবই ঠিক আছে। আমার বয়স ৫০ হয়ে গেছে। আমি এখন লোকেদের সামনে ভান করতে পারি না। আমি বেশিরভাগ সাবেক খেলোয়াড়কে পেয়েছি, খুশি হয়েছি। আমাদের স্ত্রীদের নিয়ে আমি আর লঁরা ব্লাঁ লাঞ্চ করেছি। লিলিওঁ, মার্শেল, লিজারাউ, লেবেউফ, দিওমেদে.. আমার সাথে দুগারির দেখা হয়ে গেলেও আমি হ্যালোও বলবো না।
কিলিয়ান এমবাপে দেড় বছর আগেও সর্বোচ্চ স্তরে খেলতেন না। এখন তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আপনার কী মনে হয়, সে আপনার গোল্ডেন বয়?
ও জানে, ও যা পারে, তা অন্যরা পারে না। ও স্মার্ট এবং কথা শোনে। আমি ওকে বলেছি, সে ভালো কাজ করেছে। কিন্তু লোকে তো ওটা ওকে সবসময় বলে।
আমার কাজ হলো, ওকে বলা যে, ওর কী সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু সেটা ওর খেলার মাত্র ৫ শতাংশ। বাকিটা ওর নিজের। ও কথা শোনে এবং নিজেকে সংশোধন করে প্রতিনিয়ত। ডেভিড ত্রেজেগে ও থিয়েরি অঁরি ১৯৯৮ সালে এই বয়সীই ছিলো। কিন্তু ওদের ভূমিকা এক ছিলো না। ও (এমবাপে) এরই মধ্যে গ্রেট হয়ে গেছে।
আপনি কী এতো ভালো কাউকে আর কোচিং করিয়েছেন?
আমি অনেক গ্রেট খেলোয়াড়ের সাথে খেলেছি। আমি এরকম অনেককে কোচিংও করিয়েছি। কিন্তু ওর ব্যাপারটা শুধু ওর যোগ্যতা নয়। ও এই বয়সেই যা পারে, তাতে ভবিষ্যতে আরও অনেক কিছু পারবে। ওর এখনও উন্নতির অনেক জায়গা আছে। আমি সবসময় বলি, আমি খুব খুশি যে, ও একজন ফ্রেঞ্চ।
খেলোয়াড়রা বাসে যে মিউজিক চালায়, সেটার সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছেন?
এটা অসাধারণ। আমি খুব পছন্দ করি। যদিও ওদের এসব গান আমি বেশিরভাগটাই বুঝি না। কিন্তু ওরা মাঝে মাঝে ১৯৮০-এর দিকের কিছু মিউজিকও চালায়।
আদিল রামির গোফ ধরে দেখেছেন কখনো?
হ্যাঁ। খুব শক্ত। দেখলে ভয় লাগে। মনে হয় একটা বাদুড়। এটা কী ওর জন্য সৌভাগ্যের কিছু কিনা, ও জানে।
আপনি বলেছিলেন, ইউরোর পরাজয় আপনাকে বিশ্বকাপ জয়ের পথে এনে দিয়েছে?
আমরা গত দুই বছর ধরে এটা খুঁজেছি। আপনাকে খেলাধুলায় সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, আপনি যখন বড় কিছু জিতবেন, বড় কিছু হারাতে পারেন। আমরা হেরেছি বলে জয়ের পথ খুঁজে পেয়েছি।
চার বছর পর কাতারে শিরোপা ধরে রাখার কথা ভাবছেন?
আমি অত পরের কথা কখনো চিন্তা করি না। আমি আর দুই বছর এখনও আছি। এটা যথেষ্ট ভালো। আমার চুক্তি ২০২০ সালে শেষ। এরপর কী হবে, তা নিয়ে আমি চিন্তিত না। আমি বিশ্বকাপের আগেও চিন্তিত ছিলাম না।
ফিচার ইমেজ: FIFA