টেস্ট ক্রিকেটে একটি দলের বিজয় অনেকাংশে নির্ভর করে সে দলের বোলিং বিভাগ কত শক্তিশালী তার ওপর। কারণ টেস্টে একটি দলের বোলারদেরকে দুই ইনিংস মিলে ২০ উইকেট নিতে হয়। তাই বোলিং বিভাগকে শক্তিশালী না করে কোনো দলের পক্ষে টেস্টে জয়লাভ করা খুবই দুরুহ। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এ পর্যন্ত এমন অনেক বোলারের জন্ম হয়েছে যাদের বিধ্বংসী বোলিংয়ে বিপক্ষ দলের নামকরা সব ব্যাটসম্যানদেরও মাথা নোয়াতে হয়েছে। টেস্টে ৩০০ বা তার অধিক উইকেট শিকারী বোলারদেরকে টেস্টের সফল বোলার হিসেবে ক্রিকেট বোদ্ধারা মনে করে থাকেন। তারপরও টেস্টে ৬ জন বোলারের এমন কৃতিত্ব রয়েছে যারা ৫০০ এর বেশি উইকেট শিকার করে ক্রিকেট ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন।
১. মুত্তিয়া মুরালিধরন (শ্রীলঙ্কা)
মুত্তিয়া মুরালিধরন শুধু শ্রীলঙ্কারই নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের এক অসামান্য প্রতিভাধর অফস্পিন বোলার। তার বোলিং প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে অনেক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ এই অভিমত দেন যে, মুরালিধরন চেষ্টা করলে কাঁচের তৈরি পিচের ওপরও বল ঘোরাতে পারবেন! তার রহস্যময় দুসরায় নাকাল হননি এমন ব্যাটসম্যান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পৃথিবীর যে প্রান্তে যে মাঠের পিচেই খেলা হোক না কেন, সব জায়গায় মুরালি ছিলেন ব্যাটসম্যানদের কাছে আতঙ্কের এক নাম। তার স্পিন বিষে বধ হয়েছেন ক্রিকেটের নামজাদা সব ব্যাটসম্যান। বোলিং অ্যাকশনের জন্য তার ওপর বারবার আইসিসির খড়গ নেমে আসলেও সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করেছেন অবলীলায়। প্রতিবারই বাধা পেরিয়ে নিজের যোগ্যতা ও মেধার প্রমাণ দিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ক্যান্ডিতে জন্ম নেয়া শ্রীলঙ্কান এই ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ১৯৯২ সালের আগস্টে, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। ক্যারিয়ারের ১৩৩ তম টেস্ট খেলে বিদায় নেওয়ার আগে নিয়েছেন সর্বোচ্চ ৮০০ উইকেট। তার এই বিরল কীর্তি এখনও পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি। ভবিষ্যতেও তা ভাঙবে কিনা অনেকেই এই ব্যাপারে সন্দিহান। ৫০ উইকেট নেন ১৩ ম্যাচে, ১০০ উইকেট নেন ২৭ ম্যাচে, ৩০০ উইকেট নেন ৫৮ ম্যাচে, ৫০০ উইকেট নেন ৮৭ ম্যাচে আর ৮০০ উইকেট নেন ১৩৩ ম্যাচে।
টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডটি নিয়ে অনেকদিন শেন ওয়ার্নের সঙ্গে মুরালির ইদুঁর দৌড় চলেছিল। একবার মুরালি এগিয়ে যান তো পরেরবার ওয়ার্ন। ২০০৪ সাল জুড়ে চলেছে এই খেলা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলার কোর্টনি ওয়ালশের ৫১৯ উইকেটের রেকর্ড প্রথম ভেঙেছিলেন মুরালিধরন, মুরালির রেকর্ড আবার ভেঙে দেন ওয়ার্ন। মুরালি সে রেকর্ড আবার ফিরে পান মাস দুয়েক পর। ওয়ার্ন সেটি আবার ভেঙে দেন কিছুদিনের মধ্যেই। শেষ পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা শেষ হয় যখন ওয়ার্ন অবসরের ঘোষণা করেন।
ওয়ার্নের অবসরের পরও মুরালি আরও বেশ কিছুদিন খেলা চালিয়ে যান। ওয়ার্নের রেকর্ড ভেঙে আরও বহুদূর এগিয়ে যান মুরালি। শেষ পর্যন্ত থামলেন ৮০০-তে। এই ৮০০-তেই শেষ হয় তার টেস্ট ক্যারিয়ার। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে শেষ উইকেটটি নিয়ে মুরালির তার ৮০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন। টেস্ট ক্রিকেটে তার রেকর্ডটি এখনো অক্ষত রয়ে গেছে।
২. শেন ওয়ার্ন (অস্ট্রেলিয়া)
ফুটবলের মেসি এবং রোনাল্ডোর মতোই ক্রিকেটে শেন ওয়ার্ন ও মুরালিধরন ছিলেন ক্রিকেটের গল্পের আসরে বিতর্কের প্রধান বিষয়। কে বড়? শেন ওয়ার্ন না মুরালিধরন? তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই দু’জনের হাতেই স্পিন বোলিং হয়ে উঠেছে শিল্পের চেয়েও বেশি। টেস্টে ৭০৮ উইকেট নেয়া এই অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তীর অভিষেক ঘটে ১৯৯২ সালের ২ জানুয়ারি সিডনীতে ভারতের বিরুদ্ধে। অভিষেকে নিজের দ্যুতি ছড়াতে ব্যর্থ হন শেন। জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমে প্রথম ইনিংসে ১৫০ রানের বিনিময়ে পান একটি উইকেট। সেই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে আর বল করারই সুযোগই পাননি। পরের টেস্টে থাকেন উইকেট শূন্য। স্বভাবতই টেস্ট দল থেকে বাদ পড়ে যান।
তার জীবনের স্মরণীয় উত্থান ঘটে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। মাত্র ৫২ রানের বিনিময়ে ৭ উইকেট শিকার করে সেই টেস্টে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন শেন। আর তার টেস্ট ক্যারিয়ারে রাজকীয় সফলতা পান ১৯৯৩ সালের অ্যাশেজ সিরিজে। সেই সিরিজে ৩৪টি উইকেট নিয়ে হন সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার।
লেগ স্পিন বোলিংকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন শেন ওয়ার্ন৷ ওয়ার্নের মায়াবী ফ্লিপার কিংবা স্ট্রেইটার বুঝতে বুঝতে উইকেট খুঁইয়েছেন স্পিন বোলিং খেলায় পারদর্শী অনেক ব্যাটসম্যান। ব্যাটসম্যানের নার্ভের ওপর চাপ তৈরি করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল এই লেগির।
শেন ওয়ার্ন তার ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন ১৪৫টি, তাতে ২৭৩ ইনিংসে নিয়েছেন ৭০৮ উইকেট। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৩৭ বার, আর ১০ উইকেট নিয়েছেন ১০ বার। ওয়ার্ন একজন লেগ স্পিনারের সাথে সাথে ছিলেন লোয়ার অর্ডারে কার্যকরী এক ব্যাটসম্যানও। টেস্টে প্রথম ৬০০ এবং ৭০০ উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়া বোলারের নাম শেন ওয়ার্ন। ২০০০-২০০৭ বিশ্ব ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি।
৩. অনিল কুম্বলে (ভারত)
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী বোলারের নাম ভারতীয় লেগ স্পিনার অনিল কুম্বলে। ১৯৭০ সালে জন্ম নেয়া এই ক্রিকেটার ১৮ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ক্রিকেট খেলে গেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ৯ আগস্ট ১৯৯০, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ক্যারিয়ারে ১৩২টি টেস্ট খেলে ২৯.৬৫ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ৬১৯টি, যার মধ্যে ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৩৫ বার এবং ১০ উইকেট নিয়েছেন ৮ বার। টেস্টে ভারতের অনেক ঐতিহাসিক জয়ে তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ইংল্যান্ডের জিম লেকারের সাথে তার অনন্য একটি কীর্তি টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে অমরত্ব পেয়ে গেছে। পাকিস্তানের বিরূদ্ধে এক ইনিংসে সব উইকেট অর্থাৎ, ১০ উইকেট শিকারের বিরল কীর্তির অধিকারী অনিল কুম্বলে।
৪. গ্লেন ম্যাকগ্রা (অস্ট্রেলিয়া)
নির্ভুল লাইন-লেংথের একজন ভয়ংকর অস্ট্রেলিয়ান পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা। টেস্টে ফাস্ট বোলারদের হয়ে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া ব্যক্তির নাম ম্যাকগ্রা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৯৪৯টি উইকেট শিকার করেছেন, যা ফাস্ট বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। ক্রিকেট বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট, সেরা বোলিং, এক আসরে সর্বোচ্চ শিকার- সব রেকর্ডই গ্লেন ম্যাকগ্রার দখলে। তার বোলিংয়ে খুব একটা সুইং ছিল না। একটা নির্দিষ্ট লাইন লেংথে ক্রমাগত একঘেয়ে বোলিং করে যেতে পারতেন। তার এই অস্ত্রেই অধৈর্য হয়ে শট খেলতে গিয়ে উইকেট হারিয়ে আসতেন বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা।
লম্বা পা এবং খেলার মাঠে প্রতিনিয়ত ছটফটানি দেখে সতীর্থরা তার নাম দিয়েছিল ‘পায়রা’। সেই শান্তির পায়রাই ২২ গজের পিচকে রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে ফেলতেন। শুধু গতি দিয়েই নয়, নিখুঁত লাইন এবং লেংথ দিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার এক উৎকৃষ্ট বিজ্ঞাপন ছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। অফস্টাম্পের বাইরের একটা নির্দিষ্ট করিডোরে যন্ত্রমানবের মতো ক্রমাগত বল করে যেতেন। টেস্ট ক্যারিয়ারে ১২৪টি টেস্ট খেলে উইকেট শিকার করেছেন ৫৬৩টি। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ২৯ বার এবং ১০ উইকেট নিয়েছেন ৩ বার। টেস্টের শীর্ষ দশ বোলারের মধ্যে তার বোলিং গড়টাই সেরা, মাত্র ২১.৬৪।
৫. কোর্টনি ওয়ালশ (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
৫০০ উইকেট ক্লাবের সদস্য হিসেবে তালিকায় আছে বাংলাদেশের বোলিং কোচ সাবেক ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলার কোর্টনি ওয়ালশ। তাকে ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা বোলারদের একজন বলে মনে করা হয়। সাড়ে ছ’ফুট লম্বা শরীর নিয়ে কোর্টনি ওয়ালশ যখন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ঝড়ো গতি তুলে বল করতে এগিয়ে আসতেন তখন ক্রিজে থাকা অনেক ব্যাটসম্যানের গলা শুকিয়ে যেত। ১৩২টি টেস্ট ম্যাচ খেলে তার উইকেট সংখ্যা ৫১৯। টেস্টে তিনিই প্রথম ৫০০ উইকেট শিকার করেন। ইনিংসে ২৪.৪৪ বোলিং গড়ে ৫ উইকেট নিয়েছেন ২২ বার এবং ১০ উইকেট নিয়েছেন ৩ বার।
কোর্টনি ওয়ালশ; Source: Sportskeeda.com
৬. জেমস অ্যান্ডারসন (ইংল্যান্ড)
টেস্ট ক্রিকেটে ৫০০ উইকেট ক্লাবের নতুন সদস্য হিসেবে বিশ্বের ষষ্ঠ ও ইংল্যান্ডের প্রথম বোলার হিসেবে নিজের নাম লেখান ডান-হাতি পেসার জেমস এন্ডারসন। পেস বোলার হিসেবে এই ক্লাবে তিনি তৃতীয়। ক্যারিয়ারে নিজের ১২৯তম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লর্ডস টেস্টের দ্বিতীয় দিন ৪ রান করা ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েটকে আউট করে ৫শ’ উইকেট শিকারের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। জিম্বাবুইয়ান ওপেনার মার্ক অ্যান্ড্রু ভারমালিনের উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন অ্যান্ডারসন। এখনও পর্যন্ত খেলে যাচ্ছেন জিমি। বয়সটা তার এখন ৩৫ অতিক্রম করেছে। কিন্তু বোলিংয়ের ধার এতোটুকুও কমেনি। বরং আরো বেড়েছে।
বয়সের বেড়া কীভাবে ভাঙতে হয় তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত যেন অ্যান্ডারসন। ঘন ঘন ইনজুরির কারণে যখন তার ক্যারিয়ারই হুমকির মুখে তখনই ফিরে এসে নিজের জাত চিনিয়েছেন অ্যান্ডারসন। চলতি অ্যাশেজ সিরিজের দুই টেস্টে ৮ উইকেট এবং দ্বিতীয় টেস্টে মাত্র ৪৩ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ড দলে তার অপরিহার্যতা প্রমাণ করে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ১৩১টি টেস্ট খেলে ২৭.৩৪ গড়ে ৫১৪টি উইকেট শিকার করেছেন। এই শিকারের লিস্ট কত দীর্ঘ হয় সেটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন আপামর ক্রিকেট পাগল ভক্তরা।
ফিচার ইমেজ: pinterest.com