আক্ষরিক অর্থেই এবার যেন তারার মেলা বসেছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)-এ। এর আগে জাঁকজমকের সাথে পাঁচটি আসর অনুষ্ঠিত হলেও, সেগুলোর কোনোটিই ছিল না এতটা তারকাবহুল। অস্ট্রেলিয়ার স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার এবং দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্সের সংযোজনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে বিপিএলে। একই সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় বিগ ব্যাশ লিগ চলমান থাকলেও, বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটানুরাগীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকবে বিপিএলই, এমনটিই আশা সকলের। এবং সেই কারণেই, ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিপিএলের প্রতিশ্রুতি দিয়েই শুরু হয়েছে এবারের আসর।
কিন্তু উচ্চাশার অপর পিঠে কিছু শঙ্কার অন্ধকার মেঘও এসে জমা হয়েছে, যেগুলোকে এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। বিগত পাঁচটি বিপিএলে এমন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টান্তই স্থাপিত হয়েছে, যেগুলোতে আর যা-ই হোক, পেশাদারিত্বের লেশমাত্র ছিল না। সঙ্গত কারণেই তাই বিপিএলের প্রতিটি আসরই বিতর্কিত হয়েছে। এবারও যে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, আত্মবিশ্বাসের সাথে সে-কথা বলার উপায় নেই। চলুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক এবারের বিপিএল জুড়েও যে প্রশ্নগুলো গলার কাঁটার মতো বিঁধে থাকবে, জন্ম দেবে বিতর্কের।
বারবার বদলাবে নিয়মের খেরোখাতা?
বলা হয়ে থাকে, নিয়মের জন্ম ভাঙার জন্যই। কিন্তু বিপিএলে এসে সেই কথাটিই কিঞ্চিৎ বদলে যায়, কারণ বদলই এখানে সবচেয়ে বড় বিষয়। নিয়মের জন্মও তাই এখানে বদলের উদ্দেশ্যেই। যেকোনো অনিয়মকে বৈধতা দেয়ার জন্য, মূল নিয়মকেই বদলে ফেলায় বিপিএলের জুড়ি মেলা ভার। এবং এবারের আসর শুরু হওয়ার আগে থেকেই বিপিএল টেকনিক্যাল কমিটি শুরু করে দিয়েছে সেই চিরাচরিত ঐতিহ্যের অনুসরণ।
হ্যাঁ, স্টিভেন স্মিথ বিতর্কের ব্যাপারেই বলছি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স শ্রীলংকার আসেলা গুনারাত্নের বদলী হিসেবে স্মিথকে দলে ভেড়ানোর পরপরই শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো কিছুতেই মেনে নেবে না শেষ মুহূর্তে এত বড় একটি সাইনিং। তাদের কথা হলো, স্মিথের নাম যেহেতু প্লেয়ার্স ড্রাফট তালিকায় ছিল না, তাই হুট করে তাকে দলে নিতে পারবে না কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিই। নিয়ম যে সেটিই বলছে।
স্মিথ বিতর্কের ওখানেই অবসান ঘটার কথা। স্মিথ এলে ভালো হতো, কিন্তু নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে তা হচ্ছে না- এমন হাহাকার ধ্বনিই আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু না। দেশের অন্য আর কোনো সমস্যার সমাধানে আমরা গোটা ব্যবস্থা বদলে ফেলার ক্ষমতা না রাখলেও, আমাদের বিপিএল কর্তৃপক্ষ ঠিকই পারেন যখন-তখন নিয়ম বদলে ফেলতে। স্মিথ ইস্যুতেও তার অন্যথা হলো না। বদলে ফেলা হলো নিয়ম। নতুন নিয়ম হলো: প্রতিটি দল বদলী খেলোয়াড় হিসেবে ড্রাফটের বাইরে থেকেও একজন খেলোয়াড়কে দলে নিতে পারবে। অর্থাৎ কুমিল্লা দলে স্মিথের আসা এখন আর অবৈধ কিছু নয়।
যেকোনো সমস্যা ধামাচাপা দিতে বিপিএল কর্তৃপক্ষ বরাবরই নিয়ম বদলকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। টুর্নামেন্ট চলাকালীন তো বটেই, এমনকি একটি ম্যাচের মাঝপথেও নিয়ম বদলের নজির রয়েছে। এর মাধ্যমে দ্বন্দ্বে জড়ানো দুই পক্ষের মাঝে সাময়িক মীমাংসা সম্ভব হলেও, সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা কমেছে বিপিএলের। বহির্বিশ্বে ও ভার্চুয়াল জগতে হাস্যরসের খোরাক জুগিয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক টি-টোয়েন্টির যুগে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা এই টুর্নামেন্ট। চলতি বিপিএলে যে নিয়ম বদলের সার্কাস আবারও আমরা দেখব না, তেমনটা জোর গলায় বলা যাচ্ছে না।
খেলার মাঠে ঢুকে পড়বে রাজনীতি?
খেলার সাথে রাজনীতি জড়ানো উচিৎ কি না, এ ব্যাপারে বিতর্ক চললেও চলতে পারে। কিন্তু রাজনীতি নিজেই যদি এসে খেলার মাঠে ঢুকে পড়ে, তাহলে বিষয়টি কেমন দাঁড়ায়? বিপিএলের বিগত আসরগুলোতে ঠিক এই ব্যাপারটাই হয়ে এসেছে, এবং এবারও তেমন কিছু ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
হিসেবটা বড্ড জটিল। বিপিএলের বেশ কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের করায়ত্তে। এবং কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজির কর্তাব্যক্তিরা বিসিবিতেও রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদে। তারা নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়বেন, এমন আশঙ্কা কিছুটা রয়েই যায়। এমনকি মাঝেসাঝে তাদের উপস্থিতি মাঠের খেলাকেও প্রভাবিত করতে পারে, যার সাক্ষী আমরা ইতিমধ্যেই হয়েছি।
২০১৫ সালের কথা। সেবার বিপিএলে সিলেট-চট্টগ্রামের ম্যাচে এক ঘন্টারও বেশি সময় নষ্ট হয়েছিল। সিলেট ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছে তাদের দুই বিদেশী খেলোয়াড় রবি বোপারা ও জশ কবের এনওসি (নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট) ছিল না। টস হয়ে যাওয়ার পর যখন এনওসি আসে, আর সিলেট তাদেরকে একাদশে অন্তর্ভুক্ত করে, তখন চট্টগ্রাম মাঠে নামতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ বোপারা ও কবের নাম যে সিলেটের মূল একাদশে ছিল না! অনেক বিভ্রান্তি শেষে, বোপারা ও কবকে ঐ ম্যাচে খেলার অনুমতি দেয় বিপিএল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতে সমস্যা কমার বদলে আরও বেড়ে যায়, কারণ চট্টগ্রামের খেলোয়াড়রা মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন! শেষ পর্যন্ত বোপারা ও কবকে ছাড়া সিলেট ওই ম্যাচে বাধ্যতামূলক চার বিদেশী মাঠে নামাতে ব্যর্থ হয়।
২০১৬ সালে সমস্যার বিস্তৃতি ছিল আরও গভীরে। সেবার বিপিএলের প্রথম চারটি ম্যাচ বৃষ্টির কারণে পন্ড হলে, টুর্নামেন্ট নতুন করে শুরু করতে হয়। সাধারণত বৃষ্টির কারণে ম্যাচ খেলা সম্ভব না হলে অংশগ্রহণকারী দুই দলের পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয়ার নিয়ম। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পর্দার অন্তরালে কয়েকজন প্রভাবশালী ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের চাপে পড়ে গোটা টুর্নামেন্টই নতুন করে শুরু করতে বাধ্য হয় বিসিবি।
ফের ঝিমিয়ে পড়বে মিরপুর?
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামকে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের ‘হোম অব ক্রিকেট’। বেশ গালভরা একটি নামই বটে। কিন্তু এই উপাধি অর্জন করতে গিয়ে মিরপুর স্টেডিয়ামকে কতটা কষ্ট পেতে হয়, সে-খবর রাখেন ক’জন? দেশের শীর্ষস্থানীয় সিংহভাগ ম্যাচই আয়োজিত হয় এই স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশের অধিকাংশ আন্তর্জাতিক ম্যাচ তো বটেই, এমনকি বিপিএল আয়োজনের দায়ভারও সবচেয়ে বেশি বর্তায় এই স্টেডিয়ামের উপরই। কিন্তু একটি স্টেডিয়ামের পক্ষে কি এত বেশি ম্যাচ আয়োজন করা আদৌ সম্ভব?
উত্তরটি হলো, না। কিন্তু নিতান্ত বাধ্য হয়েই আমাদের ‘হোম অব ক্রিকেট’ এই কাজটি করছে, যার ফলে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়ছে সে। আরও হয়ে পড়ছে প্রচন্ড রকমের ধীরগতির। আমরা সবসময়ই দেখে এসেছি, বিপিএলে পরপর কয়েকটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলেই এই মাঠের পিচ ও আউটফিল্ড, দুইয়ের অবস্থাই দুর্বিষহ হয়ে পড়ে, টি-টোয়েন্টি আয়োজনের উপযোগী আর থাকে না।
পরিসংখ্যান বলছে, এই মাঠে প্রথমে ব্যাট করা দলগুলোর গড় রান রেট ৭.৫৬। চট্টগ্রাম (৭.৭৬) ও সিলেট (৮.০৩) দুই ভেন্যুর রান রেটই মিরপুরের চেয়ে বেশি। এর মানে এই না যে গুণে-মানে চট্টগ্রাম বা সিলেট মিরপুরের চেয়ে এগিয়ে। মূল বিষয়টি হলো, অন্য দুই ভেন্যুর চেয়ে মিরপুরকে এত বেশি ম্যাচ আয়োজন করতে হয় যে, একসময় সে আর নিজের পারফর্মেন্স ধরে রাখতে পারে না।
একজন খেলোয়াড় যদি একটানা খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে ওঠেন, একটি স্টেডিয়ামও যে দিনের পর দিন ম্যাচ আয়োজন করতে করতে হাঁপিয়ে উঠবে, সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই সহজ বিষয়টি আজও বোধগম্য হলো না বিপিএল সংশ্লিষ্টদের। প্রতি বিপিএল মৌসুমেই তাই চট্টগ্রামে গড়ে ১০টি ও সিলেটের (কিংবা ২০১৩ সালে খুলনার) ৮টি ম্যাচের বিপরীতে মিরপুরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২৮টি ম্যাচ!
দেশী ক্রিকেটাররা অবহেলিতই থাকবেন?
এই বিষয়টি নিয়ে সেই প্রথম মৌসুম থেকেই আলোচনা হয়ে আসছে। তবে আজ পর্যন্ত ঘুম ভাঙেনি বিপিএল আয়োজকদের। অবশ্য এবার একটি মন্দের ভালো ব্যাপার ঘটেছে। গত মৌসুমে প্রতি একাদশে ছয়জন দেশী ক্রিকেটারের বিপরীতে পাঁচজন বিদেশী ক্রিকেটার রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এবার সেখান থেকে সরে এসে, ফিরে যাওয়া হয়েছে চিরাচরিত ৭-৪ ফরম্যাটে। তবু প্রশ্ন রয়েই যায়, এর মাধ্যমে কি যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হচ্ছে দেশী ক্রিকেটারদের, বিশেষ করে উঠতি, প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের?
আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান তো সর্বজনবিদিত। সেটি এতটাই অনুন্নত যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে বেশিরভাগ ক্রিকেটারকেই ফের নতুন করে শুরু করতে হয়। অথচ বিপিএল হতে পারত তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য একটি ভালো সুযোগ- নিজেদের সামর্থ্য মেলে ধরে দেশবাসীর কাছে পরিচিত মুখ হওয়া তো বটেই, কিন্তু তারচেয়েও বেশি হলো বিদেশী শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটারদের সাথে খেলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা অর্জনের।
কিন্তু সেই রাস্তা আমাদের ক্রিকেটের অভিভাবকরা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছেন। চারজন বিদেশী খেলোয়াড় খেলানো বাধ্যতামূলক বলে, এমনকি অনেক অখ্যাত বিদেশীও সুযোগ পেয়ে যান, অথচ পিছনে পড়ে থাকেন স্বদেশী প্রতিভাবানরা। এটি বোধগম্য যে, বিপিএল কর্তৃপক্ষ অন্য আর সবকিছুর মতো এক্ষেত্রেও আইপিএলের অনুকরণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু তারা বোঝেননি, ভারতে উঠতি ক্রিকেটারদের মানোন্নয়নের জন্য আইপিএলই একমাত্র মঞ্চ নয়, সেই দেশে ঘরোয়া ক্রিকেটকেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মতো গুরুত্বই দেওয়া হয়, টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করাও হয়। তাই অন্তত এই একটি বিষয়ে অন্য কারও অন্ধ অনুকরণের পরিবর্তে, নিজেদের স্বার্থকে এগিয়ে রাখা প্রয়োজন ছিল।
শেষ কথা
যত বিতর্কিতই হোক, বিপিএল আমাদের একান্ত নিজস্ব একটি টুর্নামেন্ট, এবং এই টুর্নামেন্টে আমরা দেখতে পাব আমাদের প্রিয় ক্রিকেটারদের। জাতীয় দলে সক্রিয় ক্রিকেটারদের তো বটেই, পাশাপাশি যারা এখন আর জাতীয় দলে নেই কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা অব্যাহত রেখেছেন, তাদেরও। তাই ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে এই টুর্নামেন্ট আমাদের জন্য একটি পরম প্রাপ্তি। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মেলবন্ধন হয়তো সবসময় ঘটে না, তবু আমরা মনে-প্রাণে চাইব, এতক্ষণ যেসব আশঙ্কার কথা বলে এসেছি, এবারের বিপিএলে সেগুলো যেন বাস্তবে রূপ না নেয়।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/